Saturday, August 29, 2020

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১)

#সুব্রত_মজুমদার 
                         
                                 এক
                            আশ্বিনের এখনও শেষ হয় নাই, শরতের বাতাসজুড়ে এখন  শিশিরের শীতলতা । ঘাসের আগায় শিশিরের কণাগুলো যেন হীরকখণ্ডের মতো জ্বলছে। দূরে প্রবাহিত দ্বারকার দুইকুলে কাশ আর শরের ফুলগুলো  মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে। দ্বারকার হাল্কাজলে প্যাড়ামাছের ঝাঁক আর চিকন বালির উপর প্রাতকৃত্যে আসা লোকজনের চলাচল যেন কোনও এক অদৃশ্য যাদুবলে সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যায় সুদূর অতীতে।

আশির কোঠা পেরোনো সরলাবুড়ি আজ সকাল সকালই উঠেছে। নাতি কে নিয়ে যেতে হবে পাশের গাঁয়ে। আজ যে দুর্গাষ্টমী। সারাটা বছর ধরে এই দিনটারই অপেক্ষা।
-"কই ঠাকুমা তোর হলো ?"
-"হ্যাঁ রে হ্যাঁ তোর ধকপকানিতে আর পারি না বাপু । বিলেত তো আর যাবি  না যাবি পাশের গাঁয়ে পুজো দেখতে।"
বুড়ি বেরিয়ে আসে। পরনে সাদা ইঞ্চিপাড় শাড়ি আর হাতে পুজোর ডালি। নাতি আয়ুস্মান এযুগের ছেলে, তার পরনে চেকদেওয়া হাফশার্ট আর বেল্টলাগানো ফুলপ্যাণ্ট।  চলতে চলতে হাজারো প্রশ্নে জেরবার করে তোলে ঠাকুমাকে। সরলাবুড়ি অম্লানবদনে তার উত্তর দেয়।

নাতির হাজারো প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে এগিয়ে চলে বুড়ি। জরাগ্রস্থ শরীরে একটানা হাঁটার ক্ষমতাটুকুও নেই। কিছুটা গিয়েই হাঁপিয়ে পড়ে সে। মাঠের ফুলিয়ে আসা ধানগাছগুলো হাল্কা বাতাসে নড়ে ওঠে। আর সেই নড়াচড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বুড়ির বুকটা দুলতে থাকে হাঁপরের মতো। মেঠো রাস্তার পাশেই একটা তেঁতুলের গাছ। সেই গাছের তলাতেই বসে বসে ঝিমোতে থাকে সে। নাতি আয়ুস্মান কাছাকাছি একটা ডাল হতে ঢিল মেরে তেঁতুল পড়তে ব্যস্ত।

সরলাবুড়ি তেঁতুলের তলায় বসে আধবোজা চোখে ভাবতে থাকে পুরোনো দিনের সব কথা। জলছবির মতো ভেসে ওঠে সেইসব সোনালী অতীত । শশধরপুরের ইতিহাসের কয়েকটা ঝলক।
সরলাবুড়ি এ গ্রামেরই মেয়ে। জন্মের পর হতেই দেখে আসছে এই গ্রামকে। কি ছিল আর কি হলো। যে গ্রামে একসময় সন্ধ্যা নামলেই মাথায় কাপড় দিয়ে দরজায় দরজায় জলের ছড়ো দিয়ে বেড়াতো বৌ-ঝিরা, তুলসী তলায় জ্বলে উঠতো প্রদীপ, শাঁখের আওয়াজে গমগম করে উঠতো গোটা গ্রাম, সেই গ্রামে সন্ধ্যা নামতেই বসে দেশী মদের আসর, ঘরে ঘরে উচ্চগ্রামে চলে  সিরিয়াল আর গ্রামের ক্লাবঘরে বসে রাজনৈতিক তর্কবিশ্লেষনের আসর।

-"মর মর ওলাওঠারা ঘাটে যা....." নিজের মনে গজরাতে থাকে বুড়ি।
ক্লাব তো আগেও ছিলো, তবে এমনধারা নয়। তখন গাঁয়ের পাঁচজন বসে কতরকমের সমস্যার সমাধান করত সেখানে। সব যে অবশ্য ঠিকঠাক হতো তা নয়। পক্ষপাতীত্ব গ্রাম্যরাজনীতি সেসময়ও ছিল। তবে আজকের মতো এতটা কদর্য ছিল না।

সেদিনকার কথা বেশ মনে আছে বুড়ির। পৌষের মাঝামাঝির কথা একদিন বিকেলবেলায় গোটা গ্রামে ঢিঢি পড়ে গেল। অজিত সাহার ছোটো মেয়ে সরলা ধরা পড়েছে মাল পাড়ার বিকাশ মালের সঙ্গে। 
বিকেল হতেই জগুঠাকুর গরুর জন্য খড় আনতে গিয়েছিলেন খড়ের গাদায়। দু'চার আঁটি খড় সরাতেই ঠাকুরের চোখ কপালে। হাতের খড়গুলো খসে পড়লো। ধুতিতে হাত মুছে চোখ কচলে নিলেন। যেটা দেখছেন সেটা কি সত্যি ?

হ্যাঁ সত্যি তো । একটা ছেলে আর একটা মেয়ে খড়ের গাদার ভেতরে.......
না এ ঘটনা মুখে বলার মতো নয়। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার জুড়লো ঠাকুর। তার চিলচিৎকারে আশেপাশের যে যেখানে ছিল ছুটে এলো। ঠাকুরকে সাপে কামড়েছে।
বামুনপাড়ার সনাতন চক্রবর্ত্তী এককাঠি উপরে। জগুঠাকুরের সর্পাঘাতের তত্ত্বটি মূলত তারই। কোমর হতে প্রায় খসে যাওয়া লুঙ্গিখানা গোছাতে গোছাতে চিৎকার জুড়লেন তিনি। 
"ওরে বিশে রে তোর বাবাকে আর বাঁচানো গেল না। আমি বারবার বলেছিলাম খড়ের ভেতরে হাত না দিতে, কেউটে আর খরিসের আড়গাড়া ওখানে। ও বৌদি গো দেখে যাও গো...."

সনাতনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আশেপাশের লোকজন দৌড়ে এলো। খড়ের গাদার কাছে জগুঠাকুর তখনও কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি সামনের খড়ের গাদার দিকে।
-"কোথায় কামড় দিয়েছে ? জগুদা ও জগুদা ?" সনাতন জিজ্ঞেস করলেন ।
জগুঠাকুর শান্তগলায় বললেন,"বুকে। "
সবাই শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ ওঝা ডাকার তো কেউ বাঁধন দেওয়ার কথা বলাবলি করতে লাগল। কিন্তু এগিয়ে এলো না কেউই। জগৎ সংসারে এটাই বিচিত্র ব্যাপার। মুখে হাজারো বুলি ঝাড়লেও কাজের বেলায় পাওয়া যায় না কাউকে। আর বেশি জ্ঞানদাতারাই কার্যক্ষেত্রে স্থানত্যাগ করেন অবহেলে।

বাড়ুজ্জেদের শশীবালা ঠাকরুন এসে হাজির হলেন। তিনি সবাইকে পেছনে ঠেলে এগিয়ে এসে বললেন, "হা রে জগা, সাপটা দেখেছিস ?"
-"হ্যাঁ কাকি। একটা নয় দুটো। "
-"বলিস কি রে ! দুটো ?" ঠাকরুন অবাক হন।
জগুঠাকুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "খেলা করছে কাকি।"

এই খেলা করার কথা শুনেই উপস্থিত জনতার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। সাপের খেলা তারা দেখেছে। দুটো সাপ একে অপরকে পেঁচিয়ে খেলা করে। স্থানীয়রা বলে শঙ্খলাগা। বিজ্ঞান যাই বলুক না কেনো গ্রামবাংলার লোকজন এই বিষয়টাকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়ে দেখে। তাদের কাছে এটা খুবই শুভ। একটা নতুন গামছা এনে সাপদুটোর উপর ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে। ওই গামছা হবে সর্বমনোস্কামনাপূরনের চাবিকাঠি। অফিস আদালত বাদ বিসম্বাদ সব জায়গাতেই জয় এনে দেবে ওই গামছা।

জগুঠাকুরের মুখের কথা খসতে না খসতেই তিনচারজন গামছা নিয়ে হাজির। এর মধ্যে একজন অবশ্যই আমাদের সনাতন চক্রবর্ত্তী। তিনি বীরদর্পে সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, "কেউ গামছা ছুড়বিনা। মা মনসার লীলা তোরা কি জানিস ? কি হতে কি হয়ে যাবে ! ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে তখন কি হবে?"

-"ওসব ভুজুংভাজুং বাদ দাও ঠাকুর। আমরা জানি তুমি কি চিজ।" গোবিন্দ মাল চক্রবর্ত্তীর কথার প্রতিবাদ করে ওঠে। তার হাতেও একটা নতুন গামছা। 
চক্রবর্ত্তী দাঁত খিঁচিয়ে বলেন,"কি জানিস তুই ?"
(চলবে) 

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...