Monday, June 10, 2019

সম্মানযোগ // সুব্রত মজুমদার

                        
                   
স্ত্রী আমাকে কোনোদিনের জন্যই ক্ষমা করতে পারেনি। আর পারবেই বা কেন, যে ক্ষমাহীন অক্ষমতা আমি দেখিয়েছি তা কোনো কপালে পুরুষের পক্ষে যথেষ্টই বেমানান। আরে না না, আপনারা যা ভাবছেন মোটেই তা নয়। বাঙালির এই এক দোষ মশাই, অর্ধেকটা শুনেই উল্টোপাল্টা ভেবে নেওয়া। আর আপনাদেরই কি দোষ, আমার প্রাণের বন্ধু অভিজিৎকে কথাটা  বললতেই সে চোখ গোল গোল করে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, "বলিস কি রে ! এই বয়সে এসব বাঁধালি কিকরে ? তুই আজ সকালেই হরি ডাক্তারের কাছে যা, গিয়ে বলবি কেস সিরিয়াস ওষুধ দিয়ে দেবে। অব্যর্থ ওষুধ।"
আমি হাজার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারলাম না যে আমার পতনটা দ্রুত নয় নিম্নগামী। অধঃপতনই বলতে পারেন। বাবা মা সমাজে যে সম্মান প্রতিষ্ঠা রেখে গিয়েছেন তার ভাণ্ডার আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। কেউ সম্মান দিচ্ছে না মশাই ! এ জীবনে ঘেন্না ধরে গেল।
এই তো সেদিন বাজারে গিয়েছি একদম সক্কাল বেলাতেই। শাকসব্জীর কেনাকাটা সেরে থলে নিয়ে হাজরার দোকানে হাজির হলাম। হাজরার মীনমহলে তখন মণ মণ মীনের মাণিক জ্বলছে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললাম, "ওই কাতলাটা দেখি তো ভাই।"
হাজরা একগাল হেসে জবাব দিল, "দেখতে তো মানা করিনি স্যার। ভালোকরে দেখতে চাইলে আমার চশমাটা ধার নিতে পারেন।"  হাজরার হাসি আর বাড়ল না বটে কিন্তু দোকানের বাকি খরিদ্দারদের হাসি বাড়তে বাড়তে ব্যানার্জি হয়ে গেল। একজন তো আবার সকলের চুপ করার পরেও খিঁক খিঁক হাসির রেশটা বজায় রাখলেন । অগত্যা আমাকেই বেজার মুখে বেরিয়ে যেতে হল। কথায় আছে না 'স্থানত্যাগেন দুর্জনম্' ।
কিন্তু সূযোগ সবারই আসে। আমারও এসেছিল। আর আসবেই না কেন, স্বয়ং কমলা কমলদলবিহারিনী আমার সঙ্গে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। শ্বশুরমশাই কন্যাদানের সময়  চোখের জল গামছা দিয়ে মুছে আমার দুটো হাত ধরে বলেছিলেন, "মেয়েটাকে আমার দেখো বাবা। মেয়ে আমার সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী। ওর অনাদর তুমি করো না।"
অনাদর আমি করিনি, তবে আদরটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। শুয়ে বসে বেডটি'র আবদার আর টিকটক সেল্ফিতে ফরমায়েশ মতো পোজ দিতে দিতে নিজেকে ইদানিং একটু শাখামৃগ শাখামৃগ বলে ভ্রম হয়। ভ্রমের যথাযথতা পরীক্ষা করার জন্যে একবার সজনেডাঁটা পাড়তে সজনেগাছে চেপেছিলাম। উঠতি আর পততি। উঠলাম আর পড়লাম। দু'চোখে অন্ধকার। যখন জ্ঞান ফিরল তখন হাসপাতালের বেডে, - চার চারখান সেলাই। গিন্নী বললেন, "কোনো কিছুর অতি ভালো নয়। ঘরে বানরনাচ নাচতে নাচতে ভুলে গিয়েছিলে যে ওদের থেকে তুমি অনেক পিছিয়ে।"
হ্যাঁ, সত্যিই আমি পিছিয়ে। আমার লাঙ্গুল নেই। বিবর্তনের প্রভাবে হাজার বছর পরে হয়তো স্বামী নামক প্রজাতিটির লাঙ্গুল বের হবে, তবে এখনই তার সম্ভাবনা নেই। আমি আর দেরি না করে চোখ বুজে অজ্ঞান হওয়ার ভাণ করলাম। এটাই বাঁচার শ্রেষ্ঠতম পন্থা।
এই হতভাগারও একদিন সূযোগ এল। একদম সুযোগ্য সূযোগ। তবে যোগাযোগের যুঝাযুঝিতে যে এমন সূযোগও বেরিয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি।সেদিন বৌ বললো ফুচকা খাবে। আমি আর গররাজি হলাম না। কারন ফুচকার তেঁতুল জল কেউ নিজের কপালে গোলার ইচ্ছা রাখে না।
যথারীতি আমি আগেআগে আর গিন্নী পেছন পেছন হাঁটছি এমনসময় পেছন থেকে ডাক এল, "এই যে বাবা, যাবার পথে একবার শুনে যাও।"  আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রক্তবস্ত্র পরে এলোকেশ এলিয়ে পাকুড় গাছের তলায় বসে শ্রীমান ১০৮ ভৈরবানন্দ শাস্ত্রী। সাইনবোর্ডে তার আরও প্রশস্তি উৎকীর্ণ হয়ে আছে। এই যেমন জ্যোতিষার্ণব, পিশাচসিদ্ধ, তারাপীঠ ও কামাখ্যা ধামে পঞ্চমুণ্ডী আসনে সুসিদ্ধ (পড়ুন সুসেদ্ধ) ইত্যাদি ইত্যাদি। ফিরিস্তি দেখে সসম্ভ্রমে তার চরণকমলে এসে বসলাম।
জ্যোতিষি ভৈরবানন্দ তার আতসকাচটিকে আমার ললাটে ধরে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন, "তুই খুব ভালোমনের মানুষ বাবা। তুই সবার ভালো চাস কিন্তু কেউই তোর ভালো চায় না।"  কথাগুলো আমার কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে গেল। চোখ বেয়ে আমার জল চলে এল। সজলচক্ষে আমি কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম ঠিক সেসময় পিশাচসিদ্ধ জ্যোতিষার্ণব বলে উঠলেন, "তোর রবি নিম্নস্থ, শনি দূরবীন লাগিয়ে বসে আছে, রাহু আর কেতু বক্রী হয়ে তোকে বিক্রির ধান্দায় ব্যস্ত।"
আমি আর পারলাম না। জ্যোতিষার্ণবকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললাম, "যা কিছু একটা করুন বাবা !"
তিনি তার রুদ্রাক্ষের মালা নাড়িয়ে স্বহস্তখানা বাড়িয়ে দিলেন। আর একটু হলেই বলতে যাচ্ছিলাম," বাবা, আমি তো  হস্তরেখা পড়তে জানি না;" কিন্তু তার আগেই তিনি বলে উঠলেন," দে বাবা, হাজার এক টাকা। এমন টোটকা করে দেব যে মা লক্ষ্মী ঘর ছেড়ে যাবেই না। ঘরে খোকা হবে, বৌয়ের গয়না হবে, টাকা উড়ে বেড়াবে ঘরময়...."
আর শোনার সামর্থ্য হল না। একে মাসের একত্রিশ তারিখ তার উপর হাজার এক টাকা, চাকুরিজীবী মাত্রেই এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি আবার হাঁটা দিলাম। কিন্তু গিন্নীর অগ্নিবর্ষণকারী চোখের দিকে তাকিয়েই পা অবশ হয়ে এল। ।
সংস্কৃতে শ্বশুর মানে 'যিনি আগে খান', কিন্তু এখন শ্বশুরের দুহিতাই আমাকে আগে খেয়ে ফেলে কিনা সেই চিন্তায় শরীরটা শীতল হয়ে এল। এতক্ষণে পায়ে যথেষ্টই বল এসে গেছে। সম্মান রক্ষার্থে জোরে জোরে পা চালাতে লাগলাম। যা থাকে কপালে। 

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...