Thursday, April 25, 2019

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ২ // সুব্রত মজুমদার

ক্ষয়ক্ষতি যা হবার হল। বিনয় দত্তের ধুতি গেল খুলে। রাগে গরজাতে লাগলেন তিনি। ইতিমধ্যে পাঁচু এসে হাজির। নিখিল মাষ্টারের সাইকেলের পিছনে ছুটতে ছুটতে কুকুরের মতো জিভ বেরিয়ে গেছে। সে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
- হে ভগমান ! এসকিডেন হইগিলো রে।
-"দূর হতভাগা ! এসকিডেন নয় অ্যাকসিডেন্ট ।" নিখিল মাষ্টার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে প্রতিক্রিয়া দেয়। তার আয়রন করা প্যান্টের একদিকটা ছিঁড়ে ঝুলতে থাকে। আর সেই অংশের ফাঁক দিয়ে লাল সবুজের স্ট্রাইপ দেওয়া আন্ডারপ্যান্ট উঁকি মারতে থাকে। সম্বিত ফিরে পেতেই ঐ অংশটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরেন। আর বিনয় দত্তও এতক্ষণে সাইকেলের বাহুপাশ ছাড়িয়ে উঠে পড়েছেন। সদ্য খুলে যাওয়া ধুতির দুই তৃতীয়াংশ গলায় জড়িয়ে নিয়ে কাগজটা মাষ্টারের হাতে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়েন, "বিষ নেই তার কুলোপানা চক্কর ! ভাগলপুর হতে পাশ দেওয়া মাষ্টার এসেছেন কেতা করে সাইকেল চালাতে।"
নিখিল মাষ্টার কাগজটা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এমন হাতের লেখা একটা অক্ষরও পড়া যায় না। অনেক কষ্টে লিপির পাঠোদ্ধার হল।
  আমার ভালবাসার শকু,
                                     পত্রের প্রথমে তোমাকে আমার ভালোবাসা জানাই। তোমার বাপকেও প্রণাম দিতে পারতাম, কিন্তু দেবো না। শালা আটকুড়ো তেঁতুল গাছে ঝুলে মরুক। তুমি জানো না একদিন আমি তোমাকে দেখতে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোমার বাপের ভয়ে লুকিয়ে পড়ি ছোট পাঁচিলটার পাশের ঝোঁপে । আর ঐ সাতখচ্চর বিনয় দত্ত করল কি... না বলা যাবে না। সেদিন মিত্তিরপুকুরে ডুবে ঘরে ফিরেছি। আমিও সুযোগ পাই, ওর মাথায় পেচ্ছাপ করবো বলে দিচ্ছি।
আর কি বলবো। আমার আদর নিয়ো।
                                                       ইতি
                                                   তোমার আদরের
                                                     নি. কু. চি.
চিঠি যত এগোতে থাকে বিনয় দত্তের প্রেসারও তত চড়তে থাকে। চিঠি শেষ হতেই তিনি লাফ দিয়ে ওঠেন।
- নিকুচি ! নিকুচি এবার আমি করবো। অ্যাই পেঁচো....
পাঁচু কাছেই ছিল। সে আদেশ পাওয়া মাত্র নিকুচির খোঁজ শুরু করে দিল। নিকুচিকে না পাওয়া গেলেও তার খোঁজ এখনো চলছে। কোনো পাঠক বা পাঠিকা যদি নিকুচির খবর পান তাহলে অবশ্যই জানাবেন।
এহেন নিখিল মাষ্টারের সুবোধ বালক শ্যামল। পড়াশোনায় তেমন ভালো না হওয়ায় বাপের সুনজরে থাকে না। জামাকাপড় ছেড়ে হাত পা ধুয়ে মাদুর বিছিয়ে বসেছেন নিখিল মাষ্টার। নিস্তারিণী গাইয়ের দুধের ফেনাওঠা চা আর চানাচুর - নারকেল মাখানো মুড়ি নিয়ে হাজির। বাপের পাশে বসে বসে চা- মুড়ি খাচ্ছিল শ্যামল ।হঠাৎ বাপকে শুধায়, "বাবা তোমাকে একটা কথা বলব রাগবে নাতো ?"
- "রাগবো কেন রে, বল কি বলবি।" নিখিল মাষ্টার স্নেহভরে ছেলের দিকে তাকায়।
- সবারই তো বিয়ে হচ্ছে, আমার বিয়ে দেবে না ?
- "কি বললি তুই, আবার বল।" মাষ্টারের চোখ মুখের ভাব পাল্টাতে থাকে।
-বাবা পুঁটি ......
কথা শেষ হবার আগেই নেমে এল বিরাশি শিক্কার চড়। একগালে চড় মারতে নেই। তাহলে নাকি বিয়ে হয় না। তাই শ্যামল আরেকটা চড়ের অপেক্ষা করতে লাগল। হাজার হোক সারা জীবনের ব্যাপার। আরেকটা চড় সে হজম করে নিতে পারে কিন্তু বিয়ে না হওয়া - - কভি নেহি । কিন্তু ভুল ভাঙল তখন যখন দেখল বাপের হাতে উঠে এসেছে গরু ডাকানো পাচন। শ্যামল আর দেরি করে না, এক ছুটে বাড়ির বাইরে। ঘরে তখনো বাবা চিৎকার করতে থাকে।
                                   ৩
                       এমন অগ্নিগর্ভ পরিবেশে বাড়ি ফেরা যে খুবই রিক্সের হয়ে যাবে তা শ্যামল জানত। তাই সে সোজা হাঁটা দিল মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রামটা পেরোলেই নদী আর নদী পেরোলেই ঘন বন। এই বন পেরিয়ে আরো কয়েক মাইল যাবার পর আসবে প্রাণবল্লভপুর। সেইখানেই তার মামার বাড়ি। ওখানে তার মামা সুধন্য চট্টরাজকে এক ডাকেই সবাই চেনে। একবার সুধন্য মামাকে এক পেল্লাই বাঘে ধরেছিল। সারারাত বাঘে মানুষে লড়াই। ভোরের দিকে যখন মামার জিত প্রায় সুনিশ্চিত ঠিক তখনই বড় বাইরে পেয়ে যায় মামার। মামা এক ছুটে নদীর ধারে। সকালে বাড়ি ফিরলে বৃত্তান্ত শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। অবনী ঘোষ তো পরদিনই নিজের কাঁধে চাপিয়ে সুধন্যমামাকে গোটা গ্রাম ঘোরালেন। সঙ্গে ঢাক ঢোল কাঁসি আরো কত কি।
পরদিন এলেন নিখিল মাষ্টার। শ্যালকের পিঠের আঁচরের দাগ দেখে একচোট খুব হাসলেন। শেষে বললেন, "বুঝলে সুধন্য, চিন্তার কোনো কারণ নেই। জংলি কুলের কাঁটাতে আঁচর লেগেছে সেরে যাবে।"
সুধন্য অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। ব্যাপারটা বেশি ঘাটানো ঠিক নয়, - বাঘের নখের আঁচর বলে কেউ মানতে চাইলে মানুক নয় তো বাকিটা তার ব্যাপার।
নদী পার হয়ে শ্যামল যখন জঙ্গলে ঢুকল তখন সূর্য্য পাটে যাচ্ছে। গা-টা ছমছম করতে লাগল শ্যামলের। বাঘ ভাল্লুক তো আছেই আবার রাত হলে তেনারা নামেন। ঐ যে রাতে যাদের নাম করতে নেই। রাম নাম জপ করতে করতে শ্যামল এগোতে থাকে। জঙ্গলের ভেতর কিছুটা এগোবার পরেই একটা টিমটিমে আলো চোখে এসে পড়ল। এ কোথায় এল শ্যামল ?
-"কে রে ? যে বটিস বাপু ঐখানই দাঁড়া, নইলে এমন বাণ মাব........" একটা গর্জন ভেঁসে আসে। এমন গম্ভীর গলা শ্যামল বাপের জন্মেও শোনেনি।
- আমি শ্যামল আজবপুরের নিখিল সান্যালের ছেলে।
- ও... তাই বল। আমি কৃতান্ত তান্ত্রিক। আজবপুরের সবাই আমাকে চেনে।
কৃতান্ত তান্ত্রিকের আসল বাড়ি আজবপুরেই। গৃহস্থাশ্রমে নাম ছিল সদানন্দ । সদানন্দের বৌ শান্তিময়ী। শান্তির তো বালাই নেই ছিন্নমস্তার মতো কারোর না পেলে নিজের রক্তই পান করার ক্ষমতা রাখে। এহেন শান্তির আলয়ে সদানন্দের আনন্দ বলে কিছু রইল না। সারাবেলা হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুপুরে বাড়িতে এসে সবেমাত্র খেতে বসেছেন, দেখলেন গলা গলা ভাতের সাথে একটুকরো আলুসেদ্ধ।
- "শান্তি ! শান্তি ! এই হারামজাদী !" সদানন্দ হাঁক পাড়ে। ঠিক সেই সময় গোয়ালঘর হতে মুড়ো ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে আসে শান্তিময়ী।
- কি হল রে অলপ্পেয়ে হাড়হাভাতে মিনসে ? এই ঝাঁটা দেখেছিস, - দেবো মুখের ভেতরে ভরে। খাবি খা, নাহয় ওঠ । "
শান্তিময়ীর শান্তিবারি বর্ষণে সদানন্দের মনপ্রাণ শীতল হয়ে যায়। সে তখন মিহি গলাতে ডাকে," শান্তি, আমার সুনুমুনু শান্তি !..... "
-" তোর সুনুমুনুর কাঁথায় আগুন খালভরা। খেয়েদেয়ে শিগ্গির ওঠ। " শান্তিময়ীর অগ্নিবর্ষনে সদানন্দ আর টিকতে পারলো না । খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো । 

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...