Thursday, April 25, 2019

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৬ // সুব্রত মজুমদার

এমন সময় গুড়ুম্ গুড়ুম্ শব্দে নর ও বানর সকলেই ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সকলে রণে ভঙ্গ দেয়। সম্ভাব্য বিপদের আঁচ পেয়ে হনুমানটি পগার পার।
- "হ্যান্ডস্ আপ... আই সে হ্যান্ডস্ আপ !" খাঁকি পোষাক পরা নধর ভুঁড়িওয়ালা এক পুলিশ অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ইনি হলেন রক্ষাকর পুরকায়স্থ । দেশ দশের রক্ষার চেয়ে নিজের বসামাংস সম্বলিত উদরের রক্ষাতেই ইনি সময় ব্যয় করেন বেশি। গোলগাল মুখ, নাকের নিচে হিটলার মার্কা মাছি গোঁফ আর অতিরিক্ত তেলে ভেজানো চুল বেশ পরিপাটি করে সিঁথি করা। সারাক্ষণ পানের কষে মুখ লাল হয়ে থাকে। পানের লাল কষ দুই কষা বেয়ে মাঝে মধ্যেই উঁকি মারে।
দীর্ঘ বারো বছর ধরে একই পদে আটকে থাকায় মন মেজাজ আজকাল আর ভালো থাকে না তার। ভজা ও গজা তার সর্বসময়ের সঙ্গি। দুজনেই কনস্টেবল। রক্ষাকরের মতো ভজা গজারও কোনো উন্নতি বা অবনতি নেই। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোটাকয়েক গ্রাম নিয়ে প্রাণবল্লভপুর থানা। মাঝে মধ্যে দু'একটা ছিঁচকে চুরির কেস এলেও গড়পড়তা প্রায় দিনই ঘুমিয়েই কাটাতে হয়।
রক্ষাকরবাবু থুরি বড়বাবু অনেক খুঁজে পেতে দেখেছেন কিন্তু এ তল্লাটে গত পঞ্চাশ বছরে কোন বড়সড় চুরি ডাকাতি বা ছিনতাই গোছের কিছু ঘটেনি। তবে বহু পূর্বের একটা ছেঁড়া মলিন জাবদা খাতার শেষদিকে দুজন ছিঁচকে চোরের নাম পাওয়া যায়। যদিও তারা অভাবে না পড়লে চুরি করত না বলে উল্লেখ আছে। যতই হোক চোর তো ছিল।
- কি যেন নাম - -লিলু - মিলু। বাহ্ ! খাসা নাম তো। এই ভজা গজা শোন শোন, এ তল্লাটেও চোর ছিল তাহলে।
আনন্দের আতিশয্যে বড়বাবু নাচতে শুরু করে দিলেন। সাথে যোগ দিল ভজা আর গজা। সেদিনই সদর হতে লিলু-মিলুর ছবি বাঁধিয়ে এনে বড়বাবু যেখানে বসেন ঠিক তার পেছনের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হল। প্রতিদিন চলল ধূপধূনো সহযোগে আরতী। কিন্তু এতেও ভবি ভূলল কই ? একটাও কেস এলো না। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ডায়েরি খাতা সম্পূর্ণ আনকোরা হয়ে আছে। উঁহুহু ... ভূল বললাম। বড়বাবু প্রতিদিন সকালে উঠে খাতাটায় ধূপজল দিয়ে মা চৌরেশ্বরীর নাম লেখেন একশ'আট বার।
কেস যে একেবারেই আসেনি সেটা বললে মিথ্যা বলা হবে। ঐ যে গতবার শিবরাত্রির আগের দিন বড়বাবু চেয়ারে বসে বসে সুখনিদ্রা দিচ্ছেন। নাক ডাকার তালে তালে ভুঁড়িটাও দুলে দুলে উঠছে। ঘুমের সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে পৌঁছে গেলেন এক অচেনা দ্বীপে। দ্বীপে নামার সাথে সাথেই মিলিটারি পোষাক পরা লোকজন সাঁজোয়া গাড়িতে করে বিউগল বাজাতে বাজাতে তার সামনে হাজির হল। তাদেরই এক দলনেতা গোছের লোক বড়বাবুর গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, "স্যার ! আজ হতে এই চোরাইপুরের সব দায়িত্ব আপনার।"
সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের উল্লাস আর নাচনকোদন শুরু হল। বড়বাবু ধীর পায়ে এলেন শহরের ভেতরে। কত রকমের চোর। বড় চোর, ছোট চোর, মেজ চোর, সেজ চোর--কতরকমের যে চোর তা না দেখলে বোঝা যাবে না। নিমেষের মধ্যে বেল্টটা হাওয়া হয়ে গেল। তারপর গেল পকেট হতে মানি ব্যাগ। অস্তে আস্তে জামাকাপড় সবই গেল চোরের কব্জায়। শিবরাত্রির সলতের মতো একমাত্র সম্বল আণ্ডারপ্যান্টখানা। একি রে ! কোথা হতে লিকলিকে চেহারার একটা চোর এসে আণ্ডারপ্যান্টের দড়ি ধরে টানাটানি করতে লাগল। টানাটানির চোটে ঘুমটা গেল ভেঙে। চেয়ে দেখলেন একটা নধর সাইজের ছাগল জামার নিচের দিকটা আরাম করে চিবোচ্ছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়সি লোক।
- "খুব ভালো ছাগল ! আপনার বুঝি স্যার !" লোকটা দাঁত বার করে জিগ্গেস করে।
-"হ্যাঁ, আমার ! আমি মরলে এই ছাগলের মাংস দিয়ে ভোজ করব। কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে যাবে !!" বড়বাবু হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন।
-"আপনার নিমন্ত্রণ বলে কথা স্যার, আমি কি আমার ঘাড় আসবে।" লোকটা বড়বাবুর নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত হয়।
-" তবে আর কি, এবার মানে মানে গাত্রোত্থান কর। না কি ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে ! এই ভজা ! এই গজা ! " বড়বাবু ডাকছাড়েন ।
- আজ্ঞে বেরিয়ে এক্ষুনি যেতে পারি স্যার কিন্তু.....
- কি কিন্তু ?
-" আমার বীরবাহাদুরকে খুঁজে দেন স্যার !" লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
-"ভজহরি, হামারা গাড়ি লে আও। " বড়বাবু   তর্জন গর্জন করতে করতে বের হলেন। সাথে ভজা গজা আর সেই বীরবাহাদুরের খোঁজে আসা লোকটি।
এপথ সেপথ ঘুরে নানান ফন্দিফিকির করার পর বীরবাহাদুরের খোঁজ মিলল। অনেক খোঁজ খবরের পর ঠিক সন্ধ্যার মুখে হঠাৎ লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, "রোখকে জরা রোখকে ! "
-" ফাজলামি হচ্ছে। আমার সঙ্গে হিন্দি নিয়ে মসকরা !" বড়বাবু গাড়ি থামিয়েই ধমক দিলেন।
- না স্যার, মসকরা নয়। আমার বীরবাহাদুর.... ঐ.. ঐ যে...
-কোথায় তোমার বীরবাহাদুর ? আমার নজরে তো পড়ছে না।
এমনসময় একটা গোব্দা হনুমান ঝাঁপিয়ে পড়ল জিপের উপর। তারপর লোকটি হনুমানটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল," এই আমার সবেধন নীলমণি একমাত্র আদরের বীরবাহাদুর।"
এরপরে বড়বাবুর মুখের অবস্থা কি হবে সেটা সহজেই অনুমেয় । সেদিন হতে নিখোঁজ সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে তিনি থাকেন না।
                         ৬
                             আজ সকাল বেলাতেই বিশুকাকা থানায় এসে হাজির। এসেই বদমাইসি সুলভ হাঁসি হেঁসে বড়বাবুকে নমস্কার করল বিশুকাকা।
-  একটা জরুরী কেস আছে স্যার। এক্ষুনি বেরোতে হবে।
- "কি কেস ?" চোখ বন্ধ করে গাড়ির চাবি দিয়ে কান পরিস্কার করতে করতে বড়বাবু জিজ্ঞাসা করেন।
- মিসিং কেস স্যার।
- "মিসিং কেস আমি নিইনা। গেট আউট।" বড়বাবুর নির্বিকার উত্তর।
অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বড়বাবুকে রাজি করালেন বিশুকাকা। বড়বাবুও বার বার করে জেনে নিলেন যে নিখিল মাষ্টার আর তার ছেলে শ্যামল আদতেই মানুষ কি না।  ঐসব হনুমান জাম্বুবানের মধ্যে তিনি নেই। ওদের জন্যে চিড়িয়াখানা আছে। বিশুকাকা বড়বাবুর সাথে জিপে চড়ে বসলেন। ব্রিটিশ আমলের পুরানো জিপ ছুটল ঝড়ের বেগে। জিপ যত ছোটে বিশুকাকার পিলে ততই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
- "ও স্যার, একটু আস্তে চালান। বামুনের ছেলে, ব্রহ্মহত্যা হয়ে যাবে একেবারে।" বিশুকাকা চিলচিৎকার জোড়েন।
- "কভি নেহি। আপনাকে আমি চিনি মশাই। এত তাড়াতাড়ি টেঁশে যাবার লোক আপনি নন। একহাজার শেয়াল আই মিন ক্লেভার ফক্স মরে আপনি জন্মেছন।" বড়বাবু উদাত্ত স্বরে জবাব দেন।
-" ব্রহ্মহত্যা হয়ে যাবে স্যার ! " বিশুকাকা প্রায় কেঁদে ওঠেন। 

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...