Thursday, April 25, 2019

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৭ // সুব্রত মজুমদার

হঠাৎ করে পাশে বসে থাকা ভজা গজার চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। এবার তারা চেঁচাতে লাগে," গাড়ি থামান স্যার ! গাড়ি থামান ! "
-" তোদের আবার কি হল ?একে বিশুতে রক্ষা নেই... " বড়বাবু আরো স্পিড বাড়ান।
- এই বুড়ো ভামটা কাপড়ে... খেঁ.. খেঁ... খেঁ...
- "হাঁসি নয়.. হাঁসি নয়, যা বলবি স্পষ্ট করে বলা।
এবার বিশুকাকাই বোমা ফাটায়," ওরা বলবে কি আমি বলছি। আপনার এই ঝড়ের বেগে গাড়ি চলছে, আমার ব্লাডার কি মশাই একইরকম থাকবে ? বার্স্ট হয়নি এই অনেক। "
বড়বাবু হা হা করে হেঁসে ওঠেন। আর তক্ষনি ঘটল কাণ্ড। জিপটা অন্যমনস্কতার কারনে বেরাস্তা হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষন আগেই। এবার গাড়ি গিয়ে পড়ল মাঠের মাঝখানে। মাঠের একপ্রান্তে ছিল আগলদারদের কুড়ে। গাড়ি সোজা কুঁড়েঘরে ঢুকে কুঁড়েঘর শুদ্ধ চলতে শুরু করল।
সামান্য একটু ফোঁকর দিয়ে রাস্তা চিনে বড়বাবু যখন অকুস্থলে পৌঁছলেন তখন সেখানে ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে। অগত্যাই গুলি চালাতে হলো। গুলির শব্দে যেমন খুশি তেমন মারো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা তখনকার মতো খেলায় ইতি টানল।
                         বড়বাবুকে গুলি ছুড়তে দেখে সবাই ভয় পেলেও ভয় পায় নি কেবল একজন। সে আর কেউ নয় স্বয়ং শ্রীমান বীরবাহাদুর। সে বড়বাবুকে দেখেই এগিয়ে এসে পায়ের ধুলো নিল। আর বড়বাবুও বীরবাহাদুরকে চিনতে পারলেন। এই প্রথম বানর খোঁজার জন্যে অনুশোচনার পরিবর্তে আনন্দ হল। বীরবাহাদুরকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। বীরবাহাদুরও বড়বাবুর মাথা হতে পটাপট দুটো উকুন বের করে মুখে পুরে দিল।
-"ছাড়বেন না হতচ্ছাড়াকে, জেলে পুরে দিন।" কেলোর মা চেঁচিয়ে ওঠে। তার দাবিতে সন্মতি দেয় উপস্থিত প্রায় সকলেই। একমাত্র নিখিল মাষ্টার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
-"এ সম্ভব নয়। চড় মারুক চাপাটি মারুক... যাই করুক না কেন ও তো আর মানুষ নয়। বানরের কোন শাস্তি হয় না। " বড়বাবু দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেন। আসলে এখন বীরবাহাদুরকে তার বেশ মনে ধরে গেছে। আহা ! বনের পশু, তার এমন সহবত ! ভাবা যায় !
বড়বাবুর কথায় উত্তেজিত জনতা তেড়ে আসে বীরবাহাদুরকে। বীরবাহাদুর বড়বাবুর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। তখন বড়বাবু আবার বন্দুক বার করেন। জনতা তখনকার মতো 'মিশন বীরবাহাদুর' স্থগিত রাখে।
-"বিশুবাবু কই ! কোথায় তিনি ? খুব যে বলছিলেন ছেলে হারিয়েছে,... সিরিয়াস ব্যাপার..." বড়বাবুর ডাকে বিশুকাকা এগিয়ে আসেন।
- এই যে স্যার, আমি এখানে।
-বেশিক্ষণ থাকবেন না। হাজতে পুরবো আপনাকে। বাচ্চাছেলে মিসিং বলে ডেকে এনে হনুমান ধরার কাজে লাগানো !...... আমাকে দেখে কি রিংমাষ্টার বলে মনে হয় ?
তখন এগিয়ে আসেন নিখিল মাষ্টার। শ্যামলের পালিয়ে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা তিনি বড়বাবুকে বুঝিয়ে বলেন।
-"ও এই ব্যাপার ; তা আগে বলবেন তো। মাষ্টারমশাই, আপনাকে কথা দিচ্ছি যে করেই হোক আর যেভাবেই হোক আপনার ছেলেকে আপনার হাতে তুলে দেব তবেই আমার শান্তি।" বড়বাবু নিখিল মাষ্টারের কাঁধে হাত রেখে বলেন।
-"সে সব তো হবেই, তবে তার আগে এই দত্তরপো টাকে অ্যারেস্ট করুন। মেয়েছেলের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ে স্যার। " কেলোর মা আর্জি জানায়।
সঙ্গে সঙ্গে বিনয় দত্তও প্রতিবাদ করেন," মোটেই না ;নিখিল মাষ্টারের বৌ আমাকে ঝাঁটার বাড়ি মারতে যায় নিজেকে বাঁচাতে আমি কেলোর মায়ের গায়ে পড়ে গিয়েছি। এটা দূর্ঘটনা। অ্যারেস্ট করতে হলে নিখিল মাষ্টারের বৌকে অ্যারেস্ট করুন। "
-" ষড়যন্ত্র করে আমার সংসার ভাঙবে আর আমি ছেড়ে দেব।" নিস্তারিণী আবার লেকচার শুরু করেন।
বড়বাবু বেগতিক দেখে বিশুকাকাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে ভজা ও গজা গাড়ির উপর হতে কুঁড়েঘরটিকে সরিয়ে গাড়িটা সাফসুতরো করে তুলেছে।
-আমি না ফেরা পর্যন্ত কোন অশান্তি যেন না হয়। এসে যদি শুনি কেউ বেগড়বাই করেছে.......... ডাইরেক্ট একাউন্টার। " বড়বাবু বন্দুক বেরকরে হাবুল বোসের কপালের কাছে ধরেন। হাবুল বোস হাতদুটো উপরে উঠিয়ে গৌরনিতাই হয়ে দাঁড়ায়।
গাড়ি ছেড়ে দেয়। বড়বাবুর উপর ভরসা না করে নিস্তারিণী কেলোর মায়ের স্মরণাপন্ন হন।
-" দিদি, একবার ঘুঘু গুনীনের কাছে গেলে হয় না ? " নিস্তারিণী বিগলিত স্বরে প্রশ্ন করে।
-"হয় মানে, আমার মনের কথাটাই বললে বৌ।
-" তাহলে বেলাবেলি চল দিদি। " কেলোর মা কে সঙ্গে নিয়ে নিস্তারিণী ঘুঘু গুনীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
                                     গ্রামের একপ্রান্তে ঘুঘু গুনীনের ঘর। সে নামেও ঘুঘু কাজেও ঘুঘু। জলপড়া তেলপড়া চালপড়া সব পড়াতেই ডিস্টিংশন সহ ফার্স্টক্লাস অর্জন করেছে ঘুঘু গুনীন । সে একমাত্র বিশুকাকার সঙ্গে পেরে ওঠে না। বিশুকাকা সর্বসমক্ষেই বলেন, " ঘুঘুর ফাঁদে পড়ার চেয়ে গলায় কলসি বেঁধে জলে ঝাঁপ দেওয়া ভাল।"
একবার হল কি ঘুঘু তার গোবর নিকানো উঠানে  পৌষের মিঠে রোদের দিকে পিঠ করে বসে আছে। পরনে লাল কাপড়। চোখদুটো নেশায় কড়মচা ফলের মতো লাল হয়ে আছে। নেশাটা বেশ জমলেও হুঁশ কিন্তু দিব্যি আছে। এই নেশার ঝোঁকেও কথাবার্তা একটুকুও টাল খায় না।
-" কাকা ঘরে আছো ! " একটা বাচ্চা মতো ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
- কে....? ও ঘন্টা। বল কি বলবি।
- কাকা তোমাকে একবার যেতে হবে ; বিশুদাদুর শরীর খারাপ।
ঘুঘু মনে মনে হাঁসল । গত দু'তিন দিন হতে কোনো রোজগারপাতি নেই, এ দাঁওটা ছাড়লে চলবে না। সে তার জিনিসপত্র সব একটা লালশালুর ঝোলাতে ভরে ঘন্টার সঙ্গে রওনা হল। আজ মনে তার খুব আনন্দ। বিশু চক্রবর্তীকে একহাত না নেওয়া পর্যন্ত মনের শান্তি হচ্ছে না।

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...