Thursday, April 25, 2019

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - শেষ ভাগ // সুব্রত মজুমদার

                       ৭
                                      আজকে কেলোর মাকে দেখে ঘুঘু ঘাবড়ে যায়। সেদিন বিশুকাকার ভূত তাড়াতে এসে যে নাকানি চোবানি খেয়েছে তারপর আর গ্রামের কোনো ব্যাপারে ঘুঘু থাকে না।
-"আপনারা কি মনে করে ? আমি সেইদিন হতে আপনাদের কোনো ব্যাপারে থাকি না। আপনারা আসুন।" ঘুঘু পত্রপাঠ বিদায় করে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু নিস্তারিণীর কান্না আর কেলোর মায়ের অনুনয় বিনয়ে ঘুঘু রাজি হয়।
ঘুঘু খড়ি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটে। তারপর মন্ত্র পড়তে শুরু করে।
               চ্যাং চ্যাচাং চিকা চাঁই                  জলের পোকার খবর নাই
              জলের পোকা জলকে যা             আমার শেলেট শুকিয়ে যা।
             শেলেটে পড়ল ঢিল                         ভূতে মারল কিল;
            ভূতের বাবার ছেঁড়া জামা                  সেলাই করে মিলন মামা।
           মিলন মামার টিনের চাল                  তাতে বসে কাকের পাল।
           একটা কাকের দুটো ঠ্যাং                  দুপুরে খায় মরা ব্যাঙ
           মরা ব্যাঙে মারল লাথি                     হারিয়ে গেল লেড়কা কোথি ?
          ঘন বনে ভূতের বাস                           পড়ে আছে বাঘের লাশ।
         জটাধারী যমের নাম                         পুরবে সেথায় মনষ্কাম। "
ঘন বনের মাঝে মিলবে। জটাধারী কোনো লোকের সাথে আছে। তার নাম যমের নামে। আর এর বেশি কিছু বলতে পারব না। তাড়াতাড়ি যাও তবেই ছেলেকে পাবে। একান্ন টাকা। সিধে আর কাপড়ও লাগবে।
                        ঘুঘুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেলোর মা আর নিস্তারিণী বাড়ি ফিরে এলেন। সব কথা শুনে নিখিল মাষ্টার মাথা চুলকোতে চুলকোতে কিছুক্ষন ভাবল তারপর বলল, "নেহাত মিথ্যা নয় ! যমের নাম কৃতান্ত ।আর আমাদের সদানন্দই তো কৃতান্ত নাম নিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছে। না একবার চেষ্টাটা করা যাক।"
-"হ্যাঁ মাষ্টার আমারও তাই মনে হচ্ছে। তুমি আর দেরি কোরো না। আমিও তোমার সঙ্গে যাব। পাড়ার আপদে বিপদে দাঁড়াব না তো আর মানুষ হয়ে জন্ম হল কেন ! "
সবাই মিলে কৃতান্তের ডেরার উদ্দেশ্যে রওনা হল। রাস্তায় শান্তিময়ীও সঙ্গ নিল। নদী পার হয়ে সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করলে শান্তিময়ী মুখ খুলল।
-আপনারা আমার পেছনে আসুন। ঐ খালভরার কাছে এর আগেও আমি গিয়েছি। রাস্তা আমি চিনি।"
জঙ্গলে প্রবেশ করে সোজা উত্তরদিকে কিছুটা হাঁটার পর কৃতান্তের কুটির দেখা গেল। সবাই মিলে একসাথে ডেরায় ঢুকতেই কৃতান্ত পালাবার উদ্যোগ করল।
-" খালভরা ! ড্যাকরা ! সাধুগিরি হচ্ছে ।চল ঘরে চল। "  শান্তিময়ী কৃতান্তের চুলের মুঠিতে ধরল।
এদিকে শ্যামলকে পেয়ে মা-বাবার আনন্দের শেষ নেই। "চল বাবা ঘরে চল। এবার তোকে কেউ কিছু বলুক, তার ঠ্যাং আমি ভেঙে দেব।"
শান্তিময়ীকে দর্শনমাত্র বাঘবাবাজী ভয়ে লাগায় দৌড়। ঝোঁপের ভেতরে বসে লিলু আর মিলু নতুন পঁয়তারা কষছিল। হঠাৎ কিছু একটা দৌড়ে আসতে দেখে দুজনেই লাগায় দৌড়। তারপর বাঘ সহ লিলু মিলু গিয়ে পড়ে সেই কাদার পুকুরে, যেখানে ডুবে তারা মরেছিল। কাদার ভেতরে আটকে থাকা নিজ নিজ শরীরে ঢুকে পড়ে তারা। তারপর অনেক কষ্টে কাদা হতে বেরিয়ে আসে।
             বাড়ি ফেরার পথে কেলোর মা চিৎকার করে ওঠ, "ও মাষ্টার, দ্যাখো দ্যাখো অনামুখোদের কাণ্ড দ্যাখো।"  নিখিল মাষ্টার দেখে কিছু দূরে নদীর বালিতে একটা পুলিশ জিপের সামনেটা ঢুকে আছে আর বাকি অংশ আকাশের পানে উঠে আছে। মনে হচ্ছে যেন জিপটা শীর্ষাসন করছে। পাশেই একটা মানুষ দিয়ে গড়া স্তুপ, - তার নিচে ভজা গজা আর মধ্যস্থলে বিশুকাকা স্বয়ং। একদম উপরে বড়বাবু পড়ে পড়ে গোঙাচ্ছেন ।

       পরিশিষ্ট
আজবপুরে এখনো অনেক কিছুই আজব ঘটে। কিন্তু শ্যামল আর পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় না। সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। গ্রামের মানুষের সেবা করতে হবে যে।
বিশুকাকা এখনো তার স্বভাব ছাড়তে পারেনি। সে কৃতান্তের ঘরে আজ উঁকি মারছিল। দেখে কৃতান্ত লাল কাপড় পরে জটাজুট এলিয়ে বৌয়ের কাপড় কাচছে । মুখে একরাশ বিরক্তি। এমনসময় শান্তিময়ী এসে আরো একগাদা কাপড় নামিয়ে দিয়ে গেল। কৃতান্ত "হে ভগবান !!" বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার কাপড় কাচায় মন দিল।
ইদানিং গ্রামে দুটো চোরের উৎপাত হয়েছে। একবার ধরাও পড়েছিল, কিন্তু সবাইকে চকমা দিয়ে পালায়। বড়বাবু রক্ষাকর পুরকায়স্থও এই গ্রামে ডিউটি বাড়িয়ে দিয়েছেন। চোর তিনি ধরবেনই।
কৃতান্তের পরিত্যক্ত ডেরাতে বাস করতে গিয়েছিল ঘুঘু গুনীন। কিন্তু পারেনি। একটা কেঁদো বাঘের উপদ্রব ঘটেছে আজকাল।
আজই নিখিল মাষ্টারের চিঠি পেলাম। আজবপুরে যেতে লিখেছেন। আমি ভাবছি আগামী কালই রওনা দেব। আপনারা কেউ যাবেন কি ? 

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...