Friday, August 9, 2019

শয়তানের থাবা - পর্ব ১ // সুব্রত মজুমদার


 শুক্লপক্ষের প্রতিপদের রাত, খাওয়া দাওয়া সেরে সবেমাত্র শুয়েছেন মৃগাঙ্কবাবু। এমন সময় বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। অনেক রাত করে শোয়ার দরুন ঘুম আসার নামগন্ধও নেই। তার উপরে এই অনাহুত জ্বালাতন, -  মাথা গরম হয়ে গেল মৃগাঙ্কবাবুর।
"অ্যাই কে রে ! বড্ড জ্বালাতন করিস তো ! যাই যাই।"  অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু। ঘরের খিল খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। হ্যারিকেন হাতে চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে এগিয়ে গেলেন উঠান বরাবর। বাহিরদরজার সামনে আসতেই কড়া নাড়ার শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।
 মৃগাঙ্কবাবু হাঁক পড়লেন," কে রে ! "    কোনো উত্তর নেই। নিজের মনে গজগজ করতে করতে ফিরে চললেন তিনি। কয়েক পা' যেতেই আবার কড়া নাড়ার শব্দ। আবার ফিরে এলেন দরজার কাছে। আগেরবারের মতোই এবারও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এবার আর থাকতে পারলেন না মৃগাঙ্কবাবু। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গালাগালি দিতে লাগলেন।  " ওবে হারামজাদা, আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছিস ! আমার সাথে ইয়ার্কি ! মেরে পুঁতে দেব ***********"
সত্যিই তো, মৃগাঙ্ক সেন ওরফে কেশব জালান ওরফে জগাই দাস ওরফে আরো কত কি যে সে তা বোধহয় সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। ঘন্টায় ঘন্টায় রং বদল করে যে তার সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কারোরই নেই।
অনেক চিন্তা এসে ভিড় করে মৃগাঙ্কবাবুর মাথায়। কে আছে এমন যে তার সাথে এধরনের তামাশা করতে পারে। ধীরে ধীরে ঘরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। তড়িঘড়ি জুতোজোড়া না খুলেই ঘরে ঢুকে পড়েন, দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়েন মৃগাঙ্ক সান্যাল।
ছোটোবেলা হতেই খুব ধীর স্থির ছিল ডেভিড। বাবা মায়ের  অষ্টম সন্তান ডেভিডকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল একটা সরকারী স্কুলে। স্কুলের প্রথম দিনেই  ইউসুফ মাষ্টারের মাথায় ঢিল মেরে ফেরার হয়ে গিয়েছিল সে। গ্রামে ফিরল টানা চারমাস পরে। আর স্কুলে ঠাঁই হল না। বৈকল্পিক শিক্ষায় শিক্ষিত ডেভিড হয়ে উঠল তার সমাজের মাথা।
দিন যায় দিন আসে, ডেভিড সুশীল সমাজের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে থাকে। সবাই সবকিছু জেনেও চুপকরে থাকে অজানা আতঙ্কে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে খুন ধর্ষন আর তোলাবাজীতে সিদ্ধহস্ত ডেভিডের পায়ের তলায়।
কিন্তু সব পাপেরই অন্ত আছে। ধরা পড়ল ডেভিড। জোরপূর্বক আটক, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি একাধিক ধারায় দোষী সাব্যস্ত ডেভিডের ফাঁসির সাজা দিল আদালত।
                                       - - দুই--
         কিছুদিন ধরেই হাতে কোনো কাজকর্ম নেই। একা বোকার মতো বসে আছি। এই বেকার জীবনটা বড় একঘেয়ে লাগছে। গ্যাসের উনুনে চাল, আলু আর ডিম বসিয়ে দিয়ে পুরানো একটা খবরের কাগজে শব্দছক করছি। এমন সময় বাইরের দরজায় খটখট আওয়াজ হল। উঠে গিয়ে দরজাটা খুললাম। দেখি আমার ট্রাভেল এজেন্ট বন্ধু সৌম্য।
চা খেতে খেতে সৌম্য বলল, "তোর হাতে তো ইদানিং কোনো কাজ নেই, বেকার বসেই আছিস। আমি যদি কোনো কাজ দিই করবি ?"
আমি হাঁড়ি হতে ডিমটা বের করতে করতে বললাম, "করব না মানে, আলবাত করব। কি কাজ তুই বল।"
সৌম্য চায়ের কাপটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বলল, "জানিসই তো আমার ট্রাভেলের ব্যবসা। তুই যদি আমাকে খদ্দের ধরে দিস তাহলে তোকে আমি কমিশন দেব। আর তোরও নিখরচায় বেড়াবার সূযোগ হবে। ইচ্ছা করলে এজেন্ট হিসাবে যেকোনো ট্রিপে সঙ্গে যেতে পারিস। তবে সেক্ষেত্রে মিনিমাম পাঁচজন কাস্টমার চাই। এবার ভেবে দ্যাখ কি করবি।"
ভাবার কোনো সূযোগ ছিল না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আটজন কাস্টমার জোগাড় করে ফেললাম সিকিম গ্যাংটক ভ্রমণের জন্য। আমারও বহুদিনের ইচ্ছা ছিল সিকিম দেখার। আজ স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। হারিয়ে যেতে চাই কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের কোলে। ইয়াকের পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়তে চাই নিরুদ্দেশে।
জুনের মাঝামাঝি, আমাদের এখানে তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ হতে চুয়াল্লিশে ঘোরাঘুরি করছে। এসময়টাই সিকিম ভ্রমণের জন্যে উত্তম সময়। যাত্রীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সবেমিলে জনাচল্লিশেক যাত্রি। তাদের ঠিকমতো ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আমি আপার বার্থে উঠে শুয়ে পড়লাম। শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। ট্রেন চলেছে দ্রুতগতিতে নিউজলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে।
"মশাই কি গ্যাংটক চললেন ?" একটা জড়ানো কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙ্গে গেল।  দেখি পাশের আপার বার্থ হতে একজন বৃদ্ধ লোক আমার দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছেন। আমি তার দিকে তাকাতেই তিনি একটুখানি কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিলেন। যদিও গলাটা খুব একটা পরিস্কার হল বলে মনে হল না। সেই রকমই শ্লেষ্মাজড়ানো গলাতে বললেন, " আমিও চল্লাম কিনা। আপনি তো আবার ট্রাভেলের লোক, আলাপ পরিচয় থাকলে সুবিধা হবে আরকি।"
আমি বললাম, "ট্রাভেলের লোক আমি ঠিকই কিন্তু কাউকে সুবিধা করে দেবার মতো  অভিজ্ঞতা আমার নেই। নেহাত পেটের দায়ে এই কাজ করছি। তবে আপনাকে যতটা সম্ভব আমি সাহায্য করব ।"
লোকটির  কাছ থেকে আর কিছু উত্তর পেলাম না, পরিবর্তে নাক ডাকার আওয়াজ আসতে থাকল। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
গোলবাধল পরদিন সকালে। টিটি এসে টিকিট দেখতে চাইতেই বুড়ো তার নোকিয়া ষোলোশ' মোবাইলটি টিটির হাতে দিয়ে বলল," মেসেজ ঢুকছে, দেখেনিন। "  টিটি ভদ্রলোক হাজার চেষ্টা করেও টিকিট কনফার্মের মেসেজটি পেলেন না। একসময় বিরক্ত হয়ে মোবাইলটি বুড়োর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "আইকার্ড দেন।"
  বুড়ো ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ টিটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটা উত্তাপহীন গলায় বলল, "আইকার্ড তো নেই বাবা ! রেশনকার্ড আছে, বের করব ?"   টিটি আর দাঁড়াল না।
নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন আসতেই দু'জন রেলপুলিশ এসে বুড়োকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আমার মুখোমুখি হতেই বুড়ো একটা শিশুসুলভ হেসে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
                   নিউজলপাইগুড়িতে  ব্রেকফাস্ট সেরে যাত্রিদের সাথে একটা গাড়িতে চড়ে বসলাম। দীর্ঘ যাত্রাপথ । আমাদের মোট পাঁচটা গাড়িতে চল্লিশজন যাত্রি। আমি একদম পেছনের গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছি। ড্রাইভার নেপালি হলেও বাংলা ভালোই জানে। নাম পওন প্রধান। সারা রাস্তা গল্প করতে করতে চললাম।
পওন জানাল যে গ্যাংটকে এখন  বর্ষার প্রাকমূহুর্ত। একমাত্র জিরোপয়েন্ট ছাড়া বরফ পাওয়া দুষ্কর। আমরা যেন সেখানে যাই। তবে গ্যাংটকে খুব সাবধান। আমি বিস্মিত হয়ে শুধালাম, "সাবধান কেন ?"
পওন বলল, "সাবজী, জিন্দেগি ভগবানের দেন আছে; - আপনি শুধু শুধু কেন তকলিফ উঠাবেন !"
আমি বললাম, "হেঁয়ালি বুঝি না, যা বলবে ঠিক করে বল।"
পওন ডানহাতটা দুটো কানে ঠিকিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে জপ করে নিল, তারপর বলল, " শয়তান আছে সাবজী ! একদম শয়তান ! আন্ধেরা হোয়ে গেলে ও আসে। তারপর আঁখ মু' সিনা পাঞ্জা দিয়ে সিরে লেয়। রাম রাখে সাবজী !! "
আমার বুকটা কেমন আকুপাকু করতে লাগল। বলে কি পওন, চোখ মুখ বুক ছিঁড়ে নেয় ! পেটের দায়ে কি শেষে জানে মারা পড়ব !  ট্রেন থেকে নেমেই একটা ঠান্ডা জলের বোতল কিনেছিলাম, সেটা হতে কিছুটা জল গলায় ঢেলে নিলাম। ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া গলাটাতে একটু জোর এল। আমি সভয়ে বললাম," পুলিশ কিছু করে না !"
পওন বলল, "ও দানো আসে সাবজী। দানোর সাথে কেউ ভি পারে না।"
আমি আর কথা বাড়ালাম না। গাড়ি ছুটে চলল।  প্রচণ্ড রোদে আমার অবস্থা খারাপ। মাথা ধরে গিয়েছে। পওন জানাল যে আর কিছুদূর গেলেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হবে। হ্যাঁ, তাই হল। বেশ অনেকটা চলার পর পর জঙ্গলের গাছপালাগুলোর একটা পরিবর্তন এল। জঙ্গল ঘন হচ্ছে আর শালের জঙ্গলে অনুপ্রবেশ ঘটছে পাইন দেবদারুর। বাতাসটাও শীতল হয়ে আসছে। দু'পাশের পটচিত্রে আমূল পরিবর্তন। একদিকে পাহাড়ের কোলে রাস্তা আর অন্যদিকে গভীর খাত। সেই গভীর খাতের পাশে আবার কালচে সবুজ রঙের সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। রাস্তা সাপের মতো আঁকাবাঁকা।
রাস্তার পাশে একটা হোটেলে আমাদের গাড়িগুলো দাঁড়াল। দুপুরের খাওয়ার জন্য। আমি একপ্লেট ডিমভাত অর্ডার করলাম। ভাত এল। সরু চালের ভাত সাথে ডিমের কারি ডাল আর পাঁপড়। খেয়ে মন বা পেট কিছুই ভরল না। আমরা রাঢ়বঙ্গের মানুষ, পেট ভর্তি মোটা চালের ভাত খেয়ে অভ্যাস, আমাদের কাছে এ খাবার নস্যি। কিন্তু উপাই কি ?
খেতে খেতেই শুনলাম দু'জন  ড্রাইভার নেপালি ভাষায় নিজেদের মধ্যে গ্যাংটকের দানবের ব্যাপারে আলোচনা করছে । নেপালি ভাষাটা হিন্দির কাছাকাছি হওয়ায় অনেকটাই বুঝতে পারছি । দুজনের আলোচনার সারমর্ম হল এই,
' একটা দানবের আবির্ভাব ঘটেছে গ্যাংটক শহরে। সে যেমন নির্মম তেমনি শক্তিশালী। পাহাড়ী রাস্তা হতে শুরু করে হোটেলের ঝুলবারান্দা, - সর্বত্রই তার আতঙ্ক বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম পুলিশ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই সমস্যা সমাধানে তৎপর হয়েছে।
দানবটিকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। তবে এর কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে গোটা উপত্যকায়। নিঃশব্দে আসে আর আঘাত করে। এ পর্যন্ত সাত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। সবারই চোখ মুখ ক্ষতবিক্ষত আর বুক চিরে কলজেটা বের করে নেওয়া হয়েছে। আতঙ্কে  সন্ধ্যার পর মানুষ আর  ঘর হতে বের হয় না। '
                                     ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ গ্যাংটকে পৌঁছালাম।  বোধিমার্গের কাছাকাছি একটা হোটেল আগেথেকেই ঠিক করা ছিল। পাঁচতলা হোটেলের ছাদের দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। সব যাত্রীর রুমের ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি নিজের রুমে গিয়ে লেপের তলায় ঢুকলাম। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। নেহাত ডাকাত না পড়লে রাতের খাবারে ডাক পড়ার আগে লেপ হতে বেরোবো না।
রাত্রের খাবারের আয়োজন হয়েছে। আলুপোস্ত, ডাল, ডিমকষা, ভাত আর পাঁপড় ভাজা। এখানে খাবার শেষে একটু করে জলপাইয়ের আচার দেওয়া হয়, অনেকটা আমাদের সমতলের শেষপাতে চাটনির মতো। খেতে খেতে পাশের টেবিলে চোখ যেতেই দেখলাম সেই বুড়ো। একমনে ডাল দিয়ে ভাত মাখাচ্ছে। তবে কাল রাতের তুলনায় বয়সটা একটু কম মনে হলো। আমার দিকে নজর যেতেই বুড়ো একগাল হেসে বলল, "কেমন আছেন স্যার ?"
            আমি দায়সারা ভাবে জবাব দিলাম, "ভালো।"    বুড়োটা তাতে একটুও বিরক্ত না হয়ে পরবর্তী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। "খুব ব্যস্ত আছেন কি ? মানে একটু যদি সময় দেন খাওয়ার পরে। আমি বেশিক্ষণ জ্বালাবো না।"
বুড়োর ব্যাপারে আমিও খুব কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণের পরিচয়েই লোকটার উপর একটা দূর্বলতা এসে গিয়েছিল তাই আর না করতে পারলাম না। আলুপোস্ত মাখানো ভাত মুখে তুলতে তুলতে বললাম," আচ্ছা আসুন। "
ঘরে ঢুকেই বুড়ো আমার বিছানার উপর গুছিয়ে বসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " আমি মশাই কোনো সাহায্য প্রার্থী বা  উমেদার গোছের কিছু নই। আমি এখানে এসেছি নিতান্তই নিরুপায় হয়ে। নাহয় এ বয়সে এতটা উঁচুতে শুধু শুধু প্রেসার বাড়াতে আসবো কেন।"
এই বলে বুড়ো পকেট হতে একটা জীর্ণ কাগজের টুকরো বের করে বিছানার উপর রাখল । কাগজটা বয়সের ভারে লালচে হলুদ হয়ে গেছে। বহুবার ভাঁজ করার ফলে ভাঁজগুলো ছিঁড়ে যাবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমি কাগজটা হাতে নিয়ে অতি সাবধানে খুলে ফেললাম। কালচে লাল কালিতে আঁকা একটা ম্যাপ। ম্যাপের  কিছু কিছু জায়গায় চক্রের মতো চিহ্ন দেওয়া আছে।
আমি বললাম, "এ তো মনে হচ্ছে সিকিমের ম্যাপ। কিন্তু এই ম্যাপের সাথে আপনার সিকিম আসার কি সম্পর্ক থাকতে পারে !"
বুড়ো মিটমিট করে হেসে বলল, "আপনার বুদ্ধি আছে। ম্যাপটা আমার বাবার সিন্দুক থেকে পেয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা ভাইবোনেরা পিতৃস্নেহ হতে বঞ্চিত। আমার বাবা ভবঘুরে মানুষ ছিলেন। সংসারের কোনো খোঁজ তিনি রাখতেন না। হঠাৎ হঠাৎ করে ঘর হতে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। ফিরে আসতেন দু'চার বছর পরে।  শেষ যেবার গেলেন সেবারে এলেন পাক্কা সাত বছর পর। আমরা কেউই তার জন্যে ভাবতাম না। সামান্য কিছু জমিজমা ছিল, তার আয়েই মোটামুটি দিন গুজরান হয়ে যেত। তাছাড়া দাদা বড় হয়ে সংসারের হাল ধরলেন।
হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, বাবা সেবার ফিরলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় জটা, শরীরে রক্তশূন্যতার ছাপ স্পষ্ট। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে। যেন চিনতে পারছেন না আমাদের। আমরা ধরাধরি করে বাবাকে ঘরে নিয়ে গেলাম। বিছানায় শুইয়ে দিলাম। সেই যে তিনি বিছানাগত হলেন আর উঠলেন না।
বাবা বাকশক্তি হারিয়েছিলেন। স্মৃতিশক্তিও তলানিতে। ফলে আমরা জানতেই পারলাম না কিভাবে এসব হল। এরপর একবছর বেঁচেছিলেন বাবা। বাবার মৃত্যুর পর আমরা এবিষয়ে আর কোনো কৌতূহল দেখাইনি।
ঠিক মাসখানেক আগে আমার নাতির খেলনা গাড়িখানা ভেঙ্গে যায়। কি কান্না কি কান্না ! নাতি আমার খুব আদরের । ওর কোনও কষ্ট আমি দেখতে পারি না। এজন্য দিনে কতবার যে বৌমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয় তার অন্ত নেই। লোকে  আড়ালে আবডালে আমার  এই স্বভাব নিয়ে পাঁচকথা বলে বেড়ায়। আমি ওসবে পাত্তা দিই না।
নাতিকে কি করে চুপ করাব সে নিয়ে ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ আমার ছেলেবেলার কাঠের গাড়িটার কথা মনে পড়ল। আউটহাউসে পুরানো জিনিসপত্রের সঙ্গে থাকার কথা সেটা। যেই মনে হওয়া ছুটলাম আউটহাউসে। পুরানো মরচে ধরা তালাটা খুলতেই অনেক সময় লেগে গেল।
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই গোটাদুয়েক বাদুর তীব্র গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটা আবার আমার গালে রীতিমত লাথি মেরে জানান দিয়ে গেল যে ঘরটা তাদের। আমি নিতান্তই বহিরাগত মাত্র। ঘরের ভেতরের অবস্থাও খুব খারাপ। ধুলো আর ঝুলে সবজিনিস ঢেকে আছে। মেঝেতেও এক ইঞ্চি পুরু ধুলো। এদিক সেদিক খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একটা কালো রঙের ট্রাঙ্কের দিকে নজর গেল। কাছে গিয়ে ট্রাঙ্কের গা' হতে ধুলো ঝাড়তেই সাদা পেইন্টের লেখাটা স্পষ্ট হয়ে এল।
SHASHANKA SHEKHAR MOITRA
MA, PHD,
DIPLOMA IN PARACYCHOLOGY 

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...