- - ১--
"আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ ! আগামী পনেরোই বৈশাখ আমাদের অলীকপুর ফুটবল ময়দানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিরাট যাত্রানুষ্ঠান, - রাবণের রণসজ্জ্বা। পরিচালনায় অলীকপুর আমরা ক'জন। আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ!...."
একটা ভ্যান-রিক্সায় একজন লোক মাইকে করে প্রচার করতে করতে যাচ্ছে আর পিছন পিছন একদল ছেলে ছুটে ছুটে চলেছে মহাকলোরবে। রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে দুজন বৃদ্ধ বসে বসে গল্প করছিলেন, হঠাৎ একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটিকে দেখে বোঝা যায় যে সে উত্তেজিত হয়ে আছে।
ছেলেটি বলল, "রসিক দাদু শুনেছেন !.... ওরা আবার যাত্রা নামাচ্ছে। এবার কিন্তু কোন বাধা মানব না দাদু, যাত্রা করবে অলীকপুরের লোক....... কভি নেহি !!"
রসিক দাদু বললেন, " ওরা তো সেবার তোদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিল। কি যেন পালা নামিয়েছিলি...."
পাশের বৃদ্ধ বললেন, " 'রণক্লান্ত দূর্যোধন', আমিই তো প্রোমটার ছিলাম। কিন্তু অলীকপুরের ছোঁড়ারা ধোঁয়াবাজী জ্বালিয়ে অন্ধকার করে দিলে। আমি ভাবলাম স্টেজের কোথাও আগুন লেগেছে, - মারলাম এক লাফ.... আমারই ঊরুভঙ্গ হয়ে গেল মশাই।"
রসিকদাদু ঠোঁটের ফাঁকে হাঁসি চেপে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল," এবার তো পালা নামিয়েছে ওরা, দ্যাখ কি করতে পারিস ! "
" দাদু, আমি সবাইকে খবরটা দিয়ে আসি। আজ বিকেলে চণ্ডীমণ্ডপে এসো । " ছেলেটি সেখান থেকে দৌড় লাগালে। বৃদ্ধদুজনে মাথা নেড়ে সন্মতি জানাল । তারপর রসিকদাদু অপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে একচোট হেঁসে নিলেন। অপর বৃদ্ধটিও প্রত্যুত্তরে হেঁসে উঠল। তারপর দুজনে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
গ্রামটির নাম হাতিডোবা। এই গ্রামের সঙ্গে অলীকপুরের প্রায় দু'শ বছরের শত্রুতা। লোককাহিনী অনুসারে হাতিডোবার রাজা আর অলীকপুরের রাজা দুই বন্ধু ছিলেন। হাতিডোবা আর অলীকপুরের মাঝখানে একটা সিঙ্গারার দোকান ছিল। মনুময়রার হাতের সিঙ্গারা দুইগ্রামেই সমানভাবে প্রসিদ্ধ ছিল।
হাতিডোবার রাজা সিঙ্গারার খোলাটা ফেলে দিয়ে শুধু মশলাটা খেতেন। অপরদিকে অলীকপুরের রাজার সিঙ্গারার বিষয়ে কোন বাছবিচার ছিল না। এই নিয়ে দুজনে অনেক তর্কবিবাদ হত। তবে বন্ধুত্ব অটুট ছিল। দুটি গ্রামেও এই নিয়ে অনেক আলোচনা হত। হুঁকো খেতে খেতে গ্রামের মাতব্বরেরা, গুলিডাণ্ডা খেলতে খেলতে কচিকাঁচারা বা পুকুরঘাটে মেয়ে-বৌরা এই আলোচনায় দিনপাত করত।
একদিন অলীকপুরের রাজার এক বয়স্য রাজাকে দুর্বুদ্ধি দিলেন। সেইমতো মনুময়রাকে তলব করা হল। মনুময়রাকে বলা হল স্পেশাল সিঙ্গারা তৈরি করতে, যে সিঙ্গারায় মশলার পরিবর্তে থাকবে খুব তীব্র ঝাল লঙ্কার মিশ্রণ। মনুময়রা প্রথমে রাজি না হলেও টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে বাগে আনা হয়। পরদিন সকালে দুইবন্ধু মিলে সিঙ্গারা খেতে এল মনুময়রার দোকানে। সিঙ্গারায় কামড় বসাতেই হাতিডোবার রাজার কান নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে এল। ভুতজোলাকিয়া লঙ্কার ঝাল যা ভুতকেও জ্বালিয়ে ছাড়ে, সেই লঙ্কার ঝালে হাতিডোবার রাজা গিয়ে পড়লেন ডোবার জলে। প্রজারা এসে কত অনুনয়বিনয় করল কিন্তু রাজা উঠলেন না।
হাতিডোবার রাজা সেইদিন থেকে হাতির মতোই ডোবাতেই ডুবে রইলেন, আর উঠলেন না। হাতিডোবার প্রজারা তাদের প্রিয় রাজার এমন পরিনতিতে এতটাই রেগে গেল যে সেই ডোবার জল হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করল - - অলীকপুরের কাউকে ছাড়া হবে না। অলীকপুরের সমস্ত শুভ কাজে হাতিডোবার লোক শনির মতো বাগড়া দেবে। সেই ট্রাডিশন আজও সমানতালে চলছে। তাই আজ যখন থেকে হাতিডোবার লোক শুনেছে যে অলীকপুর যাত্রাপালা নামাচ্ছে তখন থেকেই নেমে পড়েছে যাত্রাপালা ভণ্ডুলের উদ্দেশ্যে।
বিকেলের মিটিংয়ে সর্বসন্মতভাবে অলীকপুরের এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব আনা হল। সভায় কেউ কেউ গরম গরম বক্তব্য রাখল তো কেউ আবার পূর্বাভিজ্ঞতায় ভীত হয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার নিদান দিল। রসিকদাদু বললেন, " আমাদের হাতিডোবার সন্মান জড়িয়ে আছে, ওদেরকে ঢিট করতেই হবে। সামনে বছর অন্ধকারের সুযোগে ওরা আমার ধুতি নিয়ে পালিয়েছে। লড়াই চাই.... লড়াই..... ফ... ফ... ফাইট...." উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে রসিকদাদু উঁচু ঢিবি হতে উল্টে পড়ে গেলেন।
সভা সেদিনকার মতো মুলতুবি করা হল, কিন্তু সভার অধিকাংশ লোকেরাই অলীকপুরকে ঢিট করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো । তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বাড়ি ফিরে স্ত্রীর উপরে সমস্ত ক্ষোভ ঝাড়ার প্রচেষ্টা করল। কিন্তু স্ত্রীজাতি দূর্বলা নয়, তাই ঘরের লক্ষ্মী যখন কালি মূর্তি ধারন করল তখন সেই বেচারার স্থান হল চণ্ডীমণ্ডপের আটচালায়। রাতের সময় এইরকমভাবে আটদশটি গৃহপালিত বীরের একসঙ্গে আটচালায় সন্মিলন হল।
এদের এক ছোকরা তার পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করল, "কি মাখন খুঁড়ো, খুঁড়ি হেব্বি পিটিয়েছে বল !"
সুভাষ খুঁড়ো শংসপ্তকের মতো বুক চিতিয়ে বসে পড়লেন। তারপর হুঙ্কার ছাড়েন, " তোর খুঁড়ি তো খুঁড়ি, খুঁড়ির বাপও আমাকে জব্দ করতে পারবে না। সে ছিল আকালের বছর, বুঝলি ভাইপো ! তোর খুঁড়ির বাপ আমার পায়ে ধরেছিল। এই শর্ম্মাই ছিল ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো,..... আ.. আ.. আর আমাকে বলে কিনা বেরিয়ে যাও !!!" সুভাষ খুঁড়োর রৌদ্ররস করুণরসে পরিণত হল, তিনি কেঁদে ফেললেন।
এমনসময় আটচালার কোনার দিক হতে কাশির আওয়াজ কানে এল। দুজনের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল চাদরমুড়ি দেওয়া লোকটার দিকে। এই বৈশাখের গরমে যে চাদর গায়ে দিতে পারে সে আর কেউ নয় - - আমাদের হাতিডোবার রসিকদাদু। ছোকরাটি চেঁচিয়ে উঠল, "রসিকদাদু..!"
রসিকদাদু চাদরের ঢাকা খুলে মুখ বের করে একগাল হাঁসল। তারপর পকেট হতে একটা লবঙ্গ বের করে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, " খুব গ্যাস ! তাই তোদের ঠাকুমা বলল হাওয়াতে পায়চারি করতে।"
সুভাষ খুঁড়ো এবার করুণরস হতে হাস্যরসে ফিরলেন। তিনি প্রথমে খিঁক খিঁক করে হেঁসে উঠলেন তারপর কানে গোঁজা বিড়িটাকে নিয়ে দুহাতে রগড়ে নিলেন। তারপর বললেন, "এই বোশেখের রাতে চাদরের তলায় তুমি কি হাওয়া পাচ্ছ খুঁড়ো ! তারচেয়ে বল না কেন যে আমরা এখানে যারা আছি তারা সবাই একই পথের পথিক।"
রসিকদাদু কিছু না বললেও আটচালার কোণার দিক হতে প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। সেখানে শুয়েছিল হরিদাস মহান্ত। মহান্তজী বৈষ্ণব মানুষ, অলীকপুরের মানুষ ছাড়া এই ত্রিজগতে কারোর উপর তার বিদ্বেষ নেই। তিনি বৈষ্ণবোচিত বিনয়ের সঙ্গে বললেন," বাবাসকল, গোবিন্দের দুনিয়ায় সকলই মায়া। তিনিই একমাত্র মায়াধীশ, আর আমরা তার মায়ার অধীন। বাবারা, মায়া আমারো ছিল কিন্তু হতচ্ছাড়িকে আমি বর্জন করেছি। সারাদিন হাল ঠেঙিয়ে এসে শুকনো মুড়ি আর গুড় যদি পরিবেশিত হয় তাহলে কি আর সংসারে মন বসে। তাই হরির স্মরণে এলাম। তাই বাবাসকল, তোমাদের পর্যায়ে আমাকে আর ফেলো না। "
বাবাজীর বাণী শ্রবণ করে সকলে একযোগে বলে উঠলেন," বল হরি, হরি বোল...!!! "
"আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ ! আগামী পনেরোই বৈশাখ আমাদের অলীকপুর ফুটবল ময়দানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিরাট যাত্রানুষ্ঠান, - রাবণের রণসজ্জ্বা। পরিচালনায় অলীকপুর আমরা ক'জন। আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ ! আনন্দ সংবাদ!...."
একটা ভ্যান-রিক্সায় একজন লোক মাইকে করে প্রচার করতে করতে যাচ্ছে আর পিছন পিছন একদল ছেলে ছুটে ছুটে চলেছে মহাকলোরবে। রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে দুজন বৃদ্ধ বসে বসে গল্প করছিলেন, হঠাৎ একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটিকে দেখে বোঝা যায় যে সে উত্তেজিত হয়ে আছে।
ছেলেটি বলল, "রসিক দাদু শুনেছেন !.... ওরা আবার যাত্রা নামাচ্ছে। এবার কিন্তু কোন বাধা মানব না দাদু, যাত্রা করবে অলীকপুরের লোক....... কভি নেহি !!"
রসিক দাদু বললেন, " ওরা তো সেবার তোদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিল। কি যেন পালা নামিয়েছিলি...."
পাশের বৃদ্ধ বললেন, " 'রণক্লান্ত দূর্যোধন', আমিই তো প্রোমটার ছিলাম। কিন্তু অলীকপুরের ছোঁড়ারা ধোঁয়াবাজী জ্বালিয়ে অন্ধকার করে দিলে। আমি ভাবলাম স্টেজের কোথাও আগুন লেগেছে, - মারলাম এক লাফ.... আমারই ঊরুভঙ্গ হয়ে গেল মশাই।"
রসিকদাদু ঠোঁটের ফাঁকে হাঁসি চেপে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল," এবার তো পালা নামিয়েছে ওরা, দ্যাখ কি করতে পারিস ! "
" দাদু, আমি সবাইকে খবরটা দিয়ে আসি। আজ বিকেলে চণ্ডীমণ্ডপে এসো । " ছেলেটি সেখান থেকে দৌড় লাগালে। বৃদ্ধদুজনে মাথা নেড়ে সন্মতি জানাল । তারপর রসিকদাদু অপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে একচোট হেঁসে নিলেন। অপর বৃদ্ধটিও প্রত্যুত্তরে হেঁসে উঠল। তারপর দুজনে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
গ্রামটির নাম হাতিডোবা। এই গ্রামের সঙ্গে অলীকপুরের প্রায় দু'শ বছরের শত্রুতা। লোককাহিনী অনুসারে হাতিডোবার রাজা আর অলীকপুরের রাজা দুই বন্ধু ছিলেন। হাতিডোবা আর অলীকপুরের মাঝখানে একটা সিঙ্গারার দোকান ছিল। মনুময়রার হাতের সিঙ্গারা দুইগ্রামেই সমানভাবে প্রসিদ্ধ ছিল।
হাতিডোবার রাজা সিঙ্গারার খোলাটা ফেলে দিয়ে শুধু মশলাটা খেতেন। অপরদিকে অলীকপুরের রাজার সিঙ্গারার বিষয়ে কোন বাছবিচার ছিল না। এই নিয়ে দুজনে অনেক তর্কবিবাদ হত। তবে বন্ধুত্ব অটুট ছিল। দুটি গ্রামেও এই নিয়ে অনেক আলোচনা হত। হুঁকো খেতে খেতে গ্রামের মাতব্বরেরা, গুলিডাণ্ডা খেলতে খেলতে কচিকাঁচারা বা পুকুরঘাটে মেয়ে-বৌরা এই আলোচনায় দিনপাত করত।
একদিন অলীকপুরের রাজার এক বয়স্য রাজাকে দুর্বুদ্ধি দিলেন। সেইমতো মনুময়রাকে তলব করা হল। মনুময়রাকে বলা হল স্পেশাল সিঙ্গারা তৈরি করতে, যে সিঙ্গারায় মশলার পরিবর্তে থাকবে খুব তীব্র ঝাল লঙ্কার মিশ্রণ। মনুময়রা প্রথমে রাজি না হলেও টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে বাগে আনা হয়। পরদিন সকালে দুইবন্ধু মিলে সিঙ্গারা খেতে এল মনুময়রার দোকানে। সিঙ্গারায় কামড় বসাতেই হাতিডোবার রাজার কান নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে এল। ভুতজোলাকিয়া লঙ্কার ঝাল যা ভুতকেও জ্বালিয়ে ছাড়ে, সেই লঙ্কার ঝালে হাতিডোবার রাজা গিয়ে পড়লেন ডোবার জলে। প্রজারা এসে কত অনুনয়বিনয় করল কিন্তু রাজা উঠলেন না।
হাতিডোবার রাজা সেইদিন থেকে হাতির মতোই ডোবাতেই ডুবে রইলেন, আর উঠলেন না। হাতিডোবার প্রজারা তাদের প্রিয় রাজার এমন পরিনতিতে এতটাই রেগে গেল যে সেই ডোবার জল হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করল - - অলীকপুরের কাউকে ছাড়া হবে না। অলীকপুরের সমস্ত শুভ কাজে হাতিডোবার লোক শনির মতো বাগড়া দেবে। সেই ট্রাডিশন আজও সমানতালে চলছে। তাই আজ যখন থেকে হাতিডোবার লোক শুনেছে যে অলীকপুর যাত্রাপালা নামাচ্ছে তখন থেকেই নেমে পড়েছে যাত্রাপালা ভণ্ডুলের উদ্দেশ্যে।
বিকেলের মিটিংয়ে সর্বসন্মতভাবে অলীকপুরের এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব আনা হল। সভায় কেউ কেউ গরম গরম বক্তব্য রাখল তো কেউ আবার পূর্বাভিজ্ঞতায় ভীত হয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার নিদান দিল। রসিকদাদু বললেন, " আমাদের হাতিডোবার সন্মান জড়িয়ে আছে, ওদেরকে ঢিট করতেই হবে। সামনে বছর অন্ধকারের সুযোগে ওরা আমার ধুতি নিয়ে পালিয়েছে। লড়াই চাই.... লড়াই..... ফ... ফ... ফাইট...." উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে রসিকদাদু উঁচু ঢিবি হতে উল্টে পড়ে গেলেন।
সভা সেদিনকার মতো মুলতুবি করা হল, কিন্তু সভার অধিকাংশ লোকেরাই অলীকপুরকে ঢিট করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো । তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বাড়ি ফিরে স্ত্রীর উপরে সমস্ত ক্ষোভ ঝাড়ার প্রচেষ্টা করল। কিন্তু স্ত্রীজাতি দূর্বলা নয়, তাই ঘরের লক্ষ্মী যখন কালি মূর্তি ধারন করল তখন সেই বেচারার স্থান হল চণ্ডীমণ্ডপের আটচালায়। রাতের সময় এইরকমভাবে আটদশটি গৃহপালিত বীরের একসঙ্গে আটচালায় সন্মিলন হল।
এদের এক ছোকরা তার পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করল, "কি মাখন খুঁড়ো, খুঁড়ি হেব্বি পিটিয়েছে বল !"
সুভাষ খুঁড়ো শংসপ্তকের মতো বুক চিতিয়ে বসে পড়লেন। তারপর হুঙ্কার ছাড়েন, " তোর খুঁড়ি তো খুঁড়ি, খুঁড়ির বাপও আমাকে জব্দ করতে পারবে না। সে ছিল আকালের বছর, বুঝলি ভাইপো ! তোর খুঁড়ির বাপ আমার পায়ে ধরেছিল। এই শর্ম্মাই ছিল ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো,..... আ.. আ.. আর আমাকে বলে কিনা বেরিয়ে যাও !!!" সুভাষ খুঁড়োর রৌদ্ররস করুণরসে পরিণত হল, তিনি কেঁদে ফেললেন।
এমনসময় আটচালার কোনার দিক হতে কাশির আওয়াজ কানে এল। দুজনের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল চাদরমুড়ি দেওয়া লোকটার দিকে। এই বৈশাখের গরমে যে চাদর গায়ে দিতে পারে সে আর কেউ নয় - - আমাদের হাতিডোবার রসিকদাদু। ছোকরাটি চেঁচিয়ে উঠল, "রসিকদাদু..!"
রসিকদাদু চাদরের ঢাকা খুলে মুখ বের করে একগাল হাঁসল। তারপর পকেট হতে একটা লবঙ্গ বের করে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, " খুব গ্যাস ! তাই তোদের ঠাকুমা বলল হাওয়াতে পায়চারি করতে।"
সুভাষ খুঁড়ো এবার করুণরস হতে হাস্যরসে ফিরলেন। তিনি প্রথমে খিঁক খিঁক করে হেঁসে উঠলেন তারপর কানে গোঁজা বিড়িটাকে নিয়ে দুহাতে রগড়ে নিলেন। তারপর বললেন, "এই বোশেখের রাতে চাদরের তলায় তুমি কি হাওয়া পাচ্ছ খুঁড়ো ! তারচেয়ে বল না কেন যে আমরা এখানে যারা আছি তারা সবাই একই পথের পথিক।"
রসিকদাদু কিছু না বললেও আটচালার কোণার দিক হতে প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। সেখানে শুয়েছিল হরিদাস মহান্ত। মহান্তজী বৈষ্ণব মানুষ, অলীকপুরের মানুষ ছাড়া এই ত্রিজগতে কারোর উপর তার বিদ্বেষ নেই। তিনি বৈষ্ণবোচিত বিনয়ের সঙ্গে বললেন," বাবাসকল, গোবিন্দের দুনিয়ায় সকলই মায়া। তিনিই একমাত্র মায়াধীশ, আর আমরা তার মায়ার অধীন। বাবারা, মায়া আমারো ছিল কিন্তু হতচ্ছাড়িকে আমি বর্জন করেছি। সারাদিন হাল ঠেঙিয়ে এসে শুকনো মুড়ি আর গুড় যদি পরিবেশিত হয় তাহলে কি আর সংসারে মন বসে। তাই হরির স্মরণে এলাম। তাই বাবাসকল, তোমাদের পর্যায়ে আমাকে আর ফেলো না। "
বাবাজীর বাণী শ্রবণ করে সকলে একযোগে বলে উঠলেন," বল হরি, হরি বোল...!!! "
No comments:
Post a Comment