Saturday, May 4, 2019

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ২ //সুব্রত মজুমদার

                                                - - ২--
   হাতিডোবায় যখন পুরুষসিংহেরা আটচালা অবলম্বন করেছে তখন অলীকপুরের চণ্ডীমণ্ডপে চলছে যাত্রাপালার রিহার্সাল। একজন শুঁটকো মতো লোক দেহের তুলনায় ভারি একজোড়া গোঁফ নিয়ে যাত্রার পাট বলছে।
         কি আশে প্রবিশে রাম কনক লঙ্কাপুরে
        অজ কভু পশে কিরে শার্দূলের ঘরে ?
             মিটাইব রণসাধ ভিখারী রাঘবে
         সাজ তাই ত্বরা করি রণসাজে সবে।
মাঝখানে বসে থাকা মাছি গোঁফওয়ালা প্রম্পটার রাবণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, " তা যাই বল ভাই অবিনাশ, আমি তো চিন্তায় মরে যাচ্ছি এটা ভেবে যে তোমার ওই দুবলা পাতলা শরীরে দশটা মাথার ভার নিতে পারবে কিনা। "
অবিনাশ প্রম্পটাররের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, "মেলা বকোনা তো ! চারফুট গতরে ছ'ফুট গোঁফ, তাও আবার হিটলার মার্কা। পর পর তিন তিনখান পালা ফ্লপ হয়ে গেল, কোথায় ছিল তোমার মুরোদ ? হাতিডোবার ডোবায় ডুবে মরা উচিত তোমার। "
এরপর দুজনের কথা কথান্তর হাতাহাতির রুপ নিল। বেগতিক দেখে হনুমানবেশী  চঞ্চল চাকলাদার দুজনকেই বগলদাবা করে জোরজবস্তি বসিয়ে দিল। তবুও দুজনের আক্রোশ কমল না। বসে বসেই একে অপরকে বাছা বাছা বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে লাগল।
       প্রম্পটার রজত রায়  তর্জনি ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে তার মাছি গোঁফকে বার দুয়েক তা দিয়ে নিলেন। অবশ্য এটা ঠিক গোঁফে তা দেওয়া বোঝায় কিনা তা বলা শক্ত। এরপর রজত রায় বলল, "বুঝলে চাকলাদার, এখানে শিল্প-সাহিত্যের বোঝদার খুবই কম আছে। সর্বক্ষণ একটাই চেষ্টা - নিজের ঢাক কিভাবে পেটানো যায়। নাও শুরু কর।"
চাকলাদার শুরু করল, " দুর্মতি দশানন এবে পাবে দরশন কৃতান্তের মম গদাঘাতে,
                                     শির তব করি চূর্ণ করিব গোধূমচূর্ণ লুচি গড়ি খাইব প্রাতে।
                                     এখনো সময় আছে সীতা দাও রাম কাছে নতুবা নিশ্চিত মরন
                                     আসিছেন রঘুপতি এবে তব দুর্গতি, - কে ঠেকাব তোমার শমন !
                                     ওরে ব্যাটা নরাধম.. ঈ.. ঊ.. আ... খ্রি......  ঈঈঈঈঈ.....
হনুমানের গলায় বিজাতীয় শব্দসম্ভার শুনে সবাই একটু অবাক হল। রজত রায় চারপাঁচ বার বইটা দেখে নিলো । না এমন ডায়ালগ তো নেই কোত্থাও নেই । এরই মধ্যে হনুমানরুপী চাকলাদার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তার মুখ দিয়ে শুধু 'শি-শি' শব্দ বের হচ্ছে, -  মায়েরা তাদের বাচ্চাদের প্রস্রাব করাবার সময় ঠিক যেমন আওয়াজ করেন। চাকলাদারের চোখ বন্ধ।
  অবিনাশ ঘোষ এতক্ষণ রাগে গজগজ করেছিলেন, ব্যাপার দেখে তিনিও রাগ দুঃখ ভুলে রজত রায়কে বললেন, " রজতদা, কি হলো বল তো ? চাকলাদারের মতো হাট্টাগোট্টা ছেলে...."
রজত রায় গম্ভীর গলায় বললো, " নিঘঘাৎ মৃগি।"
অবিনাশ ঘোষ রজত রায়ের কথায় সন্মত হল না। তিনি মাথা নেড়ে বললেন , " আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটা আলঝাইমারের পূর্বলক্ষণ। আমার মাসতুতো দাদার শালার ভাইরাভাইয়ের মেয়ের কাকার শ্বশুরের হয়েছিল এ রোগ। প্রথম প্রথম পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে শিঁস দিত, তারপর পাড়ার মেয়েরা দিল রামঠ্যাঙানি, - যেটুকু স্মৃতি বাকি ছিল তাও গেল। তখন পাড়ার বাড়ি বাড়ি হেঁসেল খুলে খাবার খেয়ে আসতেন। সেবার হল কি... "
       অবিনাশের অনন্ত কাহিনী রজত রায়ের হুঙ্কারে থেমে গেলেন । রজত রায় বললেন ," থামুন তো মশাই ! আপনার ওই সন্মন্ধের বহর শুনেই আমার স্মৃতিও লোপ পাবার জোগাড় হয়েছে। এসব আপনার মতো রেলের টিটির কর্ম নয়। হরি ডাক্তারকে ডাকতে হবে। ওরে কে আছিস... একজন যা তো বাবা হরি ডাক্তারকে ডেকে আন। বলবি  উকিলবাবু ডেকছেন, খুব এমারজেন্সি।"
এক  অত্যুৎসাহী যুবক দৌড়ে গেল হরি ডাক্তারকে ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হরি ডাক্তার এসে হাজির হলেন। তিনি এমনিতে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করেন, তবে প্রয়োজনে অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, সিদ্ধাইয়েও তার দখল যথেষ্ট। তিনি এও দাবি করেন যে আগমবাগীশ শ্রী শ্রী ১০৮ অঘোরানন্দের তত্ত্বাবধানে তিনি তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন।
এহেন হরি ডাক্তার এসেই  রজত রায়ের মুখে থার্মোমিটার গুঁজে দিলেন। এরপর তার নজর গেল চাকলাদারের দিকে। তিনি চাকলাদারের দিকে তাকিয়েই একচোট হেঁসে উঠলেন, " ওহে চঞ্চল, ওভাবে সাধনা হয় না। সাধনার জন্য চাই ভালো গুরু, যেমন আমার গুরু আগমবাগীশ শ্রী শ্রী ১০৮ অঘোরানন্দজী মহারাজ।"  এই বলে তিনি দুই কানে হাত দিলেন।
 রজত রায় মুখে থার্মোমিটার নিয়ে উঁ উঁ শব্দে কিছু বলতে চাইলেন, হরি ডাক্তার সে আবেদনে কর্ণপাত করলেন না। শুধু বললেন," পাঁচ মিনিট। "   এ ঘটনায় উপস্থিত অন্যরা এতই হতচকিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা ডাক্তারের ভুল ধরিয়ে দেবার চেষ্টাও করলো না।
পাঁচ মিনিট পর থার্মোমিটার বের করে নিয়ে আঁতকে উঠলেন, " ও মাই গড ! এ তো অনেক জ্বর। পুকুরে স্নান করেছিলে ?"
রজত রায় কিছু বলার আগেই হরি ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলেন রজত রায়ের হাতে। ইঞ্জেকশনের ব্যাথায় কাতর হয়ে নার্ভাস রজত রায় বললেন, " হ্যাঁ, সপ্তাহখানেক আগে। আপনার বৌমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, রাস্তায় কোন শালা ইয়ে করে রেখে দিয়েছে ! পড়বই পড় ওই ইয়েতেই পা পড়ল। আপনার বৌমা স্নান না করে ঘরে ঢুকতে দিল না। "
হরি ডাক্তার বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন,"হুঁ.., এবার সামলাও ঠ্যালা। ওষুধ আমি দিচ্ছি, সাতদিন শুধু বার্লি নো অ্যানি খাবার। "
আসলে হয়েছিল কি এখানে আসার আগে হরি ডাক্তার গিয়েছিলেন এক জ্বরের রুগি দেখতে। জ্বর মাপার পর থার্মোমিটারে রিডিং থেকেই গিয়েছে। আর সেই রিডিংই রজত রায়ের জ্বরের প্রধান কারন। রজত রায়ের চিকিৎসা করার পর  ব্যাগ গোটাতে গোটাতে বললেন," তা চঞ্চল, কি সাধনা করছো তুমি ?"
      চঞ্চল চাকলাদার হুশহাস শব্দ করে কিছু বোঝাতে চাইল, কিন্তু হরি ডাক্তার তো দুরস্ত কেউই কিছু বুঝতে পারল না। এতক্ষণে রজত রায় কঁকিয়ে উঠলেন ।
" আচ্ছা বেয়ারা ডাক্তার মশাই আপনি ! আমি ডেকে পাঠিয়েছি বলেই আমার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করতে হবে ! ওই দেখুন চাকলাদারের অবস্থা। সাধন ভজন নয়, ঠিকঠাক চিকিৎসা না হলে সাধনোচিত ধামে চলে যাবে চাকলাদার।"

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...