Saturday, May 4, 2019

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৪ // সুব্রত মজুমদার

সুভাষখুঁড়ো সাহেবের দিকে লন্ঠন উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কে হে ছোকরা ! এদিকে কোন মতলবে ?"
সাহেবের মুখ দিয়ে ভয়ে আওয়াজ বেরোল না। সে জানে হাতিডোবার লোকেরা অলীকপুরের চরম শত্রু। এত রাতে অলীকপুরের কোন ছেলেকে আয়ত্তে পেয়ে ছেড়ে দেবে না। আজ সবাই মিলে মনের সুখে তার পিঠে হাতসাফ করবে। ভাবতেই ভয়ে কেঁপে ওঠে সাহেব।
রসিকদাদু বার দুয়েক কেশে নিয়ে বললেন, " এ নিঘ্ঘাত চোর। ও সুভাষ, তুমি বরং জগদীশ দারোগাকে খবর দাও। আর ততক্ষণ এই ব্যাটা চোরকে বেঁধে রাখা হোক চণ্ডিমণ্ডপে।"
সবাই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো। রাজি হলেন না কেবল মহান্তজী। তিনি বললেন, " পেটের দায় বড় দায় বাবা। ওকে পুলিশে দিয়ো না। হরির সংসারে কেউ না খেয়ে থাকবে আর কেউ খেতে পারছে না বলে অপচয় করবে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না বাবা। তুমি ভয় পেয়ে না চোর বাবা, আমি আছি। আমি থাকতে কেউ তোমার উপর অন্যায় করতে পারবে না।"
সাহেব দেখলো যদি পুলিশে দেয় তবে জগদীশ দারোগা ঠিক পেট হতে কথা বের করে ফেলবে। তখন ঢিল মারার জন্য উল্টো করে টাঙ্গিয়ে মারবে। তাই সত্যি সত্যি বলে দেওয়াটাই মঙ্গল। কথায় আছে না, - 'সচ্ বোলনে সে রাহত হ্যায়' ।
সাহেব বলল," আমি সাহেব, অলীকপুরের উকিল রজত রায়ের ছেলে।আমি চোর টোর নি।"
সুভাষখুঁড়ো বললেন, "তাহলে এত রাতে এখানে কি করছ বাছাধন ? হাতিডোবার কি সর্বনাশ করতে এসেছ ?"
মহান্তজী বললেন, "আহাহা ! ছেলেটাকে ধমকাও কেন ! ওকে থামের সাথে বেঁধে রাখো। আমি সর্বজীবে প্রেম বিলাই, কেবল অলীকপুর বাদে। ওই অলীকপুরে বিয়ে করেই আমার কাল হল। "
রসিকদাদু মহান্তজীর দিক তাকিয়ে বললেন," তখন শুনেছিলে আমার কথা ? বার বার বলেছিলাম মেয়ে না জুটলে বিলেত হতে মেম এনে দেব তবুও অলীকপুরের মেয়ে বিয়ে করো না। এখন আর আফসোস করে কি হবে ? "
সুভাষখুঁড়ো এবার বিরক্ত হয়ে বললেন," যা করবার সেটা ঠিক করো। অনেকদিন পর অলীকপুরের কাউকে বাগে পেয়েছি, ছাড়া চলবে না। হাতের সুখ করে নেবো। "
বিপদ বুঝে কাঁদো কাঁদো হয়ে সাহেব বলল," আমি আসতে চাইনি। বাবা জোর করে পাঠিয়েছে। "
রসিকদাদু বললেন," তা তো পাঠাবেই ! না পাঠালে কি হয় ! তোমার বাবার উকিলি বুদ্ধি, কাকে কি করে বাঁশ দিতে হয় তা তোমার বাবা ছাড়া ভালো কে জানেন বলো ! "
সুভাষখুঁড়ো একগাছা দড়ি এনে সাহেবকে চণ্ডিমণ্ডপের থামের সাথে বেঁধে ফেললেন। সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখে শোনা চাকলাদার আর হরি ডাক্তারের সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। সবকিছু শুনে রসিকদাদু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন," কেস তো সিরিয়াস ! কিন্তু পঞ্চানন ডাক্তার তো যাবে না।সেবার পদা নাপিতের উরুস্তম্ভ হল, হরি ডাক্তারকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম, অলীকপুরের লোক আসতে দেয়নি।"
মহান্তজী বললেন, " নৈব নৈব চ। অলীকপুরের কাউকে সাহায্য করা যাবে না। আর তোমরা সে চেষ্টা করলে আমি অনশনে বসব।"
মহান্তজীর দিকে  সকলে সভয়ে তাকাল। কারণ এর আগেও অনেক আলতু ফালতু কারনে মহান্তজী অনশনে বসেছেন, আর প্রতিবারই কোনো না কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। এই তো আগের বছর রাসপূর্ণিমার সময় মহাপ্রসাদে লুচি না ভাত কি হবে তা নিয়ে বিবাদ বাধল। মহান্তজী ভাতের পক্ষে আর রসিকদাদু লুচির পক্ষে। শেষে জনসমর্থন না পেয়ে মহান্তজী অনশনে বসলেন। অবশেষে গ্রামের সবাই মহান্তজীর কথা মেনে নিতে বাধ্য হল। রান্নার ঠাকুর ইতিমধ্যেই ময়দা মেখে ফেলেছে। ফলে কেজি চল্লিশেক ময়দার লেই গরু-ছাগলের পেটে গেল।
রসিকদাদু বললেন, " তোমরা শান্ত হও। মাথা খারাপ করো না। শত্রুতা দু'গাঁয়ের মধ্যে, কিন্তু তাবলে বিবেক মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়। অলীকপুরের লোককে আমরা দেখিয়ে দেবো যে মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে আমরা ওদের থেকে অনেক উঁচুতে।"
আজ আর মহান্তজীর অনশনের ধমকি কোনো কাজে দিল না। উপস্থিত সবাই রসিকদাদুর কথা মেনে নিলো। একজন গেল পঞ্চানন ডাক্তারকে ডাকতে।
সুভাষখুঁড়ো বললেন," আমার একটা প্রস্তাব আছে। "
সবাই সমস্বরে বলল," বলুন.. "
সুভাষখুঁড়ো বললেন," দেখো, বিপদের দিনে আমরা পাশে দাঁড়াবো ঠিক আছে কিন্তু শত্রুকে বিশ্বাস নয়। ছেলেটাকে আমাদের হেফাজতে রাখা হোক। ডাক্তারবাবু যাবেন অলীকপুর আর তার জমানত থাকবে ছেলেটা। এবার বলো তোমরা রাজি কি না। "
 সকলে জানাল তারা রাজি। বিশেষত হরিদাস মহান্ত খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন," আমার আশ্রমেই থাক ছেলেটা। আমি কথা দিচ্ছি কোনো অযত্ন হবে না। "
মহান্তজীর এই প্রস্তাবের পিছনে একটা গূঢ় কারণ ছিল। অনেকদিন হয়ে গেল মহান্তজীর পূর্বাশ্রমের পত্নী মায়ার কোনো খবর তিনি পান নি। হাজার বৈরাগ্য হোক পুরানো প্রেমের আগুন ( দাম্পত্যে কি প্রেম কি অপ্রেম বলা শক্ত ) এখনো নিভে যায় নি। সাহেবকে আশ্রমে রেখে মায়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নেবেন।
এসব কথাবার্তা যখন চলছে ঠিক সেসময় পঞ্চানন ডাক্তার এসে হাজির। তাকে সমস্ত বৃত্তান্ত বলা হলে তিনি বললেন, " ডাক্তারি যখন জানি তখন যাওয়াটা কর্তব্য। তাছাড়া অলীকপুরের লোকদেরও জানানো উচিত যে হাতিডোবাকে ছাড়া অলীকপুর অচল।"
পঞ্চানন ডাক্তাররের কথায় সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। পঞ্চানন ডাক্তারর ব্যাগপত্র নিয়ে অলীকপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সাথে গেলেন রসিকদাদু।
রাস্তায় যেতে যেতে দুজনে অলীকপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা বিষয়ে অনেক আলোচনা হল। দুজনে ধীর পায়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা জগদীশ দারোগার জিপ দেখতে পেলেন। রসিকদাদু ঘুমন্ত ড্রাইভারকে লাঠি দিয়ে এক খোঁচা মেরে বললেন, "ডিউটিতে মে ফাঁকি দেতা হে !"
ড্রাইভার খোঁচা খেয়ে মিটমিট করে তাকিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তার আবার হাঁটতে লাগলেন। রাতের পথ, আর দুজনেই বয়স্ক তাই একটু ধীরে পথ চলছেন দুজনে। একটা কালপেঁচা কর্কশকণ্ঠে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে গেল। রাস্তার দু'পাশ থেকে অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেঁসে আসছে। কতগুলো মেঠো ইঁদুর চিঁচিঁ শব্দ করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  প্রচণ্ড হাওয়ায় বগা শিরশির করছে। রসিকদাদু চাদরটা গায়ে ভালোকরে জড়িয়ে নিলেন। পঞ্চানন ডাক্তার বললেন, " বুঝলেন রসিকবাবু, ডাক্তারি করা যার তার কর্ম নয়, রীতিমতো এলেম লাগে। ওই হরি ডাক্তার আমার নামে আকথা কুকথা বলে বেড়ায়, আর কপাল দেখুন আজ সেই হরে গাঁটকাটাই আমার খপ্পরে !" এই বলে পঞ্চানন ডাক্তার একচোট হেঁসে নিলেন ।

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...