Friday, August 9, 2019

শয়তানের থাবা - পর্ব ৫ // সুব্রত মজুমদার


                                                                             - - ছয় - -
 যখন ঘুম ভাঙল তখন হাতঘড়িতে ভোর  পাঁচটা। ঘুম ভেঙ্গে চারদিকটা দেখেই আমার চক্ষুস্থির, সাধুবাবা কই ? সাধুবাবা বা তার ধুনির চিহ্নমাত্রও নেই। ধুনি তো ধুনি, আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানটা একটা শ্মশানভূমি, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মড়ার হাড়গোড় ভাঙ্গা কলসি আর ছাইয়ের স্তুপ। এ কোথায় এলাম আমি ? চোখ কচলাবার জন্য হাতটা মুখের কাছে আনতেই  নাকে এল ছাতু আর গাঁজা বীজের চাটনির ঘ্রাণ।
উঠে দাঁড়ালাম। চারদিকে ভালো করে দেখতেই বুঝতে পারলাম শ্মশানের পাশে যে পাহাড় আছে সেটা পেরোলেই কোনো জনবসতি পাওয়া যাবে। শ্মশান হতে একটা সরু রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। যেহেতু আমি পথ হারিয়েছি তাই ওই জনবসতিতে পৌঁছানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হাঁটতে লাগলাম।
রাস্তা বরাবর হাঁটতে লাগলাম। পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে যেতেই পাহাড়ের অপরদিকে কতগুলো কাঠের বাড়ি চোখে পড়ল। পাহাড়ের গায়ে ঘরগুলোকে ছবির মতো লাগছিল। কাছাকাছি যেতেই একজন বৃদ্ধ  আমার দিকে এগিয়ে এলেন । বেঁটেখাটো, মুখমণ্ডলে মঙ্গোলয়েড ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন, "আসুন সাবজী, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। ভেতরে আসুন।ধীর সে... "
অবাক হলাম, বলে কি লোকটা, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ! কি সব হচ্ছে ! আমার মাথাটা আর কাজ করছে না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। যাইহোক বৃদ্ধের পেছন পেছন একটা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে দোতলা একটা কাঠের বাড়ির সামনে হাজির হলাম। বাড়িটার রং কিঞ্চিৎ চটে গেছে, ছাদের উপরে  তিব্বতি ভাষায় মন্ত্রলেখা পতাকাগুলো উড়ছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। দোতলার উপরে কাঠের একটা তক্তপোষে আধময়লা বিছানা পাতা, দেওয়ালে বোধিসত্ত্ব ও ভৈরবের ছবি আঁকা।
কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বৃদ্ধ বলল, " নিঁদমে খোয়াব আয়াথা। খোয়াবেই নংগালামা আপনার কথা বলল। বলল কি আপনি তকলিফে আছেন, আপনার দেখভাল কোরতে হোবে।"
আমি বললাম, "আপনার 'নাংগা লামা' কে তা আমি জানি না, তবে কাল রাতে এক সাধুবাবা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।"   এরপর আমি তাকে কাল রাতের সমস্ত ঘটনা বললাম। সব শুনে বৃদ্ধ তার দু'কানে হাত দিয়ে জিভ কেটে বললেন," ওহি তো নাংগা লামা আছে। ভগবান আছে সাব। আপনি খুব ভাগ্যবান আছেন যে উনকি দর্শন পাইয়েছেন। "
এরপর বৃদ্ধ যা শোনালো তা অত্যন্ত লোমহর্ষক। এই নাংগা লামাকে একমাত্র স্বপ্নে ছাড়া বাস্তবে কেউই দেখেনি। এই এলাকার প্রত্যেক বাড়িতে তাঁর পূজা হয়। ইনি কৈলাশ পাহাড়ে বাস করেন, তবে শিব ঠাকুরের বারণ থাকায় কৈলাশের প্রবেশদ্বারের বাইরেই থাকতে হয়।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে কৈলাশ পর্বত মানুষের অগম্য। কোনও জীবিত প্রাণী কৈলাশে পা রাখতে পারেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও তাও ধর্মে এই পর্বত খুবই পবিত্র। কথিত আছে একমাত্র একজনই কৈলাশে পা রাখতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন তিব্বতি কবি ও সাধক 'জেৎসুন মিলারেপা' ( རྗེ་བཙུན་མི་ལ་རས་པ ) । ইনি একজন সিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন। গোটা তিব্বত ও সিকিমে তিনি ভগবানের মতো পূজা পান। এই মিলারেপার গুরু ছিলেন মারপা, যিনি বাঙালি তান্ত্রিক সাধক শ্রীজ্ঞান অতীশের শিষ্য দ্রমশনের প্রবর্তিত বঙ্গীয় তন্ত্র সাধনার ধারা মেনে চলতেন।
বৃদ্ধ দেয়ালের একটা কোণে একটা দেওয়াল চিত্র দেখিয়ে বললেন, "এ হে নাংগা লামা।"
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এ তো একদম অবিকল আমার দেখা সেই সাধুবাবা। অজান্তেই আমার দু'হাত জোড় হয়ে এল শ্রদ্ধায়।
বৃদ্ধের বাড়িতে সেদিনটা থাকলাম। চিঁড়ের সাথে টম্যাটো স্যুপ আর লাল রঙের ঝোলশুদ্ধ  ভেড়ার মাংস দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ  সারলাম। সারাদিন ঘুমোলাম, শরীরের সব ক্লান্তি যেন ঘুচে গেল। রাত্রিবেলায় চিনা মাটির পাত্রে করে এল ভেড়ার মাংস আর গরম গরম চাপাটি সঙ্গে তিব্বতি চা। এই তিব্বতি চায়ের বিশেষত্ব হল এটি আদপেই কোনো পানীয় নয়। ইটের মতো আকার দেওয়া শুকনো চা কে গুঁড়ো করে গরম জলে মেশানো হয়, তারপর সেই মিশ্রণে মাখন, ভেড়ার মাংস নুডলস আর লবণ মিশিয়ে রান্না করা হয়। এটা খেতে খুব সুস্বাদু না হলেও বেশ পুষ্টিকর আর শক্তিবর্ধক।
পরেরদিন সকালে বৃদ্ধ  আমাকে একটা খচ্চরের পিঠে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে চলল গ্রামেরই একটা ছেলে, - তাসি। গ্যাংটক পর্যন্ত পৌঁছে তাসি বিদায় চাইল। আমি তার হাতে একটা টাকা দিয়ে বললাম, "রাস্তায় কিছু খেয়ে নিয়ো।" তাসি হাসিমুখে বিদায় নিল।
রাজমহলে পৌঁছেই রাজার সাথে দেখা করার অনুমতি চাইলাম। রাজার ব্যক্তিগত সচিব বামনদেবের চিঠিটা নিয়ে রাজার কাছে গেল। কিছুক্ষণ পর সচিব জানালেন যে রাজামশাই আমাকে ডেকেছেন। সচিবের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম।
রাজা নমগিয়াল, খুব হাসিখুশি মানুষ। দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলার পর তিনি আমাকে নিয়োগ করলেন। এই স্বল্প সময়ে যা বুঝলাম তাতে এটা পরিষ্কার যে রাজামশাই সুপারিশের চেয়ে নিজে বাজিয়ে নিতেই বেশি পছন্দ করেন। আমাকে তার পছন্দ হয়েছে। রাজনির্দেশে আমার জন্য ঘরের ব্যবস্থা হল। পাহাড়ের কোলে কাঠের বাড়ি, সঙ্গে একজন সর্বক্ষণের কাজের লোক 'শেরিং' ।  জল তোলা, আনাজপাতি কিনে আনা, কাপড় জামা কাচা ইত্যাদি সব কাজই শেরিং করে। রান্নার কাজটি আমি নিজের কাঁধেই নিয়েছি। আমার রান্নাকরা খাবার খেয়ে শেরিং একটা বিশেষ মুখভঙ্গি করে যেটা  ভালো না খারাপ তা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আমি জিজ্ঞাসা করলে সে একগাল হেসে জবাব দেয়, "বহুত বড়িয়া সাবজী ! একদম চকাচক !"
কিছুদিন দফতর বিহীন আমলার মতো কাটানোর পর একদিন রাজামশাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি যেতেই তিনি বললেন, "আগামী পূর্ণিমায় আমি শিকারে বেরোবো, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন।"  প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো রাজা নমগিয়াল ইংরেজি পড়া লোক, বাংলা আর তিব্বতি ভাষাতেও তার প্রগাঢ় জ্ঞান। আমি মাথা নেড়ে সন্মতি জানালাম।
পূর্ণিমার রাত, থালার মতো বড় একখানা চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্নায় চারদিক প্লাবিত। আমি আর রাজামশাই দুজনে ঘোড়ার পিঠে, বাকি সেপাই সান্ত্রিরা পায়ে হেঁটে সাথে সাথে চলেছে। পাহাড়ী জঙ্গলে চিতাবাঘ আর বুনো-শুয়োরের খুব উপদ্রব, আশাকরি একটা না একটা আমাদের বন্দুকের সামনে আসবেই। রাজামশাই খুব আত্মবিশ্বাসী। আমার অবশ্য বাঙালি বিশ্বাস, কয়েকশ' ঠাকুর দেবতাকে ডাকার পরেও আত্মসন্তুষ্টি হয় না।
     একটা পরিস্কার মতো জায়গায় সবাই এসে জড়ো হলাম। সেপাই সান্ত্রিরা তাদের মোমো চিড়া নুডল ইত্যাদির প্যাটরা খুলে আহার করতে লাগল। দুজন  রাজসেবক একটা চাদর পেতে তাতে বিভিন্ন খাবারের পাত্র রাখতে লাগলেন। রাজভোগই বটে, কাবাব কোর্মা কোফতা মোমো চিকেন চাপাটি চা,..... কি নেই !  সামান্য কিছু খেতেই আমার পেট ভরে এল। রাজামশাইও তেমন কিছু খেলেন না। খাওয়ার শেষে মাচা বাঁধা হল। মাচার সামনে চিতাবাঘের ফাঁদ, আর তাতে টোপ হিসাবে নধর একটা পাহাড়ী ছাগল।
সময় যেন পেরোতেই চাইছে না, মাচার উপর বসে ফাঁদের দিকে চেয়ে বসে আছি। এইভাবে কত সময় পার হলো বলতে পারব না। একটা সময় একটু ঢুলুনি এল, ঘুমের ঘোরে হাত থেকে বন্দুক প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ঠিক সেসময় একটা রামচিমটি খেয়ে তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। চোখমেলে তাকাতেই দেখলাম ছাগলের খাঁচার ভেতরে কি একটা নড়াচড়া করছে। ছাগলটি ইতিমধ্যেই 'ম্যা ম্যা' শব্দে  চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। আমরা দুজনেই গুলি চালালাম। গুলির শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। কিন্তু  আশ্চর্যের ব্যাপার একটা গুলিও জন্তুটার গায়ে লাগল না। জন্তুটি একসময় খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে সেপাইদের আক্রমন করল। সেপাইরা তিরধনুক আর বল্লম হাতে সেই জন্তুটার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না, অধিকাংশই বেঘোরে মারা পড়ল, বাকিরা পালিয়ে প্রাণে বাঁচল।
ইতিমধ্যেই জন্তটি আমাদের মাচার নিচে এসে পড়েছে। জ্যোৎস্নার আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার অবয়ব। কালচে বানরের মতো চেহারা, মাথায় দুটো শিং আর ভয়ঙ্কর মুখমণ্ডল। মনে হচ্ছে যেন মূর্তিমান শয়তান উঠে এসেছে নরকের কোন অসুরক্ষিত অর্গল ভেদ করে। রাজামশাই জ্ঞান হারালেন। আমি ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছি, ঠিক এমন সময় কানে এল ঘোড়ার প্রবল হ্রেষারব। দেখলাম একটা সাদা ঘোড়া ছুটে আসছে আমাদের দিকে। ঘোড়ার আওয়াজে শয়তানের বাচ্চাটা বিচলিত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে তারপর হঠাৎ এক লাফে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এরপর আর জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি আমার বিছানায় শুয়ে, মাথার কাছে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে শেরিং। শেরিং যা বলল তা এই যে সেই রাত্রে একটা সাদা ঘোড়া আমাকে আর মহারাজকে পিঠে করে নিয়ে আসে। মহারাজ এখন সুস্থ্যই আছেন।
ঠিক এর পর হতেই একটা সমস্যা দেখা দিল, - ডাক্তারের মতে মানসিক স্ট্রেস হতে এই সমস্যার উৎপত্তি । ডাক্তারের মতামতকে আমি মানি না। এখনও আমি যথেষ্টই সুস্থ্য। আসলে কিছু কিছু ব্যাপার এমনই আছে যেগুলো সাধারণ বুদ্ধিতে চট করে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। যেমন ধরুন সাধুবাবার ঘটনাটা, এই ঘটনার কিয়দংশও কি আপনাদের বিশ্বাস হয়েছে ?  জানি হয়নি। হতে পারও না।
ডাক্তার বললেন, "কিছু মনে করবেন না মৈত্রমশাই, আপনার এই মানসিক সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগেই। পাহাড়ী ওয়েদার, অল্টিটিউড আর অক্সিজেনের ঘাটতি এই রোগে অণুঘটকের কাজ করেছে। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ওষুধ খান আর বিশ্রাম করুন।"
আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি যা যা দেখেছি তা অলৌকিক হলেও আমার স্বকপোলকল্পনা মোটেই নয়। আমি পাগল নই ...... আমি পাগল নই ...... '
      এই পর্যন্ত পড়ার পর ডায়েরিটা বন্ধ করলাম। বেশ ঘুম পাচ্ছে। কালকে কোথাও যাবার নেই, তাই একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোবো। ডায়েরিটার যেটুকু পড়লাম তাতে আমি নিশ্চিত শশাঙ্কশেখরবাবু হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন। তিনি স্বীকার করুন আর নাই করুন সাধুবাবা আর শয়তানের বাচ্চার গল্পটা যে তার মনের কোণের আদিম আতঙ্কের একটা সিনেমামাটিক রুপ তা বলাই বাহুল্য। ডায়েরিটা পড়ার পর বুড়োর মানসিক প্রকৃতিস্থতা নিয়েও আমার সন্দেহ জাগছে। আচ্ছা এটা কি মৈত্র ফ্যামিলির জিনগত ? - ভবিষ্যতই বলবে।

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...