- - সাত--
ভোর হতেই দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুললাম। দেখি একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে অঘোরবাবু। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে ঢুকে এলেন। এরপর একগাল হেসে বললেন, "পাখি ফুড়ুৎ ধা। উড়েছে ।"
"পাখি উড়েছে মানে !"
অঘোরবাবু এবার পাকাপোক্ত ভাবে বিছানায় বসে পড়লেন, তারপর বিছানার উপর রাখা ডায়েরিখানা তুলে নিয়ে উল্টোপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন, "মৃগাঙ্ক সেন পালিয়েছে। বামাল সমেত হাওয়া।"
খবরটাতে আমি অবাক হলাম না, মৃগাঙ্কবাবুর স্বরুপ যা দেখেছি তাতে এ ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত বৃদ্ধ লামাকে আহত করে পালিয়েছিল মৃগাঙ্ক সেন, এখন পুলিশের ভয়ে গাঢাকা দিয়েছে।
বাথরুম হতে মুখ হাত ধুয়ে এসে ওয়াটার হিটারে কফি বানালাম। কথাটা আপনাদের বলাই হয়নি, ওয়াটার হিটার কাম মিনি কফিমেকারটা আমি শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট হতে কিনেছি। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে অঘোরবাবু বললেন, "এই ডায়েরিটা আপনি কোথায় পেলেন মশাই ?"
আমি বললাম, "সে খোঁজে আপনার কাজ কি ? আমি কোথায় কি পাচ্ছি কি পাচ্ছি না তার সবকিছুই কি আপনাকে বলতে হবে ?"
আমার কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন অঘোরবাবু। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, "শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন। আমি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইছি না, আসলে হল কি... ডায়েরিটা আমার চেনা। "
" চেনা মানে ! এ ডায়েরিটা আপনি আগে দেখেছেন ? " আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করি। অঘোরবাবু কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক লাগিয়ে বললেন, " বিক্রমের কাছে দেখেছি। কি যেন মার না কি নাম, সেই শয়তানটার কথাই আছে এতে। আরে মশাই এই গ্যাংটকের খুনগুলোও তো ওই শয়তানটাই করছে। "
"এসব জেনেও আপনার মতো ঘুঘু লোক এখানে বেড়াতে এল, - এটাও আমাকে মানতে হবে !" আমি খানিকটা শ্লেষের সঙ্গেই বললাম।
অঘোরবাবু কফির কাপটা নামিয়ে রেখে একটু ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতেই বললেন," আমি কি আর নিজের ইচ্ছায় এসেছি মশাই ! রীতিমতো ব্রেইনওয়াশ করেছে আমার। পেছনেই আসছি বলে বেপাত্তা। তবে হ্যাঁ, শয়তানের হাত হতে বাঁচতে মহাশক্তিশালী একখান কবচ দিয়েছে। এই দেখুন।"
অঘোরবাবু তার ঘুনসিতে বাঁধা পেল্লাই সাইজের কবচখানা দেখালেন। কুসংস্কারের বহর দেখে আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল , আমি তৎক্ষণাৎ ঘুনসি হতে কবচখানা ছিঁড়ে নিলাম। অঘোরবাবু আচমকা আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আমিও কৌতুহলী হয়ে কবচটার ভেতরের মালমশলা বের করতে সচেষ্ট হলাম। একটু চেষ্টাতেই কবচ হতে বেরিয়ে এল একটা ভাঁজ করা চিরকূট। চিরকূটটা পড়েই আমার হাসির বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আমি হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লাম।
ব্যাপার দেখে অঘোরবাবু আমার হাত হতে চিরকূটখানা নিয়ে পড়তে লাগলেন, " 'ধাপ্পা ! অঘোরবাবু ইন দ্য ভোগ অফ মা' ।" এরপর অঘোরবাবু খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ফুঁসতে লাগলেন। " মানহানির মামলা করব মশাই ! বিক্রমবাবুর সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক শেষ মশাই । বাপের বয়সের একটা মানুষের সাথে এমন রসিকতা কেউ করে..."
আরো কি কি বললেন তা শোনার সময় আমার ছিল না। আমি ভাবছি একটা কথা, যে ডায়েরির কথা বুড়ো আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা সেটা পাবলিক হয় কি করে ! কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। তাছাড়া বিক্রমের মতো নামজাদা গোয়েন্দাই বা কেন নিজে না এসে অঘোরবাবুকে সিকিমে পাঠিয়ে দিলেন ! অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধছে, যেগুলোর উত্তর পাওয়াটা জরুরী। এ এমন একটা জটিল ধাঁধা যেখানে আমার মতো অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন, কেউ জেনে বা কেউ না জেনে।
ভেবেছিলাম অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোব, কিন্তু তা আর হলো না। অঘোরবাবু আমার ঘুমের পিণ্ডি চটকে দিয়েছেন। আমি অঘোরবাবুকে বললাম, "আপনার প্রতিবেশীটি খুবই সেয়ানা, গোলমাল বুঝেই সরে পড়েছে। আর আপনাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এবার মরুন শয়তানের হাতে।"
অঘোরবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকলেন, তারপর বিপুল ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। "একবার বেঁচে ফিরি তারপর দেখেনেব টিকটিকির বাচ্চাকে। বুঝলেন মশাই, দাপুটে লোক ছিলাম আমি, আপিসেই বলুন আর বাড়িতেই বলুন বাঘে গরুকে একঘাটে জল খাওয়াতাম আমি। আর সেই আমাকেই কিনা.... " আর বলতে পারলেন না অঘোরবাবু, তার দু'চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আমিও বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত্বনা দিয়ে তাকে শান্ত করলাম।
অঘোরবাবু চলে যেতেই একটা বিশ্রীরকম হাসতে হাসতে বুড়ো ঘরে ঢুকল। সে আসতেই আমি তার উপর আক্রমণ শানিয়ে দিলাম।
" আসুন আসুন মহোদয় ! আপনার আগমনেরই প্রতীক্ষা করেছিলাম। সত্যি করে বলুন তো আপনার এই ভজকট ব্যাপারে আর কতজন জড়িয়ে আছে ?"
আমার কথায় একটুও বিচলিত না হয়ে বুড়ো একপ্রস্থ কান এঁটো করা হাসি হেসে নিলেন। তারপর বললেন, "সময় খুবই বলবান ভায়া, সময় হলেই সব জানতে পারবেন । আপাত একটা জিনিস দেখাই... " এই বলে তিনি দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর দরজার বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখেই দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। ছিটকিনি এঁটে বিছানায় এসে বসলেন। এরপর পকেট হতে কয়েকটা ধাতুর টুকরো বের করে সমনে রাখলেন ।
মোট চারটে টুকরো। পেতলের,... উঁহু এ তো পেতল নয়, - নিখাদ সোনা। আর কিছু গুন থাক বা না থাক জিওলজিস্ট বন্ধুর কল্যাণে ধাতু রত্নের ব্যাপারে একটা অভিজ্ঞতা তৈরী হয়েছে। টুকরোগুলো বিভিন্ন আকৃতির। প্রত্যেকটি টুকরোতেই বিশেষ খাঁজ আছে। বুড়ো সেই খাঁজ বরাবর টুকরোগুলো জুড়ে দিতেই একটা চক্রের আকার নিল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
বুড়ো বলল, "শয়তানের পাঞ্জার চাবি। যে শয়তানটা অত্যাচার করে বেড়াচ্ছে তার কাছে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় । বৃহদতন্ত্রিকা মতে কোনও এক নির্জন পর্বতগহ্বরে আছে একটা যন্ত্র, যে যন্ত্রকে বিশেষ মন্ত্রে অভিষিক্ত করে এই বিশেষ চাবি ঘোরালেই উন্মুক্ত হবে সময়যন্ত্র, আর এই সময়যন্ত্রই নিয়ে যাবে শয়তানের কাছে। "
আমি বললাম," কিন্তু সেই জায়গাটা কোথায় ? আর আমার এটুকু বাহ্যজ্ঞান আছে যা দিয়ে সহজেই বুঝতে পারি যে আপনার মানসিক সুস্থ্যতা কোন পর্যায়ে। এটা জিনগত রোগ মৈত্রমশাই, আপনার বাবার থেকে আপনি পেয়েছেন। "
বুড়ো কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমার দিকে চেয়ে বললেন," শশাঙ্কশেখর মৈত্রের কোনও মানসিক ব্যাধি ছিল না, সেটা আমি যথাসময়ে প্রমাণ করে দেব। কোনও ভাবেই তিনি হ্যালুসিনেটিং করছিলেন না। আর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আছে ইয়ামথাং-এ। "
" চলুন, কালকেই তো ইয়ামথাং যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, মৃগাঙ্কবাবু পালিয়েছেন।" আমি তার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিলাম। বুড়োটা এবার একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল," মৃগাঙ্কবাবু শয়তানের পূজারী, উনি চাবি না নিয়ে কোত্থাও যাবেন না। অতএব আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, অঘোরবাবুর পহেলা নম্বর শত্রু এখনি বিদায় নিচ্ছেন না। "
আমি অবাক হয়ে বললাম," অঘোরবাবুর কেসটাও জানেন ! তাহলে আর বাকি কি রইল ! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনিই নাটের গুরু। দেখুন মশাই, আমার সাতকুলে কেউ নেই, ঝাড়াহাতপা' মানুষ আমি, তাই আমার কিছু হলেও দুনিয়ার এমনকিছু একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হবে বলে মনে করি না। তাই কাল যাচ্ছি।"
পরেরদিন ইয়ামথাং এর উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। আমাদের গন্তব্য ইয়ামথাং, ফ্লাওয়ার ভ্যালি আর জিরো পয়েন্ট। সকাল সকাল গাড়ি রওনা দিল।' ইন্ডিয়ান বাইপাস রোড' বরাবর চলতে লাগলো গাড়ি। যাত্রীদের মধ্যে কেবল মৃগাঙ্কবাবু নেই। অঘোরবাবু আজ আমার পাশেই বসেছেন, আর নিয়মিত বকরবকর করে চলেছেন। একটা বাঁক ঘুরতই অঘোরবাবু আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে উঠলেন, "ইয়াআআ...! মেঘের ভেলায় ভেঁসে চলেছি মশাই... জীবন আমার সার্থক হলো। এখন যদি শয়তানের হাতে মরেও যাই তবুও কোনো আফসোস নেই মশাই !" আনন্দের আতিশয্যে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সত্যিই খুব মায়াময় লাগছে। এত কাছ দিয়ে মেঘেদের দল উড়ে যাচ্ছে যে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের গাড়িটা মেঘের ভেলার উপরে সওয়ার হয়ে ভেঁসে চলেছে অনন্তের উদ্দেশ্যে। এ অনুভূতি একমাত্র সেই বুঝতে পারবে যার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এ সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত। ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির বর্ণনা কবিও করতে পারেন না। আর উপনিষদে তো জগৎস্রষ্টাকেই কবি বলে বর্ণনা করা হয়েছে , তিনি কবি না হলে এই সুন্দর সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব !
ইয়ামথাং পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাঝে দু'বার গাড়ি থেমেছিল একবার টিফিনের জন্য আরেকবার মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। সকালে যখন প্রাতরাশের জন্য গাড়ি থামল তখন নেমেই বুড়োর খোঁজ করলাম। বুড়োর দেখা পেলাম না। দেখলাম অঘোরবাবু একটা কফির কাপে ফুঁ দিচ্ছেন আর আনমনা হয়ে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে। আমি কাছে যেতেই আমার দিকে একবার চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। আমি বললাম, "কিসের এত রাগ ?"
"রাগ নয় অ্যাভোয়েড, আপনাকে অ্যাভোয়েড করছি মশাই । আমি চাইনা আপনার কিছু হোক। আর ও ডায়েরিটা আপনি আর খুঁজে পাবেন না, ওটি আমি চুরি করে এনেছি। আপনি এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামিয়েন না।" অঘোরবাবু মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিলেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। অঘোরবাবুর পাশের টেবিলে বসে পড়লাম। ডিম সেদ্ধ, বাটার টোস্ট আর কফি দিয়ে জলযোগ সারলাম। দুপুরেও তাই, অঘোরবাবু আর আমার কাছাকাছি হলেন না। দুপুরের খাওয়ার পর বুড়োর সাথে দেখা হল। তিনি শুধু একটাই কথা বললেন, "রাতে কথা হবে।"
রাতেরবেলা ইয়ামথাং থেকে কিছু দূরে একটা অস্থায়ী ছাউনিতে থাকার ব্যবস্থা হল। উদ্দেশ্য একটাই, - রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ছাউনিতে শীত নিবারণের সবরকমের বন্দোবস্ত আছে, লেপ কাঁথার অঢেল বন্দোবস্ত। প্রত্যেকটি ছাউনিতেই একটা করে হ্যারিকেন ঝুলছে, নিকষ অন্ধকারে এটাই একমাত্র আলোর উৎস। সন্ধ্যা হতে চলল গান-বাজনা আর হইহুল্লোড়। আট নাম্বার ছাউনির বিমল বসাক গান ধরলেন।
দোলনচাঁপায় লাগল দোলা মনকাড়া কোন বাঁশির সুরে,
সুরের ছোঁয়ায় কান্না পাওয়ায় বিবাগি মন রয়না ঘরে।
আজ শাওণের বাদলরাতে নাইকো নিঁদ আঁখিপাতে
সুরের সখা দিলে দেখা, মন যে আমার কেমন করে।
ঝড়ের রাতে হে দরদী গাইলে কি সুর, - মাতল নদী !
সুরের মোহে অলস দেহে লুটায় কুসুম ভুমির পরে।
এলেই যখন হে মোর সখা, পড়ল তোমার চরণরেখা
তখন একা কেমনে কাটে দীপনেভা মোর এই বাসরে !
অঘোরবাবু বিভোর হয়ে তাল ঠুকতে লাগলেন, যেন শ্রাবণের এই রাতে ঝড়ের বেশে এসেছে তার পরাণপ্রীয়, - সে কি মৃত্যু ! এর উত্তর অঘোরবাবুরও জানা নেই।
বাইরে প্রাঙ্গনে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। কষা কষা মুরগির মাংস আর রুটি, সঙ্গে আচার আর রসগোল্লা। খাওয়ার পর ছাউনিতে ফিরে গেলাম। আমি আর বুড়ো, দুজনেরই শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে একই ছাউনিতে। বুড়ো গলা পর্যন্ত কম্বলটা টেনে নিয়ে বলল, "এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন, ঠিক মাঝরাতে বের হবো।"
মাঝরাতে একটা ফিসফিসে আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। "ও মশাই শুনছেন, উঠে পড়ুন,.."
চোখ মেলে দেখলাম বুড়ো রেডি। আমিও তৈরিই ছিলাম, এত শীতে নতুন করে পড়ার মতো আর কিছু নেই, শুধু মাফলারটা নিয়ে নিলাম। বুড়োর পেছন পেছন এগিয়ে চললাম টর্চের আলো সম্বল করে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা ছোট্ট মতো পাহাড় চোখে পড়ল। সাধারণ পাহাড়ের সাথে এই পাহাড়টার একটা পার্থক্য আছে, এই পাহাড়টা লুমিনাস অর্থাৎ স্বপ্রভ। এগিয়ে চললাম পাহাড়টার দিকে।
পাহাড়টার কাছাকাছি আসতেই দু'তিনজন কালো পোষাকপরা লোক আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সতর্ক না থাকায় আমি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম, পাথরে লেগে কপালের কিছুটা কেটে গেল। এদিকে বুড়ো লোকগুলোর আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। বুড়ো যে ক্যারাটে জানে তা জানতাম না। ক্যারাটের এক এক প্যাঁচে আততায়িরা বেসামাল হয়ে পড়েছে। একটা সময় দেখলাম সবাই ভুলুণ্ঠিত, বুড়ো হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু এ কি ! বুড়োর পাকা চুল কই ? পাহাড়ের স্বয়ংপ্রভ আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বুড়োর একমাথা কালো কুচকুচে চুল। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বুড়ো বলল, "বয়স কমে যাওয়াটা এখন কোনও ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হল আমাদের অভিযান। তাছাড়া অনেকরকম বয়স কমানোর অ্যাপ বেরিয়েছে আজকাল, বয়স বাড়ানো কমানোটা আজকাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।" হাসতে হাসতে বুড়ো বলল। না, এখন থেকে আর বুড়ো বলে অবজ্ঞা নয়, বরং ইন্দ্রজিৎবাবু বলেই সন্মোধন করব।
ইন্দ্রজিৎবাবুর কথায় আমি সন্তুষ্ট না হলেও কথা বাড়ালাম না, এগিয়ে গেলাম পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের একদম সামনে এসে ইন্দ্রজিৎবাবু থমকে দাঁড়ালেন। এরপর পকেট হতে চক্রটা বের করে পাহাড়ের দিকে তুলে ধরলেন, সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়টা প্রবলভাবে দুলে উঠলো। টাল সামলাতে না পেরে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় দুটো হাত আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দেখলাম অঘোরবাবু, আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন।
আমি বললাম, "আপনি !"
অঘোরবাবু চোখবুজেই উত্তর দিলেন, "আপনাদের ফলো করেছিলাম। মারপিটের সময় আমি একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম মশাই। দেখলাম বিক্রমবাবু কালো কাপড়পরা লোকগুলোকে ঢিশুমঢাশুম দিচ্ছেন , আর আপনি মশাই মাটিতে পড়ে 'চিঁ চিঁ' করছেন।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "বিক্রমবাবু আবার কোথা থেকে এলেন ?" পাশ থেকে জবাব এল," এই অধমই ইন্দ্রজিৎ মৈত্র ওরফে বিক্রম মুখোপাধ্যায় ওরফে পাগলা বুড়ো... "
আরো কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ততক্ষণে পাহাড়ের একটা অংশে গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, আর সেই ফাটলদিয়ে সাতরঙা আলো বেরিয়ে আসছে। বিক্রমবাবু সেদিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও তাকে অনুসরণ করলাম।
পাহাড়ের ফাটলটা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। যত ভেতরে যাচ্ছি ঠাণ্ডা ততই বাড়ছে। গুহাপথের দু'পাশে সার দিয়ে মানুষের কঙ্কাল পড়ে আছে। এসব দেখে অঘোরবাবু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, "কিছু অন্যায় করে থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন মশাই, আমি জানি আর দেশে ফেরা আমার হবে না। বিয়ে সাদী তো করিনি, আমি না ফিরলে আমার টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি কোনও অনাথ আশ্রমে দান করে দিয়েন মশাই । বিদায়..." অঘোরবাবু অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি আর বিক্রমবাবু দুজনে মিলে অঘোরবাবুকে কোনক্রমে টেনে নিয়ে চললাম।
অনেকটা যাওয়ার পর দেখলাম সামনে একটা দেওয়াল, দেওয়ালের গায়ে বিকটাকৃতি দানবের মুখ আঁকা। বিক্রমবাবু তার হাতে থাকা চক্রটাকে দানবমূর্তীর কপালের খাঁজে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট আওয়াজ করে একটা কক্ষাকৃতি যন্ত্র বেরিয়ে এল, যন্ত্রটার ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম সবাই।
যন্ত্রের ভেতরটা স্বচ্ছ স্ফটিকে তৈরি ও স্বপ্রভ। কোথাও কোন খাঁজ নেই। আমাদের প্রবেশকরামাত্র একটা সন্মোহক আওয়াজ শোনা গেল, তারপরে আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান হল তখন দেখলাম আমরা একটা পুরানো মন্দিরের মেঝেতে পড়ে আছি, আর সেই মন্দিরটা ডুবে আছে অন্তহীন জলের অতলে। চারদিকে শুধু জল আর জল, আর মন্দিরটা রয়েছে একটা এয়ারপকেটের মধ্যে। অঘোরবাবুর জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বিক্রমবাবু এবার নিস্তবদ্ধতা ভঙ্গ করলেন, তিনি বললেন, "মার হল শয়তান, যতকিছু অজ্ঞানতা মায়া আর পাশবিকতার প্রতীক হলেন তিনি । এই মারের কোনও বিনাশ নেই। যেমন অন্ধকারের কোনও বিনাশ নেই, আলো কেবল অন্ধকারকে অবদমিত করে রাখে মাত্র। অন্যদিকে দেখতে গেলে অন্ধকার আছে বলেই আলোর অস্তিত্ব আছে। তাই মার আছেন বলেই আমরা শুভত্ব আর মঙ্গলত্বের মূল্য অনুধাবন করতে পারি। তাই মারকে অবদমিত করতে হবে, - আর এই কাজ একমাত্র সম্ভব যার পক্ষে তিনি হলেন মহাকাল। এই মহাকালই হল সময়। সময় সকল রোগের ঔষধ, সকল সমস্যার সমাধান। জাগাতে হবে মহাকালকে। "
বিক্রমবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃগাঙ্কবাবু। সম্ভবত আমাদের চোখ এড়িয়ে তিনি আমাদের সাথেই সময়যন্ত্রে করে এখানে এসেছেন। মৃগাঙ্কবাবুকে আর স্বাভাবিক মানুষের মতো দেখাচ্ছে না, তার পাশবিক চেহারা আমার রোমে রোমে আতঙ্কের শিহরন তুলেছে। কি বিভৎস !
"তার সূযোগ তুই পাবি না রে টিকটিকির বাচ্চা। আমার ঘর হতে ডায়েরি আর ম্যাপখানা চুরি করে কি ভেবেছিলি ? ভেবেছিলি ডেভিডকে তুই হারিয়ে দিবি !..." মৃগাঙ্কবাবুর তীব্র আক্রোশ ঝরে পড়ল বিক্রমবাবুর উপর। কিন্তু কিছু ভেবে ওঠার আগেই বিক্রমবাবুর একটা ক্যারাটের প্যাঁচে ধরাশায়ী হয়ে পড়ল মৃগাঙ্ক সেন। মেঝেতে পড়ে যেতেই আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল মৃগাঙ্ক সেন কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই ঘাড়ের পাশটাতে দুটো আঙুলের সাহায্য একটা মোচড় দিল বিক্রম। মৃগাঙ্ক সেন নিথর হয়ে পড়ে রইল।
বিক্রমবাবু এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, আমি তাকে অনুসরণ করলাম। দু'দশ পা এগিয়েই মন্দিরের অ্যান্টিচেম্বার। সেখানকার বাতাস যথেষ্ট শীতল, পদ্মফুলের গন্ধে গোটা কামরা ভরে উঠেছে। কামরার পেছনের দেওয়াল লাগোয়া একটা বরফের বেদীতে ধ্যানস্থ এক সন্ন্যাসী। হঠাৎ আমার স্মৃতিতে এসে গেল ডায়েরিতে বর্ণিত সেই সাধুবাবার কথা। হুবহু এক।
সাধুবাবা ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, "তুমনে কর দিখায়া। হাজারো সালো সে ম্যায়নে ইহা কয়েদ থা। মেরে মুক্ত হোনে কে সাথ সাথ ও শয়তান হামেশা কে লিয়ে মিট জায়েগা।"
এরপর সাধুবাবা উঠে দাঁড়ালেন। আমরা চললাম সময়যন্ত্রের কাছে। দেখলাম মন্দিরের মুখ্যভাগে সময়যন্ত্রটি দাঁড়িয়ে। আমি, সাধুবাবা, বিক্রমবাবু আর অঘোরবাবু সময়যন্ত্রে চড়ে চললাম বর্তমানে। আর মৃগাঙ্ক সেন পড়ে রইলেন হাজার বছর পেছনে।
--উপসংহার - -
এরপরের কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত। সাধুবাবার কাছে বিদায় নিয়ে ইয়ামথাং - এ ফিরে এলাম। জিরো পয়েন্টে গিয়ে খুব আনন্দ হলো। গ্যাংটকে ফিরে আমি আর অঘোরবাবু বিক্রমবাবুকে চেপে ধরতেই সমস্ত ঘটনা বেরিয়ে এল। বিক্রমবাবু বললেন, " আরে বলছি রে ভাই বলছি। ঘটনার শুরুটা মৃগাঙ্ক সেনের ঘর হতে। মৃগাঙ্ক সেন ওরফে কেশব জালান ওরফে জগাই দাস ওরফে ডেভিড হলো একজন সাইকোকিলার। খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় সে। এদিকে যে জেলে সে বন্দি ছিল সেই জেলে আসে নতুন এক কয়েদি - - তান্ত্রিক মোহাবেশ। এই তান্ত্রিক মোহাবেশই মৃগাঙ্ক সেনকে ফাঁসির হাত হতে রক্ষা করেন তার তন্ত্রশক্তির সাহায্যে। বিনিময়ে শশাঙ্কশেখরের বাক্স হতে ডায়েরিখানা চুরি করে আনে মৃগাঙ্ক সেন।
শশাঙ্কশেখর বাবুর ছেলে ইন্দ্রজিৎ মৈত্র ডায়েরিটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ডায়েরিটা চুরি যেতেই তিনি আমার স্মরণাপন্ন হন। আমি একদিন রাতে মৃগাঙ্কবাবুর গোপন ডেরা হতে ডায়েরিটা উদ্ধার করি। তারপর ডায়েরিখানা পড়ে বুঝতে পারি যে এই রহস্যের সমাধান আমাকেই করতে হবে। তাই অঘোরবাবুকে সিকিমের পথে রওনা করিয়ে নিজে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে ওই একই ট্রেনে রওনা দিই। তারপরের ঘটনা তো সবারই জানা। "
" আর সেই শয়তানের থাবার কি হল ? " আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। বিক্রমবাবু বললেন," তান্ত্রিক মোহাবেশই হল সেই শয়তান। তার হাতে সময় ছিল খুব কম। সময়ের ওপারে যে মন্দিরে সাধুবাবা বন্দি ছিলেন সেই মন্দিরেই ছিল স্ফটিক ড্রাগন, আর এই স্ফটিক ড্রাগন না পেলে তান্ত্রিক মোহাবেশের অস্তিত্বই থাকত না বেশিদিন। এজন্যই সে এরকম ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যাতে সেই সূযোগে সময়যন্ত্রের চাবি খোঁজার কাজ সহজ হয় । আর শশাঙ্কশেখরবাবুর স্মৃতিশক্তি চলে যাওয়া ও অকাল মৃত্যুর কারণও এই তান্ত্রিক মোহাবেশ, সে গল্প আপনি ডায়েরিতেই পেয়ে যাবেন । অঘোরবাবু, ডায়েরিটা সায়কবাবুকে দিয়ে দিয়েন। "
অঘোরবাবু একটাও কথা বললেন না। তার এই নৈশব্দ ফেরার সময়েও বহাল রইল।
কলকাতায় ফেরার পর বিক্রমের সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। এখন আর সন্মন্ধটা আপনিতে আটকে নেই, আমরা এখন খুব ভালো বন্ধু।
ভোর হতেই দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুললাম। দেখি একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে অঘোরবাবু। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে ঢুকে এলেন। এরপর একগাল হেসে বললেন, "পাখি ফুড়ুৎ ধা। উড়েছে ।"
"পাখি উড়েছে মানে !"
অঘোরবাবু এবার পাকাপোক্ত ভাবে বিছানায় বসে পড়লেন, তারপর বিছানার উপর রাখা ডায়েরিখানা তুলে নিয়ে উল্টোপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন, "মৃগাঙ্ক সেন পালিয়েছে। বামাল সমেত হাওয়া।"
খবরটাতে আমি অবাক হলাম না, মৃগাঙ্কবাবুর স্বরুপ যা দেখেছি তাতে এ ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত বৃদ্ধ লামাকে আহত করে পালিয়েছিল মৃগাঙ্ক সেন, এখন পুলিশের ভয়ে গাঢাকা দিয়েছে।
বাথরুম হতে মুখ হাত ধুয়ে এসে ওয়াটার হিটারে কফি বানালাম। কথাটা আপনাদের বলাই হয়নি, ওয়াটার হিটার কাম মিনি কফিমেকারটা আমি শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট হতে কিনেছি। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে অঘোরবাবু বললেন, "এই ডায়েরিটা আপনি কোথায় পেলেন মশাই ?"
আমি বললাম, "সে খোঁজে আপনার কাজ কি ? আমি কোথায় কি পাচ্ছি কি পাচ্ছি না তার সবকিছুই কি আপনাকে বলতে হবে ?"
আমার কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন অঘোরবাবু। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, "শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন। আমি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইছি না, আসলে হল কি... ডায়েরিটা আমার চেনা। "
" চেনা মানে ! এ ডায়েরিটা আপনি আগে দেখেছেন ? " আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করি। অঘোরবাবু কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক লাগিয়ে বললেন, " বিক্রমের কাছে দেখেছি। কি যেন মার না কি নাম, সেই শয়তানটার কথাই আছে এতে। আরে মশাই এই গ্যাংটকের খুনগুলোও তো ওই শয়তানটাই করছে। "
"এসব জেনেও আপনার মতো ঘুঘু লোক এখানে বেড়াতে এল, - এটাও আমাকে মানতে হবে !" আমি খানিকটা শ্লেষের সঙ্গেই বললাম।
অঘোরবাবু কফির কাপটা নামিয়ে রেখে একটু ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতেই বললেন," আমি কি আর নিজের ইচ্ছায় এসেছি মশাই ! রীতিমতো ব্রেইনওয়াশ করেছে আমার। পেছনেই আসছি বলে বেপাত্তা। তবে হ্যাঁ, শয়তানের হাত হতে বাঁচতে মহাশক্তিশালী একখান কবচ দিয়েছে। এই দেখুন।"
অঘোরবাবু তার ঘুনসিতে বাঁধা পেল্লাই সাইজের কবচখানা দেখালেন। কুসংস্কারের বহর দেখে আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল , আমি তৎক্ষণাৎ ঘুনসি হতে কবচখানা ছিঁড়ে নিলাম। অঘোরবাবু আচমকা আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আমিও কৌতুহলী হয়ে কবচটার ভেতরের মালমশলা বের করতে সচেষ্ট হলাম। একটু চেষ্টাতেই কবচ হতে বেরিয়ে এল একটা ভাঁজ করা চিরকূট। চিরকূটটা পড়েই আমার হাসির বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আমি হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লাম।
ব্যাপার দেখে অঘোরবাবু আমার হাত হতে চিরকূটখানা নিয়ে পড়তে লাগলেন, " 'ধাপ্পা ! অঘোরবাবু ইন দ্য ভোগ অফ মা' ।" এরপর অঘোরবাবু খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ফুঁসতে লাগলেন। " মানহানির মামলা করব মশাই ! বিক্রমবাবুর সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক শেষ মশাই । বাপের বয়সের একটা মানুষের সাথে এমন রসিকতা কেউ করে..."
আরো কি কি বললেন তা শোনার সময় আমার ছিল না। আমি ভাবছি একটা কথা, যে ডায়েরির কথা বুড়ো আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা সেটা পাবলিক হয় কি করে ! কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। তাছাড়া বিক্রমের মতো নামজাদা গোয়েন্দাই বা কেন নিজে না এসে অঘোরবাবুকে সিকিমে পাঠিয়ে দিলেন ! অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধছে, যেগুলোর উত্তর পাওয়াটা জরুরী। এ এমন একটা জটিল ধাঁধা যেখানে আমার মতো অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন, কেউ জেনে বা কেউ না জেনে।
ভেবেছিলাম অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোব, কিন্তু তা আর হলো না। অঘোরবাবু আমার ঘুমের পিণ্ডি চটকে দিয়েছেন। আমি অঘোরবাবুকে বললাম, "আপনার প্রতিবেশীটি খুবই সেয়ানা, গোলমাল বুঝেই সরে পড়েছে। আর আপনাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এবার মরুন শয়তানের হাতে।"
অঘোরবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকলেন, তারপর বিপুল ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। "একবার বেঁচে ফিরি তারপর দেখেনেব টিকটিকির বাচ্চাকে। বুঝলেন মশাই, দাপুটে লোক ছিলাম আমি, আপিসেই বলুন আর বাড়িতেই বলুন বাঘে গরুকে একঘাটে জল খাওয়াতাম আমি। আর সেই আমাকেই কিনা.... " আর বলতে পারলেন না অঘোরবাবু, তার দু'চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আমিও বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত্বনা দিয়ে তাকে শান্ত করলাম।
অঘোরবাবু চলে যেতেই একটা বিশ্রীরকম হাসতে হাসতে বুড়ো ঘরে ঢুকল। সে আসতেই আমি তার উপর আক্রমণ শানিয়ে দিলাম।
" আসুন আসুন মহোদয় ! আপনার আগমনেরই প্রতীক্ষা করেছিলাম। সত্যি করে বলুন তো আপনার এই ভজকট ব্যাপারে আর কতজন জড়িয়ে আছে ?"
আমার কথায় একটুও বিচলিত না হয়ে বুড়ো একপ্রস্থ কান এঁটো করা হাসি হেসে নিলেন। তারপর বললেন, "সময় খুবই বলবান ভায়া, সময় হলেই সব জানতে পারবেন । আপাত একটা জিনিস দেখাই... " এই বলে তিনি দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর দরজার বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখেই দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। ছিটকিনি এঁটে বিছানায় এসে বসলেন। এরপর পকেট হতে কয়েকটা ধাতুর টুকরো বের করে সমনে রাখলেন ।
মোট চারটে টুকরো। পেতলের,... উঁহু এ তো পেতল নয়, - নিখাদ সোনা। আর কিছু গুন থাক বা না থাক জিওলজিস্ট বন্ধুর কল্যাণে ধাতু রত্নের ব্যাপারে একটা অভিজ্ঞতা তৈরী হয়েছে। টুকরোগুলো বিভিন্ন আকৃতির। প্রত্যেকটি টুকরোতেই বিশেষ খাঁজ আছে। বুড়ো সেই খাঁজ বরাবর টুকরোগুলো জুড়ে দিতেই একটা চক্রের আকার নিল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
বুড়ো বলল, "শয়তানের পাঞ্জার চাবি। যে শয়তানটা অত্যাচার করে বেড়াচ্ছে তার কাছে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় । বৃহদতন্ত্রিকা মতে কোনও এক নির্জন পর্বতগহ্বরে আছে একটা যন্ত্র, যে যন্ত্রকে বিশেষ মন্ত্রে অভিষিক্ত করে এই বিশেষ চাবি ঘোরালেই উন্মুক্ত হবে সময়যন্ত্র, আর এই সময়যন্ত্রই নিয়ে যাবে শয়তানের কাছে। "
আমি বললাম," কিন্তু সেই জায়গাটা কোথায় ? আর আমার এটুকু বাহ্যজ্ঞান আছে যা দিয়ে সহজেই বুঝতে পারি যে আপনার মানসিক সুস্থ্যতা কোন পর্যায়ে। এটা জিনগত রোগ মৈত্রমশাই, আপনার বাবার থেকে আপনি পেয়েছেন। "
বুড়ো কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমার দিকে চেয়ে বললেন," শশাঙ্কশেখর মৈত্রের কোনও মানসিক ব্যাধি ছিল না, সেটা আমি যথাসময়ে প্রমাণ করে দেব। কোনও ভাবেই তিনি হ্যালুসিনেটিং করছিলেন না। আর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আছে ইয়ামথাং-এ। "
" চলুন, কালকেই তো ইয়ামথাং যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, মৃগাঙ্কবাবু পালিয়েছেন।" আমি তার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিলাম। বুড়োটা এবার একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল," মৃগাঙ্কবাবু শয়তানের পূজারী, উনি চাবি না নিয়ে কোত্থাও যাবেন না। অতএব আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, অঘোরবাবুর পহেলা নম্বর শত্রু এখনি বিদায় নিচ্ছেন না। "
আমি অবাক হয়ে বললাম," অঘোরবাবুর কেসটাও জানেন ! তাহলে আর বাকি কি রইল ! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনিই নাটের গুরু। দেখুন মশাই, আমার সাতকুলে কেউ নেই, ঝাড়াহাতপা' মানুষ আমি, তাই আমার কিছু হলেও দুনিয়ার এমনকিছু একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হবে বলে মনে করি না। তাই কাল যাচ্ছি।"
পরেরদিন ইয়ামথাং এর উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। আমাদের গন্তব্য ইয়ামথাং, ফ্লাওয়ার ভ্যালি আর জিরো পয়েন্ট। সকাল সকাল গাড়ি রওনা দিল।' ইন্ডিয়ান বাইপাস রোড' বরাবর চলতে লাগলো গাড়ি। যাত্রীদের মধ্যে কেবল মৃগাঙ্কবাবু নেই। অঘোরবাবু আজ আমার পাশেই বসেছেন, আর নিয়মিত বকরবকর করে চলেছেন। একটা বাঁক ঘুরতই অঘোরবাবু আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে উঠলেন, "ইয়াআআ...! মেঘের ভেলায় ভেঁসে চলেছি মশাই... জীবন আমার সার্থক হলো। এখন যদি শয়তানের হাতে মরেও যাই তবুও কোনো আফসোস নেই মশাই !" আনন্দের আতিশয্যে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সত্যিই খুব মায়াময় লাগছে। এত কাছ দিয়ে মেঘেদের দল উড়ে যাচ্ছে যে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের গাড়িটা মেঘের ভেলার উপরে সওয়ার হয়ে ভেঁসে চলেছে অনন্তের উদ্দেশ্যে। এ অনুভূতি একমাত্র সেই বুঝতে পারবে যার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এ সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত। ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির বর্ণনা কবিও করতে পারেন না। আর উপনিষদে তো জগৎস্রষ্টাকেই কবি বলে বর্ণনা করা হয়েছে , তিনি কবি না হলে এই সুন্দর সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব !
ইয়ামথাং পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাঝে দু'বার গাড়ি থেমেছিল একবার টিফিনের জন্য আরেকবার মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। সকালে যখন প্রাতরাশের জন্য গাড়ি থামল তখন নেমেই বুড়োর খোঁজ করলাম। বুড়োর দেখা পেলাম না। দেখলাম অঘোরবাবু একটা কফির কাপে ফুঁ দিচ্ছেন আর আনমনা হয়ে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে। আমি কাছে যেতেই আমার দিকে একবার চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। আমি বললাম, "কিসের এত রাগ ?"
"রাগ নয় অ্যাভোয়েড, আপনাকে অ্যাভোয়েড করছি মশাই । আমি চাইনা আপনার কিছু হোক। আর ও ডায়েরিটা আপনি আর খুঁজে পাবেন না, ওটি আমি চুরি করে এনেছি। আপনি এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামিয়েন না।" অঘোরবাবু মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিলেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। অঘোরবাবুর পাশের টেবিলে বসে পড়লাম। ডিম সেদ্ধ, বাটার টোস্ট আর কফি দিয়ে জলযোগ সারলাম। দুপুরেও তাই, অঘোরবাবু আর আমার কাছাকাছি হলেন না। দুপুরের খাওয়ার পর বুড়োর সাথে দেখা হল। তিনি শুধু একটাই কথা বললেন, "রাতে কথা হবে।"
রাতেরবেলা ইয়ামথাং থেকে কিছু দূরে একটা অস্থায়ী ছাউনিতে থাকার ব্যবস্থা হল। উদ্দেশ্য একটাই, - রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ছাউনিতে শীত নিবারণের সবরকমের বন্দোবস্ত আছে, লেপ কাঁথার অঢেল বন্দোবস্ত। প্রত্যেকটি ছাউনিতেই একটা করে হ্যারিকেন ঝুলছে, নিকষ অন্ধকারে এটাই একমাত্র আলোর উৎস। সন্ধ্যা হতে চলল গান-বাজনা আর হইহুল্লোড়। আট নাম্বার ছাউনির বিমল বসাক গান ধরলেন।
দোলনচাঁপায় লাগল দোলা মনকাড়া কোন বাঁশির সুরে,
সুরের ছোঁয়ায় কান্না পাওয়ায় বিবাগি মন রয়না ঘরে।
আজ শাওণের বাদলরাতে নাইকো নিঁদ আঁখিপাতে
সুরের সখা দিলে দেখা, মন যে আমার কেমন করে।
ঝড়ের রাতে হে দরদী গাইলে কি সুর, - মাতল নদী !
সুরের মোহে অলস দেহে লুটায় কুসুম ভুমির পরে।
এলেই যখন হে মোর সখা, পড়ল তোমার চরণরেখা
তখন একা কেমনে কাটে দীপনেভা মোর এই বাসরে !
অঘোরবাবু বিভোর হয়ে তাল ঠুকতে লাগলেন, যেন শ্রাবণের এই রাতে ঝড়ের বেশে এসেছে তার পরাণপ্রীয়, - সে কি মৃত্যু ! এর উত্তর অঘোরবাবুরও জানা নেই।
বাইরে প্রাঙ্গনে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। কষা কষা মুরগির মাংস আর রুটি, সঙ্গে আচার আর রসগোল্লা। খাওয়ার পর ছাউনিতে ফিরে গেলাম। আমি আর বুড়ো, দুজনেরই শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে একই ছাউনিতে। বুড়ো গলা পর্যন্ত কম্বলটা টেনে নিয়ে বলল, "এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন, ঠিক মাঝরাতে বের হবো।"
মাঝরাতে একটা ফিসফিসে আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। "ও মশাই শুনছেন, উঠে পড়ুন,.."
চোখ মেলে দেখলাম বুড়ো রেডি। আমিও তৈরিই ছিলাম, এত শীতে নতুন করে পড়ার মতো আর কিছু নেই, শুধু মাফলারটা নিয়ে নিলাম। বুড়োর পেছন পেছন এগিয়ে চললাম টর্চের আলো সম্বল করে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা ছোট্ট মতো পাহাড় চোখে পড়ল। সাধারণ পাহাড়ের সাথে এই পাহাড়টার একটা পার্থক্য আছে, এই পাহাড়টা লুমিনাস অর্থাৎ স্বপ্রভ। এগিয়ে চললাম পাহাড়টার দিকে।
পাহাড়টার কাছাকাছি আসতেই দু'তিনজন কালো পোষাকপরা লোক আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সতর্ক না থাকায় আমি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম, পাথরে লেগে কপালের কিছুটা কেটে গেল। এদিকে বুড়ো লোকগুলোর আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। বুড়ো যে ক্যারাটে জানে তা জানতাম না। ক্যারাটের এক এক প্যাঁচে আততায়িরা বেসামাল হয়ে পড়েছে। একটা সময় দেখলাম সবাই ভুলুণ্ঠিত, বুড়ো হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু এ কি ! বুড়োর পাকা চুল কই ? পাহাড়ের স্বয়ংপ্রভ আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বুড়োর একমাথা কালো কুচকুচে চুল। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বুড়ো বলল, "বয়স কমে যাওয়াটা এখন কোনও ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হল আমাদের অভিযান। তাছাড়া অনেকরকম বয়স কমানোর অ্যাপ বেরিয়েছে আজকাল, বয়স বাড়ানো কমানোটা আজকাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।" হাসতে হাসতে বুড়ো বলল। না, এখন থেকে আর বুড়ো বলে অবজ্ঞা নয়, বরং ইন্দ্রজিৎবাবু বলেই সন্মোধন করব।
ইন্দ্রজিৎবাবুর কথায় আমি সন্তুষ্ট না হলেও কথা বাড়ালাম না, এগিয়ে গেলাম পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের একদম সামনে এসে ইন্দ্রজিৎবাবু থমকে দাঁড়ালেন। এরপর পকেট হতে চক্রটা বের করে পাহাড়ের দিকে তুলে ধরলেন, সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়টা প্রবলভাবে দুলে উঠলো। টাল সামলাতে না পেরে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় দুটো হাত আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দেখলাম অঘোরবাবু, আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন।
আমি বললাম, "আপনি !"
অঘোরবাবু চোখবুজেই উত্তর দিলেন, "আপনাদের ফলো করেছিলাম। মারপিটের সময় আমি একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম মশাই। দেখলাম বিক্রমবাবু কালো কাপড়পরা লোকগুলোকে ঢিশুমঢাশুম দিচ্ছেন , আর আপনি মশাই মাটিতে পড়ে 'চিঁ চিঁ' করছেন।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "বিক্রমবাবু আবার কোথা থেকে এলেন ?" পাশ থেকে জবাব এল," এই অধমই ইন্দ্রজিৎ মৈত্র ওরফে বিক্রম মুখোপাধ্যায় ওরফে পাগলা বুড়ো... "
আরো কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ততক্ষণে পাহাড়ের একটা অংশে গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, আর সেই ফাটলদিয়ে সাতরঙা আলো বেরিয়ে আসছে। বিক্রমবাবু সেদিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও তাকে অনুসরণ করলাম।
পাহাড়ের ফাটলটা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। যত ভেতরে যাচ্ছি ঠাণ্ডা ততই বাড়ছে। গুহাপথের দু'পাশে সার দিয়ে মানুষের কঙ্কাল পড়ে আছে। এসব দেখে অঘোরবাবু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, "কিছু অন্যায় করে থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন মশাই, আমি জানি আর দেশে ফেরা আমার হবে না। বিয়ে সাদী তো করিনি, আমি না ফিরলে আমার টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি কোনও অনাথ আশ্রমে দান করে দিয়েন মশাই । বিদায়..." অঘোরবাবু অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি আর বিক্রমবাবু দুজনে মিলে অঘোরবাবুকে কোনক্রমে টেনে নিয়ে চললাম।
অনেকটা যাওয়ার পর দেখলাম সামনে একটা দেওয়াল, দেওয়ালের গায়ে বিকটাকৃতি দানবের মুখ আঁকা। বিক্রমবাবু তার হাতে থাকা চক্রটাকে দানবমূর্তীর কপালের খাঁজে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট আওয়াজ করে একটা কক্ষাকৃতি যন্ত্র বেরিয়ে এল, যন্ত্রটার ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম সবাই।
যন্ত্রের ভেতরটা স্বচ্ছ স্ফটিকে তৈরি ও স্বপ্রভ। কোথাও কোন খাঁজ নেই। আমাদের প্রবেশকরামাত্র একটা সন্মোহক আওয়াজ শোনা গেল, তারপরে আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান হল তখন দেখলাম আমরা একটা পুরানো মন্দিরের মেঝেতে পড়ে আছি, আর সেই মন্দিরটা ডুবে আছে অন্তহীন জলের অতলে। চারদিকে শুধু জল আর জল, আর মন্দিরটা রয়েছে একটা এয়ারপকেটের মধ্যে। অঘোরবাবুর জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বিক্রমবাবু এবার নিস্তবদ্ধতা ভঙ্গ করলেন, তিনি বললেন, "মার হল শয়তান, যতকিছু অজ্ঞানতা মায়া আর পাশবিকতার প্রতীক হলেন তিনি । এই মারের কোনও বিনাশ নেই। যেমন অন্ধকারের কোনও বিনাশ নেই, আলো কেবল অন্ধকারকে অবদমিত করে রাখে মাত্র। অন্যদিকে দেখতে গেলে অন্ধকার আছে বলেই আলোর অস্তিত্ব আছে। তাই মার আছেন বলেই আমরা শুভত্ব আর মঙ্গলত্বের মূল্য অনুধাবন করতে পারি। তাই মারকে অবদমিত করতে হবে, - আর এই কাজ একমাত্র সম্ভব যার পক্ষে তিনি হলেন মহাকাল। এই মহাকালই হল সময়। সময় সকল রোগের ঔষধ, সকল সমস্যার সমাধান। জাগাতে হবে মহাকালকে। "
বিক্রমবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃগাঙ্কবাবু। সম্ভবত আমাদের চোখ এড়িয়ে তিনি আমাদের সাথেই সময়যন্ত্রে করে এখানে এসেছেন। মৃগাঙ্কবাবুকে আর স্বাভাবিক মানুষের মতো দেখাচ্ছে না, তার পাশবিক চেহারা আমার রোমে রোমে আতঙ্কের শিহরন তুলেছে। কি বিভৎস !
"তার সূযোগ তুই পাবি না রে টিকটিকির বাচ্চা। আমার ঘর হতে ডায়েরি আর ম্যাপখানা চুরি করে কি ভেবেছিলি ? ভেবেছিলি ডেভিডকে তুই হারিয়ে দিবি !..." মৃগাঙ্কবাবুর তীব্র আক্রোশ ঝরে পড়ল বিক্রমবাবুর উপর। কিন্তু কিছু ভেবে ওঠার আগেই বিক্রমবাবুর একটা ক্যারাটের প্যাঁচে ধরাশায়ী হয়ে পড়ল মৃগাঙ্ক সেন। মেঝেতে পড়ে যেতেই আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল মৃগাঙ্ক সেন কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই ঘাড়ের পাশটাতে দুটো আঙুলের সাহায্য একটা মোচড় দিল বিক্রম। মৃগাঙ্ক সেন নিথর হয়ে পড়ে রইল।
বিক্রমবাবু এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, আমি তাকে অনুসরণ করলাম। দু'দশ পা এগিয়েই মন্দিরের অ্যান্টিচেম্বার। সেখানকার বাতাস যথেষ্ট শীতল, পদ্মফুলের গন্ধে গোটা কামরা ভরে উঠেছে। কামরার পেছনের দেওয়াল লাগোয়া একটা বরফের বেদীতে ধ্যানস্থ এক সন্ন্যাসী। হঠাৎ আমার স্মৃতিতে এসে গেল ডায়েরিতে বর্ণিত সেই সাধুবাবার কথা। হুবহু এক।
সাধুবাবা ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, "তুমনে কর দিখায়া। হাজারো সালো সে ম্যায়নে ইহা কয়েদ থা। মেরে মুক্ত হোনে কে সাথ সাথ ও শয়তান হামেশা কে লিয়ে মিট জায়েগা।"
এরপর সাধুবাবা উঠে দাঁড়ালেন। আমরা চললাম সময়যন্ত্রের কাছে। দেখলাম মন্দিরের মুখ্যভাগে সময়যন্ত্রটি দাঁড়িয়ে। আমি, সাধুবাবা, বিক্রমবাবু আর অঘোরবাবু সময়যন্ত্রে চড়ে চললাম বর্তমানে। আর মৃগাঙ্ক সেন পড়ে রইলেন হাজার বছর পেছনে।
--উপসংহার - -
এরপরের কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত। সাধুবাবার কাছে বিদায় নিয়ে ইয়ামথাং - এ ফিরে এলাম। জিরো পয়েন্টে গিয়ে খুব আনন্দ হলো। গ্যাংটকে ফিরে আমি আর অঘোরবাবু বিক্রমবাবুকে চেপে ধরতেই সমস্ত ঘটনা বেরিয়ে এল। বিক্রমবাবু বললেন, " আরে বলছি রে ভাই বলছি। ঘটনার শুরুটা মৃগাঙ্ক সেনের ঘর হতে। মৃগাঙ্ক সেন ওরফে কেশব জালান ওরফে জগাই দাস ওরফে ডেভিড হলো একজন সাইকোকিলার। খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় সে। এদিকে যে জেলে সে বন্দি ছিল সেই জেলে আসে নতুন এক কয়েদি - - তান্ত্রিক মোহাবেশ। এই তান্ত্রিক মোহাবেশই মৃগাঙ্ক সেনকে ফাঁসির হাত হতে রক্ষা করেন তার তন্ত্রশক্তির সাহায্যে। বিনিময়ে শশাঙ্কশেখরের বাক্স হতে ডায়েরিখানা চুরি করে আনে মৃগাঙ্ক সেন।
শশাঙ্কশেখর বাবুর ছেলে ইন্দ্রজিৎ মৈত্র ডায়েরিটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ডায়েরিটা চুরি যেতেই তিনি আমার স্মরণাপন্ন হন। আমি একদিন রাতে মৃগাঙ্কবাবুর গোপন ডেরা হতে ডায়েরিটা উদ্ধার করি। তারপর ডায়েরিখানা পড়ে বুঝতে পারি যে এই রহস্যের সমাধান আমাকেই করতে হবে। তাই অঘোরবাবুকে সিকিমের পথে রওনা করিয়ে নিজে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে ওই একই ট্রেনে রওনা দিই। তারপরের ঘটনা তো সবারই জানা। "
" আর সেই শয়তানের থাবার কি হল ? " আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। বিক্রমবাবু বললেন," তান্ত্রিক মোহাবেশই হল সেই শয়তান। তার হাতে সময় ছিল খুব কম। সময়ের ওপারে যে মন্দিরে সাধুবাবা বন্দি ছিলেন সেই মন্দিরেই ছিল স্ফটিক ড্রাগন, আর এই স্ফটিক ড্রাগন না পেলে তান্ত্রিক মোহাবেশের অস্তিত্বই থাকত না বেশিদিন। এজন্যই সে এরকম ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যাতে সেই সূযোগে সময়যন্ত্রের চাবি খোঁজার কাজ সহজ হয় । আর শশাঙ্কশেখরবাবুর স্মৃতিশক্তি চলে যাওয়া ও অকাল মৃত্যুর কারণও এই তান্ত্রিক মোহাবেশ, সে গল্প আপনি ডায়েরিতেই পেয়ে যাবেন । অঘোরবাবু, ডায়েরিটা সায়কবাবুকে দিয়ে দিয়েন। "
অঘোরবাবু একটাও কথা বললেন না। তার এই নৈশব্দ ফেরার সময়েও বহাল রইল।
কলকাতায় ফেরার পর বিক্রমের সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। এখন আর সন্মন্ধটা আপনিতে আটকে নেই, আমরা এখন খুব ভালো বন্ধু।
~সমাপ্ত~
No comments:
Post a Comment