- - পাঁচ--
এরপরে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে পুঁথির কথাও আমার মন হতে অপসৃত হয়ে গেছে। চাণ্ডেলের রাজার কাজ হতে অব্যাহতি নিয়ে কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম। বাড়িতে আমার মন বসে না। সারাদিন পড়াশোনা করি আর ছেলে বৌয়ের সাথে ঝগড়া, - বাস, এই নিয়েই দিন কাটছিল।
একদিন দুপুরবেলা, সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি সমরাঙ্গ সূত্রের একটা পুঁথি নিয়ে কপি করছি। একটু ঢুলুনিও এসেছিল। হঠাৎ একটা বাজখাই কন্ঠে ঘুমের রেশটা কেটে গেল।
"অলখ্ নিরঞ্জন ! অলখ্ নিরঞ্জন ! অলখ্ নিরঞ্জন !"
তাকিয়ে দেখলাম জানালার ওপারে একটা ছাইমাখা মুখমণ্ডল। মাথায় বিশাল জটা বুক বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। কপালে ত্রিপুণ্ডক। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে এই নাগাবাবাকে দর্শন করে আমার একদম সসেমিরা অবস্থা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্বিত ফিরে এল নাগাসাধুর কথায়।
" বেটা থোরা পানি মিলেগা ?"
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সাধুবাবা ভেতরে এলেন না। অগত্যা ঠাকুরঘর হতে একটা পেতলের ঘটি এনে কুয়ো হতে ঠাণ্ডা জল তুলে আনলাম। কিন্তু অতিথি নারায়ণ, তাকে তো আর শুধু জল দেওয়া যায় না, তাই একটা রেকাবিতে করে কিছু গুড় বাতাসও নিয়ে এলাম। জল খেয়ে খালি ঘটিটা নামিয়ে রাখলেন সাধুবাবা ।
"তু খুব সচ্চা আদমি আছিস বেটা। পরন্তু বেটা তেরা আচ্ছা সময় তেজিসে খতম হো রাহা হে। করিব করিব সাত সাল হ্যা তেরে পাস। উস্কে বাদ ও আপদা আয়েগা।" সাধুবাবা গম্ভীর স্বরে বললেন। তার কথা আমি খুব একটা বিশ্বাস করলাম না। হয়তো এর পরেই তাবিজ কবচ নিতে বলবে।
আমি বললাম," এ জীবনটাতো বিপদ আপদ করেই পেরিয়ে গেল, নতুন কিছু থাকলে বলুন বাবা। "
আমার কথায় হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন সাধুবাবা। তারপর জটার ভেতর হতে একখানা ভাঁজকরা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলেন। সাধুবাবার বিকট অট্টহাসিতে আমার নার্ভ দূর্বল হয়ে উঠেছে। হাত থর থর করে কাঁপছে। সেই কম্পিত হাতেই আমি কাগজটা নিলাম। একটা তুলোট কাগজ, কোনও জায়গার মানচিত্র বোধহয়। সেই ম্যাপের জায়গায় জায়গায় চক্রের চিহ্ন দেওয়া আছে।
সাধুবাবা বললেন, "তেরে পাস যো শয়তানকা কিতাব হ্যা না উসকি অন্দরে ইয়ে রাখ দে বাদ মে কাম আয়েগা।" অবাক গেলাম, কি করে জানলেন ইনি আমার পুঁথির কথা ! ... আমিই তো ভুলে গিয়েছিলাম।
কাজটা হতে চোখ তুলতেই দেখি সাধুবাবা নেই। নিয়ে যাবার জন্য ঘটিটা তুলতেই আবার একটা ঝটকা লাগল, - ঘটিটা জলপূর্ণ হয়েই আছে, একটুও জল কমেনি। তা কি করে হয়, আমার সামনেই তো ঢকঢক করে জলপান করলেন সাধুবাবা।
এরপরে মাসদুয়েক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, সংসারজীবনে হাঁপিয়ে উঠেছি। এদিকে আষাঢ় মাসের দরদর ধারায় বৃষ্টি মনকে আনমনা করে তুলেছে। সবমিলিয়ে একটা মনখারাপের আবহাওয়া চারিদিকে।
আজ আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া। রথের দিন। শাস্ত্রে আছে, 'দোলায়মান গোবিন্দং মঞ্চস্থং মধুসূদনং রথস্থং বামনং দৃষ্টবা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে' । পরের জন্মের অভিলাষ আমার নেই, তাই চললাম রথ দেখতে। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? না মশাই, এইফাঁকে কিছুটা আনন্দভ্রমণও হবে। আর রথের মেলার পাঁপড় জিলাপি, সে তো অমৃত। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কত যে পুরানো স্মৃতি উজাগর হয়ে এল তা বলে বোঝানো সম্ভব না। তবে ছোটবেলার মতো আনন্দ এই বয়সে আর সম্ভব নয়। সেসময় না ছিল চিন্তা না ছিল ভাবনা, মেলাময় ঘুরে বেড়াতাম বন্ধুদের সঙ্গে। পয়সাকড়ি ছিল না বটে তবে সে অভাব আনন্দের জোয়ারে বিন্দুমাত্র বাধার কারণ হত না। আজ সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। আছে কেবল বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া জরজর একটা দেহ।
মেলায় দেখা হয়ে গেল স্বয়ং বামনদেবের সাথে, - বামনদেব সেনগুপ্ত, ব্রিটিশ সার্ভেয়ার। ইংরেজরা তাকে যথেষ্টই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে, কারণ অমন শিক্ষিত আর দুঃসাহসী ভূভারতে পাওয়া ভার। সে আমার বর্তমান অবস্থার কথা শুনে বলল, "দেখো মৈত্র, ঘরে বসে না থেকে একটা চাকরি বাকরি করো। তোমার প্রতিভা আমার কাছে অজানা নয়, তাই আমি তোমার জন্যে কাজের ব্যবস্থা করে দেব। কলকাতার অফিসে আসার আগে আমি কিছুকাল সিকিমে ছিলাম, তুমি চাইলে আমি সিকিমের রাজাকে চিঠি লিখে তোমার একটা কাজের জন্যে সুপারিশ করতে পারি। "
আমি হাতে চাঁদ পেলাম। বামনদেবের চিঠি নিয়ে পরের সপ্তাহেই সিকিম রওনা হলাম। সময়টা এখন বর্ষাকাল, তাই সিকিমের রাস্তাও খুব দূর্গম। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো খচ্চরের পিঠে চেপে এগোতে লাগলাম। সমতলে মোটরগাড়ির কোনো কমতি না থাকলেও এ পথে মোটরগাড়ির দেখা মেলে না। গোরুর গাড়িও এ পথে অচল।
জলপাইগুড়ির পর থেকে একটানা হাঁটছি। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে, আর চলা সম্ভব নয়। কাছেপিঠে কোন গ্রাম বা বসতি পেলে আশ্রয় নেবো। তিস্তার ধার বরাবর হাঁটছি। লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। ঠিক মুখআঁধারির সময় একটা ছোট্ট গ্রামের কাছে এসে পড়লাম। গ্রামের লোক কৌতুহলী হয়ে আমার সঙ্গ নিল। আমি বললাম, "সিকিম যাব, ব্রাহ্মণ মানুষ, এই রাতটুকু যদি আশ্রয় পাই তো খুব উপকার হয়।"
আমার কথা শুনে একজন মাতব্বর গোছের লোক এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, "তা কেন পাবেন না, আমার বাড়িতে চলুন।" আমি তার পিছনে পিছনে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম যশেশ্বর রাই, সম্পন্ন গৃহস্থ তিনি। যাওয়ার মাত্র পা ধুইয়ে বসবার জন্যে আসন দিলেন। ভেতরের ঘর হতে ঘটিভর্তি জল আর খাঁটি দুধের পেঁড়া এল। জলের সাথে গোটা পাঁচেক পেঁড়া গলাধকরন করার পর চা এল। খাঁটি দুধের বানানো দার্জিলিং চা। কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে ভদ্রলোকের ছেলে দার্জিলিংয়ে একটা চায়ের বাগানে কাজ করে।
রাইমশাই খুবই বিনয়ী মানুষ। হরিভক্তও খুব। খোল করতাল নিয়ে বসলেন তিনি। দেখতে দেখতে গ্রামের কিছু লোকজন এসে জুটল। রাইমশাই এবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, "অপরাধ মার্জনা করবেন, আপনি যদি একটা গান ধরেন তো আসরটা জমে যায় ।" কি করব, গান ধরলাম।
সখি হেরি কালোরুপ গেলনাকো দুখ কেবলই বিরহে দহি
বাঁশরীর তাণে দহে এ পরাণে, (এ) যাতনা কেমনে সহি ?
ব্রজের গোয়ালা জানে কি পিরিতি ধেনু সনে যার বাস,
আমার কপালে কিবা কু লাগিল কালিয়া রচিল রাস।
ঘরেতে ননদী যেন ন-নদী বিষম জলধি পারা
লোহিত নয়ন মত্ত আয়াণ, শাশুড়ি বিষের জারা।
এ হেন বচনে সুব্রত ভনে ও রাইকিশোরী ধনী
না কর বিলাপ না কর মনস্তাপ কালিয়া নয়নমণি।।
অনেক রাত পর্যন্ত গান-বাজনা চলল। সবাই চলে যাওয়ার পর ভেতর ঘর হতে খাওয়ার ডাক পড়ল। বাড়ির বারান্দায় খাওয়ার আয়োজন হয়েছে। কাঁসার থালায় সরু চালের ভাত, পুরুপুরু মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, পাঁচমেশালি তরকারি আর মাছের ঝোল। সন্ধ্যাবেলায় জেলে ডেকে মাছ ধরিয়েছেন রাইমশাই।
খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। খাওয়ার পর বৈঠকখানায় আমার শোয়ার ব্যবস্থা হল। পথশ্রমে ক্লান্ত থাকায় রাতে ঘুমটাও বেশ ভালো হল। সকালে উঠেই চা-মুড়ি খেয়ে রওনা দিলাম। বিদায় নেওয়ার সময় রাইমশাই একটা ধুতি আর পাঁচটা টাকা দিয়ে প্রণাম করলেন।
রাস্তায় আবার একটা গ্রাম পড়ল। গ্রামের শেষে পাশাপাশি দুটো পুকুর, পুকুরের জল স্বচ্ছ কাচের মতো। হাতের বাক্সটা নামিয়ে রেখে স্নান করে নিলাম। আসার সময় রাইমশাই কিছু চিড়েমুড়ি আর মণ্ডা দিয়েছিলেন, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু। পথ আরো দুর্গম হয়ে আসছে। আমার একদিকে এখন তিস্তা নদী আর অপরদিকে খাড়া পাহাড়। তিস্তার গর্ভদেশ হতে রাস্তার উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে। পথশ্রমে ক্লান্ত হলে রাস্তার ধারে কখনো কোনো গাছের তলায় আবার কখনও কোনো পাথরের চাঁইয়ের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে।
একটা জায়গায় রঙ্গিত গিয়ে তিস্তায় মিশেছে, সেখানটা খুবই নির্জন।এদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে । এখন আর নিজের অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এ সবকিছুর জন্য আমিই দায়ি। আমার উচিত ছিল দুপুরবেলা যে গ্রামটার পেরিয়ে এসেছি সেখানেই আশ্রয় নেওয়া, কিন্তু আর কি করার আছে ! বৃষ্টির কারনে তাপমাত্রা নেমে এসেছে, তার উপরে আছে তিস্তার হাওয়া । বন্য কোন জন্তুর হাতে যদি নাও মরি প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এরকম যখন ভাবছি ঠিক তখনই দেখতে পেলাম দূরে জঙ্গলের ভিতরে গাছের আড়াল ভেদ করে একটা ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। এত রাত্রে এরকম দুর্গম জায়গায় আলোর ব্যাপারটা আমার খুব একটা স্বাভাবিক লাগল না। কিন্তু ডুবন্ত লোকের খরকুঁটোই ভরসা।
সাহসে ভর করে ওই আলোর দিকে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গলের ভেতর একটা অনুচ্চ পাহাড়ের তলায় হাজির হলাম। পাহাড়ের তলদেশে কয়েকটা গাছের আড়াল ভেদ করে আলোটা বেরিয়ে আসছে। আলোর দিকে এগিয়ে যেতেই একটা গুহার মতো কিছু একটা দেখা গেল, ভেতরে মশাল জ্বলছে। আমি অতি সাবধানে ভেতরে ঢুকে এলাম, দেখি একটা সাধু ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম, এ সেই সেদিনকার দুপুরের দেখা সাধুবাবা। আমি কাছে গিয়ে প্রনাম করতেই তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গি করে বললেন, "তু আ গেয়া ?"
আমি বললাম, "সিকিম যাচ্ছি বাবা, পথে রাত হয়ে গেল, আপনি না থাকলে আমার যে কি হত.."
সাধুবাবা মৃদু হেসে বললেন, "তেরা কিস্মত তুঝে ইঁহা লে আয়া, তু তো সির্ফ মোহরা হ্যায়। দেখ বেটা, উও যশেশ্বর কি তরা মছলি চাওল তো ম্যা নেহি খিলা সাকতা, ভিখমাঙ্গনেবালা হুঁ। "
আমি বললাম, "আপনি যখন সবই জানেন তখন আমি আর কি বলব ! আপনার চরণে আশ্রয় মিলল এটাই অনেক।" আমি সাধুবাবার কাছে নতি স্বীকার করলাম। আগেরবার যখন সাধুবাবার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন সাধুবাবা কে দেখে ভণ্ড বলে ভেবেছিলাম, আজ আর সেরকম মনোভাব আমার নেই।
সাধুবাবা বললেন, "উয়ো কিতাব মে তু জো কুছ পড়া সব সচ হ্যা, ঝুঠ কি কোই গুঞ্জাইস হি নেহি। উও ন লোক আবভি হ্যা।"
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, "এখনো জীবিত আছেন মানে..! এতবছর বেঁচে থাকা সম্ভব ? আমি যতদূর জানি ত্রৈলঙ্গ স্বামী সাড়ে তিনশ বছর বেঁচে ছিলেন, তাবলে দু'হাজার বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকা...... অসম্ভব। " সাধুবাবা আমার কথা শুনে হাসলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর যা বললেন তার অর্থ এই যে মৃত্যুকে এড়িয়ে বেঁচে থাকার দুরাশা তাদের বিন্দুমাত্র ছিল না। উত্তরাধিকার আর শিষ্য পরম্পরাতেই আজও জীবিত আছেন তারা। আর সেই জ্ঞানের পিছনে পড়েছে মারের সৈন্যরা। কিন্তু জ্ঞানের সন্ধান পেতে হলে পৌঁছতে হবে জ্ঞানের চাবিকাঠিটির কাছে। আমাকে যে ম্যাপটি দেওয়া হয়েছে সেটি সেই জ্ঞানের চাবিকাঠিটির সন্ধান দেবে।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর সাধুবাবা তার ঝোলা হতে ছাতু বের করলেন। সামান্য লবন দিয়ে মাখা ছাতু, কি অপূর্ব তার স্বাদ ! সঙ্গে গাঁজার বীজের চাটনি। দুজনে খাওয়া দাওয়া সেরে ধুনির পাশে শুয়ে পড়লাম। পথশ্রম আর উদরপূর্তির কারণে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এল।
No comments:
Post a Comment