প্রচণ্ড শীত আর উচ্চতার জন্য অনেকেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমরা যখন নাথুলা পৌঁছলাম তখন অনেকেই অসুস্থ্য। কিন্তু তিন বুড়োর শরীরে এতটুকুও পথশ্রমের বা আবহাওয়াজনিত ক্লেশের কোন চিহ্ন নেই। নাথুলায় বাবা হরভজন সিংয়ের স্মৃতিমন্দির।
বাবা হরভজন সিং ১৯৪৬ সালের ৩০শে আগষ্ট পূর্বতন পাকিস্তানের সদর্ণাতে জন্মগ্রহণ করেন। প্যারামিলিটারি ট্রেনিংয়ের পর তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগদান করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে চিনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে তার মৃত্যু হয়। তিনদিন পর তার দেহাবশেষ খুঁজে সমাহিত করা হয়। দাবি করা হয় যে এই কাজে নাকি তিনি খোঁজিদলের সাহায্য করেন। আজও তিনি কর্তব্যরত হয়ে রক্ষা করে চলেছেন দেশবাসীকে। ওই এলাকায় কোন সৈনিক কর্তব্যে অবহেলা করলে বা কোনও খারাপ কাজ করলে বাবা তাকে চড় মেরে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রতিবছর ১১ই সেপ্টেম্বর একটা জীপ তার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে নিকটবর্তী নিউজলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে যায়। সেখান থেকে সেই স্মৃতিচিহ্ন একটা ফাঁকা বার্থে করে রওনা দেয় কাপুরথালার কুকা গ্রামের উদ্দেশ্যে । তিনজন সৈন্য তার প্রহরায় নিযুক্ত থাকে। সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি নাথুলায় কর্তব্যরত সৈন্যরাও বাবা হরভজন সিংয়ের মায়ের কাছে প্রতি মাসে কিছু কিছু সাহায্য পাঠায়।
নাথুলাকে তিব্বতি ভাষায় লেখা হয় རྣ་ཐོས་ལ་ । এটি প্রাচীন সিল্করুটের একটা অংশ। 'নাথু' শব্দের অর্থ কান আর 'লা' শব্দের অর্থ পার্বত্যপথ। সমুদ্রতল হতে ৪৩১০মিটার উঁচু এই নাথুলা পাশে এসে অব্দি মৈত্রবুড়োর ছটফটানির বিরাম নেই। লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। কিছুটা কৌতূহলের বশেই আমি বুড়োর পিছু নিলাম। বুড়ো পেছনে না তাকিয়েই বলে উঠল, "টুপিটা ফ্যাশনের জন্য নয়। কানটা ঢাকুন।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম। টুপিটা আমি পেরেছি মিনিট খানেক আগে। আর বুড়ো তো একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। তাহলে জানল কি করে যে আমার কান টুপি হতে বেরিয়ে আছে ! ম্যাজিক জানে নাকি ! আমি বললাম, "আপনি কি ম্যাজিসিয়ান !"
বুড়ো বলল, "এতে কোনো 'ভানুমতীর খেল' নেই। সঠিক অনুমান আর সঠিক পর্যবেক্ষণ করলে আপনিও এরকম বলতে পারবেন। আমার পেছন পেছন আসুন। আরেকটা চক্রের হদিস মিলেছে।"
বুড়োর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। একটা টিলামতো অংশের উপরে উঠেই আমি তাজ্জব। আগের বৌদ্ধস্তুপটার মতোই একটা স্তুপ ভেঙ্গেচুড়ে পড়ে আছে। বুড়ো স্তুপটার কাছে গিয়ে সেই খুরপির মতো জিনিসটা দিয়ে কিছু একটা বের করে আনল। উদ্ধার করা বস্তুটি পকেটে রাখতে রাখতে বুড়ো বলল," শুধু শারীরিক বল আর চালাকি দিয়ে সবসময় কার্যসিদ্ধি সম্ভব হয় না । কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়জ্ঞান আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির দরকার। আপনার মৃগাঙ্ক সেন শেয়ালের মতো চালাক হলেও জ্ঞান বুদ্ধির ছিটেমাত্রও তার মধ্যে নেই। যাইহোক এবার চলুন শিবের মূর্তির কাছে যাই। অঘোরবাবুর তো অনেক ছবি তুলে দিলেন, এবার আমার উপরে দয়া করুন। "
বুড়োর কথাগুলো সন্মোহিতের মতো শুনছিলাম। যত দেখছি ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে বুড়োর উপর। এই যা ! নামটা তো জিজ্ঞাসা করিনি। বললাম," আপনার সঙ্গে এই এত আলাপ কিন্তু কি আশ্চর্য বলুন তো একবারের জন্যেও নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। "
বুড়ো তার ব্যাগ হতে জলের বোতল বের করে গলাটা ভিজিয়ে নিল। তারপর বলল, "নামে কি আসে যায় ? যদি রবিন্দ্রনাথের নাম চন্দ্রশেখর হত তাহলেও তিনি কবিকুলচূড়ামনণিই থেকে যেতেন। কর্মই আসল। তবুও যখন একান্তই জানতে চান তখন অগত্যা..। অধমের নাম ইন্দ্রজিৎ মৈত্র। ডায়েরিটা পড়া হয়ে ওঠেনি আপনার তাই জিজ্ঞাসা করলেন। "
সত্যিই তো, ডায়েরিটার কথা আমার মনেই ছিল না। কি ভুলো মন আমার। আজকে রাতে ডায়েরিটা নিয়ে বসব। জানতে হবে সেই রহস্য যার জন্যে শশাঙ্কশেখর মৈত্র পাগল হয়ে গেলেন আর তার ছেলে এতগুলো বছর পরে এসেছ পাণ্ডববর্জিত স্থানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। মৃগাঙ্কবাবু যে ভালোমানুষ নন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর এই ইন্দ্রজিৎ বুড়োর আর মৃগাঙ্কবাবুর উদ্দেশ্য যে একই তা বোঝার জন্যে খুব বুদ্ধির দরকার পড়ে না। যাইহোক দুজনে শিব মূর্তিটার কাছে এগিয়ে গেলাম।
"কি সুন্দর আবহাওয়া দেখেছেন ! ..." অঘোরবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ তার আনন্দের চুলোয় জল ঢেলে বুড়ো বলে উঠল, "আর্থ্রাইটিসে ভোগেন, সাইনাসের ধাত, বাথরুমে পুরো একপালা গাওয়ার পরেও কোষ্ঠ সাফ হয় না,..... এরপরেও প্রাণে ফূর্তি আসে ! "
অঘোরবাবু প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন, তারপর একদম আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, "কে আপনি মশাই ! ডাক্তার ! আমার গেঁটে বাত থাক, আমাশা থাক আর যাখুশিই থাক না কেন তাতে আপনার কি ? জানেন আমি কে ? এই অঘোর বাঁড়ুজ্জেকে আপনি টিটকিরি মারেন ! দেশে ফিরি তারপর আপনার নামে যদি মানহানির মামলা না করি তবে আমার নামে কুত্তা পুষে দেবেন মশাই।"
বুড়োর মুখে কিন্তু ফিচেল হাসি লেগেই আছে। বোঝাই যাচ্ছে যে অঘোরবাবুকে রাগিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে বুড়ো। আমিই বাধ্য হয়ে অঘোরবাবুকে শান্ত করলাম। অঘোরবাবুর রক্তচাপ একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে বুড়ো অঘোরবাবুর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল," চটে যাচ্ছেন কেন, আমি যা বলেছি তা কি মিথ্যা ?"
অঘোরবাবু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন। বুড়ো বলল, "জন্ম থেকেই আমার এই গুনটা আছে। আমি কপাল দেখে মানুষের ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান বলে দিতে পারি।" কথাটা বলেই বুড়ো আমার দিকে চেয়ে চোখটিপে ইঙ্গিত করল। বুঝতেই পারলাম অঘোরবাবুর ঘোর লাগানোর জন্যে বুড়ো সচেষ্ট হয়ে উঠেছে।
অঘোরবাবুর চোখদুটো এবার যেন চকচক করে উঠল। তিনি বুড়োর দিকে নিজের প্রশস্ত কপাল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন," সময় খুব খারাপ চলছে মশাই। কোন এক উটকো মৃগাঙ্ক সেন আমার ভ্রমণের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল। একটু ঠিক করে দেখে দেন তো ! আর যা কিছু বলেছি তার জন্য দুঃখিত মশাই। হয়ে গেছে বয়ে গেছে।"
বুড়ো পকেট হতে আতসকাচ বের করে অঘোরবাবুর কপাল পর্যবেক্ষণ ও ত্রিকাল দর্শনান্তে প্রতিকার বাতলাতে লাগলেন। আমি নাথুলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি অপরুপা এই প্রকৃতি ! পাহাড়ের শ্রেণি ভূমি আর আকাশের মাঝখানে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে। সেই স্তম্ভের মাথায় উড়ছে মেঘেদের জয়ধ্বজা। রোদ আর ছায়ায় মায়াময় হয়ে উঠেছে উপত্যকা।
নাথুলা থেকে ছাঙ্গু আসার পথে অঘোরবাবুর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মৃগাঙ্ক সেনকে আর পাত্তা দিচ্ছেন না। বুড়োর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছেন। সাদা পেস্ট জাতীয় কিছু দিয়ে কপালে তিলকও এঁকেছেন। বুঝতেই পারলাম এসবই বুড়োর দুস্টুবুদ্ধির নমুনা। ছাঙ্গুতে নেমে সবাই রোপওয়ে নিয়ে মেতে উঠল। এই ফাঁকে বুড়ো কখন যে অঘোরবাবুকে এড়িয়ে পেছনের টিলাটার দিকে হাঁটা দিয়েছেন তা বুঝে উঠতেই পারিনি। একরকম দৌড় দিয়েই বুড়োর সঙ্গ ধরলাম। টিলার পেছনে একটা ছোট্ট মনেস্ট্রি। রাস্তা খুবই বন্ধুর। আমরা অনেক কষ্টে মনেস্ট্রির দরজা পর্যন্ত পৌঁছলাম।
দরজা খোলাই ছিল। দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে যাব এমন সময় বুড়ো আমাকে আটকে দিল। আমি কিছু বলার আগেই বুড়ো বলল, "এসব কাজে পর্যবেক্ষণ শক্তি তীক্ষ্ণ হওয়া দরকার। নিচের দিকে তাকাও।"
নিচের দিকে নজর যেতেই আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। দেখি দরজার কাছেই পড়ে আছেন একজন বয়স্ক লামা। তার মাথার ক্ষত হতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুড়ো লামার ঘাড়ে ও কব্জিতে ধাত পরীক্ষা করে বলল, "বেশিক্ষণ হয়নি। প্রাণে বেঁচে আছে। জলের বোতলটা দেন তো। "
আমি জলের বোতলটা এগিয়ে দিতেই বোতল হতে জল নিয়ে লামার চোখেমুখে ছিটে মারল। জ্ঞান ফিরতেই লামার মুখ দিয়ে অস্ফূটভাবে বেরিয়ে এল, "মার... মার.."
বুড়ো বলল, "মার কি করেছে ?"
"আ গেয়া...." লামা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। মনেস্ট্রিতে ঢুকেই বুড়ো পুলিশে ফোন করেছিল।কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন কনস্টেবল সহ পুলিশ অফিসার অর্জুন কুমার প্রধান এসে হাজির হলেন। লামাকে আর্মির মেডিক্যাল ক্যাম্পে পাঠানো হল।
-- চার - -
বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। রুটি আর সব্জির সাথে চিকেন কষা দিয়ে রাতের খাবার সম্পন্ন হল। তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে গেলাম। ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম।
ডায়েরির ভাষা অগোছালো । ডায়েরির প্রথম দুটো পাতা ফাঁকা। তৃতীয় পাতায় একটা কলমে আঁকা স্কেচ। স্কেচটা এতটাই বীভৎস যে দেখামাত্র আমার রোমে রোমে অজানা একটা আতঙ্ক খেলা করে গেল। একটা দানবীয় মূর্তি। গোল গোল দুটো চোখ আর মুলোর মতো দাঁত। লকলকে জিভখানা সামনের দিকে বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে। জিভের দুপাশে দুটো গজদন্ত। আর পারছি না। কেমন একটা যেন সন্মোহন আছে ছবিটাতে। আমি নিজেকে আর বশে রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন হাজারো জোনাকি ঘুরছে চোখের সামনে। যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। পাতাটা ওল্টানোর ক্ষমতাও আর আমার মধ্যে নেই। অনেক কষ্টে পাতাটা ওল্টালাম।
বেশ গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শশাঙ্কশেখর মৈত্রের ডায়েরি, - বিভীষিকার জ্যান্ত দলিল। আমি পড়তে লাগলাম।
'আমি শশাঙ্কশেখর মৈত্র, জন্ম নিয়েছিলাম বীরভূমের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। হাজারো অভাব আর অনটনের মাঝেও লেখাপড়া কখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। এর একমাত্র কারন ছিলেন আমার ঠাকুরদা। তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। পৌরহিত্যের সামান্য রোজগারে সংসার ঠিকমতো চলত না। বাবা আর ঠাকুরদা দুজনেই খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন। কোনো সংস্কার তাদের চলার পথে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। আমার পড়াশোনাতেও তাই তারা কোনো বাধা উপস্থিত হতে দেন নি।
স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় গেলাম। সেখানে আমার দাদুর এক শিষ্য থাকতেন। লালবাজারের বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি। তার বাড়িতে থেকেই কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলাম। ততদিনে ঠাকুরদা গত হয়েছেন। আমাকে চাকরির সন্ধানে বিশেষ ঘোরাঘুরি করতে হল না। খুব সহজেই একটা কলেজের অধ্যাপনার কাজ জুটে গেল। কিন্তু যার কপালে বিধি বিশ্বনিখিল ঘুরে বেড়ানোর ফরমান লিখে দিয়েছেন তার এই মোহগর্তে থাকাটা যথেষ্টই বেমানান । কত যে চাকরি বদল করলাম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কখনো মনোহরপুর রয়েলস্টেটের সেক্রেটারি তো কখনো ইংল্যান্ডের কোন অখ্যাত শহরের লাইব্রেরীয়ান। দেশে বিদেশে কত যে চাকরি ধরলাম আর কত যে চাকরি ছাড়লাম তার হিসেব আমি নিজেও দিতে পারব না।
তখন আমি চাণ্ডেলের রাজার ব্যক্তিগত সহায়ক হিসাবে কাজ করছি। দিব্যি আছি। মাসে মাসে কিছু করে টাকা ঘরে পাঠিয়ে দিই। জানি, টাকা পয়সাটাই সবসময় মানুষের জীবনের সবকিছু নয়। কিন্তু আমি করব কি ! পায়ের তলায় সর্ষে আমার। এই একটা কারনের জন্যেই স্ত্রী পুত্র কন্যা কাউকেই সুখ দিতে পারিনি । আমার ছেলেমেয়েরা তাই আজ আমি বেঁচে থাকতেও অনাথের মতো জীবনযাপন করছে।
যাই হোক সেদিন সকালবেলায় আমি আমার ঘরে বসে মহারাজের সারাদিনের রোজনামচায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। এটাই আমার কাজ। মহারাজ সারাদিন কোথায় কি করবেন, কি খাবেন, কার সাথে দেখা করবেন তার শিডিউল আমিই তৈরি করে দিই। কাজ করতে করতে মাথাটা ধরে এসেছিল। চায়ের জন্য সুন্দররামাইয়াকে হাঁক দিলাম। সুন্দররামাইয়া আমার ফাইফরমাশ খাটে।
সুন্দররামাইয়া চা নিয়ে এল। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখার পরও যখন সে যাচ্ছে না তখন আমি বললাম, "কি হল সুন্দর তুমি কিছু বলবে ?"
সুন্দররামাইয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, "সাহেব একটা নিবেদন ছিল।"
"বল।"
"আজ্ঞে সাহেব, আমার এক বন্ধু আছে। আগে তিব্বতে থাকতো। কিছুদিন আগেই এসেছে। ওকে যদি একটা কাজ দেন তো খুব উপকার হয়।"
"আচ্ছা নিয়ে এসো দেখা যাবে।"
সুন্দররামাইয়ার সেই বন্ধুটি বিকালবেলায় এল। খুব শান্তশিষ্ট ও কথা বলে কম। ইংরাজি আর হিন্দিতে যথেষ্টই জ্ঞান আছে দেখে ওকে আমার সহকারী হিসেবে রেখে নিলাম।
দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু একদিন গোল বাধল। একদিন সন্ধ্যার সময় দেখি ছেলেটি কম্বলে ঢাকা নিয়ে ঘরের এককোণে বসে কাঁপছে । আমি কম্বলটা টেনে খুলে নিতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠল। " আমাকে বাঁচান সাহেব, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে......। "
আমি বললাম, "কারা তোমাকে মেরে ফেলবে ?"
"মারের সৈন্য সাহেব !!" এক নিঃশ্বাসে জবাব দিল ছেলেটি।
"কোথায় ?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়েই নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগল। আমি সুন্দররামাইয়াকে দিয়ে একটা ডাক্তার ডাকিয়ে আনলাম। ডাক্তারবাবু পরীক্ষানিরীক্ষা করে বললেন," ভয়ের কিছু নেই। তবে নার্ভ যথেষ্টই উইক। প্রেসারটাও বেড়েছে। ওষুধ লিখে দিলাম, জ্বরটা কমে যাবে। তবে চাঙ্গা হতে সময় লাগবে।"
ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। ছেলেটার সুস্থ্য হয়ে উঠতে কয়েকদিন লাগল। ততদিনে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি যে ওর কোনো মানসিক সমস্যা আছে।
একদিন রাতে একটা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বিছানা হতে উঠে বসলাম। ঘরের আলো জ্বেলে বালিশের তলা থেকে পিস্তলটা বের করে নিলাম। রাতে বিরেতে সঙ্গে অস্ত্র থাকাটা ভালো। ঘরের বাইরে বেরোতে বোঝা গেল চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স হতেই আসছে। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্সের দিকে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে গোলযোগ থেমে গেছে। কিছুটা এগোতেই দেখলাম সুন্দররামাইয়ার ঘরের দরজা খোলা। ঘরের ভেতরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দররামাইয়া। আর বিছানায় অর্ধমৃতের মতো পড়ে আছে তার বন্ধু। গোটা ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে।
সেই রাত্রে কি হয়েছিল তা সুন্দররামাইয়া আমাকে বলেছিল, তবে পরের দিন সকালে। রাত্রে কথাবলার মতো মানসিক অবস্থা সুন্দররামাইয়ার ছিল না। সে আমাকে যা বলেছিল তা মোটামুটি এইরকম -
সুন্দররামাইয়া আর তার বন্ধু একটা ঘরেই থাকে। সারাদিন খাটাখাটনির পর বিছানায় শোয়ামাত্রই সুন্দরের আর কোনো জ্ঞান থাকে না। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায় একেবারে। অন্যদিকে সুন্দরের বন্ধু ছেলেটির বায়ুচড়া ধাত আছে। চট করে ঘুম আসে না। সেদিন মাঝরাতে দুপদাপ আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় সুন্দরের। বিছানার উপরে উঠে বসে চোখ কচলাতে থাকে সে। আধো আলোয় তার নজরে পড়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি সারাঘরময় কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর একটা ছায়ামূর্তি সুন্দরের বন্ধুর গলাটা টিপে ধরে চাপা গলায় তর্জনগর্জন করছে।
"মানচিত্রটা কোথায় বল ? কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস ?"
ছেলেটির উত্তর একটাই, "আমি মরে গেলেও বলব না।" এইরকম তাণ্ডব কতক্ষণ চলেছিল তা সুন্দরের মনে নেই। আমার ডাকেই তার সম্বিত ফেরে।
এরপর আর ঝুঁকি নিইনি। ছেলেটিকে তার দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। যাবার সময় একটা পুরোনো ভূর্জপত্রের পুঁথি আমাকে দিয়ে গিয়েছিল সে। না, পুঁথির ব্যাপারে কিছুই বলেনি। হয়তো সে নিজেও কিছু জানে না।
পুঁথিটা পালি ভাষায় লেখা। কোনো এক বৌদ্ধ সন্নাসী মহা গুপ্তের রচনা। গোটা পুঁথিজুড়েই আছে মারের বৃত্তান্ত, আর মারকে পরাজিত করার জন্য সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোকের নয়জন জ্ঞানীর কথা।
মার হলো বুদ্ধের সাধনার পথে বিঘ্নসৃষ্টিকারি অশুভ শক্তি। চিনা ভাষায় 天魔/魔羅 । মার কথার অর্থ হলো হত্যা বা ধ্বংস করা । এর তিন কন্যা, - তৃষ্ণা, অরাতি এবং রাগ। অন্যত্র এই মারকে অসৎ দেবপুত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা সংখ্যায় একাধিক। এরা মানুষের মুক্তির পথে বাধাদান করে। কখনো পশুপাখি, কখনো ভয়াবহ মূর্তি, কখনো বুদ্ধমূর্তি, রমনীয়া কন্যা বা দুঃস্বপ্ন রুপে সাধকের সাধনাভঙ্গ করে। বুদ্ধঘোষের মতে মার হল অকুশল মনোবৃত্তি বা মনের রিপুসকল।
সিদ্ধার্থ যখন বোধি লাভের আশায় বটবৃক্ষের তলায় সাধনায় বসেন তখন মারের মনে ক্রোধ জন্মায়। মার তার সুন্দরী ও মনমোহনকারিনী কন্যাদের পাঠান সিদ্ধার্থের তপোভঙ্গের উদ্দেশ্যে। মারের কন্যাদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না গৌতম।
মার আরো ক্রুদ্ধ হয়ে তার সৈন্যদের নিয়ে আক্রমণ করেন সিদ্ধার্থকে। ব্যর্থ হন এবারও। তখন তিনি সিদ্ধার্থকে বলেন, "হে শাক্য ! কে তোমার হয়ে সাক্ষ্য প্রদান করবে ?"
সিদ্ধার্থ মৃদু হাসলেন। তারপর তার হাত দিয়ে ভূমিস্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী বলে উঠল, "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। সিদ্ধার্থই বোধিলাভের উপযুক্ত।"
মার অদৃশ্য হয়ে গেল। ইন্দ্রাদি দেবতারা আকাশ হতে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।
এতো গেল মারের কথা। পুঁথির পরের অংশেই আছে নয়জন জ্ঞানী ব্যক্তির কথা, যারা মারের হাত হতে বৈদিক জ্ঞানের সংরক্ষণ করেছিলেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী।
এই জ্ঞান যাতে কোনো দুষ্ট ব্যক্তি তথা মারের হস্তগত না হয় তার জন্য তিনি সমস্ত জ্ঞান নয়ভাগে ভাগ করে মন্ত্রীদের মধ্যে বন্টন করেন। এই জ্ঞানী ব্যক্তিগন সম্রাটের কাছে শপথ করেন যে উত্তরাধিকার পরম্পরায় এই জ্ঞান তারা সংরক্ষণ করবেন। এই জ্ঞানের সংরক্ষণের জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না। এর পরেই পুঁথিটি খণ্ডিত। সম্ভবত কালের হস্তক্ষেপে জীর্ণ ও দীর্ণ হয়েছে পুঁথিটি।
No comments:
Post a Comment