Thursday, April 25, 2019

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ১ // সুব্রত মজুমদার

অনেকদিন পর বিক্রমের বেড়াবার অবকাশ হয়েছে। রায়ভিলার ভুতের রহস্য সমাধান করার পর থেকেই বিক্রমের হাতে কোন কাজ নেই। দেবলীনাও এখন পাটায়া ট্যুরে। এই মধুমাসে অলসের মত বসে থাকাটা বিক্রমের পক্ষে খুবই অসহনীয়। ভরসা শিবরাম। হ্যাঁ, মুক্তারাম স্ট্রিটের সেই আদি অকৃত্রিম শিবরাম চক্রবর্তী। বিক্রম আরামকেদারায় বসে বাগিয়ে ধরে শিবরাম রচনা সমগ্র। এবার একটু চা চাই। তাই সজোরে হাঁক দিল বিক্রম, " মাধবদা, চা দিয়ে যাও।"
এরপর সদর দরজার দিকে নজর যেতেই দেখলেন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছেন এক ব্যক্তি। লোকটির মাথায় ব্যাকব্রাশ করা একরাশ কালো চুল, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা আর হাতে একটা ছোটমতো নোটবুক। আরে ইনি তো পাশের বাড়ির অঘোরবাবু !
        অঘোরবাবু রিটায়ার্ড মানুষ। ইরিগেশন না কি একটা দফতরে চাকরি করতেন। এখন রিটায়ারের পর সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হয়েছেন। ইনি এলেই বিক্রমের দফারফা করে ছাড়েন। এটা কি করে হল, ওটার মানে কি, - - এজাতীয় প্রশ্নের বিরাম নেই। এহেন অঘোরবাবুকে আসতে দেখে বিক্রম মনে মনে প্রমাদ গুনলেন।
" এই যে বিক্রমবাবু, আছেন কেমন ? আপনার ঐ মেয়েছেলে বন্ধুটিকে তো আর আসতে দেখি না !" একটা আঁতেল হাঁসি হাঁসলেন অঘোরবাবু।
বিক্রম জবাব দিল, " ওটা বান্ধবী হবে। আর সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, আপনার মতো পরছিদ্রান্বেষণের সময় কারোর নেই।"
" আরে মশাই, এত রেগে যাচ্ছেন কেন ? আজ আপনাকে এমন খবর দেব মশাই আনন্দে দু'হাত তুলে নাচবেন। " অঘোরবাবু বিক্রমের পাশের চেয়ারে বসলেন। মাধবদা চা নিয়ে এল। সে অঘোরবাবুকে আগেই দেখেছে, ফলে দুজনের জন্যেই চা এনেছে।
" সুসংবাদটা কি ? আমি রাজা হচ্ছি ? নাকি আমার লটারি লাগল ? " বিক্রম চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে।
অঘোরবাবু চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বিক্রমের দিকে তাকিয়ে খিঁক খিঁক করে হেঁসে ওঠেন।  "আরে না না মশাই, লটারি তো লেগেছে আমার। সেই যে সেদিন এসেছিলাম আপনার কাছে, জানতে পরপর চারটে সংখ্যা বলতে বললাম, মনে আছে তো ! সেই নাম্বারের লটারি টিকিট কিনেছিলাম। দেড় লাখ টাকা মশাই ! "
"তাতে আমার আনন্দের কি হল ? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হল আপনার।" বিক্রম বিরক্ত হল।
এবার অঘোরবাবু আসল কথা পাড়লেন। " ব্যাপার হল কি দুটো আপডাউন টিকিট কিনেছি, - টু পুরি। পুরো খরচা আমার। আপনি আমার কাছে খুব লাকি আরকি। তাছাড়া আপনার মতো লোক সাথে থাকলে ভরসা পাই মশাই। "
অন্যদিন হলে বিক্রম অঘোরবাবুকে পত্রপাঠ বিদায় দিতেন কিন্তু আজ আর না বললেন না।
                                                        - - দুই - -
                     হাওড়া-পুরি এক্সপ্রেসে চেপে রওনা দিলো বিক্রম। গোটা রাস্তা অঘোরবাবু বকবক করেছেন। বিভিন্ন স্টেশনের নাম কিভাবে হল, রেলের খাবার তৈরিতে কতগুলো ঘুঁটে গুল লাগে, উড়িয়ারা কি সত্যিই উড়তে পারে ইত্যাদি নানান প্রশ্নে বিক্রমকে জেরবার করে তুললেন অঘোরবাবু।
 পুরিতে নেমে স্বর্গদ্বারের কাছে হোটেল ভাড়া করা হল। হোটেল সুপ্রভাত। বাঙালি মালিক, কলকাতার লোক। বিক্রমকে তিনি টিভিতে দেখেছেন। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন বিক্রমকে।. " কি সৌভাগ্য আমার, বিক্রমবাবু অমি যে আপনার কতবড় ফ্যান তা বলে বোঝাতে পারব না। আপনার সব কীর্তিকাহিনী আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।"
অঘোরবাবুও হোটেল মালিককে জড়িয়ে ধরতে গেলেন, কিন্তু পাত্তা পেলেন না। খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্রমের কানে কানে বললেন, " দেখছেন তো মশাই, আমার মতো উদিয়মান সাহিত্যিককে পাত্তা দিল না। ঘোর কলিকাল। ". বিক্রম মুচকি হাঁসল।
হোটেলমালিক বিজনবাবু জানালেন যে সব রুম বুকড। তিনতলার ৩০৭ আর ৩০৮ ফাঁকা আছে। তবে ৩০৮ রুমটি দেওয়া যাবে না। কারনটা ব্যক্তিগত। অগত্যা ৩০৭ এই দুজনের থাকার ব্যবস্থা হল। বিজনবাবু বিক্রমের কাছে ভাড়া নিলেন না, এমনকি খাবার চিন্তা করতেও মানা করলেন।
সারাদিন সমুদ্রে স্নান করে আর সন্ধ্যাবেলায় অটোতে করে পুরি শহর দেখে বেড়ালো বিক্রম আর অঘোরবাবু। রাতের মেনু ছিল গরম গরম খাঁসির মাংস আর রুটি। দিন ও রাতের খাবারের দায়িত্ব নিয়েছেন বিজনবাবু। সিসাইড জানালা থাকায় সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল বিক্রম।
মাঝরাতে অঘোরবাবুর ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল বিক্রমের। বিক্রম বিরক্ত হয়ে বলল, " কোন চাক্কির আটা খান মশাই, রাতেও ঘুম নেই ! রাতের আঁধারে কোন গল্পের প্লট মাথায় এল নাকি ? আমার মাথা না খেয়ে লিখে ফেলুন।"
অঘোরবাবুর মুখে তার পেটেন্ট হাঁসিটি নেই, তিনি শশঙ্কিত হয়ে বললেন, " আরে মশাই কথাটা তো শুনুন। পাশের ঘরটা ভালো নয় বিক্রমবাবু। ভালোকরে শুনুন.... "
বিক্রম দেওয়ালে কান পাতল। অঘোরবাবু চাপা স্বরে বললেন," কি কিছু শুনতে পাচ্ছেন ? " বিক্রম মাথা নেড়ে সন্মতি জানাল। তারপর অঘোরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, " অনেকগুলো ছেলেমেয়ের গলা। চাপা গলায় যেন কি আলোচনা করছে। "
" কিন্তু ঘরটা তো বন্ধ মশাই, ছেলেপিলে আসবে কোথা থেকে ? ভুত প্রেত নয়তো !! রাম রাম রাম.... !!!". অঘোরবাবু ভয়ে রামনাম জপতে লাগলেন।
বিক্রম দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে ৩০৮ এর দরজায় কান পাতল। হ্যাঁ, আওয়াজ স্পষ্ট। কিন্তু বাইরে থেকে তো তালা বন্ধ। বিক্রম নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ল। অঘোরবাবু ততক্ষণে মাথা হতে পা অব্দি চাদর ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
চাদরের ভিতর হতে আওয়াজ এল, "কিছু বুঝলেন..?"    বিক্রম জবাব দিল, " ভুত।"  এরপর অঘোরবাবুর আর আওয়াজ পাওয়া গেল না।
      সকালবেলা চা খেতে খেতে বিক্রম কালকের রাতের অভিজ্ঞতার কথা বিজনবাবুকে বললেন। বিজনবাবু প্রথমে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে তারপর বললেন, " রুমটা আজ তিন বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে। আজ থেকে তিন বছর আগে ওই ঘরে এসে উঠেছিলেন এক দম্পতি, তাদের দুই ছেলে আর এক মেয়ে সহ। হঠাৎ কি হল জানিনা এক রাতে সবাই মিলে সুইসাইড করে। সকালবেলায় আমাদের হোটেলের সার্ভিসবয় গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করেও উত্তর না পেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমি পুলিশে খবর দিই। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে দেহগুলো উদ্ধার করে। "
অঘোরবাবু এতক্ষণ চুপ ছিলেন, তিনি এবার কৌতুহল প্রকাশ করেন। " বলেন কি মশাই, এ তো একদম নির্ভেজাল ঘোষ্ট ষ্টোরি। আমার পরের গল্পের বেশ ভালো প্লট হবে। 'হোটেলে হাহাকার'।

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...