Thursday, April 25, 2019

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ৬ // সুব্রত মজুমদার

আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। বিক্রম বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। অঘোরবাবু গাড়িতে বসেই প্রশ্ন করলেন," আচ্ছা মশাই, আপনি কি করে জানলেন যে এ সবকিছুই গুপ্তধনের জন্যে হচ্ছে ? "
বিক্রম শান্ত গলায় জবাব দিল," সবই বলব অঘোরবাবু, শুধু সঠিক সময়টা হতে দিন। আমার মনে হয় দলের পাণ্ডাকে আমি পেয়ে গেছি।"  অঘোরবাবু আর কিছু বললেন না। বিক্রম গাড়ি থেকে নেমে সোজা ডাইনিং হলে চলে গেল। অনেক রাত হয়েছে। অঘোরবাবু আসার পথে একটা হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরেছেন। আজ খেতে খেতে বিক্রমেরও একটা আনসিকিওর আনসিকিওর ফিলিং হচ্ছিল। না অঘোরবাবুর সঙ্গদোষে নয়, বরং ঘটনা যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে অঘোরবাবুর নয় প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে বিক্রমেরই।
খাওয়া দাওয়া সেরে বিক্রম রুমে ফিরে দেখল অঘোরবাবু মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। জলের জাগ হতে জল নিয়ে চোখে মুখে ছিটাতেই অঘোরবাবুর জ্ঞান ফিরে এল। তিনি কিছুক্ষণ গোল গোল চোখ করে বিক্রমের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, "চোর... চোর.."
বিক্রম বলল, "কোথায় চোর ?"
অঘোরবাবু বললেন, "আপনি ডাইনিং হলে ঢুকে গেলেন, আমি চলে এলাম রুমে। এসে দেখি রুমের দরজা খোলা। কি বলব মশাই একটা চিমড়ে মতো লোক আমাদের জিনিসপত্র হাঁতড়ে দেখছিল। আমি চোর বলে চিৎকার করতেই নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ এল, তারপর আর জানি না। "
বিক্রম অঘোরবাবুকে  ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। অঘোরবাবু একটু জল চাইলেন। বিক্রম জলের জাগ হতে গ্লাসে করে জল এনে অঘোরবাবুকে দিয়ে বললেন," চিন্তা করবেন না অঘোরবাবু, জাল আমি গুটিয়ে এনেছি, দুদিনের মধ্যেই সব রহস্যের সমাধান করব। "   অঘোরবাবু জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন। বিক্রমের ঘুম এলো না। সে টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালেই বিক্রম আর অঘোরবাবু বেরিয়ে পড়লেন। তাদের গন্তব্য নন্দনকানন। গাড়িতে চেপেই অঘোরবাবু বললেন," ভগবানকে ডাকুন বিক্রমবাবু যেন আজ আর কোনো ঝামেলা না হয়। আচ্ছা বিক্রমবাবু, নন্দনকাননে বাঘ আছে ?"
বিক্রম বলল, "বাঘ আছে, হাতি আছে, আরো অনেক পশুপাখি আছে। এই অভয়ারণ্যটা হল ছন্দক অরণ্যের একটা অংশ। ১৯৬০ সালে এই অভয়ারণ্য তথা চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠা হয় ।"
নন্দনকাননে ঢুকবার মুখেই টিকিটঘর ।বিক্রম লাইনে দাঁড়াল টিকিট কাটার জন্যে। অঘোরবাবু হঠাৎ এসে বললেন," সব চোর মশাই, এ তো দিনে ডাকাতি।
-কেন কি হল ?
- ওই যে ওই ওজন মেশিনগুলো রয়েছে না মশাই, তা ভাবলাম ওজনটা একটু মেপে নিই। বারো কেজি বেশি। পুরি আসার আগেই কৈলাশের দোকানের কম্পিউটার কাঁটায় ওজন করিয়েছি মশাই । ভাবুন কি কাণ্ড !
বিক্রম বলল," কৈলাশের দোকানে ওজন করানোর সময় নিশ্চয়ই আপনার কাঁধের ভারি ব্যাগটা ছিল না।"
অঘোরবাবু জিভ কেটে বললেন, "কি বিপদ বলুন তো মশাই, এ হে হে হে..."
অঘোরবাবুর কথা শেষ করতে না দিয়ে বিক্রম বলল, "কিসব এনেছেন ! ওগুলো নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারবেন তো !
                            বিক্রমের কথা ভুল প্রমাণ করে অঘোরবাবু ওই ব্যাগ নিয়েই গোটা নন্দনকানন ঘুরলেন। কুমিরের এনক্লোজারের সামনে এসে একটু বিমর্ষ দেখাল তাকে। " ঈসস্ ! কয়েকটা পাউরুটি নিয়ে এলে ভালো হতো বিক্রমবাবু। আহারে ! বেচারা কুমিরগুলো কেমন মরার মতো পড়ে আছে। নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে।"
বিক্রম বলল, "ক্ষিধে পেয়েছে কিনা জানি না, তবে কুমির আপনার পাউরুটি খায় না।"
-  তবে কি খায় মশাই ?
- এই ধরুন আপনার মতো সাহিত্যিক পেলে একটু চেখে দেখত আরকি ! ওদের আবার লবণ লঙ্কাও লাগে না।
বিক্রমের এহেন জবাবে অঘোরবাবু যে আরো মুষড়ে গেলেন তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। শুধু তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন," এ ধরনের জীবজন্তু হতে দূরে থাকাটাই শ্রেয়স্কর।
ফোয়ারার জলে স্নান করার ইচ্ছা জেগেছিল অঘোরবাবুর, বিক্রমের হস্তক্ষেপে এ যাত্রা সে ইচ্ছা অবদমিত রইল। তবে গোটা চিড়িয়াখানাতে এতগুলো বানর থাকলেও পূর্বের অভিজ্ঞতার বলে অঘোরবাবু বানরদের ধারে কাছেও যাননি। অবশ্য দু'একটা বানর অঘোরবাবুর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু অঘোরবাবু আর ওপথে যাননি।
নন্দনকানন থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে ঢুকল বিক্রম। অঘোরবাবুর পছন্দ কাঁকড়া কারি, কারনটা অবশ্যই ফুগু। বিক্রমও কাঁকড়াই খেল। এক প্লেটে বড় বড় দুটো করে কাঁকড়া। বেশ জম্পেশ ভোজন হল। এবার গন্তব্য কোনার্ক।
কোনার্কে এসে হতে অঘোরবাবুর মনটা উড়ু উড়ু করছে। তিনি সিঁড়ির উপর ধপ করে বসে পড়লেন। তারপর বিক্রমকে ডেকে বললেন, "একটা ফাইন করে ছবি তুলুন তো মশাই। বয়স হয়েছে বলেকি শখ সাধ সব জলাঞ্জলি দিয়েছি নাকি। আর হ্যাঁ, বাড়ি ফিরেই একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেবেন তো। বুঝলেন মশাই, সারাজীবন আইবুড়োই থেকে গেলাম। মিথ্যা বলব না প্রেম এসেছিল জীবনে। কিন্তু টিকল না !"  দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অঘোরবাবু।
বিক্রম বুড়োর মনের কষ্টটা বুঝতে পারল কি না জানি না সে বলল," আপনি অঘোর অর্থৎ সব অসুন্দরকে পরাজিত করেছেন। জানেন তো শিবের এক নাম অঘোর। আর এই অঘোর হতেই অঘোরী। "
অঘোরবাবু বললেন," অতশত বুঝি না। তবে এটুকু বলতে পারি যে জীবনের অনেককিছুই আমি হারিয়েছি। মশাই, এখনো সময় আছে, ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে সংসারী হন। পাশেই থাকি বৌমার হাতের রান্না কপালে জুটবে। আপনারা ছাড়া আমার আর কে আছে বলুন ! "
বিক্রমের মুখে কথা যোগালো না, কারন অঘোরবাবুর কথার সাথে তার মনের ইচ্ছাটা মিলে যায় যে। দেবলীনাও তাই চায়। কিন্তু দেবলীনার মা বাবা কি মেনে নেবে বিক্রমকে ? ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর আইএএস হয়েছিল বিক্রম। কিন্তু সরকারি চাকরি সে বেশিদিন করতে পারেনি। দুর্নীতির সাথে লড়াই করতে গিয়ে চাকরি হতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড হয় বিক্রম। কোর্টে আবেদন করেছিল, এখনো চলছে সেই মামলা। এমন চাকরি হারানো হাড়-হাভাতে ছেলের হাতে কেই বা তার মেয়েকে তুলে দিতে চায় !
বিক্রম বলল, " কোনার্ক   একটা সূর্যমন্দির। এই সূর্যমন্দিরটি তৈরি করেন গঙ্গ রাজবংশের শাসক প্রথম নরসিংহদেব। আর ধ্বংস করেন সেই কুখ্যাত কালাপাহাড়।"
অঘোরবাবু বললেন, "সেই কালাপাহাড়, যে অনেক মন্দির ধ্বংস করেছিল !"

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...