Sunday, May 5, 2019

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ৩ // সুব্রত মজুমদার

-"এ মা তা কেন ! মানুষের স্বাভাবিক কৌতুহল থাকতে পারে না !"  দেবলীনা হকচকিয়ে গেল।
তিয়াশা এবার নিজেকে সংযত করে দেবলীনার দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলল। " রাগ করলে নাকি, আমি এমনি এমনি বললাম। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড।"
" ইটস ওকে।"
"আচ্ছা বিক্রমবাবু তোমার কেমন বন্ধু হয় ? মানে কিছু চলছে কিনা সেটাই জানতে চাইছি। "  তিয়াশা কথা পাল্টায়।
দেবলীনা কিছু বলল না কেবল ইতিবাচক একটা ভঙ্গি করল। তিয়াশা ব্যাপার বুঝতে পেরে মুচকি হাঁসল।
                        সন্ধ্যার সময় দুর্গামন্ডপ হতে শাঁখের আওয়াজ ভেঁসে এল। ঠাকুরমশাই তড়িঘড়ি আরতি শেষ করে একরকম ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলেন। বাড়ির সকলে যে যার ঘরে ঢুকে গিয়ে খিলকপাট দিয়ে দিল। পাশাপাশি দুটো রুমে দেবলীনার ও বিক্রমের শেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাবল বিক্রমের দেওয়া মন্ত্রটা জপতে জপতে দেবলীনার ঘরে খাবার দিতে ঢুকল। দেখল মেমসাহেব ঘরে নেই। সটান ওঘর হতে বেরিয়ে বিক্রমের ঘরে এল।  "বাবু  রাতের খাবার। এই যে মেমসাহেব ও আছেন দেখছি। আপনার খাবার কি এখানেই দেব ?"
"হ্যাঁ, দুজনের খাবারই রাখ। কিন্তু রাতের খাবার সন্ধ্যায় কেন ? আর এ বাড়িতে সবার খাবারই কি এরকম হোম ডেলিভারি হয় ?" বিক্রম হাবলকে জিজ্ঞাসা করে।
হাবল একগাল হেঁসে বলে, " আগে তো সবাই টেবিল পেতে একসঙ্গে বসে খেতেন বাবু, এখন ভূতের ভয়ে সন্ধ্যার পর কেউই ঘর হতে বেরোয় না। যাই তাড়াতাড়ি, মাসিমাকে খাইয়ে দিয়ে আসতে হবে। "
" মাসিমা মানে... "
" আজ্ঞে গিন্নীমার বোন। প্যারালিসিস হয়ে পড়ে আছেন। আমিই খাওয়া দাওয়া করিয়ে দিই।"  হাবল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে । " না বাবু চলি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। রম্ভ করম্ভ উদুম্ব দুন্দুভি, রম্ভ করম্ভ উদুম্ব..... "   হাবল মন্ত্র জপ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
" কি সব বলতে বলতে গেল রম্ভ করম্ভ... " দেবলীনা অবাক হয়ে বিক্রমের দিকে তাকায়।
বিক্রম তার পিস্তলটি ব্যাগ হতে বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলে," তেমন কিছু না, স্বামী বিক্রমানন্দের দেওয়া ভূত অপসারক মন্ত্র। "
দেবলীনা হো হো করে হেঁসে ওঠে। এমনসময় পিস্তলটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায় বিক্রম। একটা ছায়া যেন পর্দার আড়াল হতে স্যাত করে সরে গেল। বিক্রম পর্দা সরিয়ে দেখে বাইরে কেউ নেই। পুরানো বাল্বের হলুদ আলোতে গোটা বারান্দা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল দরজার সামনে পাপোশটার দিকে, - - একটা চিরকুট। চিরকুটটা তুলে নিল বিক্রম। তারপর একবার চোখ বুলিয়েই পকেটে রেখে দিল। দরজা ভেজিয়ে ঘরে ঢুকল।
      "কি হল বিক্রম !" দেবলীনা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
বিক্রম পকেট থেকে চিরকুটটা বেরকরে দেবলীনার হাতে দিয়ে বলল, "সম্ভবত কেউ আমাদের উপরে নজর রাখছে। একটা ছায়ামূর্তি দরজায় আড়ি পেতে ছিল। সেই দিয়ে গেছে সূত্র। বা এমনও হতে পারে অসাবধানতা বশত তার হাত হতে পড়ে গেছে। দ্বিতীয়টি সত্যি হলে আমাদের সাবধান হতে হবে। কারণ চিরকুটটা উদ্ধার করতে সে আসবেই।"
দেবলীনা চিরকুটটায় চোখ রাখল। একটা পুরোনো তুলোট কাগজের চিরকুট। কাগজটিতে বহুপুরানো কালিতে লেখা একটা কবিতা।
        পুরের কি কাজ কোণের পাশে
        যাও সেখানে ফলের আশে।
         মালার গুটি সংখ্যা ধরো
       রাজার হালে বসত করো।।
" এ তো মনে হচ্ছে কোন ধাঁধা। কিন্তু কিসের ?"
বিক্রম মুচকি হাঁসে। " কাগজটা দেখেছ দেবলীনা, তুলোট কাগজ। তুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রসেসিং করে এই কাগজ তৈরি হত বলে একে তুলোট কাগজ বলে। এই কাগজ অনেক পুরোনো। আর কালিটা দেখ। বাবলার আঁঠা, হীরাকষ আর চিনি দিয়ে তৈরি কালি। ফলে চিরকুটটা যে বহুকাল আগে লেখা হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। "
" হীরাকষটা কি, - - হীরা গুঁড়ো টুঁড়ো ? "
" আরে না না। হীরাগুঁড়ো নয়। হীরাকষ হল গ্রীন ভিট্রিওল অর্থাৎ সাত অনু জল সহ আর্দ্র্য ফেরাস সালফেট। "
দেবলীনা বিক্রমের কাছ ঘেঁষে বসে। বিক্রম ভেবে পায় না এই নৈকট্য কিসের, - - ভয় নাকি প্রেম। সে যাইহোক বিক্রম দেবলীনার বিশ্বস্ত চুলগুলো মুখের উপর হতে সরিয়ে দেয়।
" এখনো দুজনের সাথে আমাদের পরিচয় হয় নি। রথিনবাবু আর মাসিমা । তিয়াশার সঙ্গে কথা বলে কেমন বুঝলে ?"
" খুব জটিল মহিলা। বাইরে হতে যতটা সহজ সরল দেখায় ততটা সহজ সরল নয়। আরেকটা কথা, ওর হ্যাণ্ড ব্যাগের শখ আছে। তোমাকে যেরকম ব্যাগে করে টাকা পাঠানো হয়েছিল সেরকম মডেলের গোটা দুই ব্যাগ ওর কালেকশনে আছে। "  দেবলীনাকে গম্ভীর দেখায়।
                      রাত দশটা। দেবলীনা আর বিক্রম খেতে বসে। হাবল বেশ যত্ন করে খাবার রেখে গিয়েছে। হটপটে ভরা নরম নরম রুটি, বাটিভর্তি খাঁসির মাংস, ঘন অড়হড়ের ডাল।এখানেই শেষ নয়, একগ্লাস দুধ, কিছু ফল ও মিষ্টিও আছে। দুজনের রাতের খাবারটা বেশ পরিপাটি করেই সমাধা হল।
  দেবলীনার দুধে প্রবল অনীহা। সে দুধ খেল না।
দেবলীনাকে খাট শুয়ে পড়তে দেখে বিক্রম বলল "এটা কি হল ! নিজের কক্ষে যাও বালিকা।"
" সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব আমার কুঞ্জে।" দেবলীনা পাশবালিশটাকে আঁকড়ে ধরে উত্তর দিল।
বিক্রম তখন বালিশটা কেড়ে নিতে নিতে বলল, " কবিগুরুর প্যারোডি, দেখাচ্ছি মজা। ভুতের ভয়ে একা থাকার মুরোদ নেই, তিনি আবার ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট। "
       ওদের খুনসুটি কতক্ষণ চলল জানি না। তবে দেবলীনা খাটের উপরে আর বিক্রম মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়ল। এই দীর্ঘ ব্যাচেলর জীবনে পাশে কেউ শুলে ঘুম হয় না বিক্রমের। একলা থাকার এই এক ডিসঅ্যাডভান্টেজ। রাতে এত ভালো ঘুম হল যে এক ঘুমেই সকাল। 

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...