Saturday, May 4, 2019

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৮ // সুব্রত মজুমদার

দারোগা গিন্নী অকুস্থলে হাজির হয়ে দেখলেন তার কর্তা একটা পাতলা প্যাকপ্যাকে লোকের উপরে উপুর হয়ে পড়ে আছেন, আর তার উপরে রেলিং এর খুঁটির সাথে শোভা পাচ্ছে সাধের গোলাপের গামলাটা। তিনি তো সঙ্গে সঙ্গেই কান্না জুড়ে দিলেন, "ওগো তোমরা কে কোথায় আছো দেখে যাও গো.. ওও... ওওও.... আমার মাছ খাওয়া সারাজীবনের মতো ঘুচে গেল গো... ওওওওও.....।"
দারোগা গিন্নীর কান্নাকাটি শুনে পাড়া প্রতিবেশী সেপাই সবাই এসে হাজির হলো। তাদের দেখে দারোগার গিন্নীর কান্না আরো বেড়ে গেল। তিনি আবার শুরু করলেন," ওগো কোথায় গেলে গো ! যাবার সময় এটিএম-কার্ডের পিন নাম্বারটা বলে কেন গেলেনা গো ! গ্রামের বাড়ি বারো ভুতে দখল করছে গো ! তোমার মা আমাকে তার ভাগ দেবেনা গো !"
কান্নার সাথে সাথে দারোগাবাবুর পিঠে কিল মেরে চলেছেন অনবরত। দারোগাবাবু আর পারলেন না। তিনি ওই সুর নকল করে বললেন," এখনো মরিনি গো। তবে তোমার কিলে নিশ্চয়ই মরবো গো। দয়া করে আমাকে ওঠাও গো। তারপরে জমিসম্পত্তির ভাগ নিয়ো গো।"
উপস্থিত লোকেরা দারোগাবাবুকে উদ্ধার করলেন। এ যাত্রা দারোগাবাবু বেঁচে গেলেন। সামান্য চোট আঘাত ছাড়া আর কিছু হয়নি। আর উদ্ধার হলো প্যাঁকা চোর। প্যাঁকা চোরকে নিয়ে যাওয়া হলো হাজতে। চারদিন ধরে আচ্ছা রকমের ধোলাই খাওয়ার পর প্যাঁকাকে ছাড়া হলো। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণার থেকেও মনের যন্ত্রণায় বেশি কষ্ট পেয়েছিল প্যাঁকা। সে আর ঘরমুখো হয়নি। কোথায় যে গেল তা আর জানা গেল না।
প্যাঁকার  অন্তর্ধানে সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন জগদীশ দারোগা। তিনি সদর্পে বলে বেড়াতে লাগলেন, " আমাকে চ্যালেঞ্জ ! জগদীশ দারোগাকে চ্যালেঞ্জ ! দিয়েছি দেশান্তরি করে।"
আশেপাশের এলাকায় রটে গেল যে প্যাঁকা চোর জগদীশ দারোগার হেফাজতে দিনচারেক থেকেই শুধরে গেছে। সংসারে আর তার মায়ামোহ নেই। কোন এক মহান্তজীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সে এখন পুরোদস্তুর সাধুবাবা। আর হাতিডোবার মহান্তজী এই রটনাকে দস্তুরমতো কাজে লাগালেন। তিনি বললেন," সবই হরির লীলা, আমরা সবাই নিমিত্ত মাত্র। এসেছিল, প্যাঁকা এসেছিল। রাতের অন্ধকারে এসে লুটিয়ে পড়ল আমার শ্রীচরণে। আমি বললাম, বল বৎস কি দরকারে আগমন। প্যাঁকা কেঁদে বলল, সংসারে আর রুচি নেই প্রলয়ের প্রভূ, আমাকে উদ্ধার করুন। আমি মস্তক মুণ্ডণ করিয়ে কাষায় বস্ত্র পরিয়ে দীক্ষা দিলাম। সে চলে গেল হিমালয়ের পথে, তপস্যায়। "
রঘু গোয়ালা দুধ দিতে এসেছিল। সে সবকিছু শুনে বলল," বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না বাবু, আমি কাকভোরে দুধের ড্রাম নিয়ে আসছিলাম  দেখলাম সামনে এক  নাগাবাবা। পাতলা চেহারা, সারা শরীরে ছাইমাখা। আমাকে একগ্লাস দুধ চাইলেন । আমি বললাম, একগ্লাস কেন যত ইচ্ছা দুধ খাও বাবা। বাবাজী দুধ খেয়ে বললেন, তোর দুধ যা মিষ্টি আর টাটকা  খেয়ে শরীর চাঙ্গা হয়ে গেল। তারপর আমাকে আশীর্বাদ দিয়ে বললেন , আমার এই ড্রামের দুধ যে  খাবে তার শরীরে কোন রোগ এসে বাঁসা বাঁধবে না। "                              বলা বাহুল্য সেদিন থেকে রঘু গোয়ালার দুধের বিক্রি বেড়ে গেল। যাদের অম্বলের ধাত পেটে একফোঁটাও দুধ সহ্য হয় না তারাও লিটার লিটার দুধ কিনে খেতে লাগল। এভাবে প্যাঁকার অন্তর্ধান অনেকেরই ব্যবসার বিজ্ঞাপনে পরিণত হল। গল্পও রটল অনেক। সবেমিলে পরিস্থিতি সরগরম হয়ে উঠল।
  জগদীশ দারোগার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্যাঁকার আর বাঁচতে ইচ্ছা করল না। সে মরতে গেল, কিন্তু মরা হল না। চোরসম্রাট চৌর্য্যকুমার প্যাঁকাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল নিজের ডেরায়। চৌর্য্যকুমারের উপদেশে প্যাঁকার মনোবল ফিরে এল। প্যাঁকা শপথ নিল জগদীশ দারোগাকে যেকোনো উপায়ে জব্দ করার।
  অলীকপুর আর হাতিডোবার পাশে যে জঙ্গল আছে সেখানে ডেরাবাঁধল প্যাঁকা। গব্বর সিং এর সাথে মিলিয়ে নিজের নাম রাখল ছপ্পর সিং। ছপ্পর সিংয়ের অনেক সহযোগী জুটে গেল। দলবেঁধে ডাকাতি করতে শুরু করে প্যাঁকা ওরফে ছপ্পর সিং। কিন্তু কপাল তার বিরূপ। সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয় না। সব পরিকল্পনা তখন ঘেঁটে-ঘ হয়ে যায়।
এই তো সেদিন ছপ্পর সিং গিয়েছিল হরি ডাক্তারের বাড়িতে ডাকাতি করতে। গোটা ডাকাত দল দরজা ভেঙ্গে ঢুকছে ডাক্তারের ঘরের ভেতর। হরি ডাক্তারের কোষ্ঠকাঠিণ্যের ধাত ।তিনি প্রতিদিন দুধের সাথে সামান্য জোলাপ মিশিয়ে খেয়ে শুতে যান, এতে সকালবেলায় খুব সহজেই পেট সাফ হয়ে যায়। ছপ্পর সিংয়ের খোচর হরি ডাক্তারের বাড়ি রেকি করতে এসে সেটা দেখে। তার ধারনা হয় বৃদ্ধ বয়সেও শরীর স্বাস্থ্য যৌবন অটুট রাখতে হরি ডাক্তার এই ওষুধ খান বোধহয়। তাই ঘরে ঢুকেই হরি ডাক্তারের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ছপ্পর সিং বলল, "বল, শরীরে তাগদ হবার ওষুধ কোথায় রেখেছিস বল।"
হরি ডাক্তার ঢোঁক গিলে বলল, "ওরকম কোন ওষুধ নেই বাবা প্যাঁকা।"
ছপ্পর সিং রেগে বলল, "কে প্যাঁকা ! আমি ছপ্পর সিং, ডাকু ছপ্পর সিং। আর মিথ্যে কথা বললে বুড়ো সবকটা পেতল তোর মগজে ভরে দেব।"
হরি ডাক্তার দেখলেন যে এরা সত্যিকথা বিশ্বাস করবে না, অতএব মিথ্যা বলে জীবন বাঁচানোয় শ্রেয়। তিনি ওষুধের আলমারির কোনার দিকে রাখা জোলাপের বোতলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন," ওই বোতলটা। "
 বোতলটা বগলদাবা করে ছপ্পর সিং অ্যান্ড কোম্পানি ডেরায় ফিরে গেল। হরি ডাক্তার এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ডাকাতেরা জোলাপের বোতলটা পেয়ে এতটাই আনন্দ পেয়েছিল যে তারা আর কোনো জিনিসে হাত দেয়নি।
                    ডেরায় গিয়ে এক ড্রাম দুধে গোটা বোতলটাই খালি করে দেয়। শুরু হয় আনন্দোৎসব। ছপ্পর সিং আলাদা পাত্রে বেশি পরিমাণে জোলাপ গুলে নিয়েছে। সর্দার হিসাবে বেশি ক্ষমতা তারই হওয়া উচিত। দেখতে দেখতে ড্রাম খালি হয়ে গেল।
      জোলাপের অ্যাকশন শুরু হতেই সবার পেট মোচড় দিয়ে উঠল। ছপ্পর সিং বলল, " শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে অ্যাকশন। এবার দেহে হবে হাতির মতো বল। তারপর জগদীশ দারোগা তোমার খেল খতম।"
        ছপ্পর সিংয়ের দলের এক হিন্দুস্থানি ডাকু তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, " তাগদ নেহি, টাট্টি আ রাহা হ্যা।"   এই বলেই সে মারল এক দৌড়। তারপরেই ছপ্পর সিং পেট হাতে করে ধরে বলল," ঠিক বা। "  গভীর নিম্নচাপে বাংলা আর ভোজপুরি গুলিয়ে গেল ছপ্পর সিংয়ের। ছপ্পর সিং কিন্তু আর দৌড়াতে পারল না, সে দু'পা গিয়েই বসে পড়ল। দলের অন্যান্যদের অবস্থাও সঙ্গীন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলাকাটা বিশ্রী দুর্গন্ধে ভরে উঠল। ভোর হতে হতেই সবার চোখের কোণে কালি পড়ে গেল। আধমরা হয়ে পড়ে রইল সবাই। কার মুখে কে জল দেয়।
                সময়ের সাথে সাথে সবাই সুস্থ্য হলেও ছপ্পর সিংয়ের পেট বিগড়ে গেল। এখন প্রতি আধঘন্টা অন্তর বড় বাইরে যেতে হয়।
এক খোচর এসে ছপ্পর সিংকে খবর দিল যে হাতিডোবায় কিছু একটা ঘটেছে। ছপ্পর সিং বলল, " যা বলবি স্পষ্ট করে বল। তোর আধখাওয়া খবর শুনে আজ আমার এই হাল।"
খোচর বলল, "হাতিডোবার লোকেরা অলীকপুরের উকিলবাবুর ছেলেকে আটকে রেখেছে। বলি দেবে। মহান্তজী ইয়াব্বড় খাঁড়া নিয়ে শান দিচ্ছে। আজ অমাবস্যা। আজকে নরবলি দিয়ে মায়ের কাছে আপনার ধ্বংস চাইবে।"
প্রসঙ্গত বলে রাখি এই খোচরটির তিলকে তাল করার অভ্যাস আছে। এইরকম লোক সর্বত্রই দেখা যায় এবং এরা এদের এই বদভ্যাসের জন্য এমন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা কল্পনা করতেও ভীতির উদ্রেক হয়।

No comments:

Post a Comment

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...