Friday, August 9, 2019

শয়তানের থাবা - শেষ পর্ব // সুব্রত মজুমদার

                                - - সাত--
ভোর হতেই দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুললাম। দেখি একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে অঘোরবাবু। আমাকে  কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে ঢুকে এলেন। এরপর একগাল হেসে বললেন, "পাখি ফুড়ুৎ ধা। উড়েছে ।"
"পাখি উড়েছে মানে !"
অঘোরবাবু এবার পাকাপোক্ত ভাবে বিছানায় বসে পড়লেন, তারপর বিছানার উপর রাখা ডায়েরিখানা তুলে নিয়ে উল্টোপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন, "মৃগাঙ্ক সেন পালিয়েছে। বামাল সমেত হাওয়া।"
খবরটাতে আমি অবাক হলাম না, মৃগাঙ্কবাবুর স্বরুপ যা দেখেছি তাতে এ ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত বৃদ্ধ লামাকে আহত করে পালিয়েছিল মৃগাঙ্ক সেন, এখন পুলিশের ভয়ে গাঢাকা দিয়েছে।
বাথরুম হতে মুখ হাত ধুয়ে এসে ওয়াটার হিটারে কফি বানালাম। কথাটা আপনাদের বলাই হয়নি, ওয়াটার হিটার কাম মিনি কফিমেকারটা আমি শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট হতে কিনেছি। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে অঘোরবাবু বললেন, "এই ডায়েরিটা আপনি কোথায় পেলেন মশাই ?"
আমি বললাম, "সে খোঁজে আপনার কাজ কি ? আমি কোথায় কি পাচ্ছি কি পাচ্ছি না তার   সবকিছুই কি আপনাকে বলতে হবে ?"
আমার কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন অঘোরবাবু।  তিনি আমতা আমতা করে বললেন, "শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন। আমি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইছি না, আসলে হল কি... ডায়েরিটা আমার চেনা। "
" চেনা মানে ! এ ডায়েরিটা আপনি আগে দেখেছেন ? " আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করি। অঘোরবাবু কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক লাগিয়ে বললেন, " বিক্রমের কাছে দেখেছি। কি যেন মার না কি নাম, সেই শয়তানটার কথাই আছে এতে। আরে মশাই এই গ্যাংটকের খুনগুলোও তো ওই শয়তানটাই করছে। "
"এসব জেনেও আপনার মতো ঘুঘু লোক এখানে বেড়াতে এল, - এটাও আমাকে মানতে হবে !"  আমি খানিকটা শ্লেষের সঙ্গেই বললাম।
অঘোরবাবু কফির কাপটা নামিয়ে রেখে একটু ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতেই বললেন," আমি কি আর নিজের ইচ্ছায় এসেছি মশাই ! রীতিমতো ব্রেইনওয়াশ করেছে আমার। পেছনেই আসছি বলে বেপাত্তা। তবে হ্যাঁ, শয়তানের হাত হতে বাঁচতে মহাশক্তিশালী একখান কবচ দিয়েছে। এই দেখুন।" 
অঘোরবাবু তার ঘুনসিতে বাঁধা পেল্লাই সাইজের কবচখানা দেখালেন। কুসংস্কারের বহর দেখে আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল , আমি তৎক্ষণাৎ ঘুনসি হতে কবচখানা ছিঁড়ে নিলাম। অঘোরবাবু আচমকা আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আমিও কৌতুহলী হয়ে কবচটার ভেতরের মালমশলা বের করতে সচেষ্ট হলাম। একটু চেষ্টাতেই কবচ হতে বেরিয়ে এল একটা ভাঁজ করা চিরকূট। চিরকূটটা পড়েই আমার হাসির বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আমি হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লাম।
ব্যাপার দেখে অঘোরবাবু আমার হাত হতে চিরকূটখানা নিয়ে পড়তে লাগলেন, "  'ধাপ্পা ! অঘোরবাবু ইন দ্য ভোগ অফ মা' ।"  এরপর অঘোরবাবু খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ফুঁসতে লাগলেন।  " মানহানির মামলা করব মশাই ! বিক্রমবাবুর সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক শেষ মশাই । বাপের বয়সের একটা মানুষের সাথে এমন রসিকতা কেউ করে..."   
আরো কি কি বললেন তা শোনার সময় আমার ছিল না। আমি ভাবছি একটা কথা, যে ডায়েরির কথা বুড়ো আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা সেটা পাবলিক হয় কি করে ! কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। তাছাড়া বিক্রমের মতো নামজাদা গোয়েন্দাই বা কেন নিজে না এসে অঘোরবাবুকে সিকিমে পাঠিয়ে দিলেন ! অনেক প্রশ্ন দানা বাঁধছে, যেগুলোর উত্তর পাওয়াটা জরুরী। এ এমন একটা জটিল ধাঁধা যেখানে আমার মতো অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন, কেউ জেনে বা কেউ না জেনে।
ভেবেছিলাম অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোব, কিন্তু তা আর হলো না। অঘোরবাবু আমার ঘুমের পিণ্ডি চটকে দিয়েছেন। আমি অঘোরবাবুকে বললাম, "আপনার প্রতিবেশীটি খুবই সেয়ানা, গোলমাল বুঝেই সরে পড়েছে। আর আপনাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এবার মরুন শয়তানের হাতে।"
অঘোরবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকলেন, তারপর  বিপুল ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। "একবার বেঁচে ফিরি তারপর দেখেনেব টিকটিকির বাচ্চাকে। বুঝলেন মশাই, দাপুটে লোক ছিলাম আমি, আপিসেই বলুন আর বাড়িতেই বলুন বাঘে গরুকে একঘাটে জল খাওয়াতাম আমি। আর সেই আমাকেই কিনা.... "      আর বলতে পারলেন না অঘোরবাবু, তার দু'চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আমিও বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত্বনা দিয়ে তাকে শান্ত করলাম।
অঘোরবাবু চলে যেতেই একটা বিশ্রীরকম হাসতে হাসতে বুড়ো ঘরে ঢুকল। সে আসতেই আমি তার উপর আক্রমণ শানিয়ে দিলাম।
" আসুন আসুন মহোদয় ! আপনার আগমনেরই প্রতীক্ষা করেছিলাম। সত্যি করে বলুন তো আপনার এই ভজকট ব্যাপারে আর কতজন জড়িয়ে আছে ?"
আমার কথায় একটুও বিচলিত না হয়ে বুড়ো একপ্রস্থ কান এঁটো করা হাসি হেসে নিলেন। তারপর বললেন, "সময় খুবই বলবান  ভায়া, সময় হলেই সব জানতে পারবেন । আপাত একটা জিনিস দেখাই... "    এই বলে তিনি দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর দরজার বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখেই দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। ছিটকিনি এঁটে বিছানায় এসে বসলেন। এরপর পকেট হতে কয়েকটা ধাতুর টুকরো বের করে সমনে রাখলেন ।
মোট চারটে টুকরো। পেতলের,... উঁহু এ তো পেতল নয়, - নিখাদ সোনা। আর কিছু গুন থাক বা না থাক জিওলজিস্ট বন্ধুর কল্যাণে ধাতু রত্নের ব্যাপারে একটা অভিজ্ঞতা তৈরী হয়েছে।  টুকরোগুলো বিভিন্ন আকৃতির। প্রত্যেকটি টুকরোতেই  বিশেষ খাঁজ আছে। বুড়ো সেই খাঁজ বরাবর টুকরোগুলো জুড়ে দিতেই একটা চক্রের আকার নিল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
বুড়ো বলল, "শয়তানের পাঞ্জার চাবি। যে শয়তানটা অত্যাচার করে বেড়াচ্ছে তার কাছে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় । বৃহদতন্ত্রিকা মতে কোনও এক নির্জন পর্বতগহ্বরে আছে একটা যন্ত্র, যে যন্ত্রকে বিশেষ মন্ত্রে অভিষিক্ত করে এই বিশেষ চাবি ঘোরালেই উন্মুক্ত হবে সময়যন্ত্র, আর এই সময়যন্ত্রই নিয়ে যাবে শয়তানের কাছে। "
আমি বললাম," কিন্তু সেই জায়গাটা কোথায় ? আর আমার এটুকু বাহ্যজ্ঞান আছে যা দিয়ে সহজেই বুঝতে পারি যে আপনার মানসিক সুস্থ্যতা কোন পর্যায়ে। এটা জিনগত রোগ মৈত্রমশাই, আপনার বাবার থেকে আপনি পেয়েছেন। "
বুড়ো কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমার দিকে চেয়ে বললেন," শশাঙ্কশেখর মৈত্রের কোনও মানসিক ব্যাধি ছিল না, সেটা আমি যথাসময়ে প্রমাণ করে দেব। কোনও ভাবেই তিনি হ্যালুসিনেটিং করছিলেন না। আর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আছে ইয়ামথাং-এ। "
" চলুন, কালকেই তো ইয়ামথাং যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, মৃগাঙ্কবাবু পালিয়েছেন।" আমি তার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিলাম। বুড়োটা এবার একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল," মৃগাঙ্কবাবু শয়তানের পূজারী, উনি চাবি না নিয়ে কোত্থাও যাবেন না। অতএব আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, অঘোরবাবুর পহেলা নম্বর শত্রু এখনি বিদায় নিচ্ছেন না। "
আমি অবাক হয়ে বললাম," অঘোরবাবুর কেসটাও জানেন ! তাহলে আর বাকি কি রইল ! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনিই নাটের গুরু। দেখুন মশাই, আমার সাতকুলে কেউ নেই, ঝাড়াহাতপা' মানুষ আমি, তাই আমার কিছু হলেও দুনিয়ার এমনকিছু একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হবে বলে মনে করি না। তাই  কাল যাচ্ছি।"
পরেরদিন ইয়ামথাং এর উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। আমাদের গন্তব্য ইয়ামথাং, ফ্লাওয়ার ভ্যালি আর জিরো পয়েন্ট। সকাল সকাল গাড়ি রওনা দিল।' ইন্ডিয়ান বাইপাস রোড' বরাবর চলতে লাগলো গাড়ি। যাত্রীদের মধ্যে কেবল মৃগাঙ্কবাবু নেই। অঘোরবাবু আজ আমার পাশেই বসেছেন, আর নিয়মিত বকরবকর করে চলেছেন। একটা বাঁক ঘুরতই অঘোরবাবু আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে উঠলেন, "ইয়াআআ...! মেঘের ভেলায় ভেঁসে চলেছি মশাই... জীবন আমার সার্থক হলো। এখন যদি শয়তানের হাতে মরেও যাই তবুও কোনো আফসোস নেই মশাই !"  আনন্দের আতিশয্যে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সত্যিই খুব মায়াময় লাগছে। এত কাছ দিয়ে মেঘেদের দল উড়ে যাচ্ছে যে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের গাড়িটা মেঘের ভেলার উপরে সওয়ার হয়ে ভেঁসে চলেছে অনন্তের উদ্দেশ্যে। এ অনুভূতি একমাত্র সেই বুঝতে পারবে যার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এ সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত। ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির বর্ণনা কবিও করতে পারেন না। আর উপনিষদে তো জগৎস্রষ্টাকেই   কবি বলে বর্ণনা করা হয়েছে , তিনি কবি না হলে এই সুন্দর সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব !
ইয়ামথাং পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাঝে দু'বার গাড়ি থেমেছিল একবার  টিফিনের জন্য আরেকবার মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। সকালে যখন প্রাতরাশের জন্য গাড়ি থামল তখন নেমেই বুড়োর খোঁজ করলাম। বুড়োর দেখা পেলাম না। দেখলাম অঘোরবাবু একটা কফির কাপে ফুঁ দিচ্ছেন আর আনমনা হয়ে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে। আমি কাছে যেতেই আমার দিকে একবার চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। আমি বললাম, "কিসের এত রাগ ?"
"রাগ নয় অ্যাভোয়েড, আপনাকে অ্যাভোয়েড করছি মশাই । আমি চাইনা আপনার কিছু হোক। আর ও ডায়েরিটা আপনি আর খুঁজে পাবেন না, ওটি আমি চুরি করে এনেছি। আপনি এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামিয়েন না।"   অঘোরবাবু মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিলেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। অঘোরবাবুর পাশের টেবিলে বসে পড়লাম।  ডিম সেদ্ধ, বাটার টোস্ট আর কফি দিয়ে জলযোগ সারলাম। দুপুরেও তাই, অঘোরবাবু আর আমার কাছাকাছি হলেন না। দুপুরের খাওয়ার পর বুড়োর সাথে দেখা হল। তিনি শুধু একটাই কথা বললেন, "রাতে কথা হবে।"
 রাতেরবেলা ইয়ামথাং থেকে কিছু দূরে একটা অস্থায়ী ছাউনিতে থাকার ব্যবস্থা হল। উদ্দেশ্য একটাই, - রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ছাউনিতে শীত নিবারণের সবরকমের বন্দোবস্ত আছে, লেপ কাঁথার অঢেল বন্দোবস্ত। প্রত্যেকটি ছাউনিতেই একটা করে হ্যারিকেন ঝুলছে, নিকষ অন্ধকারে এটাই একমাত্র আলোর উৎস। সন্ধ্যা হতে চলল গান-বাজনা আর হইহুল্লোড়। আট নাম্বার ছাউনির বিমল বসাক গান ধরলেন।
                        দোলনচাঁপায় লাগল দোলা মনকাড়া কোন বাঁশির সুরে,
                        সুরের ছোঁয়ায় কান্না পাওয়ায় বিবাগি মন রয়না ঘরে।
                        আজ শাওণের বাদলরাতে নাইকো নিঁদ আঁখিপাতে
                        সুরের সখা দিলে দেখা, মন যে আমার কেমন করে।
                         ঝড়ের রাতে হে দরদী গাইলে কি সুর, - মাতল নদী !
                        সুরের মোহে অলস দেহে লুটায় কুসুম ভুমির পরে।
                          এলেই যখন হে মোর সখা, পড়ল তোমার চরণরেখা
                           তখন একা কেমনে কাটে দীপনেভা মোর এই বাসরে !

অঘোরবাবু  বিভোর হয়ে তাল ঠুকতে লাগলেন, যেন শ্রাবণের এই রাতে ঝড়ের বেশে এসেছে তার পরাণপ্রীয়, - সে কি মৃত্যু ! এর উত্তর অঘোরবাবুরও জানা নেই।
বাইরে প্রাঙ্গনে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। কষা কষা মুরগির মাংস আর রুটি, সঙ্গে আচার আর রসগোল্লা। খাওয়ার পর ছাউনিতে ফিরে গেলাম। আমি আর বুড়ো, দুজনেরই শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে একই ছাউনিতে। বুড়ো গলা পর্যন্ত  কম্বলটা টেনে নিয়ে বলল, "এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন, ঠিক মাঝরাতে বের হবো।" 
মাঝরাতে একটা ফিসফিসে আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। "ও মশাই শুনছেন, উঠে পড়ুন,.."
চোখ মেলে দেখলাম বুড়ো রেডি। আমিও তৈরিই ছিলাম, এত শীতে নতুন করে পড়ার মতো আর কিছু নেই, শুধু মাফলারটা নিয়ে নিলাম। বুড়োর পেছন পেছন এগিয়ে চললাম টর্চের আলো সম্বল করে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা ছোট্ট মতো পাহাড় চোখে পড়ল। সাধারণ পাহাড়ের সাথে এই পাহাড়টার একটা পার্থক্য আছে, এই পাহাড়টা লুমিনাস অর্থাৎ স্বপ্রভ। এগিয়ে চললাম পাহাড়টার দিকে।
পাহাড়টার কাছাকাছি আসতেই দু'তিনজন কালো পোষাকপরা লোক আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সতর্ক না থাকায় আমি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম, পাথরে লেগে কপালের কিছুটা কেটে গেল। এদিকে বুড়ো লোকগুলোর আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। বুড়ো যে ক্যারাটে জানে তা জানতাম না। ক্যারাটের এক এক প্যাঁচে আততায়িরা বেসামাল হয়ে পড়েছে। একটা সময় দেখলাম সবাই ভুলুণ্ঠিত, বুড়ো হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু এ কি ! বুড়োর পাকা চুল কই ? পাহাড়ের স্বয়ংপ্রভ আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বুড়োর একমাথা কালো কুচকুচে চুল। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বুড়ো বলল, "বয়স কমে যাওয়াটা এখন কোনও ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হল আমাদের অভিযান। তাছাড়া অনেকরকম বয়স কমানোর অ্যাপ বেরিয়েছে আজকাল, বয়স বাড়ানো কমানোটা আজকাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।"  হাসতে হাসতে বুড়ো বলল। না, এখন থেকে আর বুড়ো বলে অবজ্ঞা নয়, বরং ইন্দ্রজিৎবাবু বলেই সন্মোধন করব।
ইন্দ্রজিৎবাবুর কথায় আমি সন্তুষ্ট না হলেও কথা বাড়ালাম না, এগিয়ে গেলাম পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের একদম সামনে এসে ইন্দ্রজিৎবাবু  থমকে দাঁড়ালেন। এরপর পকেট হতে চক্রটা বের করে পাহাড়ের দিকে তুলে ধরলেন, সঙ্গে সঙ্গে  পাহাড়টা প্রবলভাবে দুলে উঠলো। টাল সামলাতে না পেরে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় দুটো হাত আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দেখলাম অঘোরবাবু, আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন।
আমি বললাম, "আপনি !"
অঘোরবাবু চোখবুজেই উত্তর দিলেন, "আপনাদের ফলো করেছিলাম। মারপিটের সময় আমি একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম মশাই। দেখলাম বিক্রমবাবু কালো কাপড়পরা লোকগুলোকে ঢিশুমঢাশুম দিচ্ছেন , আর আপনি মশাই মাটিতে পড়ে 'চিঁ চিঁ' করছেন।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "বিক্রমবাবু আবার কোথা থেকে এলেন ?"    পাশ থেকে জবাব এল," এই অধমই ইন্দ্রজিৎ মৈত্র ওরফে বিক্রম মুখোপাধ্যায় ওরফে পাগলা বুড়ো... "
আরো কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ততক্ষণে পাহাড়ের একটা অংশে  গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, আর সেই ফাটলদিয়ে সাতরঙা আলো বেরিয়ে আসছে। বিক্রমবাবু সেদিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও তাকে অনুসরণ করলাম।
পাহাড়ের ফাটলটা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। যত ভেতরে যাচ্ছি ঠাণ্ডা ততই বাড়ছে। গুহাপথের দু'পাশে সার দিয়ে মানুষের কঙ্কাল পড়ে আছে। এসব দেখে অঘোরবাবু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, "কিছু অন্যায় করে থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন মশাই, আমি জানি আর দেশে ফেরা আমার হবে না। বিয়ে সাদী তো করিনি, আমি না ফিরলে আমার টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি কোনও অনাথ আশ্রমে দান করে দিয়েন মশাই । বিদায়..."   অঘোরবাবু অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি আর বিক্রমবাবু দুজনে মিলে অঘোরবাবুকে কোনক্রমে টেনে নিয়ে চললাম।
অনেকটা যাওয়ার পর দেখলাম সামনে একটা দেওয়াল,  দেওয়ালের গায়ে বিকটাকৃতি দানবের মুখ আঁকা। বিক্রমবাবু তার হাতে থাকা চক্রটাকে দানবমূর্তীর কপালের খাঁজে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট আওয়াজ করে একটা কক্ষাকৃতি যন্ত্র বেরিয়ে এল, যন্ত্রটার ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম সবাই।
যন্ত্রের ভেতরটা স্বচ্ছ স্ফটিকে তৈরি ও স্বপ্রভ। কোথাও কোন খাঁজ নেই। আমাদের প্রবেশকরামাত্র একটা সন্মোহক আওয়াজ শোনা গেল, তারপরে আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান হল তখন দেখলাম আমরা  একটা পুরানো মন্দিরের মেঝেতে পড়ে আছি, আর সেই মন্দিরটা ডুবে আছে অন্তহীন জলের অতলে। চারদিকে শুধু জল আর জল, আর মন্দিরটা রয়েছে একটা এয়ারপকেটের মধ্যে। অঘোরবাবুর জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বিক্রমবাবু এবার নিস্তবদ্ধতা ভঙ্গ করলেন, তিনি বললেন, "মার হল শয়তান, যতকিছু অজ্ঞানতা মায়া আর পাশবিকতার প্রতীক হলেন তিনি । এই মারের কোনও বিনাশ নেই। যেমন অন্ধকারের কোনও বিনাশ নেই, আলো কেবল অন্ধকারকে অবদমিত করে রাখে মাত্র। অন্যদিকে দেখতে গেলে অন্ধকার আছে বলেই আলোর অস্তিত্ব আছে। তাই মার আছেন বলেই আমরা শুভত্ব আর মঙ্গলত্বের মূল্য অনুধাবন করতে পারি। তাই মারকে অবদমিত করতে হবে, - আর এই কাজ একমাত্র সম্ভব যার পক্ষে তিনি হলেন মহাকাল। এই মহাকালই হল সময়। সময় সকল রোগের ঔষধ, সকল সমস্যার সমাধান। জাগাতে হবে মহাকালকে। "
বিক্রমবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃগাঙ্কবাবু। সম্ভবত আমাদের চোখ এড়িয়ে তিনি আমাদের সাথেই সময়যন্ত্রে করে এখানে এসেছেন। মৃগাঙ্কবাবুকে আর স্বাভাবিক মানুষের মতো দেখাচ্ছে না, তার পাশবিক চেহারা আমার রোমে রোমে আতঙ্কের শিহরন তুলেছে। কি বিভৎস !
"তার সূযোগ তুই পাবি না রে টিকটিকির বাচ্চা। আমার ঘর হতে ডায়েরি আর ম্যাপখানা চুরি করে কি ভেবেছিলি ? ভেবেছিলি ডেভিডকে তুই হারিয়ে দিবি !..." মৃগাঙ্কবাবুর তীব্র আক্রোশ ঝরে পড়ল বিক্রমবাবুর উপর। কিন্তু কিছু ভেবে ওঠার আগেই বিক্রমবাবুর একটা ক্যারাটের প্যাঁচে ধরাশায়ী হয়ে পড়ল মৃগাঙ্ক সেন। মেঝেতে পড়ে যেতেই আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল মৃগাঙ্ক সেন কিন্তু উঠে দাঁড়াবার  আগেই ঘাড়ের পাশটাতে দুটো আঙুলের সাহায্য একটা মোচড় দিল বিক্রম। মৃগাঙ্ক সেন নিথর হয়ে পড়ে রইল।
বিক্রমবাবু এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, আমি তাকে অনুসরণ করলাম। দু'দশ পা এগিয়েই মন্দিরের অ্যান্টিচেম্বার। সেখানকার বাতাস যথেষ্ট শীতল, পদ্মফুলের গন্ধে গোটা কামরা ভরে উঠেছে। কামরার পেছনের দেওয়াল লাগোয়া একটা বরফের বেদীতে ধ্যানস্থ এক সন্ন্যাসী। হঠাৎ আমার স্মৃতিতে এসে গেল ডায়েরিতে বর্ণিত সেই সাধুবাবার কথা। হুবহু এক।
 সাধুবাবা ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, "তুমনে কর দিখায়া। হাজারো সালো সে ম্যায়নে ইহা কয়েদ থা। মেরে মুক্ত হোনে কে সাথ সাথ ও শয়তান হামেশা কে লিয়ে মিট জায়েগা।"
এরপর সাধুবাবা উঠে দাঁড়ালেন। আমরা চললাম সময়যন্ত্রের কাছে। দেখলাম মন্দিরের মুখ্যভাগে  সময়যন্ত্রটি দাঁড়িয়ে। আমি, সাধুবাবা, বিক্রমবাবু আর অঘোরবাবু সময়যন্ত্রে চড়ে চললাম বর্তমানে। আর মৃগাঙ্ক সেন পড়ে রইলেন হাজার বছর পেছনে।
                                                                   --উপসংহার - -
এরপরের কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত। সাধুবাবার কাছে বিদায় নিয়ে ইয়ামথাং - এ ফিরে এলাম। জিরো পয়েন্টে গিয়ে খুব আনন্দ হলো। গ্যাংটকে ফিরে আমি আর অঘোরবাবু বিক্রমবাবুকে চেপে ধরতেই সমস্ত ঘটনা বেরিয়ে এল। বিক্রমবাবু   বললেন, " আরে বলছি রে ভাই বলছি। ঘটনার শুরুটা মৃগাঙ্ক সেনের ঘর হতে। মৃগাঙ্ক সেন ওরফে কেশব জালান ওরফে জগাই দাস ওরফে ডেভিড হলো একজন সাইকোকিলার। খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় সে। এদিকে যে জেলে সে বন্দি ছিল সেই জেলে আসে নতুন এক কয়েদি - - তান্ত্রিক মোহাবেশ।  এই তান্ত্রিক মোহাবেশই মৃগাঙ্ক সেনকে ফাঁসির হাত হতে রক্ষা করেন তার তন্ত্রশক্তির সাহায্যে। বিনিময়ে শশাঙ্কশেখরের বাক্স হতে ডায়েরিখানা চুরি করে আনে মৃগাঙ্ক সেন।
শশাঙ্কশেখর বাবুর ছেলে ইন্দ্রজিৎ মৈত্র ডায়েরিটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ডায়েরিটা চুরি যেতেই তিনি  আমার স্মরণাপন্ন হন। আমি একদিন রাতে মৃগাঙ্কবাবুর গোপন ডেরা হতে ডায়েরিটা উদ্ধার করি। তারপর ডায়েরিখানা পড়ে বুঝতে পারি যে এই রহস্যের সমাধান আমাকেই করতে হবে। তাই অঘোরবাবুকে সিকিমের পথে রওনা করিয়ে নিজে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে ওই একই ট্রেনে রওনা দিই। তারপরের ঘটনা তো সবারই জানা। "
" আর সেই শয়তানের থাবার কি হল ? " আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। বিক্রমবাবু বললেন," তান্ত্রিক মোহাবেশই হল সেই শয়তান। তার হাতে সময় ছিল খুব কম। সময়ের ওপারে যে মন্দিরে সাধুবাবা বন্দি ছিলেন সেই মন্দিরেই ছিল স্ফটিক ড্রাগন, আর এই স্ফটিক ড্রাগন না পেলে তান্ত্রিক মোহাবেশের অস্তিত্বই থাকত না বেশিদিন। এজন্যই সে এরকম ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যাতে সেই সূযোগে সময়যন্ত্রের চাবি খোঁজার কাজ সহজ হয় । আর শশাঙ্কশেখরবাবুর স্মৃতিশক্তি চলে যাওয়া ও অকাল মৃত্যুর কারণও এই তান্ত্রিক মোহাবেশ, সে গল্প আপনি ডায়েরিতেই পেয়ে যাবেন । অঘোরবাবু, ডায়েরিটা সায়কবাবুকে দিয়ে দিয়েন। "
অঘোরবাবু একটাও কথা বললেন না। তার এই নৈশব্দ ফেরার সময়েও বহাল রইল।
 কলকাতায় ফেরার পর বিক্রমের সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। এখন আর সন্মন্ধটা আপনিতে আটকে নেই, আমরা এখন খুব ভালো বন্ধু।
                                                                                                                   ~সমাপ্ত~

শয়তানের থাবা - পর্ব ৫ // সুব্রত মজুমদার


                                                                             - - ছয় - -
 যখন ঘুম ভাঙল তখন হাতঘড়িতে ভোর  পাঁচটা। ঘুম ভেঙ্গে চারদিকটা দেখেই আমার চক্ষুস্থির, সাধুবাবা কই ? সাধুবাবা বা তার ধুনির চিহ্নমাত্রও নেই। ধুনি তো ধুনি, আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানটা একটা শ্মশানভূমি, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মড়ার হাড়গোড় ভাঙ্গা কলসি আর ছাইয়ের স্তুপ। এ কোথায় এলাম আমি ? চোখ কচলাবার জন্য হাতটা মুখের কাছে আনতেই  নাকে এল ছাতু আর গাঁজা বীজের চাটনির ঘ্রাণ।
উঠে দাঁড়ালাম। চারদিকে ভালো করে দেখতেই বুঝতে পারলাম শ্মশানের পাশে যে পাহাড় আছে সেটা পেরোলেই কোনো জনবসতি পাওয়া যাবে। শ্মশান হতে একটা সরু রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। যেহেতু আমি পথ হারিয়েছি তাই ওই জনবসতিতে পৌঁছানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হাঁটতে লাগলাম।
রাস্তা বরাবর হাঁটতে লাগলাম। পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে যেতেই পাহাড়ের অপরদিকে কতগুলো কাঠের বাড়ি চোখে পড়ল। পাহাড়ের গায়ে ঘরগুলোকে ছবির মতো লাগছিল। কাছাকাছি যেতেই একজন বৃদ্ধ  আমার দিকে এগিয়ে এলেন । বেঁটেখাটো, মুখমণ্ডলে মঙ্গোলয়েড ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন, "আসুন সাবজী, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। ভেতরে আসুন।ধীর সে... "
অবাক হলাম, বলে কি লোকটা, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ! কি সব হচ্ছে ! আমার মাথাটা আর কাজ করছে না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। যাইহোক বৃদ্ধের পেছন পেছন একটা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে দোতলা একটা কাঠের বাড়ির সামনে হাজির হলাম। বাড়িটার রং কিঞ্চিৎ চটে গেছে, ছাদের উপরে  তিব্বতি ভাষায় মন্ত্রলেখা পতাকাগুলো উড়ছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। দোতলার উপরে কাঠের একটা তক্তপোষে আধময়লা বিছানা পাতা, দেওয়ালে বোধিসত্ত্ব ও ভৈরবের ছবি আঁকা।
কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বৃদ্ধ বলল, " নিঁদমে খোয়াব আয়াথা। খোয়াবেই নংগালামা আপনার কথা বলল। বলল কি আপনি তকলিফে আছেন, আপনার দেখভাল কোরতে হোবে।"
আমি বললাম, "আপনার 'নাংগা লামা' কে তা আমি জানি না, তবে কাল রাতে এক সাধুবাবা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।"   এরপর আমি তাকে কাল রাতের সমস্ত ঘটনা বললাম। সব শুনে বৃদ্ধ তার দু'কানে হাত দিয়ে জিভ কেটে বললেন," ওহি তো নাংগা লামা আছে। ভগবান আছে সাব। আপনি খুব ভাগ্যবান আছেন যে উনকি দর্শন পাইয়েছেন। "
এরপর বৃদ্ধ যা শোনালো তা অত্যন্ত লোমহর্ষক। এই নাংগা লামাকে একমাত্র স্বপ্নে ছাড়া বাস্তবে কেউই দেখেনি। এই এলাকার প্রত্যেক বাড়িতে তাঁর পূজা হয়। ইনি কৈলাশ পাহাড়ে বাস করেন, তবে শিব ঠাকুরের বারণ থাকায় কৈলাশের প্রবেশদ্বারের বাইরেই থাকতে হয়।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে কৈলাশ পর্বত মানুষের অগম্য। কোনও জীবিত প্রাণী কৈলাশে পা রাখতে পারেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও তাও ধর্মে এই পর্বত খুবই পবিত্র। কথিত আছে একমাত্র একজনই কৈলাশে পা রাখতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন তিব্বতি কবি ও সাধক 'জেৎসুন মিলারেপা' ( རྗེ་བཙུན་མི་ལ་རས་པ ) । ইনি একজন সিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন। গোটা তিব্বত ও সিকিমে তিনি ভগবানের মতো পূজা পান। এই মিলারেপার গুরু ছিলেন মারপা, যিনি বাঙালি তান্ত্রিক সাধক শ্রীজ্ঞান অতীশের শিষ্য দ্রমশনের প্রবর্তিত বঙ্গীয় তন্ত্র সাধনার ধারা মেনে চলতেন।
বৃদ্ধ দেয়ালের একটা কোণে একটা দেওয়াল চিত্র দেখিয়ে বললেন, "এ হে নাংগা লামা।"
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এ তো একদম অবিকল আমার দেখা সেই সাধুবাবা। অজান্তেই আমার দু'হাত জোড় হয়ে এল শ্রদ্ধায়।
বৃদ্ধের বাড়িতে সেদিনটা থাকলাম। চিঁড়ের সাথে টম্যাটো স্যুপ আর লাল রঙের ঝোলশুদ্ধ  ভেড়ার মাংস দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ  সারলাম। সারাদিন ঘুমোলাম, শরীরের সব ক্লান্তি যেন ঘুচে গেল। রাত্রিবেলায় চিনা মাটির পাত্রে করে এল ভেড়ার মাংস আর গরম গরম চাপাটি সঙ্গে তিব্বতি চা। এই তিব্বতি চায়ের বিশেষত্ব হল এটি আদপেই কোনো পানীয় নয়। ইটের মতো আকার দেওয়া শুকনো চা কে গুঁড়ো করে গরম জলে মেশানো হয়, তারপর সেই মিশ্রণে মাখন, ভেড়ার মাংস নুডলস আর লবণ মিশিয়ে রান্না করা হয়। এটা খেতে খুব সুস্বাদু না হলেও বেশ পুষ্টিকর আর শক্তিবর্ধক।
পরেরদিন সকালে বৃদ্ধ  আমাকে একটা খচ্চরের পিঠে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে চলল গ্রামেরই একটা ছেলে, - তাসি। গ্যাংটক পর্যন্ত পৌঁছে তাসি বিদায় চাইল। আমি তার হাতে একটা টাকা দিয়ে বললাম, "রাস্তায় কিছু খেয়ে নিয়ো।" তাসি হাসিমুখে বিদায় নিল।
রাজমহলে পৌঁছেই রাজার সাথে দেখা করার অনুমতি চাইলাম। রাজার ব্যক্তিগত সচিব বামনদেবের চিঠিটা নিয়ে রাজার কাছে গেল। কিছুক্ষণ পর সচিব জানালেন যে রাজামশাই আমাকে ডেকেছেন। সচিবের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম।
রাজা নমগিয়াল, খুব হাসিখুশি মানুষ। দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলার পর তিনি আমাকে নিয়োগ করলেন। এই স্বল্প সময়ে যা বুঝলাম তাতে এটা পরিষ্কার যে রাজামশাই সুপারিশের চেয়ে নিজে বাজিয়ে নিতেই বেশি পছন্দ করেন। আমাকে তার পছন্দ হয়েছে। রাজনির্দেশে আমার জন্য ঘরের ব্যবস্থা হল। পাহাড়ের কোলে কাঠের বাড়ি, সঙ্গে একজন সর্বক্ষণের কাজের লোক 'শেরিং' ।  জল তোলা, আনাজপাতি কিনে আনা, কাপড় জামা কাচা ইত্যাদি সব কাজই শেরিং করে। রান্নার কাজটি আমি নিজের কাঁধেই নিয়েছি। আমার রান্নাকরা খাবার খেয়ে শেরিং একটা বিশেষ মুখভঙ্গি করে যেটা  ভালো না খারাপ তা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আমি জিজ্ঞাসা করলে সে একগাল হেসে জবাব দেয়, "বহুত বড়িয়া সাবজী ! একদম চকাচক !"
কিছুদিন দফতর বিহীন আমলার মতো কাটানোর পর একদিন রাজামশাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি যেতেই তিনি বললেন, "আগামী পূর্ণিমায় আমি শিকারে বেরোবো, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন।"  প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো রাজা নমগিয়াল ইংরেজি পড়া লোক, বাংলা আর তিব্বতি ভাষাতেও তার প্রগাঢ় জ্ঞান। আমি মাথা নেড়ে সন্মতি জানালাম।
পূর্ণিমার রাত, থালার মতো বড় একখানা চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্নায় চারদিক প্লাবিত। আমি আর রাজামশাই দুজনে ঘোড়ার পিঠে, বাকি সেপাই সান্ত্রিরা পায়ে হেঁটে সাথে সাথে চলেছে। পাহাড়ী জঙ্গলে চিতাবাঘ আর বুনো-শুয়োরের খুব উপদ্রব, আশাকরি একটা না একটা আমাদের বন্দুকের সামনে আসবেই। রাজামশাই খুব আত্মবিশ্বাসী। আমার অবশ্য বাঙালি বিশ্বাস, কয়েকশ' ঠাকুর দেবতাকে ডাকার পরেও আত্মসন্তুষ্টি হয় না।
     একটা পরিস্কার মতো জায়গায় সবাই এসে জড়ো হলাম। সেপাই সান্ত্রিরা তাদের মোমো চিড়া নুডল ইত্যাদির প্যাটরা খুলে আহার করতে লাগল। দুজন  রাজসেবক একটা চাদর পেতে তাতে বিভিন্ন খাবারের পাত্র রাখতে লাগলেন। রাজভোগই বটে, কাবাব কোর্মা কোফতা মোমো চিকেন চাপাটি চা,..... কি নেই !  সামান্য কিছু খেতেই আমার পেট ভরে এল। রাজামশাইও তেমন কিছু খেলেন না। খাওয়ার শেষে মাচা বাঁধা হল। মাচার সামনে চিতাবাঘের ফাঁদ, আর তাতে টোপ হিসাবে নধর একটা পাহাড়ী ছাগল।
সময় যেন পেরোতেই চাইছে না, মাচার উপর বসে ফাঁদের দিকে চেয়ে বসে আছি। এইভাবে কত সময় পার হলো বলতে পারব না। একটা সময় একটু ঢুলুনি এল, ঘুমের ঘোরে হাত থেকে বন্দুক প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ঠিক সেসময় একটা রামচিমটি খেয়ে তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। চোখমেলে তাকাতেই দেখলাম ছাগলের খাঁচার ভেতরে কি একটা নড়াচড়া করছে। ছাগলটি ইতিমধ্যেই 'ম্যা ম্যা' শব্দে  চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। আমরা দুজনেই গুলি চালালাম। গুলির শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। কিন্তু  আশ্চর্যের ব্যাপার একটা গুলিও জন্তুটার গায়ে লাগল না। জন্তুটি একসময় খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে সেপাইদের আক্রমন করল। সেপাইরা তিরধনুক আর বল্লম হাতে সেই জন্তুটার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না, অধিকাংশই বেঘোরে মারা পড়ল, বাকিরা পালিয়ে প্রাণে বাঁচল।
ইতিমধ্যেই জন্তটি আমাদের মাচার নিচে এসে পড়েছে। জ্যোৎস্নার আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার অবয়ব। কালচে বানরের মতো চেহারা, মাথায় দুটো শিং আর ভয়ঙ্কর মুখমণ্ডল। মনে হচ্ছে যেন মূর্তিমান শয়তান উঠে এসেছে নরকের কোন অসুরক্ষিত অর্গল ভেদ করে। রাজামশাই জ্ঞান হারালেন। আমি ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছি, ঠিক এমন সময় কানে এল ঘোড়ার প্রবল হ্রেষারব। দেখলাম একটা সাদা ঘোড়া ছুটে আসছে আমাদের দিকে। ঘোড়ার আওয়াজে শয়তানের বাচ্চাটা বিচলিত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে তারপর হঠাৎ এক লাফে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এরপর আর জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি আমার বিছানায় শুয়ে, মাথার কাছে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে শেরিং। শেরিং যা বলল তা এই যে সেই রাত্রে একটা সাদা ঘোড়া আমাকে আর মহারাজকে পিঠে করে নিয়ে আসে। মহারাজ এখন সুস্থ্যই আছেন।
ঠিক এর পর হতেই একটা সমস্যা দেখা দিল, - ডাক্তারের মতে মানসিক স্ট্রেস হতে এই সমস্যার উৎপত্তি । ডাক্তারের মতামতকে আমি মানি না। এখনও আমি যথেষ্টই সুস্থ্য। আসলে কিছু কিছু ব্যাপার এমনই আছে যেগুলো সাধারণ বুদ্ধিতে চট করে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। যেমন ধরুন সাধুবাবার ঘটনাটা, এই ঘটনার কিয়দংশও কি আপনাদের বিশ্বাস হয়েছে ?  জানি হয়নি। হতে পারও না।
ডাক্তার বললেন, "কিছু মনে করবেন না মৈত্রমশাই, আপনার এই মানসিক সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগেই। পাহাড়ী ওয়েদার, অল্টিটিউড আর অক্সিজেনের ঘাটতি এই রোগে অণুঘটকের কাজ করেছে। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ওষুধ খান আর বিশ্রাম করুন।"
আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি যা যা দেখেছি তা অলৌকিক হলেও আমার স্বকপোলকল্পনা মোটেই নয়। আমি পাগল নই ...... আমি পাগল নই ...... '
      এই পর্যন্ত পড়ার পর ডায়েরিটা বন্ধ করলাম। বেশ ঘুম পাচ্ছে। কালকে কোথাও যাবার নেই, তাই একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোবো। ডায়েরিটার যেটুকু পড়লাম তাতে আমি নিশ্চিত শশাঙ্কশেখরবাবু হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন। তিনি স্বীকার করুন আর নাই করুন সাধুবাবা আর শয়তানের বাচ্চার গল্পটা যে তার মনের কোণের আদিম আতঙ্কের একটা সিনেমামাটিক রুপ তা বলাই বাহুল্য। ডায়েরিটা পড়ার পর বুড়োর মানসিক প্রকৃতিস্থতা নিয়েও আমার সন্দেহ জাগছে। আচ্ছা এটা কি মৈত্র ফ্যামিলির জিনগত ? - ভবিষ্যতই বলবে।

শয়তানের থাবা - পর্ব ৪ // সুব্রত মজুমদার


                                                                               - - পাঁচ--
এরপরে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে পুঁথির কথাও আমার মন হতে অপসৃত হয়ে গেছে। চাণ্ডেলের রাজার কাজ হতে অব্যাহতি নিয়ে কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম।  বাড়িতে আমার মন বসে না। সারাদিন পড়াশোনা করি আর ছেলে বৌয়ের সাথে ঝগড়া, - বাস, এই নিয়েই দিন কাটছিল।
একদিন দুপুরবেলা, সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি  সমরাঙ্গ সূত্রের একটা পুঁথি নিয়ে কপি করছি। একটু ঢুলুনিও এসেছিল। হঠাৎ একটা বাজখাই কন্ঠে ঘুমের রেশটা কেটে গেল।
"অলখ্ নিরঞ্জন ! অলখ্ নিরঞ্জন ! অলখ্ নিরঞ্জন !"
তাকিয়ে দেখলাম জানালার ওপারে একটা ছাইমাখা মুখমণ্ডল। মাথায় বিশাল জটা বুক বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। কপালে ত্রিপুণ্ডক। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে এই নাগাবাবাকে দর্শন করে আমার একদম সসেমিরা অবস্থা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্বিত ফিরে এল নাগাসাধুর কথায়।
" বেটা থোরা পানি মিলেগা ?"
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সাধুবাবা ভেতরে এলেন না। অগত্যা ঠাকুরঘর হতে একটা পেতলের ঘটি এনে কুয়ো হতে ঠাণ্ডা জল তুলে আনলাম। কিন্তু অতিথি নারায়ণ, তাকে তো আর শুধু জল দেওয়া যায় না, তাই একটা রেকাবিতে করে কিছু গুড় বাতাসও নিয়ে এলাম। জল খেয়ে খালি ঘটিটা  নামিয়ে রাখলেন সাধুবাবা ।
"তু খুব সচ্চা আদমি আছিস বেটা। পরন্তু বেটা তেরা  আচ্ছা সময় তেজিসে খতম হো রাহা হে। করিব করিব সাত সাল হ্যা তেরে পাস। উস্কে বাদ ও আপদা আয়েগা।"   সাধুবাবা গম্ভীর স্বরে বললেন। তার কথা আমি খুব একটা বিশ্বাস করলাম না। হয়তো এর পরেই তাবিজ কবচ নিতে বলবে।
আমি বললাম," এ জীবনটাতো বিপদ আপদ করেই পেরিয়ে গেল, নতুন কিছু থাকলে বলুন বাবা। "
আমার কথায় হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন সাধুবাবা। তারপর জটার ভেতর হতে একখানা ভাঁজকরা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলেন। সাধুবাবার বিকট অট্টহাসিতে আমার নার্ভ দূর্বল হয়ে উঠেছে। হাত থর থর করে কাঁপছে। সেই কম্পিত হাতেই আমি কাগজটা নিলাম। একটা তুলোট কাগজ, কোনও জায়গার মানচিত্র বোধহয়। সেই ম্যাপের জায়গায় জায়গায় চক্রের চিহ্ন দেওয়া আছে।
সাধুবাবা বললেন, "তেরে পাস যো শয়তানকা কিতাব হ্যা না উসকি অন্দরে ইয়ে রাখ দে বাদ মে কাম আয়েগা।"   অবাক গেলাম, কি করে জানলেন ইনি আমার পুঁথির কথা ! ... আমিই তো ভুলে গিয়েছিলাম।
কাজটা হতে চোখ তুলতেই দেখি সাধুবাবা নেই। নিয়ে যাবার জন্য ঘটিটা তুলতেই আবার একটা ঝটকা লাগল, - ঘটিটা জলপূর্ণ হয়েই আছে, একটুও জল কমেনি। তা কি করে হয়, আমার সামনেই তো ঢকঢক করে জলপান করলেন সাধুবাবা।
এরপরে মাসদুয়েক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, সংসারজীবনে হাঁপিয়ে উঠেছি। এদিকে আষাঢ় মাসের দরদর ধারায় বৃষ্টি মনকে আনমনা করে তুলেছে।  সবমিলিয়ে একটা মনখারাপের আবহাওয়া চারিদিকে।
আজ আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া। রথের দিন। শাস্ত্রে আছে, 'দোলায়মান গোবিন্দং মঞ্চস্থং মধুসূদনং রথস্থং বামনং দৃষ্টবা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে' । পরের জন্মের অভিলাষ আমার নেই, তাই চললাম রথ দেখতে। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? না মশাই, এইফাঁকে কিছুটা আনন্দভ্রমণও হবে। আর রথের মেলার পাঁপড় জিলাপি, সে তো অমৃত। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কত যে পুরানো স্মৃতি উজাগর হয়ে এল তা বলে বোঝানো সম্ভব না। তবে ছোটবেলার মতো আনন্দ এই বয়সে আর সম্ভব নয়। সেসময় না ছিল চিন্তা না ছিল ভাবনা, মেলাময় ঘুরে বেড়াতাম বন্ধুদের সঙ্গে। পয়সাকড়ি ছিল না বটে তবে সে অভাব আনন্দের জোয়ারে বিন্দুমাত্র বাধার কারণ হত না। আজ সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। আছে কেবল বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া জরজর একটা দেহ।
মেলায় দেখা হয়ে গেল স্বয়ং বামনদেবের সাথে, - বামনদেব সেনগুপ্ত, ব্রিটিশ সার্ভেয়ার। ইংরেজরা তাকে যথেষ্টই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে, কারণ অমন শিক্ষিত আর দুঃসাহসী ভূভারতে পাওয়া ভার। সে আমার বর্তমান অবস্থার কথা শুনে বলল, "দেখো মৈত্র, ঘরে বসে না থেকে একটা চাকরি বাকরি করো। তোমার প্রতিভা আমার কাছে অজানা নয়, তাই আমি তোমার জন্যে কাজের ব্যবস্থা করে দেব। কলকাতার অফিসে আসার আগে আমি কিছুকাল সিকিমে ছিলাম, তুমি চাইলে আমি সিকিমের রাজাকে চিঠি লিখে তোমার একটা কাজের জন্যে সুপারিশ করতে পারি। "
আমি হাতে চাঁদ পেলাম। বামনদেবের চিঠি নিয়ে পরের সপ্তাহেই সিকিম রওনা হলাম। সময়টা এখন বর্ষাকাল, তাই সিকিমের রাস্তাও খুব দূর্গম। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো খচ্চরের পিঠে চেপে এগোতে লাগলাম। সমতলে মোটরগাড়ির কোনো কমতি না থাকলেও এ পথে মোটরগাড়ির দেখা মেলে না। গোরুর গাড়িও এ পথে অচল।
  জলপাইগুড়ির পর থেকে একটানা হাঁটছি। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে, আর চলা সম্ভব নয়। কাছেপিঠে কোন গ্রাম বা বসতি পেলে আশ্রয় নেবো। তিস্তার ধার বরাবর হাঁটছি। লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। ঠিক মুখআঁধারির সময় একটা ছোট্ট গ্রামের কাছে এসে পড়লাম।  গ্রামের লোক কৌতুহলী হয়ে আমার সঙ্গ নিল। আমি বললাম, "সিকিম যাব, ব্রাহ্মণ মানুষ, এই রাতটুকু যদি আশ্রয় পাই তো খুব উপকার হয়।"
আমার কথা শুনে একজন মাতব্বর গোছের লোক এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, "তা কেন পাবেন না, আমার বাড়িতে চলুন।"   আমি তার পিছনে পিছনে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম যশেশ্বর রাই, সম্পন্ন গৃহস্থ তিনি। যাওয়ার মাত্র পা ধুইয়ে বসবার জন্যে আসন দিলেন। ভেতরের ঘর হতে ঘটিভর্তি জল আর খাঁটি দুধের পেঁড়া এল। জলের সাথে গোটা পাঁচেক পেঁড়া গলাধকরন করার পর চা এল। খাঁটি দুধের বানানো দার্জিলিং চা। কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে ভদ্রলোকের ছেলে দার্জিলিংয়ে একটা চায়ের বাগানে কাজ করে।
রাইমশাই খুবই বিনয়ী মানুষ। হরিভক্তও খুব। খোল করতাল নিয়ে বসলেন তিনি। দেখতে দেখতে গ্রামের কিছু লোকজন এসে জুটল। রাইমশাই এবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, "অপরাধ মার্জনা করবেন, আপনি যদি একটা গান ধরেন তো আসরটা জমে যায় ।"   কি করব, গান ধরলাম।
         সখি হেরি কালোরুপ গেলনাকো দুখ কেবলই বিরহে দহি
         বাঁশরীর তাণে দহে এ পরাণে, (এ) যাতনা কেমনে সহি ?
         ব্রজের গোয়ালা জানে কি পিরিতি ধেনু সনে যার বাস,
         আমার কপালে কিবা কু লাগিল কালিয়া রচিল রাস।
         ঘরেতে ননদী যেন ন-নদী বিষম জলধি পারা
         লোহিত নয়ন মত্ত আয়াণ, শাশুড়ি বিষের জারা।
         এ হেন বচনে সুব্রত ভনে ও রাইকিশোরী ধনী
          না কর বিলাপ না কর মনস্তাপ কালিয়া নয়নমণি।।
অনেক রাত পর্যন্ত গান-বাজনা চলল।  সবাই চলে যাওয়ার পর ভেতর ঘর হতে খাওয়ার ডাক পড়ল। বাড়ির বারান্দায় খাওয়ার আয়োজন হয়েছে। কাঁসার থালায় সরু চালের ভাত, পুরুপুরু মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, পাঁচমেশালি তরকারি আর মাছের ঝোল। সন্ধ্যাবেলায় জেলে ডেকে মাছ ধরিয়েছেন রাইমশাই।
খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। খাওয়ার পর বৈঠকখানায় আমার শোয়ার ব্যবস্থা হল। পথশ্রমে ক্লান্ত থাকায় রাতে ঘুমটাও বেশ ভালো হল। সকালে উঠেই চা-মুড়ি খেয়ে রওনা দিলাম। বিদায় নেওয়ার সময় রাইমশাই একটা ধুতি আর পাঁচটা টাকা দিয়ে প্রণাম করলেন।
রাস্তায় আবার একটা গ্রাম পড়ল। গ্রামের শেষে পাশাপাশি দুটো পুকুর, পুকুরের জল স্বচ্ছ কাচের মতো। হাতের বাক্সটা নামিয়ে রেখে স্নান করে নিলাম। আসার সময় রাইমশাই কিছু চিড়েমুড়ি আর মণ্ডা দিয়েছিলেন, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু। পথ আরো দুর্গম হয়ে আসছে। আমার একদিকে এখন তিস্তা নদী আর অপরদিকে খাড়া পাহাড়। তিস্তার গর্ভদেশ হতে রাস্তার উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে। পথশ্রমে ক্লান্ত হলে রাস্তার ধারে কখনো কোনো গাছের তলায় আবার কখনও কোনো পাথরের চাঁইয়ের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে।
একটা জায়গায় রঙ্গিত গিয়ে তিস্তায় মিশেছে, সেখানটা খুবই নির্জন।এদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে । এখন আর নিজের অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এ সবকিছুর জন্য আমিই দায়ি। আমার উচিত ছিল দুপুরবেলা যে গ্রামটার পেরিয়ে এসেছি সেখানেই আশ্রয় নেওয়া, কিন্তু আর কি করার আছে !  বৃষ্টির কারনে তাপমাত্রা নেমে এসেছে, তার উপরে আছে তিস্তার হাওয়া । বন্য কোন জন্তুর হাতে যদি নাও মরি প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।  এরকম যখন ভাবছি ঠিক তখনই দেখতে পেলাম দূরে জঙ্গলের ভিতরে গাছের আড়াল ভেদ করে একটা ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। এত রাত্রে এরকম দুর্গম জায়গায় আলোর ব্যাপারটা আমার খুব একটা স্বাভাবিক লাগল না। কিন্তু ডুবন্ত লোকের খরকুঁটোই ভরসা।
          সাহসে ভর করে ওই আলোর দিকে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গলের ভেতর একটা অনুচ্চ পাহাড়ের তলায় হাজির হলাম। পাহাড়ের তলদেশে কয়েকটা গাছের আড়াল ভেদ করে আলোটা বেরিয়ে আসছে। আলোর দিকে এগিয়ে যেতেই একটা গুহার মতো কিছু একটা দেখা গেল, ভেতরে মশাল জ্বলছে। আমি অতি সাবধানে ভেতরে ঢুকে এলাম, দেখি একটা সাধু ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম, এ সেই সেদিনকার দুপুরের দেখা সাধুবাবা। আমি কাছে গিয়ে প্রনাম করতেই তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গি করে বললেন, "তু আ গেয়া ?"
আমি বললাম, "সিকিম যাচ্ছি বাবা, পথে রাত হয়ে গেল, আপনি না থাকলে আমার যে কি হত.."
সাধুবাবা মৃদু হেসে বললেন, "তেরা কিস্মত তুঝে ইঁহা লে আয়া, তু তো সির্ফ মোহরা হ্যায়। দেখ বেটা, উও যশেশ্বর  কি তরা মছলি চাওল তো ম্যা নেহি খিলা সাকতা, ভিখমাঙ্গনেবালা হুঁ। "
আমি বললাম, "আপনি যখন সবই জানেন তখন আমি আর কি বলব ! আপনার চরণে আশ্রয় মিলল এটাই অনেক।"  আমি সাধুবাবার কাছে নতি স্বীকার করলাম। আগেরবার যখন সাধুবাবার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন সাধুবাবা কে দেখে ভণ্ড বলে ভেবেছিলাম, আজ আর সেরকম মনোভাব আমার নেই।
সাধুবাবা বললেন, "উয়ো কিতাব মে তু জো কুছ পড়া সব সচ হ্যা, ঝুঠ কি কোই গুঞ্জাইস হি নেহি। উও ন লোক আবভি হ্যা।" 
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, "এখনো জীবিত আছেন মানে..! এতবছর বেঁচে থাকা সম্ভব ? আমি যতদূর জানি ত্রৈলঙ্গ স্বামী সাড়ে তিনশ বছর বেঁচে ছিলেন, তাবলে দু'হাজার বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকা...... অসম্ভব। "  সাধুবাবা আমার কথা শুনে হাসলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর যা বললেন তার অর্থ এই যে মৃত্যুকে এড়িয়ে বেঁচে থাকার দুরাশা তাদের বিন্দুমাত্র ছিল না। উত্তরাধিকার আর শিষ্য পরম্পরাতেই আজও জীবিত আছেন তারা। আর সেই জ্ঞানের পিছনে পড়েছে মারের সৈন্যরা। কিন্তু জ্ঞানের সন্ধান পেতে হলে পৌঁছতে হবে জ্ঞানের চাবিকাঠিটির কাছে। আমাকে যে ম্যাপটি দেওয়া হয়েছে সেটি সেই জ্ঞানের চাবিকাঠিটির সন্ধান দেবে।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর সাধুবাবা তার ঝোলা হতে ছাতু বের করলেন। সামান্য লবন দিয়ে মাখা ছাতু, কি অপূর্ব তার স্বাদ ! সঙ্গে গাঁজার বীজের চাটনি। দুজনে খাওয়া দাওয়া সেরে ধুনির পাশে শুয়ে পড়লাম। পথশ্রম আর উদরপূর্তির কারণে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এল। 

শয়তানের থাবা - পর্ব ৩ // সুব্রত মজুমদার


প্রচণ্ড শীত আর উচ্চতার জন্য অনেকেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমরা যখন নাথুলা পৌঁছলাম তখন অনেকেই অসুস্থ্য। কিন্তু তিন বুড়োর শরীরে এতটুকুও পথশ্রমের বা আবহাওয়াজনিত ক্লেশের কোন চিহ্ন নেই। নাথুলায় বাবা হরভজন সিংয়ের স্মৃতিমন্দির।
বাবা হরভজন সিং ১৯৪৬ সালের ৩০শে আগষ্ট পূর্বতন পাকিস্তানের সদর্ণাতে জন্মগ্রহণ করেন। প্যারামিলিটারি ট্রেনিংয়ের পর তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগদান করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে চিনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে তার মৃত্যু হয়। তিনদিন পর তার দেহাবশেষ খুঁজে সমাহিত করা হয়। দাবি করা হয় যে এই কাজে নাকি তিনি খোঁজিদলের সাহায্য করেন। আজও তিনি কর্তব্যরত হয়ে রক্ষা করে চলেছেন দেশবাসীকে। ওই এলাকায় কোন সৈনিক কর্তব্যে অবহেলা করলে বা কোনও খারাপ কাজ করলে বাবা তাকে চড় মেরে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন।
          প্রতিবছর ১১ই সেপ্টেম্বর একটা জীপ তার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে নিকটবর্তী নিউজলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে যায়। সেখান থেকে সেই স্মৃতিচিহ্ন একটা ফাঁকা বার্থে করে রওনা দেয় কাপুরথালার কুকা গ্রামের উদ্দেশ্যে । তিনজন সৈন্য তার প্রহরায় নিযুক্ত থাকে। সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি নাথুলায় কর্তব্যরত সৈন্যরাও বাবা হরভজন সিংয়ের মায়ের কাছে প্রতি মাসে কিছু কিছু সাহায্য পাঠায়।
নাথুলাকে তিব্বতি ভাষায় লেখা হয়  རྣ་ཐོས་ལ་ । এটি প্রাচীন সিল্করুটের একটা অংশ। 'নাথু' শব্দের অর্থ কান আর 'লা' শব্দের অর্থ পার্বত্যপথ। সমুদ্রতল হতে ৪৩১০মিটার উঁচু এই নাথুলা পাশে এসে অব্দি মৈত্রবুড়োর ছটফটানির বিরাম নেই। লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। কিছুটা কৌতূহলের বশেই আমি বুড়োর পিছু নিলাম। বুড়ো পেছনে না তাকিয়েই বলে উঠল, "টুপিটা ফ্যাশনের জন্য নয়। কানটা ঢাকুন।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম। টুপিটা আমি পেরেছি মিনিট খানেক আগে। আর বুড়ো তো একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। তাহলে জানল কি করে যে আমার কান টুপি হতে বেরিয়ে আছে ! ম্যাজিক জানে নাকি ! আমি বললাম, "আপনি কি ম্যাজিসিয়ান !"
বুড়ো বলল, "এতে কোনো 'ভানুমতীর খেল' নেই। সঠিক অনুমান আর সঠিক পর্যবেক্ষণ করলে আপনিও এরকম বলতে পারবেন। আমার পেছন পেছন আসুন। আরেকটা চক্রের হদিস মিলেছে।"
বুড়োর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। একটা টিলামতো অংশের উপরে উঠেই আমি তাজ্জব। আগের বৌদ্ধস্তুপটার মতোই একটা স্তুপ ভেঙ্গেচুড়ে পড়ে আছে। বুড়ো স্তুপটার কাছে গিয়ে সেই খুরপির মতো জিনিসটা দিয়ে কিছু একটা বের করে আনল। উদ্ধার করা বস্তুটি পকেটে রাখতে রাখতে বুড়ো বলল," শুধু শারীরিক বল আর চালাকি দিয়ে সবসময় কার্যসিদ্ধি সম্ভব হয় না । কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়জ্ঞান আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির দরকার। আপনার মৃগাঙ্ক সেন শেয়ালের মতো চালাক হলেও জ্ঞান বুদ্ধির ছিটেমাত্রও তার মধ্যে নেই। যাইহোক এবার চলুন শিবের মূর্তির কাছে যাই। অঘোরবাবুর তো অনেক ছবি তুলে দিলেন, এবার আমার উপরে দয়া করুন। "
বুড়োর কথাগুলো সন্মোহিতের মতো শুনছিলাম। যত দেখছি ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে বুড়োর উপর। এই যা ! নামটা তো জিজ্ঞাসা করিনি। বললাম," আপনার সঙ্গে এই এত আলাপ কিন্তু কি আশ্চর্য বলুন তো একবারের জন্যেও নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। "
বুড়ো  তার ব্যাগ হতে জলের বোতল বের করে গলাটা ভিজিয়ে নিল। তারপর বলল, "নামে কি আসে যায় ? যদি রবিন্দ্রনাথের নাম চন্দ্রশেখর হত তাহলেও তিনি কবিকুলচূড়ামনণিই থেকে যেতেন। কর্মই আসল। তবুও যখন একান্তই জানতে চান তখন অগত্যা..। অধমের নাম ইন্দ্রজিৎ মৈত্র। ডায়েরিটা পড়া হয়ে ওঠেনি আপনার তাই জিজ্ঞাসা করলেন। "
সত্যিই তো, ডায়েরিটার কথা আমার মনেই ছিল না। কি ভুলো মন আমার। আজকে রাতে ডায়েরিটা নিয়ে বসব। জানতে হবে সেই রহস্য যার জন্যে শশাঙ্কশেখর মৈত্র পাগল হয়ে গেলেন আর তার ছেলে এতগুলো বছর পরে এসেছ পাণ্ডববর্জিত স্থানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। মৃগাঙ্কবাবু যে ভালোমানুষ নন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর এই ইন্দ্রজিৎ বুড়োর আর মৃগাঙ্কবাবুর উদ্দেশ্য যে একই তা বোঝার জন্যে খুব বুদ্ধির দরকার পড়ে না। যাইহোক দুজনে শিব মূর্তিটার কাছে এগিয়ে গেলাম।
"কি সুন্দর আবহাওয়া দেখেছেন ! ..." অঘোরবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ তার আনন্দের চুলোয় জল ঢেলে বুড়ো বলে উঠল, "আর্থ্রাইটিসে ভোগেন, সাইনাসের ধাত, বাথরুমে পুরো একপালা গাওয়ার পরেও কোষ্ঠ সাফ হয় না,..... এরপরেও প্রাণে ফূর্তি আসে ! "
অঘোরবাবু প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন, তারপর   একদম আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, "কে আপনি মশাই ! ডাক্তার ! আমার গেঁটে বাত থাক, আমাশা থাক আর যাখুশিই থাক না কেন তাতে আপনার কি ? জানেন আমি কে ? এই অঘোর বাঁড়ুজ্জেকে আপনি টিটকিরি মারেন ! দেশে ফিরি তারপর আপনার নামে যদি মানহানির মামলা না করি তবে আমার নামে কুত্তা পুষে দেবেন মশাই।"
বুড়োর মুখে কিন্তু ফিচেল হাসি লেগেই আছে। বোঝাই যাচ্ছে যে অঘোরবাবুকে রাগিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে বুড়ো। আমিই বাধ্য হয়ে অঘোরবাবুকে শান্ত করলাম। অঘোরবাবুর রক্তচাপ  একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে বুড়ো অঘোরবাবুর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল," চটে যাচ্ছেন কেন, আমি যা বলেছি তা কি মিথ্যা ?"
অঘোরবাবু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন। বুড়ো বলল, "জন্ম থেকেই আমার এই গুনটা আছে। আমি কপাল দেখে মানুষের ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান বলে দিতে পারি।"  কথাটা বলেই বুড়ো আমার দিকে চেয়ে চোখটিপে ইঙ্গিত করল। বুঝতেই পারলাম অঘোরবাবুর ঘোর লাগানোর জন্যে বুড়ো সচেষ্ট হয়ে উঠেছে।
অঘোরবাবুর চোখদুটো এবার যেন চকচক করে উঠল। তিনি বুড়োর দিকে নিজের প্রশস্ত কপাল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন," সময় খুব খারাপ চলছে মশাই।  কোন এক উটকো মৃগাঙ্ক সেন আমার ভ্রমণের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল। একটু  ঠিক করে দেখে দেন তো ! আর যা কিছু বলেছি তার জন্য দুঃখিত মশাই। হয়ে গেছে বয়ে গেছে।"
বুড়ো পকেট হতে আতসকাচ বের করে অঘোরবাবুর  কপাল পর্যবেক্ষণ ও ত্রিকাল দর্শনান্তে প্রতিকার বাতলাতে লাগলেন। আমি  নাথুলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি অপরুপা এই প্রকৃতি ! পাহাড়ের শ্রেণি ভূমি আর আকাশের মাঝখানে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে। সেই স্তম্ভের মাথায় উড়ছে মেঘেদের জয়ধ্বজা। রোদ আর ছায়ায় মায়াময় হয়ে উঠেছে উপত্যকা।
নাথুলা থেকে ছাঙ্গু আসার পথে অঘোরবাবুর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মৃগাঙ্ক সেনকে আর পাত্তা দিচ্ছেন না। বুড়োর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছেন। সাদা পেস্ট জাতীয় কিছু দিয়ে কপালে তিলকও এঁকেছেন। বুঝতেই পারলাম এসবই বুড়োর দুস্টুবুদ্ধির নমুনা। ছাঙ্গুতে নেমে সবাই রোপওয়ে নিয়ে মেতে উঠল। এই ফাঁকে বুড়ো কখন যে অঘোরবাবুকে এড়িয়ে  পেছনের টিলাটার দিকে হাঁটা দিয়েছেন তা বুঝে উঠতেই পারিনি। একরকম দৌড় দিয়েই বুড়োর সঙ্গ ধরলাম। টিলার পেছনে একটা ছোট্ট মনেস্ট্রি। রাস্তা খুবই বন্ধুর। আমরা অনেক কষ্টে মনেস্ট্রির দরজা পর্যন্ত পৌঁছলাম।
দরজা খোলাই ছিল। দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে যাব এমন সময় বুড়ো আমাকে আটকে দিল। আমি কিছু বলার আগেই বুড়ো বলল, "এসব কাজে পর্যবেক্ষণ শক্তি তীক্ষ্ণ হওয়া দরকার। নিচের দিকে তাকাও।"
নিচের দিকে নজর যেতেই আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। দেখি দরজার কাছেই পড়ে আছেন একজন বয়স্ক লামা। তার মাথার ক্ষত হতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুড়ো লামার ঘাড়ে ও কব্জিতে ধাত পরীক্ষা করে বলল, "বেশিক্ষণ হয়নি। প্রাণে বেঁচে আছে। জলের বোতলটা দেন তো। "
আমি জলের বোতলটা এগিয়ে দিতেই বোতল হতে জল নিয়ে লামার চোখেমুখে ছিটে মারল। জ্ঞান ফিরতেই লামার মুখ দিয়ে অস্ফূটভাবে বেরিয়ে এল, "মার... মার.."
বুড়ো বলল, "মার কি করেছে ?"
"আ গেয়া...." লামা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। মনেস্ট্রিতে ঢুকেই বুড়ো পুলিশে ফোন করেছিল।কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন কনস্টেবল সহ পুলিশ অফিসার অর্জুন কুমার প্রধান এসে হাজির হলেন। লামাকে আর্মির মেডিক্যাল ক্যাম্পে পাঠানো হল।
                                                           -- চার - -
বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। রুটি আর সব্জির সাথে চিকেন কষা দিয়ে রাতের খাবার সম্পন্ন হল। তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে গেলাম। ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম।
ডায়েরির ভাষা অগোছালো । ডায়েরির প্রথম দুটো পাতা ফাঁকা। তৃতীয় পাতায় একটা কলমে আঁকা স্কেচ। স্কেচটা এতটাই বীভৎস যে দেখামাত্র আমার রোমে রোমে অজানা একটা আতঙ্ক খেলা করে গেল। একটা দানবীয় মূর্তি। গোল গোল দুটো চোখ আর মুলোর মতো দাঁত। লকলকে জিভখানা সামনের দিকে বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে। জিভের দুপাশে দুটো গজদন্ত। আর পারছি না। কেমন একটা যেন সন্মোহন আছে ছবিটাতে। আমি নিজেকে আর বশে রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন হাজারো জোনাকি ঘুরছে চোখের সামনে। যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। পাতাটা ওল্টানোর ক্ষমতাও আর আমার মধ্যে নেই। অনেক কষ্টে পাতাটা ওল্টালাম।
বেশ গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শশাঙ্কশেখর মৈত্রের ডায়েরি, - বিভীষিকার জ্যান্ত দলিল। আমি পড়তে লাগলাম।
     'আমি শশাঙ্কশেখর মৈত্র, জন্ম নিয়েছিলাম বীরভূমের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। হাজারো অভাব আর অনটনের মাঝেও লেখাপড়া কখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। এর একমাত্র কারন ছিলেন আমার ঠাকুরদা। তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। পৌরহিত্যের সামান্য রোজগারে সংসার ঠিকমতো চলত না। বাবা আর ঠাকুরদা দুজনেই খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন। কোনো সংস্কার তাদের চলার পথে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। আমার পড়াশোনাতেও তাই তারা কোনো বাধা উপস্থিত হতে দেন নি।
স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় গেলাম। সেখানে আমার দাদুর এক শিষ্য থাকতেন। লালবাজারের বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি। তার বাড়িতে থেকেই কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলাম। ততদিনে ঠাকুরদা গত হয়েছেন। আমাকে চাকরির সন্ধানে  বিশেষ ঘোরাঘুরি করতে হল না। খুব সহজেই একটা কলেজের অধ্যাপনার কাজ জুটে গেল। কিন্তু যার কপালে বিধি বিশ্বনিখিল ঘুরে বেড়ানোর ফরমান লিখে দিয়েছেন তার এই মোহগর্তে থাকাটা যথেষ্টই বেমানান । কত যে চাকরি বদল করলাম তার কোনো ইয়ত্তা নেই।  কখনো মনোহরপুর রয়েলস্টেটের সেক্রেটারি তো কখনো ইংল্যান্ডের কোন অখ্যাত শহরের লাইব্রেরীয়ান। দেশে বিদেশে কত যে চাকরি ধরলাম আর কত যে চাকরি ছাড়লাম তার হিসেব আমি নিজেও দিতে পারব না।
তখন আমি চাণ্ডেলের রাজার ব্যক্তিগত সহায়ক হিসাবে কাজ করছি। দিব্যি আছি। মাসে মাসে কিছু করে টাকা ঘরে পাঠিয়ে দিই। জানি, টাকা পয়সাটাই সবসময় মানুষের জীবনের সবকিছু নয়। কিন্তু আমি করব কি ! পায়ের তলায় সর্ষে আমার। এই একটা কারনের জন্যেই স্ত্রী পুত্র কন্যা কাউকেই সুখ দিতে পারিনি । আমার ছেলেমেয়েরা তাই আজ আমি বেঁচে থাকতেও অনাথের মতো জীবনযাপন করছে।
যাই হোক সেদিন সকালবেলায় আমি আমার ঘরে বসে  মহারাজের সারাদিনের রোজনামচায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। এটাই আমার কাজ। মহারাজ সারাদিন কোথায় কি করবেন, কি খাবেন, কার সাথে দেখা করবেন তার শিডিউল আমিই তৈরি করে দিই।  কাজ করতে করতে মাথাটা ধরে এসেছিল। চায়ের জন্য সুন্দররামাইয়াকে হাঁক দিলাম। সুন্দররামাইয়া আমার ফাইফরমাশ খাটে।
সুন্দররামাইয়া চা নিয়ে এল। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখার পরও যখন সে যাচ্ছে না তখন আমি বললাম, "কি হল সুন্দর তুমি কিছু বলবে ?"
সুন্দররামাইয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, "সাহেব একটা নিবেদন ছিল।"
"বল।"
"আজ্ঞে সাহেব, আমার এক বন্ধু আছে। আগে তিব্বতে থাকতো। কিছুদিন আগেই এসেছে। ওকে যদি একটা কাজ দেন তো খুব উপকার হয়।"
"আচ্ছা নিয়ে এসো দেখা যাবে।"
সুন্দররামাইয়ার সেই বন্ধুটি বিকালবেলায় এল। খুব শান্তশিষ্ট ও কথা বলে কম। ইংরাজি আর হিন্দিতে যথেষ্টই জ্ঞান আছে দেখে ওকে আমার সহকারী হিসেবে রেখে নিলাম।
দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু একদিন গোল বাধল। একদিন সন্ধ্যার সময় দেখি ছেলেটি কম্বলে ঢাকা নিয়ে ঘরের এককোণে বসে কাঁপছে । আমি কম্বলটা টেনে খুলে নিতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠল।  " আমাকে বাঁচান সাহেব, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে......। "
আমি বললাম, "কারা তোমাকে মেরে ফেলবে ?"
"মারের সৈন্য সাহেব !!" এক নিঃশ্বাসে জবাব দিল ছেলেটি।
"কোথায় ?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়েই নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগল। আমি সুন্দররামাইয়াকে দিয়ে একটা ডাক্তার ডাকিয়ে আনলাম। ডাক্তারবাবু পরীক্ষানিরীক্ষা করে বললেন," ভয়ের কিছু নেই। তবে নার্ভ যথেষ্টই উইক। প্রেসারটাও বেড়েছে। ওষুধ লিখে দিলাম, জ্বরটা কমে যাবে। তবে চাঙ্গা হতে সময় লাগবে।"
ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। ছেলেটার সুস্থ্য হয়ে উঠতে কয়েকদিন লাগল। ততদিনে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি যে ওর কোনো মানসিক সমস্যা আছে।
একদিন রাতে একটা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বিছানা হতে উঠে বসলাম। ঘরের আলো জ্বেলে বালিশের তলা থেকে পিস্তলটা বের করে  নিলাম। রাতে বিরেতে সঙ্গে অস্ত্র থাকাটা ভালো। ঘরের বাইরে বেরোতে বোঝা গেল চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স হতেই আসছে। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্সের দিকে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে গোলযোগ থেমে গেছে। কিছুটা এগোতেই দেখলাম সুন্দররামাইয়ার ঘরের দরজা খোলা।  ঘরের ভেতরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দররামাইয়া। আর বিছানায় অর্ধমৃতের মতো পড়ে আছে তার বন্ধু। গোটা ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে।
সেই রাত্রে কি হয়েছিল তা সুন্দররামাইয়া আমাকে বলেছিল, তবে পরের দিন সকালে। রাত্রে কথাবলার মতো মানসিক অবস্থা সুন্দররামাইয়ার ছিল না। সে আমাকে যা বলেছিল তা মোটামুটি এইরকম -
সুন্দররামাইয়া আর তার বন্ধু একটা ঘরেই থাকে। সারাদিন খাটাখাটনির পর বিছানায় শোয়ামাত্রই সুন্দরের আর কোনো জ্ঞান থাকে না। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায় একেবারে। অন্যদিকে সুন্দরের বন্ধু ছেলেটির বায়ুচড়া ধাত আছে। চট করে ঘুম আসে না। সেদিন মাঝরাতে দুপদাপ আওয়াজে  ঘুম ভেঙ্গে যায় সুন্দরের। বিছানার উপরে উঠে বসে চোখ কচলাতে থাকে সে। আধো আলোয় তার নজরে পড়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি সারাঘরময় কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর একটা ছায়ামূর্তি সুন্দরের বন্ধুর গলাটা টিপে ধরে চাপা গলায় তর্জনগর্জন করছে।
"মানচিত্রটা কোথায় বল ? কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস ?"
ছেলেটির উত্তর একটাই, "আমি মরে গেলেও বলব না।"  এইরকম তাণ্ডব কতক্ষণ চলেছিল তা সুন্দরের মনে নেই। আমার ডাকেই তার সম্বিত ফেরে।
এরপর আর ঝুঁকি নিইনি। ছেলেটিকে তার দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। যাবার সময় একটা পুরোনো ভূর্জপত্রের পুঁথি আমাকে দিয়ে গিয়েছিল সে। না, পুঁথির ব্যাপারে কিছুই বলেনি। হয়তো সে নিজেও কিছু জানে না।
পুঁথিটা পালি ভাষায় লেখা। কোনো এক বৌদ্ধ সন্নাসী মহা গুপ্তের রচনা। গোটা পুঁথিজুড়েই আছে মারের বৃত্তান্ত, আর মারকে পরাজিত করার জন্য সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোকের নয়জন জ্ঞানীর কথা।
মার হলো বুদ্ধের সাধনার পথে বিঘ্নসৃষ্টিকারি অশুভ শক্তি। চিনা ভাষায় 天魔/魔羅 । মার কথার অর্থ হলো হত্যা  বা ধ্বংস করা । এর তিন কন্যা, - তৃষ্ণা, অরাতি এবং রাগ। অন্যত্র এই মারকে অসৎ দেবপুত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা সংখ্যায় একাধিক। এরা মানুষের মুক্তির পথে বাধাদান করে। কখনো পশুপাখি, কখনো ভয়াবহ মূর্তি, কখনো বুদ্ধমূর্তি, রমনীয়া কন্যা বা দুঃস্বপ্ন রুপে সাধকের সাধনাভঙ্গ করে। বুদ্ধঘোষের মতে মার হল অকুশল মনোবৃত্তি বা মনের রিপুসকল।
সিদ্ধার্থ যখন বোধি লাভের আশায় বটবৃক্ষের তলায় সাধনায় বসেন তখন মারের মনে ক্রোধ জন্মায়। মার তার সুন্দরী ও মনমোহনকারিনী কন্যাদের পাঠান সিদ্ধার্থের তপোভঙ্গের উদ্দেশ্যে। মারের কন্যাদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না গৌতম।
মার আরো ক্রুদ্ধ হয়ে তার সৈন্যদের নিয়ে আক্রমণ করেন সিদ্ধার্থকে। ব্যর্থ হন এবারও। তখন তিনি সিদ্ধার্থকে  বলেন, "হে শাক্য ! কে তোমার হয়ে সাক্ষ্য প্রদান করবে ?"
সিদ্ধার্থ মৃদু হাসলেন। তারপর তার হাত দিয়ে ভূমিস্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী বলে উঠল, "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। সিদ্ধার্থই বোধিলাভের উপযুক্ত।"
মার অদৃশ্য হয়ে গেল। ইন্দ্রাদি দেবতারা আকাশ হতে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।
এতো গেল মারের কথা। পুঁথির পরের অংশেই আছে নয়জন জ্ঞানী ব্যক্তির কথা, যারা মারের হাত হতে বৈদিক জ্ঞানের সংরক্ষণ করেছিলেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী।
এই জ্ঞান যাতে কোনো দুষ্ট ব্যক্তি তথা মারের হস্তগত না হয় তার জন্য তিনি সমস্ত জ্ঞান নয়ভাগে ভাগ করে মন্ত্রীদের মধ্যে বন্টন করেন। এই জ্ঞানী ব্যক্তিগন সম্রাটের কাছে শপথ করেন যে উত্তরাধিকার পরম্পরায় এই জ্ঞান তারা সংরক্ষণ করবেন। এই জ্ঞানের সংরক্ষণের জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না। এর পরেই পুঁথিটি খণ্ডিত। সম্ভবত কালের হস্তক্ষেপে জীর্ণ ও দীর্ণ হয়েছে পুঁথিটি।

শয়তানের থাবা - পর্ব ২ // সুব্রত মজুমদার


মরচে ধরা তালাটা টান মারতেই খুলে গেল। ভেতরে অজস্র কাগজপত্র আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সম্ভার।  কাঠের সুদৃশ্য ব্রাশ, মেড-ইন-ইংল্যাণ্ড রেজার, আরো কত কি । তবে এত  সবকিছুর মধ্যেও যে জিনিসটা আমার নজর কাড়লো সেটা হল একটা মরক্কো চামড়ার বাঁধাই একটা সুদৃশ্য ডায়েরি। "
এতটা বলার পর বুড়ো সোয়েটারের ভিতর থেকে একটা মাঝারি সাইজের চামড়া বাঁধানো ডায়েরি বের করে আমার হাতে দিলেন। মরক্কোর তৈরি আসল ছাগল বা বাছুরের চামড়া দিয়ে বাঁধানো ডায়েরিটা উজ্জ্বল লাল রঙের। এতদিনের পুরানো হওয়া সত্ত্বেও এতটুকুও ঔজ্জ্বল্যে ঘাটতি পড়েনি। মরক্কো চামড়ার এটাই বিশেষত্ব।
   আমি ডাইরিটা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলাম। নমস্কার জানিয়ে বুড়োকে বললাম, "আজ রাত অনেক হয়েছে। কাল আবার  সাইটসিইংয়ে  যাব। একটু ঘুমিয়ে নিই।"
বুড়ো আর কথা বাড়াল না। প্রতিনমস্কার জানিয়ে   বিদায় নিল।
                                                                         - - তিন - -
রাত্রে কেমন ঘুম হয়েছিল সেটা আর বলবার অবকাশ থাকে না। সারাদিনের জার্ণি আর আবহাওয়ার শীতলতা ঘুমের উত্তম অনুঘটক হয়ে দাঁড়াল। বিছানায় শোয়ার মাত্রই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের আওয়াজে। ভোর চারটেয় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। উঠেই ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। আজ 'নাথুলা পাস' আর 'ছাঙ্গু' লেক যাওয়ার কথা। গাড়ি আসবে সকাল ছয়টা নাগাদ।
কপালে সুখ লেখা না থাকলে যা হয়, তিন বুড়োতে আমার ভ্রমণের আনন্দের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল। এদের মধ্যে একজন হলেন শশাঙ্কশেখর মৈত্রের পক্ককেশ আঁতেল পুত্র যিনি আমার পেছনে পৃষ্ঠব্রণের মতো আটকে আছেন। অপর দু'জন আমার ট্রাভেলেরই যাত্রি শ্রীমান অঘোরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীমান মৃগাঙ্ক সেন।
ঠাণ্ডায় আমেজ করে বসে বসে ডিম টোস্ট সহযোগে কফি খাচ্ছি। আরো দু'একজন রয়েছেন। সবাই নিজেরমতো খোশগল্পে ব্যস্ত। এমন সময় হন হন করে এগিয়ে এলেন অঘোরবাবু। এসেই আমার সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে জুত করে বসে কটমট চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, "আপনাদের কি ব্যাপার বলুন তো মশাই, লোক ঠকানোর ব্যবসা ফেঁদেছেন ?"
ডিমটোস্টের টুকরোটা আর আমার গলা দিয়ে নামল না। আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন, কি হল হঠাৎ ?"
"হবার কিছু বাকি আছে কি ? কি লোককে সঙ্গে দিয়েছেন মশাই ! একটু ঘুম আসে আর ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দেয়। বলে কিনা কেমন নৈসর্গিক শোভা দেখুন ! আরে মশাই, এতগুলো টাকা খরচ করে কি আমি রাত জেগে নৈসর্গিক শোভা দেখতে এসেছি ! আমার টাকা ফেরত দেন মশাই। অনেক হয়েছে আপনাদের কেরামতি, রাত জেগে জেগে মানসিক রোগী হয়ে যাব এবার। "
অনেক কষ্টে অঘোরবাবুকে বোঝালাম। অঘোরবাবু আমাকে দিয়ে একরকম প্রতিজ্ঞাই করিয়ে নিলেন যে নাথুলাপাস পৌঁছে আমি মৃগাঙ্কবাবুকে চিন বর্ডার পার করে দেব। ভাগ্য ভালো পরিহাস ছলে মিথ্যা বলায় কোন পাপ হয় না।
ওয়েটার অঘোরবাবুর জন্যে ওমলেট আর কফি এনে টেবিলে রাখল। অঘোরবাবু কফির কাপে সুরুৎ করে একটা চুমুক দিলেন। তারপর আমার দিকে এবার প্রেমেপড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন," একমাত্র আপনার উপরেই বিশ্বাস করতে পারি মশাই। সেই যৌবনকাল যদি থাকত তবে ওরকম মৃগাঙ্ক সেনকে আমি এমন যুযুৎসুর প্যাঁচ কষতাম না একদম ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। বিক্রম মুখোপাধ্যায়কে চেনেন ? "
বিক্রম মুখোপাধ্যায়কে আমি স্বচক্ষে দেখিনি, কিন্তু রেডিও, টিভি আর খবরের কাগজের দৌলতে ওই নামটি আমার চেনা। পুরীর হোটেলে বন্ধ রুমের রহস্য সমাধান থেকে হুয়াকোপার মমির রহস্যভেদের সব কাহিনীই আমার জানা। তাই বললাম," চিনি। "
" আমার প্রতিবেশী মশাই। ওই যে পুরীর হোটেলে শিশুপাচারকারীদের ধরা হয়েছিল, তখন বিক্রমের সহকারী কে ছিল ?" অঘোরবাবু ভ্রু-নাচাতে নাচাতে জিজ্ঞাসা করলেন।
"কে ?"
"বলুন দেখি ! গেস করুন।"
আমি বললাম, "খবরের কাগজে যা পড়েছি  তাতে সেসময় তার সঙ্গে একটা সাইকিক বুড়ো ছিল। খুব জ্বালিয়েছিল বিক্রমবাবুকে। "
অঘোরবাবু একটা ওমলেট এর টুকরো মুখে নিয়ে চিবোচ্ছিলেন, আমার উত্তরটা কেন জানি নিতে পারলেন না বিষম খেয়ে প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি বাঁহাত দিয়ে  অঘোরবাবুকে ধরলাম। উল্টেযাওয়ার হাত রক্ষাপেয়েই তিনি আবার খাওয়ার দিকে মন দিলেন। আর গোয়েন্দা বিক্রমের প্রসঙ্গ আনলেন না।
  কার মুখ দেখে উঠেছি জানি না দুই বুড়োই আমার গাড়িতে। মাঝের সিটে পাশাপাশি দুই বুড়ো অঘোরবাবু আর মৃগাঙ্কবাবু। দুজনেই দুজনের বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে গোমরামুখে বসে আছেন। মনে আনন্দ নেই। আমাকে দেখেই অঘোরবাবু একটা ইঙ্গিত করে মৃগাঙ্কবাবুকে দেখালেন। এর অর্থ এই যে আসামী হাজির, এইবার বেঁধেছেঁদে চায়নাতে পাঠাতে পারলেই হলো।
গাড়ি চলতে লাগল। চেকপোষ্টের কাছে গাড়ি দাঁড়াল। চেকপোষ্টে সিকিম পুলিশের হাতে ছবিসাঁটা অনুমতিপত্র জমা দিতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। এরপর গন্তব্যস্থল নাথুলা পাশ। সেখানে বাবা মন্দিরে বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির দেখে ফেরার সময় ছাঙ্গু লেকে থামব।
রাস্তা পাকা হলেও  কিছু কিছু জায়গায় ধ্বস নেমেছে। তবে সেখানেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে রাস্তা মেরামতির কাজ। দুটো গাড়ি একে অপরকে ক্রস করে যেতে পারে সহজেই। তবে তার অতিরিক্ত রাস্তা নেই। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা সামান্য বেশি চওড়া, সেখানে গাড়িগুলো প্রয়োজন মতো পার্ক করে। গাড়ির দু'এক জনের হাইঅল্টিটিউডের সমস্যা আছে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তায় তাদের মূহুর্মূহু বমি হচ্ছে। ওন্ডেম জাতীয় ওষুধেও কাজ হচ্ছে না।
ছাঙ্গু লেকের কিছুটা আগে একটা মাঝারি মাপের ঝর্ণা আছে। গাড়ি সেখানে থামল। গাড়ি থামতেই পেছনের সিট হতে মৈত্রবুড়ো নেমে এগিয়ে এলেন। তার হাতে সেই কাগজের টুকরোটা। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, "এই সেই জায়গা। এখানেই ম্যাপে চক্র আছে।"
"বলেন কি !"   আমি কাগজটা বুড়োর হাত হতে নিয়ে খুলে দেখলাম। হ্যাঁ, তাইতো। ম্যাপ অনুযায়ী এই ঝর্ণাটাকে চক্র চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমি বললাম,"তাইতো দেখছি। কিন্তু কি করা যায় বলুন তো !
 মৈত্রবুড়ো বলল," এখানে নির্ঘাত কিছু আছে। চলুন। একটু গোয়েন্দাগিরি করা যাক।"
আমি বুড়োর পেছন ধরলাম। বুড়োর শরীরে শক্তি আছে, যে চড়াই উঠতে আমার মতো যুবকেরও হাঁসফাঁস অবস্থা সেই চড়াই অবহেলে উঠে যাচ্ছে বুড়ো। আমরা ঝর্ণার পাশের ঝোপ বরাবর উঠছি। ভেজা নরম পাথর খসে পড়ছে অবিরত। পাথরের খাঁজের ঠিকমতো হাত জমাতে পারছি না। বুড়ো তড়তড়িয়ে উঠে যাচ্ছে। আমিও বুড়োর পদাঙ্ক অনুসরণ করে উঠছি। কতক্ষণ লাগলো জানি না একটা সমতল মতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু বুড়ো আমার জামার পেছনে ধরে এক হ্যাঁচকায় আমাকে টেনে নিলো । বাপরে বুড়ো হাড়ের জোর ! একটা ঝোপের ভেতরে টেনে ঢুকিয়ে নিল। তারপর চাপা গলায় বলল, "চুপ ! সামনে দেখুন।"
সামনের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম একটা বৌদ্ধস্তুপ। বৌদ্ধস্তুপটির মাথায় একটা চক্র। আমি কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আরে ওটা কে ! মৃগাঙ্কবাবু না ! হ্যাঁ তাই তো। দেখলাম মৃগাঙ্কবাবু এগিয়ে যাচ্ছেন স্তুপটার দিকে। সাথে একজন গোর্খা যুবক। দুজনে মিলে স্তুপটাকে শাবল আর গাঁইতি দিয়ে উপড়ে ফেলল। তারপর তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজতে লাগল । খোঁজা শেষ হতেই উৎড়াই বেয়ে নেমে গেল দু'জনে।
ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতেই বুড়ো মাটিতে শোয়ানো স্তুপটার দিকে এগিয়ে গেল। আমিও পিছু নিলাম।  শাবল গাঁইতির আঘাতে বিধ্বস্ত স্তুপটা মাটিতে পড়ে আছে। বুড়ো একটা খুরপির মতো জিনিস নিয়ে স্তুপটার মাথার একটা বিশেষ অংশে আঘাত করতেই একটা ধাতব টুকরো বেরিয়ে এল। বুড়ো সেই টুকরোটা পকেটে ভরে নিয়ে বলল, "এবার চলুন। আমাদের এখানকার কাজ শেষ।"
আমি কিছু বলার আগেই বুড়ো বলল, "হোটেলে গিয়ে সব বলব। এখন ভ্রমণের আনন্দটা মাটি করা উচিত হবে না।"   আমিও আর কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে আসার জন্য পা বাড়ালাম।
নিচে এসে দেখি সবাই সেলফি তোলায় ব্যস্ত। এদিকে বুড়োও কখন কেটে পড়েছে। আমাকে দেখতে পেয়েই অঘোরবাবু দৌড়ে এলেন। তার হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। আমার হাতে মোবাইলটা জোর করে ধরিয়ে দিয়ে বললেন," কয়েকটা ছবি তুলে দেন তো মশাই । এই সুন্দর কলোকল্লোলিনী ঝর্ণা, এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি না তুললে জীবনটাই বৃথা মশাই।"
আমি সংশোধন করে দিয়ে বললাম, "ঝর্ণা কখনো কলোকল্লোলিনী হয় না। নদী হলে হতে পারে।"  অঘোরবাবু কোনো প্রতিবাদ করলেন না। ঝর্ণাটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে অনেকগুলো ছবি তুলে দিলাম ভদ্রলোকের। সত্যি বলতে কি পরিবেশটি খুবই মনোমুগ্ধকর। ঝর্ণার আওয়াজ এই সৌন্দর্য্যকে একটা বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। আরেকটা জিনিস আমার নজরে এল, সেটা হল স্ট্রবেরীর ঝোপ। ঝর্ণার আশেপাশে অজস্র স্ট্রবেরীর ঝোপে  প্রচুর ফুল ফুটে রয়েছে। নার্সারি হতে স্ট্রবেরীর কাটিং এনে বাড়িতে টবে লাগিয়েছিলাম। ফুল ধরার পর গাছটা গরমে শুকিয়ে যেতে লাগল। বাঁচাতে পারিনি। আথচ এখানে প্রকৃতির কোলে বিনা কোন পরিচর্যায় কতশত স্ট্রবেরী গাছ তাদের একাধিপত্য জাহির করছে। এই হল প্রকৃতি। তার করুণা যার উপর বর্ষিত হয় সে পত্রেপুস্পে বিকশিত হয়ে ওঠে আর প্রকৃতির রোষ...! সে তো আমরা নিত্য উপলব্ধি করতে পারছি। বিশ্বউষ্ণায়ন তিলে তিলে গ্রাস করছে সভ্যতাকে, দিন দিন পৃথিবী হয়ে উঠছে ধ্বংস যজ্ঞের হোমকুণ্ড। সে অবশ্য আমাদের দোষেই।
এবার দেখতে পেলাম মৃগাঙ্ক সেনকে। তিনি ঝর্ণার পাশে একটা পাথরে চুপচাপ বসে আছেন। তাকে দেখলে বোঝাই যাবে না যে একটু আগেই তিনি মিটার দশেক চড়াই পেরিয়ে প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপের দফারফা করে এসেছেন। আমার মতোই অঘোরবাবুর দৃষ্টিও মৃগাঙ্ক সেনের উপর পড়ল। অঘোরবাবু আমার পাশটাতে দাঁড়িয়ে বললেন, "দেখলেন তো মশাই, কেমন ভিজে বেড়াল হয়ে বসে আছে। গাড়ি থামার আগেই আমাকে চিমটি কেটেছিল। আমিও দিয়েছি। আমি কারোর খেয়ে থাকি না মশাই।" অঘোরবাবু একটা বিজয়ীর হাসি হাসলেন।
                                              অন্যসময় হলে অঘোরবাবুর কথায় বিরক্তি প্রকাশ করতাম, কিন্তু এখন কেন জানি না অঘোরবাবুর মতোই আমারও ইচ্ছা করছে মৃগাঙ্ক সেনের পেটে একটা রামচিমটি লাগাই। ইতিমধ্যে ড্রাইভার তাড়া দিতে শুরু করেছে। তাই সবাইকে গুটিয়ে নিয়ে নিজের নিজের গাড়িতে তুলে দিলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল।
আস্তে আস্তে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। গাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে ক্রমাগত উঠে চলেছে। ঘন কুয়াশার মতো মেঘ হাতের নাগালে ঘোরাফেরা করছে। কখনো কখনো গাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকে আরোহীর সঙ্গে সুখালাপের চেষ্টা করছে । কিন্তু এই প্রচেষ্টা ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা আরোহীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে । সে তখন ড্রাইভারকে ধীরে সুস্থ্যে গাড়ি চালাবার জন্যে অনুনয় করতে থাকে। ড্রাইভার খুব শান্ত ছেলে। সে মোটেও বিরক্ত হয় না।
গাড়ি ছাঙ্গু পেরিয়ে গেল। জানালা হতে হ্রদটাকে দেখলাম। কি অপূর্ব সুন্দর !  যেন কোন পাহাড়ী মেয়ে তার উদ্ধত বুকের উপর কালচে সবুজ পনচো জড়িয়ে বসে আছে। ফিকে নীল রঙের রেশমি দোপাট্টা তার গভীর নাভিদেশের উপর পড়ে রয়েছে অবহেলে। কখনো কখনো হাল্কা হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে ওড়নাখানা। আমার মতো যারা আনকোরা, যারা এখনও প্রেমে পড়েনি তাদের মনকেও বিচলিত করতে পারে এই দৃশ্য। মনে পড়ে গেল মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের সেই অমোঘ উক্তি।
'... কামার্তা হি প্রকৃতিকৃপণাশ্চেতনাচেতনেষু।'
অর্থাৎ কামনাগ্রস্থ ব্যক্তির কাছে চেতন আর অচেতনের কোন পার্থক্য নেই। তাই কখনো মেঘ হয় দূত তো কখনো সুউচ্চ পাহাড়কে দেখে মনে হয় কোন চপলমতি কিশোরীর উদ্ধত বক্ষদেশ।

শয়তানের থাবা - পর্ব ১ // সুব্রত মজুমদার


 শুক্লপক্ষের প্রতিপদের রাত, খাওয়া দাওয়া সেরে সবেমাত্র শুয়েছেন মৃগাঙ্কবাবু। এমন সময় বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। অনেক রাত করে শোয়ার দরুন ঘুম আসার নামগন্ধও নেই। তার উপরে এই অনাহুত জ্বালাতন, -  মাথা গরম হয়ে গেল মৃগাঙ্কবাবুর।
"অ্যাই কে রে ! বড্ড জ্বালাতন করিস তো ! যাই যাই।"  অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু। ঘরের খিল খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। হ্যারিকেন হাতে চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে এগিয়ে গেলেন উঠান বরাবর। বাহিরদরজার সামনে আসতেই কড়া নাড়ার শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।
 মৃগাঙ্কবাবু হাঁক পড়লেন," কে রে ! "    কোনো উত্তর নেই। নিজের মনে গজগজ করতে করতে ফিরে চললেন তিনি। কয়েক পা' যেতেই আবার কড়া নাড়ার শব্দ। আবার ফিরে এলেন দরজার কাছে। আগেরবারের মতোই এবারও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এবার আর থাকতে পারলেন না মৃগাঙ্কবাবু। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গালাগালি দিতে লাগলেন।  " ওবে হারামজাদা, আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছিস ! আমার সাথে ইয়ার্কি ! মেরে পুঁতে দেব ***********"
সত্যিই তো, মৃগাঙ্ক সেন ওরফে কেশব জালান ওরফে জগাই দাস ওরফে আরো কত কি যে সে তা বোধহয় সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। ঘন্টায় ঘন্টায় রং বদল করে যে তার সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কারোরই নেই।
অনেক চিন্তা এসে ভিড় করে মৃগাঙ্কবাবুর মাথায়। কে আছে এমন যে তার সাথে এধরনের তামাশা করতে পারে। ধীরে ধীরে ঘরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। তড়িঘড়ি জুতোজোড়া না খুলেই ঘরে ঢুকে পড়েন, দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়েন মৃগাঙ্ক সান্যাল।
ছোটোবেলা হতেই খুব ধীর স্থির ছিল ডেভিড। বাবা মায়ের  অষ্টম সন্তান ডেভিডকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল একটা সরকারী স্কুলে। স্কুলের প্রথম দিনেই  ইউসুফ মাষ্টারের মাথায় ঢিল মেরে ফেরার হয়ে গিয়েছিল সে। গ্রামে ফিরল টানা চারমাস পরে। আর স্কুলে ঠাঁই হল না। বৈকল্পিক শিক্ষায় শিক্ষিত ডেভিড হয়ে উঠল তার সমাজের মাথা।
দিন যায় দিন আসে, ডেভিড সুশীল সমাজের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে থাকে। সবাই সবকিছু জেনেও চুপকরে থাকে অজানা আতঙ্কে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে খুন ধর্ষন আর তোলাবাজীতে সিদ্ধহস্ত ডেভিডের পায়ের তলায়।
কিন্তু সব পাপেরই অন্ত আছে। ধরা পড়ল ডেভিড। জোরপূর্বক আটক, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি একাধিক ধারায় দোষী সাব্যস্ত ডেভিডের ফাঁসির সাজা দিল আদালত।
                                       - - দুই--
         কিছুদিন ধরেই হাতে কোনো কাজকর্ম নেই। একা বোকার মতো বসে আছি। এই বেকার জীবনটা বড় একঘেয়ে লাগছে। গ্যাসের উনুনে চাল, আলু আর ডিম বসিয়ে দিয়ে পুরানো একটা খবরের কাগজে শব্দছক করছি। এমন সময় বাইরের দরজায় খটখট আওয়াজ হল। উঠে গিয়ে দরজাটা খুললাম। দেখি আমার ট্রাভেল এজেন্ট বন্ধু সৌম্য।
চা খেতে খেতে সৌম্য বলল, "তোর হাতে তো ইদানিং কোনো কাজ নেই, বেকার বসেই আছিস। আমি যদি কোনো কাজ দিই করবি ?"
আমি হাঁড়ি হতে ডিমটা বের করতে করতে বললাম, "করব না মানে, আলবাত করব। কি কাজ তুই বল।"
সৌম্য চায়ের কাপটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বলল, "জানিসই তো আমার ট্রাভেলের ব্যবসা। তুই যদি আমাকে খদ্দের ধরে দিস তাহলে তোকে আমি কমিশন দেব। আর তোরও নিখরচায় বেড়াবার সূযোগ হবে। ইচ্ছা করলে এজেন্ট হিসাবে যেকোনো ট্রিপে সঙ্গে যেতে পারিস। তবে সেক্ষেত্রে মিনিমাম পাঁচজন কাস্টমার চাই। এবার ভেবে দ্যাখ কি করবি।"
ভাবার কোনো সূযোগ ছিল না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আটজন কাস্টমার জোগাড় করে ফেললাম সিকিম গ্যাংটক ভ্রমণের জন্য। আমারও বহুদিনের ইচ্ছা ছিল সিকিম দেখার। আজ স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। হারিয়ে যেতে চাই কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের কোলে। ইয়াকের পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়তে চাই নিরুদ্দেশে।
জুনের মাঝামাঝি, আমাদের এখানে তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ হতে চুয়াল্লিশে ঘোরাঘুরি করছে। এসময়টাই সিকিম ভ্রমণের জন্যে উত্তম সময়। যাত্রীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সবেমিলে জনাচল্লিশেক যাত্রি। তাদের ঠিকমতো ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আমি আপার বার্থে উঠে শুয়ে পড়লাম। শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। ট্রেন চলেছে দ্রুতগতিতে নিউজলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে।
"মশাই কি গ্যাংটক চললেন ?" একটা জড়ানো কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙ্গে গেল।  দেখি পাশের আপার বার্থ হতে একজন বৃদ্ধ লোক আমার দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছেন। আমি তার দিকে তাকাতেই তিনি একটুখানি কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিলেন। যদিও গলাটা খুব একটা পরিস্কার হল বলে মনে হল না। সেই রকমই শ্লেষ্মাজড়ানো গলাতে বললেন, " আমিও চল্লাম কিনা। আপনি তো আবার ট্রাভেলের লোক, আলাপ পরিচয় থাকলে সুবিধা হবে আরকি।"
আমি বললাম, "ট্রাভেলের লোক আমি ঠিকই কিন্তু কাউকে সুবিধা করে দেবার মতো  অভিজ্ঞতা আমার নেই। নেহাত পেটের দায়ে এই কাজ করছি। তবে আপনাকে যতটা সম্ভব আমি সাহায্য করব ।"
লোকটির  কাছ থেকে আর কিছু উত্তর পেলাম না, পরিবর্তে নাক ডাকার আওয়াজ আসতে থাকল। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
গোলবাধল পরদিন সকালে। টিটি এসে টিকিট দেখতে চাইতেই বুড়ো তার নোকিয়া ষোলোশ' মোবাইলটি টিটির হাতে দিয়ে বলল," মেসেজ ঢুকছে, দেখেনিন। "  টিটি ভদ্রলোক হাজার চেষ্টা করেও টিকিট কনফার্মের মেসেজটি পেলেন না। একসময় বিরক্ত হয়ে মোবাইলটি বুড়োর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "আইকার্ড দেন।"
  বুড়ো ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ টিটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটা উত্তাপহীন গলায় বলল, "আইকার্ড তো নেই বাবা ! রেশনকার্ড আছে, বের করব ?"   টিটি আর দাঁড়াল না।
নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন আসতেই দু'জন রেলপুলিশ এসে বুড়োকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আমার মুখোমুখি হতেই বুড়ো একটা শিশুসুলভ হেসে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
                   নিউজলপাইগুড়িতে  ব্রেকফাস্ট সেরে যাত্রিদের সাথে একটা গাড়িতে চড়ে বসলাম। দীর্ঘ যাত্রাপথ । আমাদের মোট পাঁচটা গাড়িতে চল্লিশজন যাত্রি। আমি একদম পেছনের গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছি। ড্রাইভার নেপালি হলেও বাংলা ভালোই জানে। নাম পওন প্রধান। সারা রাস্তা গল্প করতে করতে চললাম।
পওন জানাল যে গ্যাংটকে এখন  বর্ষার প্রাকমূহুর্ত। একমাত্র জিরোপয়েন্ট ছাড়া বরফ পাওয়া দুষ্কর। আমরা যেন সেখানে যাই। তবে গ্যাংটকে খুব সাবধান। আমি বিস্মিত হয়ে শুধালাম, "সাবধান কেন ?"
পওন বলল, "সাবজী, জিন্দেগি ভগবানের দেন আছে; - আপনি শুধু শুধু কেন তকলিফ উঠাবেন !"
আমি বললাম, "হেঁয়ালি বুঝি না, যা বলবে ঠিক করে বল।"
পওন ডানহাতটা দুটো কানে ঠিকিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে জপ করে নিল, তারপর বলল, " শয়তান আছে সাবজী ! একদম শয়তান ! আন্ধেরা হোয়ে গেলে ও আসে। তারপর আঁখ মু' সিনা পাঞ্জা দিয়ে সিরে লেয়। রাম রাখে সাবজী !! "
আমার বুকটা কেমন আকুপাকু করতে লাগল। বলে কি পওন, চোখ মুখ বুক ছিঁড়ে নেয় ! পেটের দায়ে কি শেষে জানে মারা পড়ব !  ট্রেন থেকে নেমেই একটা ঠান্ডা জলের বোতল কিনেছিলাম, সেটা হতে কিছুটা জল গলায় ঢেলে নিলাম। ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া গলাটাতে একটু জোর এল। আমি সভয়ে বললাম," পুলিশ কিছু করে না !"
পওন বলল, "ও দানো আসে সাবজী। দানোর সাথে কেউ ভি পারে না।"
আমি আর কথা বাড়ালাম না। গাড়ি ছুটে চলল।  প্রচণ্ড রোদে আমার অবস্থা খারাপ। মাথা ধরে গিয়েছে। পওন জানাল যে আর কিছুদূর গেলেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হবে। হ্যাঁ, তাই হল। বেশ অনেকটা চলার পর পর জঙ্গলের গাছপালাগুলোর একটা পরিবর্তন এল। জঙ্গল ঘন হচ্ছে আর শালের জঙ্গলে অনুপ্রবেশ ঘটছে পাইন দেবদারুর। বাতাসটাও শীতল হয়ে আসছে। দু'পাশের পটচিত্রে আমূল পরিবর্তন। একদিকে পাহাড়ের কোলে রাস্তা আর অন্যদিকে গভীর খাত। সেই গভীর খাতের পাশে আবার কালচে সবুজ রঙের সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। রাস্তা সাপের মতো আঁকাবাঁকা।
রাস্তার পাশে একটা হোটেলে আমাদের গাড়িগুলো দাঁড়াল। দুপুরের খাওয়ার জন্য। আমি একপ্লেট ডিমভাত অর্ডার করলাম। ভাত এল। সরু চালের ভাত সাথে ডিমের কারি ডাল আর পাঁপড়। খেয়ে মন বা পেট কিছুই ভরল না। আমরা রাঢ়বঙ্গের মানুষ, পেট ভর্তি মোটা চালের ভাত খেয়ে অভ্যাস, আমাদের কাছে এ খাবার নস্যি। কিন্তু উপাই কি ?
খেতে খেতেই শুনলাম দু'জন  ড্রাইভার নেপালি ভাষায় নিজেদের মধ্যে গ্যাংটকের দানবের ব্যাপারে আলোচনা করছে । নেপালি ভাষাটা হিন্দির কাছাকাছি হওয়ায় অনেকটাই বুঝতে পারছি । দুজনের আলোচনার সারমর্ম হল এই,
' একটা দানবের আবির্ভাব ঘটেছে গ্যাংটক শহরে। সে যেমন নির্মম তেমনি শক্তিশালী। পাহাড়ী রাস্তা হতে শুরু করে হোটেলের ঝুলবারান্দা, - সর্বত্রই তার আতঙ্ক বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম পুলিশ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই সমস্যা সমাধানে তৎপর হয়েছে।
দানবটিকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। তবে এর কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে গোটা উপত্যকায়। নিঃশব্দে আসে আর আঘাত করে। এ পর্যন্ত সাত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। সবারই চোখ মুখ ক্ষতবিক্ষত আর বুক চিরে কলজেটা বের করে নেওয়া হয়েছে। আতঙ্কে  সন্ধ্যার পর মানুষ আর  ঘর হতে বের হয় না। '
                                     ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ গ্যাংটকে পৌঁছালাম।  বোধিমার্গের কাছাকাছি একটা হোটেল আগেথেকেই ঠিক করা ছিল। পাঁচতলা হোটেলের ছাদের দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। সব যাত্রীর রুমের ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি নিজের রুমে গিয়ে লেপের তলায় ঢুকলাম। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। নেহাত ডাকাত না পড়লে রাতের খাবারে ডাক পড়ার আগে লেপ হতে বেরোবো না।
রাত্রের খাবারের আয়োজন হয়েছে। আলুপোস্ত, ডাল, ডিমকষা, ভাত আর পাঁপড় ভাজা। এখানে খাবার শেষে একটু করে জলপাইয়ের আচার দেওয়া হয়, অনেকটা আমাদের সমতলের শেষপাতে চাটনির মতো। খেতে খেতে পাশের টেবিলে চোখ যেতেই দেখলাম সেই বুড়ো। একমনে ডাল দিয়ে ভাত মাখাচ্ছে। তবে কাল রাতের তুলনায় বয়সটা একটু কম মনে হলো। আমার দিকে নজর যেতেই বুড়ো একগাল হেসে বলল, "কেমন আছেন স্যার ?"
            আমি দায়সারা ভাবে জবাব দিলাম, "ভালো।"    বুড়োটা তাতে একটুও বিরক্ত না হয়ে পরবর্তী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। "খুব ব্যস্ত আছেন কি ? মানে একটু যদি সময় দেন খাওয়ার পরে। আমি বেশিক্ষণ জ্বালাবো না।"
বুড়োর ব্যাপারে আমিও খুব কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণের পরিচয়েই লোকটার উপর একটা দূর্বলতা এসে গিয়েছিল তাই আর না করতে পারলাম না। আলুপোস্ত মাখানো ভাত মুখে তুলতে তুলতে বললাম," আচ্ছা আসুন। "
ঘরে ঢুকেই বুড়ো আমার বিছানার উপর গুছিয়ে বসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " আমি মশাই কোনো সাহায্য প্রার্থী বা  উমেদার গোছের কিছু নই। আমি এখানে এসেছি নিতান্তই নিরুপায় হয়ে। নাহয় এ বয়সে এতটা উঁচুতে শুধু শুধু প্রেসার বাড়াতে আসবো কেন।"
এই বলে বুড়ো পকেট হতে একটা জীর্ণ কাগজের টুকরো বের করে বিছানার উপর রাখল । কাগজটা বয়সের ভারে লালচে হলুদ হয়ে গেছে। বহুবার ভাঁজ করার ফলে ভাঁজগুলো ছিঁড়ে যাবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমি কাগজটা হাতে নিয়ে অতি সাবধানে খুলে ফেললাম। কালচে লাল কালিতে আঁকা একটা ম্যাপ। ম্যাপের  কিছু কিছু জায়গায় চক্রের মতো চিহ্ন দেওয়া আছে।
আমি বললাম, "এ তো মনে হচ্ছে সিকিমের ম্যাপ। কিন্তু এই ম্যাপের সাথে আপনার সিকিম আসার কি সম্পর্ক থাকতে পারে !"
বুড়ো মিটমিট করে হেসে বলল, "আপনার বুদ্ধি আছে। ম্যাপটা আমার বাবার সিন্দুক থেকে পেয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা ভাইবোনেরা পিতৃস্নেহ হতে বঞ্চিত। আমার বাবা ভবঘুরে মানুষ ছিলেন। সংসারের কোনো খোঁজ তিনি রাখতেন না। হঠাৎ হঠাৎ করে ঘর হতে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। ফিরে আসতেন দু'চার বছর পরে।  শেষ যেবার গেলেন সেবারে এলেন পাক্কা সাত বছর পর। আমরা কেউই তার জন্যে ভাবতাম না। সামান্য কিছু জমিজমা ছিল, তার আয়েই মোটামুটি দিন গুজরান হয়ে যেত। তাছাড়া দাদা বড় হয়ে সংসারের হাল ধরলেন।
হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, বাবা সেবার ফিরলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় জটা, শরীরে রক্তশূন্যতার ছাপ স্পষ্ট। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে। যেন চিনতে পারছেন না আমাদের। আমরা ধরাধরি করে বাবাকে ঘরে নিয়ে গেলাম। বিছানায় শুইয়ে দিলাম। সেই যে তিনি বিছানাগত হলেন আর উঠলেন না।
বাবা বাকশক্তি হারিয়েছিলেন। স্মৃতিশক্তিও তলানিতে। ফলে আমরা জানতেই পারলাম না কিভাবে এসব হল। এরপর একবছর বেঁচেছিলেন বাবা। বাবার মৃত্যুর পর আমরা এবিষয়ে আর কোনো কৌতূহল দেখাইনি।
ঠিক মাসখানেক আগে আমার নাতির খেলনা গাড়িখানা ভেঙ্গে যায়। কি কান্না কি কান্না ! নাতি আমার খুব আদরের । ওর কোনও কষ্ট আমি দেখতে পারি না। এজন্য দিনে কতবার যে বৌমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয় তার অন্ত নেই। লোকে  আড়ালে আবডালে আমার  এই স্বভাব নিয়ে পাঁচকথা বলে বেড়ায়। আমি ওসবে পাত্তা দিই না।
নাতিকে কি করে চুপ করাব সে নিয়ে ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ আমার ছেলেবেলার কাঠের গাড়িটার কথা মনে পড়ল। আউটহাউসে পুরানো জিনিসপত্রের সঙ্গে থাকার কথা সেটা। যেই মনে হওয়া ছুটলাম আউটহাউসে। পুরানো মরচে ধরা তালাটা খুলতেই অনেক সময় লেগে গেল।
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই গোটাদুয়েক বাদুর তীব্র গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটা আবার আমার গালে রীতিমত লাথি মেরে জানান দিয়ে গেল যে ঘরটা তাদের। আমি নিতান্তই বহিরাগত মাত্র। ঘরের ভেতরের অবস্থাও খুব খারাপ। ধুলো আর ঝুলে সবজিনিস ঢেকে আছে। মেঝেতেও এক ইঞ্চি পুরু ধুলো। এদিক সেদিক খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একটা কালো রঙের ট্রাঙ্কের দিকে নজর গেল। কাছে গিয়ে ট্রাঙ্কের গা' হতে ধুলো ঝাড়তেই সাদা পেইন্টের লেখাটা স্পষ্ট হয়ে এল।
SHASHANKA SHEKHAR MOITRA
MA, PHD,
DIPLOMA IN PARACYCHOLOGY 

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...