যক্ষপুরি
সুব্রত মজুমদার
"এই বলো না আমি যদি মরে যাই তুমি আবার বিয়ে করবে ?" অপরুপা দু'হাত দিয়ে সৌমেন্দুর কলারটা টেনে ধরে। সৌমেন্দু অপরুপার উপর ঝুঁকে পড়ে বলে, " কি আজেবাজে বক তুমি। আমার খুব খারাপ লাগে ওসব ননসেন্স কথাবার্তা শুনে।"
মাসখানেক ধরে জটিল রোগে শয্যাশায়ী অপরুপা। বছর তিনেকের বিবাহিত জীবনে খুবই সুখী ছিল তারা। ভালোবেসে বিয়ে। অনাথ আশ্রমে প্রতিপালিত অপরুপাকে সৌমেন্দুর বাবা মা মেনে নেয় নি। সৌমেন্দুর বাবা তো সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার আপত্তির কথা। অপরুপাকে তিনি বৌমা হিসাবে মেনে নিতে অপারগ।
সৌমেন্দুর বেশ মনে পড়ে দিনটার কথা। শহরতলির একটা জীর্ণ বাড়ির একচিলতে একটা ঘরে সৌমেন্দু আর অপরুপা পেতেছে তার নতুন সংসার। ভাড়া মাসে ছয়শ' টাকা। একটা ফুড প্রসেসিং কোম্পানিতে তিন হাজার টাকার মাস মাইনের চাকরি তার। সংসার টানতে অভারটাইম করতে হয়। অপরুপা টিউশনি পড়ায়। দুজনের ইনকামে সংসারের চাকা সাবলীল গতিতে গড়িয়ে চলে।
ছেলে বিয়ে করেছে শুনে বিরূপাক্ষবাবু মনে খুব আঘাত পেলেন। হাইপ্রেসারের রোগী, সামান্য উত্তেজনাতেই বিপি বেড়ে যায়। অসুস্থ্য হয়ে দিনদুয়েক বিছানাগত থাকার পর যখনই একটু সুস্থ্য হলেন হাঁক পড়লেন গিন্নীকে, " সৌমেন্দুর মা, ও সৌমেন্দুর মা, একবার এদিকে শুনে যাও।"
সৌমেন্দুর মা ঘরে এলে মেঝের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, "সৌমেন্দুর ঠিকানাটা দাও। আমি একবার ওর ওখানে যাব।" সৌমেন্দুর মা আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। একটা কাগজের টুকরো স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তারপর নিরুত্তাপ গলায় বললেন," ছেলে বড় হয়েছে, ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা ও রাখে। ওর উপরে রাগ করে নিজের শরীর খারাপ করো না। তোমার ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে আমার কি হবে ? "
বিরূপাক্ষবাবু কোনো উত্তর দিলেন না। ঠিকানা লেখা কাগজটা পাঞ্জাবির পকেটে চালান করে দিলেন। মনে পড়ে গেল আজ হতে তিরিশ বছর আগের একটা দিনের কথা। বিরূপাক্ষবাবু সেদিন হাঁসপাতালের মেটারনিটি ওয়ার্ডের সামনে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। এমন সময় কাঁচের দরজা খুলে গেল। একজন নার্স সাদা নরম কাপড়ে মোড়া একটা সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে এসে বললেন, " মমতাবালা ঘোষের বাড়ির কে আছে ? ছেলে হয়েছে। মিষ্টি খাবার টাকা বের করুন, তবেই ছেলের মুখ দেখাবো।"
বিরূপাক্ষবাবু পকেট হতে একটা একশ টাকার নোট বের করে নার্সের হাতে দিলেন। নার্স কাপড়ে জড়ানো একরত্তি বাচ্চাটাকে বিরূপাক্ষবাবুর কোলে তুলে দিলেন। বিরূপাক্ষবাবু প্রত্যক্ষ করলেন নিজেকে। শাস্ত্রে যথার্থই বলে যে পুত্রের মধ্যে পিতা নিজের আত্মাকে দর্শন করেন। আত্মদর্শন করলেন বিরূপাক্ষবাবু।
আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগে তার। একমাত্র ছেলে, সে কিনা বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করেছে একটা অনাথ মেয়েকে। মাথায় রক্ত উঠে যায় বিরূপাক্ষবাবুর। তিনি পাখার রেগুলেটারটা বাড়িয়ে দেন। সংসার একটা পাগলাগারদ, যারা সুস্থ্য তাঁদেরই টেকা দায়।
বাস হতে নেমে রিক্সা নিলেন বিরূপাক্ষবাবু। রিক্সাওয়ালা বলল, " আপনি সৌমেন বাবুর বাবা। খুব ভালো লোক তেনারা। জুটি তো লয় য্যানো মা লক্ষ্মী। তা দিদিমণি তো খুব ইস্মারট।" এই বলে খিঁক খিঁক করে হেঁসে নিলো একপ্রস্থ। কান এঁটো করা হাঁসিতে বিরূপাক্ষবাবুর কানের পর্দা যেন ফেটে যাবার উপক্রম হল। চুপ করে রইলেন তিনি।
রিক্সা হতে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভেতর। অপরুপা শ্বশুরকে দেখে মাথায় কাপড় দিয়ে প্রণাম করতে গেলেন। পা সরিয়ে নিলেন বিরূপাক্ষবাবু। বললেন, " কোনো প্রয়োজন নেই। এমনিতেই যা করেছ ওই অনেক।"
মুখ নিচু করে ঘরের ভেতরে চলে গেল অপরুপা। সৌমেন্দু ঠিক তখনই ঘরে ফিরল। শশব্যস্ত হয়ে সে বাবাকে প্রণাম করল। বিরূপাক্ষবাবু আশীর্বাদ করে বললেন, "সুমতি হোক।"
ছেলের শত অনুনয়েও ঘরের ভেতরে ঢুকলেন না বিরূপাক্ষবাবু। উঠানে দাঁড়িয়েই ছেলের সঙ্গে বার্তালাপ সারলেন। ছেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো বাবার সামনে। বিরূপাক্ষবাবু বললেন, "তোমাকে আমি অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি। নিজে না খাইয়ে তোমাকে খাইয়েছি। তুমি অসুস্থ্য হলে রাতের পর রাত আমি আর তোমার মা জেগেছি। কোনো কর্তব্যের ত্রুটি করিনি। এখন তুমি লায়েক হয়েছ, কি করবে সে ভার তোমার। ওই অজাত কুজাতের মেয়েকে আমি কোনোদিন মেনে নেব না।"
অপরুপা কাঁদতে লাগল। সৌমেন্দু বিরূপাক্ষবাবুকে বলল," আমি কোনো অন্যায় করিনি বাবা। অপরুপা অনাথ, এটা তার অন্যায়টা কোথায় ? আমি একমাত্র তখনই ফিরে যাব যখন তোমরা অপরুপাকে মেনে নেবে। "
বিরূপাক্ষবাবু আর কথা বাড়ালেন না। তিনি ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন।
সৌমেন্দু আর বাড়ি ফেরেনি। তার আর অপরুপার মিলিত শ্রমে সংসারে আনন্দ ফুর্তি সুখ সমৃদ্ধি বিরাজ করতে লাগল। সারাদিন খাটাখাটির পর ঘরে এসে কোনোদিন দাবা তো কোনোদিন লুডো নিয়ে বসে দুজনে। সৌমেন্দু সহজ সরল মানুষ, তাই প্রতিবারই হেরে যায়। অপরুপা চুরিতে ওস্তাদ। কাঁচা গুঠি পাকিয়ে নেওয়া বা দানে দানে ছক্কা মারা তার বাঁ হাতের খেল। যেদিন ধরা পড়ে সেদিন সৌমেন্দু খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে। বলে, "চোর ডাকাতের সাথে খেলা আমার কর্ম নয়। ভাত বাড়ো, খিদে পেয়েছে।"
অপরুপা আসন পেতে জলের গ্লাসে জল ভরে ভাত নিয়ে আসে। কন্টলের চালের ছোটো ছোটো ফাটা ফাটা ভাত। আলু ঢ্যাঁড়সের পাতলা ঝোল আর আলুসেদ্ধ। খুব তৃপ্তি করে খায় সৌমেন্দু। সৌমেন্দুর খাওয়া হয়ে গেলে তার পাতে বসে পড়ে অপরুপা। সংসারে সে যেন সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী।
অপরুপা টিউশন পড়ায়। আশেপাশের বস্তির গরীব ছেলেমেয়েরা সামান্য অর্থের বিনিময়ে টিউশন পড়তে আসে। তাও মাস গেলে হাজার খানেক টাকা হয়ে যায়। টাকা জমিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনেছে অপরুপা। যা সামান্য রোজগার করা যায়।
মানুষের সুখ চিরস্থায়ী হয় না। অপরুপা-সৌমেন্দুর জীবনেও সুখ সইল না। অপরুপা প্রেগনেন্ট হল। সৌমেন্দুর আনন্দের শেষ নেই । ঘর ভর্তি করে ফেলল খেলনাতে। নামও ঠিক হল শ'খানেক। প্রতিদিনই ঝগড়া, সৌমেন্দুর মেয়ে চাই আর অপরুপার ছেলে। সৌমেন্দু বলল, "দেখো, আমাদের উচিত কোনো গাইনোর সাথে কনসাল্ট করা। এভাবে চলতে পারে না।"
অপরুপার শত আপত্তি সত্ত্বেও সৌমেন্দু তাকে নিয়ে গেল ডঃ ব্যানার্জির চেম্বারে। অপরুপাকে পরীক্ষা করার পর ডাঃ ব্যানার্জি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, "কিছু টেষ্ট লিখে দিচ্ছি। সামনের সপ্তাহে আসুন। মিসেস ঘোষকে আনার প্রয়োজন নেই। "
ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্যি হল। অপরুপার জরায়ুতে ফিটাস নয়, বড় হচ্ছে একটা টিউমার। শীঘ্রই অপারেশন না করালে বিপদ হতে পারে। আর অপারেশনের পর অপরুপা আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। খবরটা পেয়ে অপরুপা ভেঙ্গে পড়ল। সৌমেন্দু বলল," নিজের হল না তো কি হল, আমরা দত্তক নেব। "
অপারেশনের পর মাস ছয়েক শয্যাশায়ী ছিল অপরুপা। সেসময় সৌমেন্দু জীবন দিয়ে তার সেবা করেছে। সৌমেন্দুর সেবায় আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠল অপরুপা।
একদিন দুপুরে অপরুপা খেতে বসেছে এমন সময় সৌমেন্দুর কারখানার একজন এসে খবর দিল সৌমেন্দুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একটা ভারী ড্রাম পড়েছে সৌমেন্দুর কোমরের উপর। অপরুপা ভাত ফেলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল।
এ যাত্রা বেঁচে গেল সৌমেন্দু। কিন্তু হারিয়ে ফেলল চলাফেরার শক্তি। কোমর হতে নিম্নাংশ অসাড় হয়ে গেছে জীবনের মতো। অপরুপা কাজ পেয়েছে সৌমেন্দুর কারখানাতে। আজ আর সৌমেন্দুর জন্য একটুও সময় নেই অপরুপার। কারখানায় যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে অপরুপা, সৌমেন্দু ক্ষীণকণ্ঠে ডাকল, "অপরুপা ! অপরুপা !..."
অপরুপা রাগতস্বরে বলল, "কি চাই ? কত জ্বালাবে তুমি। মরতে পারো না ! আমি মুক্তি পাই তাহলে..."
সৌমেন্দু বলল, "একটু বস না ! কতদিন তোমাকে কাছ থেকে দেখিনি।"
এমন সময় বাইরে হতে একটা পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ এল, " অপু, জলদি করো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। "
লিপস্টিকটা ঠোঁটে লাগাতে লাগাতে বলল, "যাই...."