Sunday, May 26, 2019

যক্ষপুরী // সুব্রত মজুমদার


                            যক্ষপুরি
                      সুব্রত মজুমদার 

          "এই বলো না আমি যদি মরে যাই তুমি আবার বিয়ে করবে ?" অপরুপা দু'হাত দিয়ে সৌমেন্দুর কলারটা টেনে ধরে। সৌমেন্দু অপরুপার উপর ঝুঁকে পড়ে বলে, " কি আজেবাজে বক তুমি। আমার খুব খারাপ লাগে ওসব ননসেন্স কথাবার্তা শুনে।" 
মাসখানেক ধরে জটিল রোগে শয্যাশায়ী অপরুপা। বছর তিনেকের বিবাহিত জীবনে খুবই সুখী ছিল তারা। ভালোবেসে বিয়ে। অনাথ আশ্রমে প্রতিপালিত অপরুপাকে সৌমেন্দুর বাবা মা মেনে নেয় নি। সৌমেন্দুর বাবা তো সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার আপত্তির কথা। অপরুপাকে তিনি বৌমা হিসাবে মেনে নিতে অপারগ। 
   সৌমেন্দুর বেশ মনে পড়ে দিনটার কথা। শহরতলির একটা জীর্ণ বাড়ির একচিলতে একটা ঘরে সৌমেন্দু আর অপরুপা পেতেছে তার নতুন সংসার। ভাড়া মাসে ছয়শ' টাকা। একটা ফুড প্রসেসিং কোম্পানিতে তিন হাজার টাকার মাস মাইনের চাকরি তার। সংসার টানতে অভারটাইম করতে হয়। অপরুপা টিউশনি পড়ায়। দুজনের ইনকামে সংসারের চাকা সাবলীল গতিতে গড়িয়ে চলে। 
ছেলে বিয়ে করেছে শুনে বিরূপাক্ষবাবু মনে খুব আঘাত পেলেন। হাইপ্রেসারের রোগী, সামান্য উত্তেজনাতেই বিপি বেড়ে যায়। অসুস্থ্য হয়ে দিনদুয়েক বিছানাগত থাকার পর যখনই একটু সুস্থ্য হলেন হাঁক পড়লেন গিন্নীকে, " সৌমেন্দুর মা, ও সৌমেন্দুর মা, একবার এদিকে শুনে যাও।" 
সৌমেন্দুর মা ঘরে এলে মেঝের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, "সৌমেন্দুর ঠিকানাটা দাও। আমি একবার ওর ওখানে যাব।"  সৌমেন্দুর মা আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। একটা কাগজের টুকরো স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তারপর নিরুত্তাপ গলায় বললেন," ছেলে বড় হয়েছে, ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা ও রাখে। ওর উপরে রাগ করে নিজের শরীর খারাপ করো না। তোমার ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে আমার কি হবে ? "
বিরূপাক্ষবাবু কোনো উত্তর দিলেন না। ঠিকানা লেখা কাগজটা পাঞ্জাবির পকেটে চালান করে দিলেন। মনে পড়ে গেল আজ হতে তিরিশ বছর আগের একটা দিনের কথা। বিরূপাক্ষবাবু সেদিন হাঁসপাতালের মেটারনিটি ওয়ার্ডের সামনে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। এমন সময় কাঁচের দরজা খুলে গেল। একজন নার্স সাদা নরম কাপড়ে মোড়া একটা সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে এসে বললেন, " মমতাবালা ঘোষের বাড়ির কে আছে ? ছেলে হয়েছে। মিষ্টি খাবার টাকা বের করুন, তবেই ছেলের মুখ দেখাবো।" 
বিরূপাক্ষবাবু পকেট হতে একটা একশ টাকার নোট বের করে নার্সের হাতে দিলেন। নার্স কাপড়ে জড়ানো একরত্তি বাচ্চাটাকে বিরূপাক্ষবাবুর কোলে তুলে দিলেন। বিরূপাক্ষবাবু প্রত্যক্ষ করলেন নিজেকে। শাস্ত্রে যথার্থই বলে যে পুত্রের মধ্যে পিতা নিজের আত্মাকে দর্শন করেন। আত্মদর্শন করলেন বিরূপাক্ষবাবু। 
                            আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগে তার। একমাত্র ছেলে, সে কিনা বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করেছে একটা অনাথ মেয়েকে। মাথায় রক্ত উঠে যায় বিরূপাক্ষবাবুর। তিনি পাখার রেগুলেটারটা বাড়িয়ে দেন। সংসার একটা পাগলাগারদ, যারা সুস্থ্য তাঁদেরই টেকা দায়। 
  বাস হতে নেমে রিক্সা নিলেন বিরূপাক্ষবাবু। রিক্সাওয়ালা বলল, " আপনি সৌমেন বাবুর বাবা। খুব ভালো লোক তেনারা। জুটি তো লয় য্যানো মা লক্ষ্মী। তা দিদিমণি তো খুব ইস্মারট।"  এই বলে খিঁক খিঁক করে হেঁসে নিলো একপ্রস্থ। কান এঁটো করা হাঁসিতে বিরূপাক্ষবাবুর কানের পর্দা যেন ফেটে যাবার উপক্রম হল। চুপ করে রইলেন তিনি। 
           রিক্সা হতে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভেতর। অপরুপা শ্বশুরকে দেখে মাথায় কাপড় দিয়ে প্রণাম করতে গেলেন। পা সরিয়ে নিলেন বিরূপাক্ষবাবু। বললেন, " কোনো প্রয়োজন নেই। এমনিতেই যা করেছ ওই অনেক।" 
মুখ নিচু করে ঘরের ভেতরে চলে গেল অপরুপা। সৌমেন্দু ঠিক তখনই ঘরে ফিরল। শশব্যস্ত হয়ে সে বাবাকে প্রণাম করল। বিরূপাক্ষবাবু আশীর্বাদ করে বললেন, "সুমতি হোক।"
ছেলের শত অনুনয়েও ঘরের ভেতরে ঢুকলেন না বিরূপাক্ষবাবু। উঠানে দাঁড়িয়েই ছেলের সঙ্গে বার্তালাপ সারলেন। ছেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো বাবার সামনে। বিরূপাক্ষবাবু বললেন, "তোমাকে আমি অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি। নিজে না খাইয়ে তোমাকে খাইয়েছি। তুমি অসুস্থ্য হলে রাতের পর রাত আমি আর তোমার মা জেগেছি। কোনো কর্তব্যের ত্রুটি করিনি। এখন তুমি লায়েক হয়েছ, কি করবে সে ভার তোমার। ওই অজাত কুজাতের মেয়েকে আমি কোনোদিন মেনে নেব না।"
অপরুপা কাঁদতে লাগল। সৌমেন্দু বিরূপাক্ষবাবুকে বলল," আমি কোনো অন্যায় করিনি বাবা। অপরুপা অনাথ, এটা তার অন্যায়টা কোথায় ? আমি একমাত্র তখনই ফিরে যাব যখন তোমরা অপরুপাকে মেনে নেবে। "
বিরূপাক্ষবাবু আর কথা বাড়ালেন না। তিনি ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন।
         সৌমেন্দু আর বাড়ি ফেরেনি। তার আর অপরুপার মিলিত শ্রমে সংসারে আনন্দ ফুর্তি সুখ সমৃদ্ধি বিরাজ করতে লাগল। সারাদিন খাটাখাটির পর ঘরে এসে কোনোদিন দাবা তো কোনোদিন লুডো নিয়ে বসে দুজনে। সৌমেন্দু সহজ সরল মানুষ, তাই প্রতিবারই হেরে যায়। অপরুপা চুরিতে ওস্তাদ। কাঁচা গুঠি পাকিয়ে নেওয়া বা দানে দানে ছক্কা মারা তার বাঁ হাতের খেল। যেদিন ধরা পড়ে সেদিন সৌমেন্দু খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে। বলে, "চোর ডাকাতের সাথে খেলা আমার কর্ম নয়। ভাত বাড়ো, খিদে পেয়েছে।"
অপরুপা আসন পেতে জলের গ্লাসে জল ভরে ভাত নিয়ে আসে। কন্টলের চালের ছোটো ছোটো ফাটা ফাটা ভাত। আলু ঢ্যাঁড়সের পাতলা ঝোল আর আলুসেদ্ধ। খুব তৃপ্তি করে খায় সৌমেন্দু। সৌমেন্দুর খাওয়া হয়ে গেলে তার পাতে বসে পড়ে অপরুপা। সংসারে সে যেন সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী।
       অপরুপা টিউশন পড়ায়। আশেপাশের বস্তির গরীব ছেলেমেয়েরা সামান্য অর্থের বিনিময়ে টিউশন পড়তে আসে। তাও মাস গেলে হাজার খানেক টাকা হয়ে যায়। টাকা জমিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনেছে অপরুপা। যা সামান্য রোজগার করা যায়।
     মানুষের সুখ চিরস্থায়ী হয় না। অপরুপা-সৌমেন্দুর জীবনেও সুখ সইল না। অপরুপা প্রেগনেন্ট হল। সৌমেন্দুর আনন্দের শেষ নেই । ঘর ভর্তি করে ফেলল খেলনাতে। নামও ঠিক হল শ'খানেক। প্রতিদিনই ঝগড়া, সৌমেন্দুর মেয়ে চাই আর অপরুপার ছেলে। সৌমেন্দু বলল, "দেখো, আমাদের উচিত কোনো গাইনোর সাথে কনসাল্ট করা। এভাবে চলতে পারে না।"
 অপরুপার শত আপত্তি সত্ত্বেও সৌমেন্দু তাকে নিয়ে গেল ডঃ ব্যানার্জির চেম্বারে।  অপরুপাকে পরীক্ষা করার পর ডাঃ ব্যানার্জি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, "কিছু টেষ্ট লিখে দিচ্ছি। সামনের সপ্তাহে আসুন। মিসেস ঘোষকে আনার প্রয়োজন নেই। "
ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্যি হল। অপরুপার জরায়ুতে ফিটাস নয়, বড় হচ্ছে একটা টিউমার। শীঘ্রই অপারেশন না করালে বিপদ হতে পারে। আর অপারেশনের পর অপরুপা আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। খবরটা পেয়ে অপরুপা ভেঙ্গে পড়ল। সৌমেন্দু বলল," নিজের হল না তো কি হল, আমরা দত্তক নেব। "
 অপারেশনের পর মাস ছয়েক শয্যাশায়ী ছিল অপরুপা। সেসময় সৌমেন্দু জীবন দিয়ে তার সেবা করেছে। সৌমেন্দুর সেবায় আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠল অপরুপা।
                          একদিন দুপুরে অপরুপা খেতে বসেছে এমন সময় সৌমেন্দুর কারখানার একজন এসে খবর দিল সৌমেন্দুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একটা ভারী ড্রাম পড়েছে সৌমেন্দুর কোমরের উপর। অপরুপা ভাত ফেলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল।
এ যাত্রা বেঁচে গেল সৌমেন্দু। কিন্তু হারিয়ে ফেলল চলাফেরার শক্তি। কোমর হতে নিম্নাংশ অসাড় হয়ে গেছে জীবনের মতো। অপরুপা কাজ পেয়েছে সৌমেন্দুর কারখানাতে। আজ আর সৌমেন্দুর জন্য একটুও সময় নেই অপরুপার। কারখানায় যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে অপরুপা, সৌমেন্দু ক্ষীণকণ্ঠে ডাকল, "অপরুপা ! অপরুপা !..."
      অপরুপা রাগতস্বরে বলল, "কি চাই ? কত জ্বালাবে তুমি। মরতে পারো না ! আমি মুক্তি পাই তাহলে..."
সৌমেন্দু বলল, "একটু বস না ! কতদিন তোমাকে কাছ থেকে দেখিনি।"
এমন সময় বাইরে হতে একটা পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ এল, " অপু, জলদি করো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। "
লিপস্টিকটা ঠোঁটে লাগাতে লাগাতে বলল, "যাই...." 

স্বপনচারিনী // সুব্রত মজুমদার

দেখেছি তোমাকে স্বপনচারিনী বিদ্যুন্মালা গলে
মদির নয়ন চপল চরণ কিঙ্কিণী রব তোলে।
সন্ধ্যা তারার মালিকা গলায়  চাঁদের মুকুট শিরে
পাকা কেঁদুরির মতন ওষ্ঠে জ্যোৎস্নার হাঁসি ঝরে।
সন্ধ্যার যত হংসবলাকা আপন কুলায় ফেরে
তাদের শুভ্র পালক তোমার সকল অঙ্গ ঘিরে।
বেলির গুচ্ছ নীবিবন্ধন রসনা কমলদল
কমলপত্রে শিশিরের মতো আঁখি করে টলমল। 
স্বপনের ঘোরে দেখেছি তোমায় তমসা নদীর কূলে, 
সবুজ পাড়ের আশমানী শাড়ি দখিনা হাওয়ায় দোলে। 
লাল শালুকের মালা পরে গলে ঢেউ তুলে কালো জলে
হে মৃগনয়ণা ভাবো কার কথা এলাইয়ে এলোচুলে।
 ঝিঁঝিঁ ঝঙ্কারে শিঞ্জন তুলে বেলির সুবাস ছড়ায়ে
স্বর্ণলতার মতন প্রেয়সী অঙ্গে রহ গো জড়ায়ে। 
তোমায় দেখেছি দ্বারকার কূলে দেখেছি গিরিকন্দরে
ইলোরার রুপে ধৌলির স্তুপে দেখেছি হৃদয় মন্তরে;
তোমারে হেরিয়া রচে কালিদাস মন্দাক্রান্তা ছন্দ, 
ভিঞ্চির তুলি তোমার সুষমা আঁকে দিয়ে তার আনন্দ। 
বৈজুর সুরে বীণাঝঙ্কারে বিরহীর অভিমানে 
তুমি আছ প্রিয়া, আছ চিরকাল হৃদয়ের নিধুবনে। 

Sunday, May 5, 2019

ঈশানপুরের অশরীরী - শেষ ভাগ // সুব্রত মজুমদার

  অপরুপার সাথে কথা বলে বিক্রম যা বুঝল তাতে অপরুপাও তার শাশুড়ির প্রতি প্রসন্ন নয়। শশাঙ্কের বাড়িতে কফি খেতে খেতে ভুতের ব্যাপারে আলোচনা হল। বোঝা গেল ডাক্তার হলেও শশাঙ্ক ভুতে বিশ্বাস করে।
" আপনাদের দুজনের কাছেই একটা কমন প্রশ্ন আছে। তিয়াশা দেবীর ব্যাপারে।" বিক্রমের কথাটা শেষ হবার আগেই অপরুপা বলে ওঠে, " মহা ধড়িবাজ মেয়ে। ওর পেটে পেটে শয়তানি।"
শশাঙ্ক আপত্তি জানায়, " অপরুপার কথায় কান দেবেন না। তিয়াশা কিচ্ছু বোঝে না। না বুঝেই আলটপকা মন্তব্য করার অভ্যাস ওর। রথিনের পূর্বজন্মের পূন্যের ফল যে ওকে বৌ হিসেবে পেয়েছে।"
          যে ভ্রাতৃবধূ ভাসুরকে সন্মান দেয় না তার জন্য ভাসুর মহাশয়টির এত দরদ কেন তা বুঝে উঠতে পারে না বিক্রম। আসার সময় শশাঙ্ক তার গাড়িতে করে বিক্রম আর দেবলীনাকে রায়ভিলার সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়।
              রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিক্রমরা ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ঠিক দুটো নাগাদ ঘুম ভেঙ্গে যায় বিক্রমের। লোডশেডিং হয়ে গেছে। টর্চ জ্বালিয়ে বিছানা থেকে উঠে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় সে। জলের জাগ হতে কাঁচের গ্লাসে জল ঢালে বিক্রম। জল খেতে খেতে দেবলীনার দিকে তাকায়, - - কি সুন্দর লাগছে দেবলীনাকে। মনে হচ্ছে গল্পের রাজকন্যা জাদুকরের রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে।
                       হঠাৎ একটা চাপা কথোপকথনে সজাগ হয়ে ওঠে বিক্রম। দরজার ওপার হতে ভেঁসে আসছে সেই আওয়াজ। খুব সন্তর্পনে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় বিক্রম। সিঁড়ির কাছে দুটো ছায়া মূর্তি নিজেদের মধ্যে কি যেন কথা বলছে। এমন সময় একটা তীব্র আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হয়ে গেল। একটা ছায়ামূর্তি লুটিয়ে পড়ল সিঁড়ির উপর আর আরেকজন দৌড়ে পালাল। বিক্রম টর্চটা জ্বালিয়ে দৌড়ে এল সিঁড়ির কাছে। দেখল সিঁড়ির উপর পড়ে আছে হাবল। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বুকের উপর বেঁধানো একটা ধারালো ছুরি। ক্ষতস্থান হতে গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। পরীক্ষা করে দেখল বিক্রম, - - না আশা নেই। হি হ্যাজ নো মোর।
                     চিৎকারের শব্দে ইতিমধ্যেই বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এর মধ্যেই বিদ্যুৎও এসে গেছে। একে একে সবাই অকুস্থলে হাজির হল। সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। বিক্রম মোবাইল বের করে পুলিশকে খবর দিল।
 পুলিশ ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে পৌঁছল । পুলিশ অফিসার বিক্রমকে ভালোকরে চেনেন। এসডিপিও প্রেমা সিং চৌহানের বন্ধু হিসাবে বিক্রমের পুলিশ মহলে খুব খাতির। এছাড়া মুয়াদেবের রহস্য সমাধান করার পর (   পড়ুন বিক্রম কাহিনী - 'মুয়াদেবের শাপ'  ) বিক্রমের নাম সব বড় বড় পেপারে বেরিয়েছিল। তাই তদন্তের ভার বিক্রমের উপর ছেড়ে অফিসার ডেডবডি মর্গে পাঠিয়ে দিলেন।
       "আপনারা যে যার রুমে যান। আমি কথা দিচ্ছি কালকেই সব রহস্যের সমাধান করব।"  বিক্রম সকলকে নিজের নিজের রুমে পাঠিয়ে নিজেও চলল ঘুমোতে। খুব ঘুম পাচ্ছে। তাছাড়া দেবলীনা একা আছে ঘরে।
  সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় বিক্রমের পায়ে কি একটা ঠেকল। জিনিসটা সন্তর্পনে তুলে নিল বিক্রম। উল্টে পাল্টে দেখল। একটা কেমিক্যালের শিশি । মেড ইন জার্মান। শিশিটা স্যাম্পল ব্যাগে ভরে নিল।


                                           - - শেষের কথা - - -
      সকালে উঠেই বিক্রম ঘোষণা করেছিল যে সে আজ সব রহস্যের সমাধান করবে। এজন্য বাড়ির সবাইকে মাসিমার রুমে ডেকে পাঠিয়েছে। সবাই একে একে জড়ো হল। শশাঙ্ক ও অপরুপাও এল। এবার বিক্রম শুরু করল।
   " রায়ভিলার রহস্য আমার এযাবৎ নেওয়া সব কেসকেই ছাপিয়ে যায়। কারণ,.... কারণ হলো এই কেসে আমার ভূমিকা। রহস্য সমাধানের জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয় কুড়ি হাজা টাকার অগ্রীম পারিশ্রমিক দিয়ে। কিন্তু কি কেস, কে আমার নিয়োগকর্ত্রী এসবের কিছুই আমি জানতাম না। আমার কাছে সম্বল কেবল একটা ঠিকানা, - - ঈশানপুর রায়ভিলা।
                          এখানে এসে দেখলাম একটা ভূত রাতবিরেতে মোমবাতি নিয়ে শোক মিছিল করছে আর সামনে যাকে পাচ্ছে তার মাথার পিণ্ডি চটকে দিয়ে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠাবার সুবন্দোবস্ত করছে। অনেকের মতে তিনি বাড়ির বড়কর্তা মহেন্দ্র রায়। মহেন্দ্রবাবু আবার মারা যাওয়ার সময় 'র..' বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই 'র' টি কে ? র দিয়ে নাম এমন লোকের অভাব এ বাড়িতে নেই। রথিন, রমলা, রমেশ.... "
    " রমেশ ? এ আবার কে ? " দেবলীনা অবাক হয়।
বিক্রম আবার শুরু করে। " সব বলব। এখন একটা ম্যাজিক দেখাই। "  এই বলে বিক্রম মাসিমার কাছে এগিয়ে যান। "মাসিমা, একটু উঠে দাঁড়াবেন দয়া করে, - - একটু চরণধূলি নেব। "
  মাসিমার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। বিক্রম এবার সবার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন," আপনারা সবাই জানেন যে মাসিমা বহু বছর ধরে বিছানাগত। কিন্তু যেটা জানেন না সেটা হল আমার নিয়োগকর্ত্রী ইনিই। আর ইনিই হাবলকে খুন করেছেন। "
বিক্রমের কথা শেষ হতে না হতেই মাসিমা বিছানা হতে উঠে পাশের টেবিলে রাখা ওষুধের শিশিগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, " মিথ্যে কথা। আমি কারোর খুন করিনি। হাবলকে আমি ছেলের মতো ভালোবাসতাম। "
বিক্রম এবার মৃদু হেঁসে জবাব দেন," জানি মাসিমা। আমি সব জানি। আপনি খুনি হতে পারেন না কোনোদিনই। আপনি চেয়েছিলেন বাড়িতে শান্তি ফিরে আসুক। আর আসল অপরাধীকেও আপনি চেনেন। সে যাতে কোনো অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে তার জন্যেই আপনি আমাকে এখানে ডেকে আনলেন। কি ঠিক বলছি তো ?"
মাসিমা বিছানায় বসে পড়লেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন," হ্যাঁ, আমি সবই জানতাম। আর বিক্রমবাবুকে আমিই নিয়োগ করেছি। আমি চেয়েছিলাম সব ঝঞ্ঝাটের শেষ হোক। "
" কিন্তু হাবলের খুনি কে ? "   রায়গিন্নী বিক্রমকে প্রশ্ন করলেন।
" খুনি কে জানতে হলে জানতে হবে এ বাড়ির একটা অজানা রহস্যের ব্যাপারে। সবাই জানে মাসিমার দিদি আর দিদির ছেলে ছাড়া তিনকুলে কেউ নেই। এই ধারণাটা ভুল। মাসিমার একটি ছেলে আছে। আর এই ব্যাপারটা এই বাড়িতে তিনজন জানেন, - - শশাঙ্কবাবু, জ্যেঠিমা আর মাসিমা। জ্যেঠিমা জানতেন বলেই সেই সন্তানকে সমস্ত সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন। মহেন্দ্র জ্যেঠুকে দিয়ে উইল করিয়ে তিনি বঞ্চিত করেন সেই সন্তানকে।
জ্যেঠিমার প্রথম সন্তান গর্ভেই নষ্ট হয়ে যায়। এসময় তিনি যথেষ্ট অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। আর তখনই অসুস্থ্য দিদির সেবার জন্যে আসে বোন। রায়বাবুর সঙ্গে তাঁর শ্যালিকার একটা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে গর্ভে আসেন শশাঙ্কবাবু। শুরু হয় তুমুল অশান্তি। আর তার জেরেই শিশু সন্তানকে দিদির হেফাজতে রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে যান রমলা স্যান্যাল অর্থাৎ মাসিমা।
     মাসিমা যখন আবার এ বাড়িতে ফেরেন তখন শশাঙ্কবাবু মেডিক্যাল কলেজে পড়ছেন। সাজানো সংসার যাতে ভেঁসে না যায় তার জন্য দিদি বোনের কাছে এক অদ্ভুত শর্ত রাখে, - মাসিমা কোনোদিন ছেলের কাছে নিজের পরিচয় দিতে পারবেন না।
রায়জ্যেঠু মারা যাওয়ার সময় 'র' অর্থাৎ রমলা মাসিমার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। তিনি অনুরোধ জানাতে চাইছিলেন তার স্ত্রীর কাছে যে রমলা ও তার ছেলেকে যেন বঞ্চিত না করা হয়। "  এতদূর বলে বিক্রম থামল। শশাঙ্ক আর মাসিমার চোখ ভিজে এসেছে। রায়গিন্নী স্তম্ভিত।
   জ্যেঠিমা কিন্তু বরাবরই শশাঙ্কবাবুর প্রতি বিদ্বেষপোষন করতেন। শশাঙ্কবাবুর শৈশবকাল থেকে ডাক্তার হওয়া সমস্ত কিছুতেই জ্যেঠিমা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। রায়জ্যেঠু তার সমস্ত শক্তি দিয়ে শশাঙ্কবাবুকে আগলে রেখেছিলেন । ইতিমধ্যে শশাঙ্কবাবু অপরুপা দেবীকে বিয়ে করেন বাড়ির অমতে। আর এতেই জ্যেঠিমা বিরাট সূযোগ পেয়ে গেলেন। রায়জ্যেঠুর সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে শশাঙ্কবাবুকে বাড়িছাড়া করেন।
শশাঙ্কবাবুর বিয়ের খবরে আঘাত পেয়েছিলেন আরেকজন। তিনি রথিনবাবুর স্ত্রী তিয়াশা। "
এতক্ষণে তিয়াশা মৌনব্রত ভেঙে গর্জে উঠল, "ইউ স্কাউন্ড্রেল !! আই উইল কিল ইউ !!"   তিয়াশা ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল বিক্রমের উপর। দেবলীনা তিয়াশাকে ধরে ফেলল। তারপর লাগাল কষে দুই চড়। তিয়াশা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
" আপনি উত্তেজিত হবেন না ম্যাডাম, আপনাকে চুপ করাবার ওষুধ আমার কাছে আছে।"   বিক্রম স্যাম্পল ব্যাগে ভরা একটা কাঁচের শিশি বের করে সবার সামনে তুলে ধরে। " এটা হল সেই ড্রাগ যেটি ভিকটিমের নাকে মোমবাতির ধোঁয়ার মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে পাগল করে দেওয়া হত। আর সেই কাজটি করতেন স্বয়ং তিয়াশা ম্যাডাম।
এখন প্রশ্ন মোটিভটা কি ? কারণ ছাড়া তো আর কার্য হয় না। তাই কারণ অবশ্যই আছে। আর সেই কারণটা হল অপূর্ণ প্রেম। তিয়াশা ম্যাডাম ও শশাঙ্কবাবুর মধ্যে একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল। তাই শশাঙ্কবাবুর বিয়েতে তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হন। শশাঙ্কবাবু তিয়াশা দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেন। চক্রান্ত শুরু হয় রথিনবাবু সমেত অন্যদেরকে পথ হতে সরিয়ে ফেলার। তাই শুরু হল ভুতের অত্যাচার। "
" কিন্তু রমা তো শশাঙ্কের ভালো চায়, তাহলে তোমাকে সে ডাকলো কেন ? "   রায়গিন্নী বিক্রমকে জিজ্ঞাসা করলেন।
বিক্রম রায়গিন্নীর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল," কারণ উনি চাননি রথিনবাবু বা বাড়ির আর কারো কোনো ক্ষতি হোক। পুত্রস্নেহ থাকলেও মাসিমা সেই পুত্রস্নেহকে পারিবারিক স্বার্থের উর্ধে স্থান দেন নি।দেবলীনার হাবভাবে তিয়াশা দেবীর সন্দেহ হয়। তখন তিনি শশাঙ্কবাবুকে খবর দেন। আর শশাঙ্কবাবুই মন্দিরে সাধুর বেশে আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করেন। "
এবার রমলা মাসিমা নীরবতা ভঙ্গ করলেন। " কিন্তু বিক্রম হাবলের মত নিরীহ মানুষকে মারল কে ? ও তো কারোর কোন ক্ষতি করে নি ! "
" মাসিমা, আপনার মতো ভালো মানুষ তো সবাই নয়। মন্দিরে সাধুর বেশে এসেছিল হাবল আর তিয়াশা দেবী চাননি তাদের ষড়যন্ত্রের কেউ সাক্ষী থাকুক। অফিসার আপনার কাজ করুন।"
বিক্রমের কথা শেষ হবার মাত্র পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন। এগিয়ে গেলেন তিয়াশার দিকে।
" হ্যাঁ, আমিই মেরেছি হাবলদাকে। কোনো উপাই ছিল না। "  তিয়াশা কাঁদতে থাকল।
      পুলিশ অ্যারেস্ট করল তিয়াশাকে খুন আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। শশাঙ্ককেও ষড়যন্ত্রে শামিল থাকার চার্জে অ্যারেস্ট করা হল। বিন্দিকে চিকিৎসার জন্য অ্যাসাইলামে পাঠানো হল।
আসার সময় একটা দশ হাজার টাকার চেক দিয়ে রায়গিন্নী বললেন," এটা রাখো। রমার উপর আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই। বড় বৌমাকেও আমি মেনে নেবো। তুমি না এলে কতবড় অনর্থ হয়ে যেত ! আবার এসো। তবে বিয়ে করে। দেবলীনা মা আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।"
                               -- সমাপ্ত - - 

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ৬ // সুব্রত মজুমদার

শশাঙ্ক জোর করে দোতলায় উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন নিচে নেমে এল তখন তার চোখেমুখে একটা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দরজার সামনেই বিক্রমকে দেখে  শশাঙ্ক সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকাল। বিক্রম হাঁসিমুখে এগিয়ে এল শশাঙ্কের কাছে। " আমি যদি খুব ভুল না করি তাহলে আপনিই শশাঙ্ক শেখর রায়।"
" হ্যাঁ, কিন্তু আপনি ? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না !" শশাঙ্ক উত্তর দেয়।
বিক্রম হাতজোড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে বলেন, " আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ বিক্রম মুখোপাধ্যায়। আপনার জনৈকা শুভাকাঙ্খী আমাকে অ্যাপোয়েণ্ট করেছেন। উদ্দেশ্য কি তা ডিটেইলসে জানি না, তবে তিনি যে আপনাকে বাঁচাতে চান তা পরিস্কার। "
শশাঙ্কবাবুর মুখে হারানো দীপ্তি আবার ফিরে আসে। " যদি তাই হয় তাহলে আপনাকে আমার কিছু বলার আছে। কিন্তু উনি কে ? " শশাঙ্ক দেবলীনার দিকে তাকায়।
বিক্রম শশাঙ্ককে আশ্বস্ত করে," আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, দেবলীনা। আপনি ওর সামনেই সবকিছু বলতে পারেন। "
       শশাঙ্ক বিক্রমকে নিয়ে গাড়ির ভেতরে যায়। দেবলীনা, শশাঙ্ক আর বিক্রম গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ে । গাড়িটা কিছুদূর এগোতেই নজরে পড়ে একটা মিছিল। একদল লোক আবিরে রাঙা হয়ে গান গাইতে গাইতে আসছে। কাজের চাপে খেয়ালই ছিল না যে আজ হোলি। দেবলীনার ইশারায় গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। বিক্রম আর দেবলীনা নেমে পড়ে। তারা মিশে যায় ঐ ভিড়ের মধ্যে। উড়তে থাকে আবির। বিক্রম গান ধরে -
আজ ফাগুন হাওয়ায় উড়িয়ে দাও
                                            ব্যর্থ প্রাণের যত আবর্জনা
আজ নতুন আলোয় ধুইয়ে দাও
                                        কঠোর প্রাণের যত নিষেধ যত প্রবঞ্চনা।
ঐ দিকে দিকে পলাশ হাঁসে
                                       (তার ) আগুন রঙে ফাগুন আসে
আমের বোলে ভ্রমর বসে
                               - মেলে নবীন ডানা।
ভোরের রবি আবির মেখে
                                 দ্বারে দ্বারে যায় গো ডেকে,
কার কপালে তিলক আঁকে
                                      প্রজাপতির ডানা।
আজ শিমূলবনে পাগলা হাওয়া
                                          করে কেবল আসা যাওয়া,
(তার) নদীর জলে উজান বাওয়া,
                                     ঘুচিয়ে নিষেধ-মানা ।
হোলির দল গেয়ে ওঠে,
          হোলি হ্যায় হোলি হ্যায়....
বৃন্দাবনমে হোরি খেলে রাধা প্যারী
আবিরে আবিরে রাঙা হল অঙ্গ ভিজিল নীল শাড়ি।
হাতে পিচকারি চলে গোপনারী
                                   কালো তমালে লুকাইল হরি,
আহিড়িনী রোষে টানে পীত শাড়ি,
                            বসন ধরে কানা কাঁপে থরথরি।
সাত রঙে রাঙে গোপী সাত সুর তুলে
                                দখিনা পবন বয় যমুনার কূলে,
শিমূল পলাশ ঝরে ফাগুনের কালে
                              পঞ্চমে ধরে তাণ কোকিল কূহরী।
                                  হোলির শোভাযাত্রা এগিয়ে যেতেই বিক্রম আর দেবলীনা গাড়িতে এসে বসে । দুজনেই আবির গুলালে মাখামাখি হয়ে এসেছে। বিক্রম শশাঙ্ককে রহস্যময়ী মহিলাকণ্ঠ আর সাধুবাবার কথা বললেন। সবকিছু শুনে শশাঙ্ক কিছুক্ষন থ হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন, " আমার বিপদ সন্মন্ধে কিছুটা পূর্বাভাস আমাকে ছোটমা দিয়েছেন।"
" ছোটমা ! কিন্তু তিনি তো প্যারালাইজড।" বিক্রম দ্বিধা প্রকাশ করে।
" প্যারালাইজড হলেও কথাবার্তা বলতে পারেন। তবে অনেক কষ্টে।"
বিক্রম বাধা দিয়ে বলে, " আমি সেকথা বলছি না। একজন প্যারালাইজড মহিলা যিনি নিজের ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তিনি এত খবর পান কোথা থেকে ? "
" বিক্রমবাবু, যারা মা বা মাতৃতুল্য তারা সন্তানের বিপদের আঁচ অনেক আগে থেকেই পান। "  শশাঙ্ক ব্রেক কষে। গাড়িটা এসে দাঁড়ায় একটা দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ির সামনে।
                     দোতলা বাড়িটা বেশ আধুনিক। একতলায় গাড়ির পার্কিং। সিঁড়ি বরাবর উঠে গিয়ে দোতলার সামনে ঝুলবারান্দা। সেখানে এক ভদ্রমহিলা বসে মোবাইল ঘাঁটছেন। বিক্রমরা এসে পড়াতেও তার কোনো ভাবান্তর হল না। শশাঙ্ক বিক্রমকে বসতে বললেন।
এতক্ষণে চোখ তুললেন ভদ্রমহিলা।  "সকাল সকাল কোথায় বেরিয়েছিলে ?"
" বাড়ি গিয়েছিলাম। পরিচয় করিয়ে দিই ইনি বিখ্যাত গোয়েন্দা বিক্রম মুখার্জি।"   শশাঙ্ক বিক্রমের দিকে নির্দেশ করল। বিক্রম হাত জোড় করে নমস্কার জানাল।
"... আমি ডাঃ অপরুপা সাহা রায়"  ভদ্রমহিলা প্রতি নমস্কার জানাল।

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ৫ // সুব্রত মজুমদার

   " মহাদেবের মাথায় স্থান..... সে তো চন্দ্র। "  দেবলীনা বলে ওঠে। বিক্রমের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে প্রায় লাফিয়ে ওঠে। " ইউরেকা ! ইউরেকা ! আমি পেয়ে গেছি দেবলীনা। শশাঙ্ক.... শশাঙ্ক শেখর রায়। কিন্তু ওর ক্ষতি করবে কে ? যে কোনো উপায়ে শশাঙ্কবাবুকে বাঁচাতে হবে। "
" কিন্তু সাধুবাবা.... "
" ও ঝুঠা বাবা । তুমি ভালো করে লক্ষ্য করোনি, লক্ষ্য করলে দেখতে পেতে জটার ঠিকমতো সেটিং হয়নি। আর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখের নেলপলিশটা দিন দুয়েক আগের লাগানো। ছেলেরা এভাবে নেলপলিশ লাগায়, তবে সাধুরা নয়। "
বিক্রমের কথায় অবাক হয় দেবলীনা। " তোমার অবজারভেশন পাওয়ারকে স্যালুট করতে হয়। আমি তো সাধুবাবার অঙ্গভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। "
বিক্রম ব্যাগ হতে জলের বোতল বের করে গলাটা ভিজিয়ে নেয়। ফাল্গুন মাসের শেষ। রোদের তীব্রতাও বেড়েছে। নিজে জল খেয়ে বোতলটা দেবলীনার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
" ম্যাডাম আমাদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি সর্বত্র। আমরা তার দর্শন পাই না এটা আমাদের মন্দভাগ্য। "  বিক্রম কপালে হাত দেয়।
        মন্দিরের দরজা ইতিমধ্যেই খুলে গেছে। পুরোহিত মশাই পেতলের কলসিতে করে জল নিয়ে মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ পরিস্কার করছেন। একজন ভক্ত পাশের শক্তি বিগ্রহে প্রণাম করছেন। বিক্রমের কানে এল মন্ত্রের শেষ কথাগুলো।
               " .... ধর্মার্থ মোক্ষদা নিত্যং চতুর্বর্গ ফলপ্রদা ॥"  অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফল তিনি প্রদান করেন। বিক্রমের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে দেবলীনাকে ডাকে।
" দেবলীনা, মন্দির আসা আমাদের সার্থক হয়েছে। ধাঁধার আরো একটা  লাইন সলভড।"
দেবলীনা ঘুরে তাকায়।" সত্যি ! "
" হ্যাঁ ।  'যাও সেখানে ফলের আশে' - এই ফল কি ফল জানো ?"
" আম জাম কলা কত ফল আছে। এদের মধ্যে ধাঁধার ফল বের করা আমার কর্ম নয়।" দেবলীনা জবাব দেয়।
" আরে পাগলী, মাথাটা খাটাবার জন্য। এ ফল সে ফল নয়। এ হলো মানব জীবনের চারটি প্রধান কাম্য ফল। ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখানে দ্বিতীয় ফল অর্থাৎ অর্থের কথা বলা হয়েছে। জপের মালাতে কয়টা গুটি অর্থাৎ beads থাকে জানো ? "
দেবলীনা মাথা নেড়ে বলে, "হ্যাঁ জানি। একশ আটটি। "
বিক্রম বলল," ঠিক। এখানে শিব মন্দিরের সংখ্যা একশো আট। অর্থাৎ এখানেই কোন না কোনো মন্দিরের মধ্যে আছে গুপ্তধন। আর যেটা পেলেই রাজার হালে জীবন কাটানো যাবে। কিন্তু সেই গুপ্তধন বেরকরা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ ভূতের রহস্য ফাঁস করে শশাঙ্কবাবুর জীবন বাঁচানো। "
দেবলীনা বিক্রমের কথাতে সায় দেয়। " তুমি ঠিকই বলেছ। আর কোনো দিকে লক্ষ্য দিলে হবে না।"
               বিক্রম আর দেবলীনা মন্দির হতে বেরিয়ে আসে। মন্দিরের সামনের বিশাল মাঠে হাল্কা হাওয়া ঘাসের মাথাগুলোকে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা শালিখ নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত। মাঠের একপাশে বিশাল বটগাছ তার অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে কায়েমি স্বত্ব লাভ করেছে। আর সেই বটের ছায়ায় বসে একটা রাখাল আড়বাঁশিতে সুর তুলেছে - - মন পাগল করা সুর।
                                            - - চার - -
                         বিক্রম ও দেবলীনা যখন রায়ভিলাতে ফিরে এল তখন বেলা সাড়ে দশটা বাজে। দরজার সামনেই একটা টোয়েটা ফরচুনার দাঁড়িয়ে। তার মানে কেউ একজন এসেছে এ বাড়িতে। এ বাড়ির সব গাড়িই বাড়ির গ্যারেজে রাখা হয়। আরোহী গাড়ি নিয়ে সোজা মূল দরজা পেরিয়ে ঢুকে যায়। এ গাড়িটি বাইরেই আছে।
         ঘরের ভেতর থেকে  চিৎকার চেঁচামেচি ভেঁসে আসছে। বিক্রম আরো এগিয়ে যায়। দেখে একজন বছর চল্লিশের ভদ্রলোকের সাথে রায়গিন্নীর তুমুল ঝগড়া চলছে।
" আমার ভাগের সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করে এখন ভালোমানুষ সাজছ ? বাবা মরার সময় আমাকে তার কাছে যেতে দাওনি। কেন দাওনি তা আমি জানিনা ভেবেছ ? তুমি ধরা পড়ে গেছ মা। তোমার কোনো জারিজুরি আর খাটবে না।"   লোকটি রায়গিন্নীর দিকে তর্জনি তুলে অভিযোগ করে।
রায়গিন্নী স্বভাবসুলভ শান্ত গলাতেই উত্তর দেন। " যে অজাত কুজাতের ঘরের মেয়েকে মা বাবার বিনা অনুমতিতে বিয়ে করে তার সঙ্গে আমার কোনোদিন সম্পর্ক ছিল না আর থাকবেও না। তুমি কি ভেবেছ ঐ বেহায়া মেয়েটাকে আমি ঘরে ঢোকাবো। তুমি আমার কাছে মৃত।"
" মা যখন চাননা তখন বারবার এ বাড়িতে এসে অশান্তি করেন কেন দাদা ! অশান্তি করাটা আপনার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। "  তিয়াশা এসে শাশুড়ির পক্ষাবলম্বন করে।
         বোঝা গেল এই আগন্তুকই হলেন শশাঙ্ক শেখর রায়, - - রায়ভিলার বড়বাবু। কিন্তু শশাঙ্কবাবুর এই সামান্য ভুলের জন্য রায়গিন্নী এতটা কঠোর হতে পারেন কিভাবে ?  নিজের আত্মজকে মৃত বলে ঘোষণা করাটা কোনো মায়ের পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ নয়। 
         শশাঙ্ক তার মাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভিতর দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক সেই সময় রায়গিন্নী জলদগম্ভীর সুরে হাঁক ছাড়েন, "যাচ্ছ কোথায় ?"
" ছোট মাকে দেখতে।" শশাঙ্ক উত্তর দিল।
"এতদিন কোথায় ছিলে তুমি ? তোমার লজ্জ্বা করে না ! অসুস্থ্য মানুষটার একটিবার খবর নেওয়ারও সময় হয়নি তোমার, আবার এসেছ কর্তব্য করতে !"
"ছোটমা যে কার জন্য অসুস্থ্য সেটা সকলেই জানে। স্লোপয়েজনিং করে তিলে তিলে মেরে ফেলছ ছোটমাকে। তোমার আর রথিনের তো জেলে থাকা দরকার। " শশাঙ্ক প্রত্যুত্তর দেয়।
এবার রায়গিন্নী ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন " মারতে হলে ওকে অনেকদিন আগেই মেরে ফেলতাম। মরার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া আমার অভ্যেসে নেই। তোমার ডাক্তার বৌকে বলেদিয়ো এক কানাকড়িও আমি বেঁচে থাকতে তোমরা পাবে না। তুমি ঘর দখল নিতে এসেছ। ঘরের দখল তখনি পাবে যখন এ বাড়ি হতে আমার মৃতদেহ বেরোবে। যাও ততদিনের অপেক্ষা কর। "

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ৪ // সুব্রত মজুমদার

     - - তিন--
            খুব ভোরে উঠেছে বিক্রম। দেবলীনা এখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কালকের রাতের দমবন্ধ করা পরিবেশের সাথে আজকের ভোরের এই মিষ্টি পরিবেশের কোন তুলনা নেই। রাস্তায় বিভিন্ন বয়সের লোকজন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। মোড়ের মাথায় দু'একটা চায়ের দোকান ছাড়া সব দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ। বিক্রম হাঁটতে হাঁটতে আগেরদিনের সেই চায়ের দোকানটায় হাজির হল। চায়ের দোকানটার সামনে মাটিতে বসে কালকের দেখা সেই পাগল মেয়েটি। বিড়বিড় করে কি যেন বকছে।
দোকানের বেঞ্চে এসে বসতেই চাওয়ালা হাজির। বিক্রমকে অনেকক্ষণ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে প্রশ্ন করেন, "কেমন আছেন বাবু ?"
বিক্রম বিকট চিৎকার করে একলাফে চাওয়ালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চাওয়ালা 'রাম রাম' করতে করতে মেঝেতে পড়ে যায়। বিক্রম হেঁসে ওঠে। চাওয়ালাকে টেনে তুলে বলে, "কি ভয় পেয়ে গেলেন তো। আরে না বাবা পাগল হইনি। পা আমার সোজাই আছে।"
" খুব জোর ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাবু। ও বাড়িতে রাত কাটিয়ে এলেন তো তাই ভরসা করতে পারিনি। ওই দেখুন বাবু, ওই যে পাগলীটা দোকানের সামনে বসে আছে ও কাজ করত রায়ভিলাতে। এখন বদ্ধ পাগল। হাওয়ার সঙ্গে কথা বলে। "  চাওয়ালা বিক্রমের পাশেই বসে পড়ে।
বিক্রম চাওয়ালার দিকে মুখ ঘোরায়। " আপনার বাড়ি কি এখানেই ? "
" হ্যাঁ বাবু, আমি স্কুলের পেছনের পাড়াটাতে থাকি। 'হঠাৎ পাড়া' বললে সবাই চিনবে। "
" হুমম্ ! আচ্ছা রায়ভিলার বড়কর্তার শ্যালিকা কি যেন নাম... "
চাওয়ালা কথাটা লুফে নেয়। " রমলা। আমরা রমা মাসি বলে ডাকি। কিন্তু উনি তো বহুদিন ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। "
" আর রথিনবাবু, তিনি লোক হিসাবে কেমন ? "
" রথিনবাবু কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর এখন ব্যবসা উনিই দেখেন। তবে শশাঙ্কবাবুর সাথে তার বনিবনা কম।"
"শশাঙ্কবাবুটি কে ?"  বিক্রম উৎসাহী হয়ে ওঠে।
" আজ্ঞে শশাঙ্কবাবু হলেন রথিনবাবুর দাদা । বড় ডাক্তার তিনি। এক্কেবারে ধন্বন্তরি। উনার বৌও ডাক্তার, - তবে স্বজাতির নয়। রায়গিন্নী তাই শশাঙ্কবাবুকে বাড়িতে ঢুকতে দেন না। সব সম্পত্তি এখন রথিনবাবুর কব্জায়। তবে মাসিমা শশাঙ্কবাবুকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি রায়গিন্নীকে শাসিয়েছিলেন যে শশাঙ্কবাবুর ন্যায্য পাওনা তিনি আদায় করে তবেই মরবেন । তারপর থেকেই উনি বিছানাগত। "
বিক্রম চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে। রুমে এসে দেখে দেবলীনা তখনও ঘুমাচ্ছে। দেবলীনাকে উঠিয়ে ডায়েরি বের করে বিক্রম। দিনলিপি লেখার একটা বাতিক আছে তার।
দেবলীনা বাথরুম হতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এল। আর তখনই চায়ের ট্রে হাতে ঢুকল হাবল পাল।
" চা এসে গেছে। মেমসাহেব দাদাবাবু আপনারা চা বেরেকফাস্ট করে নেন।"  হাবল চায়ের কাপে চা ঢেলে পাউরুটিতে মাখন লাগাতে থাকে। ট্রেতে প্লেটে করে বিস্কুট, ডিমের পোচ আর আপেলের টুকরো। দেবলীনা চায়ে চুমুক দেয়। বিক্রম একটা টোস্টে কামড় দিয়ে হাবলের দিকে তাকায়।
" আচ্ছা হাবল, এখানে দর্শনীয় মানে দেখবার মতো কিছু আছে ?  - যেমন ধর মন্দির, নদী.,পার্ক।"
বিক্রমের প্রশ্নে হাবল প্রথমে হকচকিয়ে যায় তারপর বুঝতে পেরেই আবার মুখর হয়ে ওঠে। " এই তো নদীর ধারে রায়বাবুদের প্রতিষ্ঠা করা একশো আট শিব মন্দির আছে। অনেক পুরোনো বাবু। ঈশানেশ্বর শিব। খুব মাহাত্ম্য তেনার ।  "
  বিক্রমদের চা খাওয়া শেষ হয়। ট্রে নিয়ে হাবল বেরিয়ে যায়। বিক্রমকে চিন্তিত দেখায়। দেবলীনা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। " কি ব্যাপার বিক্রম, তোমাকে টেনসড লাগছে। "
" তোমার ছড়াটা মনে আছে দেবলীনা ? ওই যে  'পুরের কি কাজ কোণের পাশে', মানেটা আমি পেয়ে গেছি। "
" পেয়ে গেছো ! দ্যাটস গুড !" দেবলীনা উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
"এ গ্রামটার নাম হল ঈশানপুর আর সেটা থেকে পুর বাদ দিলে থাকে ঈশান। ঈশানেশ্বর মহাদেব। তার মানে আমাদের সূত্র নির্দেশ করছে শিব মন্দিরটা। রেডি হয়ে নাও যেতে হবে। কুইক ! "
বিক্রম আর দেবলীনা শিব মন্দিরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। রায়ভিলা হতে দুই কিলোমিটারের মতো রাস্তা। নদীর ধারে একশো আট শিবের মন্দির মালার মতো আকার রচনা করেছে। আর সেই মালার গ্রন্থির জায়গায় একটা বড় দরজা। দরজার চৌকাঠে পাথরের কলস আঁকা। মন্দিরগুলির কারুকার্য অনেকটা বিষ্ণুপুর ঘরানার।
 "একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ দেবলীনা, দুটো করে মন্দির জোড় তৈরি করেছে। একটা জোড়ের পর কিছুটা রাস্তা তারপর আরেকটা জোড়া। কেবল দক্ষিণদিকের দুটো বড় বড় মন্দির স্বতন্ত্র। এদুটিকে নিয়ে মোট একশত দশটা। সব মন্দিরের গায়েই শিল্পকর্ম আছে তবে পারম্পর্য্যহীন। এ হতে বোঝা যায় মন্দিরগুলির অনেকবার সংস্কার হয়েছে। " বিক্রম বর্ণনা দেয়।
দেবলীনা একটা মন্দিরের সামনের চালালে বসে পড়ে। "  এই মন্দিরের সাথে রায়ভিলার ভুতের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ? আর পরের লাইনগুলো 'যাও সেখানে ফলের আশে। /মালার গুটি সংখ্যা ধর/রাজার হালে বসত করো।।  " 
বিক্রম এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভাবছিল। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। "কবিতা ছাড়, বেলা হয়েছে রায়ভিলায় ফিরে যেতে হবে। মনে রেখো আমরা তাকে চিনতে পারি আর নাই পারি শ্রীমতী অন্তর্বাসিনী কিন্তু আমাদের উপর নজর রাখছেন। "
" হ্যাঁ, কুড়ি হাজার টাকা যে দিতে পারে সে তোমাকে কুড়ি টুকরো করে পার্শেল করে দিতেও পারে।"  দেবলীনা বিক্রমকে খোঁচা দেয়।
" নারী চরিত্র দেবা নঃ জানয়ন্তি কুতঃ মনুষা । মেয়েদের বিশ্বাস নেই। "
বিক্রমের কথায় দেবলীনা উঠে বিক্রমকে তেড়ে যায়। হঠাৎ সামনে এসে পড়েন এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী। সারা শরীরে ছাই মাখা, কপালে অষ্টগন্ধার ত্রিপুণ্ড্রক। ত্রিপুণ্ড্রকের মাঝখানে এবং আজ্ঞাচক্রের উপর দুটি সিঁদুরের ফোঁটা। স্পষ্ট বাংলাতে বলে উঠল," মহাদেবের মাথায় যার স্থান তিনি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। তাকে বাঁচাও। তার খুব বিপদ।"
বিক্রম সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করে, "বাবা, আপনি যদি সবই জানেন তবে নিজেই রক্ষা করছেন না কেন ? আর এত হেঁয়ালি করে কি লাভ আপনাদের ? আমার বুদ্ধির পরীক্ষা করছেন !"
সাধুবাবা কোনো উত্তর দিলেন না। আশীর্বাদের ভঙ্গি করে মন্দিরের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। 

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ৩ // সুব্রত মজুমদার

-"এ মা তা কেন ! মানুষের স্বাভাবিক কৌতুহল থাকতে পারে না !"  দেবলীনা হকচকিয়ে গেল।
তিয়াশা এবার নিজেকে সংযত করে দেবলীনার দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলল। " রাগ করলে নাকি, আমি এমনি এমনি বললাম। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড।"
" ইটস ওকে।"
"আচ্ছা বিক্রমবাবু তোমার কেমন বন্ধু হয় ? মানে কিছু চলছে কিনা সেটাই জানতে চাইছি। "  তিয়াশা কথা পাল্টায়।
দেবলীনা কিছু বলল না কেবল ইতিবাচক একটা ভঙ্গি করল। তিয়াশা ব্যাপার বুঝতে পেরে মুচকি হাঁসল।
                        সন্ধ্যার সময় দুর্গামন্ডপ হতে শাঁখের আওয়াজ ভেঁসে এল। ঠাকুরমশাই তড়িঘড়ি আরতি শেষ করে একরকম ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলেন। বাড়ির সকলে যে যার ঘরে ঢুকে গিয়ে খিলকপাট দিয়ে দিল। পাশাপাশি দুটো রুমে দেবলীনার ও বিক্রমের শেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাবল বিক্রমের দেওয়া মন্ত্রটা জপতে জপতে দেবলীনার ঘরে খাবার দিতে ঢুকল। দেখল মেমসাহেব ঘরে নেই। সটান ওঘর হতে বেরিয়ে বিক্রমের ঘরে এল।  "বাবু  রাতের খাবার। এই যে মেমসাহেব ও আছেন দেখছি। আপনার খাবার কি এখানেই দেব ?"
"হ্যাঁ, দুজনের খাবারই রাখ। কিন্তু রাতের খাবার সন্ধ্যায় কেন ? আর এ বাড়িতে সবার খাবারই কি এরকম হোম ডেলিভারি হয় ?" বিক্রম হাবলকে জিজ্ঞাসা করে।
হাবল একগাল হেঁসে বলে, " আগে তো সবাই টেবিল পেতে একসঙ্গে বসে খেতেন বাবু, এখন ভূতের ভয়ে সন্ধ্যার পর কেউই ঘর হতে বেরোয় না। যাই তাড়াতাড়ি, মাসিমাকে খাইয়ে দিয়ে আসতে হবে। "
" মাসিমা মানে... "
" আজ্ঞে গিন্নীমার বোন। প্যারালিসিস হয়ে পড়ে আছেন। আমিই খাওয়া দাওয়া করিয়ে দিই।"  হাবল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে । " না বাবু চলি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। রম্ভ করম্ভ উদুম্ব দুন্দুভি, রম্ভ করম্ভ উদুম্ব..... "   হাবল মন্ত্র জপ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
" কি সব বলতে বলতে গেল রম্ভ করম্ভ... " দেবলীনা অবাক হয়ে বিক্রমের দিকে তাকায়।
বিক্রম তার পিস্তলটি ব্যাগ হতে বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলে," তেমন কিছু না, স্বামী বিক্রমানন্দের দেওয়া ভূত অপসারক মন্ত্র। "
দেবলীনা হো হো করে হেঁসে ওঠে। এমনসময় পিস্তলটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায় বিক্রম। একটা ছায়া যেন পর্দার আড়াল হতে স্যাত করে সরে গেল। বিক্রম পর্দা সরিয়ে দেখে বাইরে কেউ নেই। পুরানো বাল্বের হলুদ আলোতে গোটা বারান্দা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল দরজার সামনে পাপোশটার দিকে, - - একটা চিরকুট। চিরকুটটা তুলে নিল বিক্রম। তারপর একবার চোখ বুলিয়েই পকেটে রেখে দিল। দরজা ভেজিয়ে ঘরে ঢুকল।
      "কি হল বিক্রম !" দেবলীনা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
বিক্রম পকেট থেকে চিরকুটটা বেরকরে দেবলীনার হাতে দিয়ে বলল, "সম্ভবত কেউ আমাদের উপরে নজর রাখছে। একটা ছায়ামূর্তি দরজায় আড়ি পেতে ছিল। সেই দিয়ে গেছে সূত্র। বা এমনও হতে পারে অসাবধানতা বশত তার হাত হতে পড়ে গেছে। দ্বিতীয়টি সত্যি হলে আমাদের সাবধান হতে হবে। কারণ চিরকুটটা উদ্ধার করতে সে আসবেই।"
দেবলীনা চিরকুটটায় চোখ রাখল। একটা পুরোনো তুলোট কাগজের চিরকুট। কাগজটিতে বহুপুরানো কালিতে লেখা একটা কবিতা।
        পুরের কি কাজ কোণের পাশে
        যাও সেখানে ফলের আশে।
         মালার গুটি সংখ্যা ধরো
       রাজার হালে বসত করো।।
" এ তো মনে হচ্ছে কোন ধাঁধা। কিন্তু কিসের ?"
বিক্রম মুচকি হাঁসে। " কাগজটা দেখেছ দেবলীনা, তুলোট কাগজ। তুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রসেসিং করে এই কাগজ তৈরি হত বলে একে তুলোট কাগজ বলে। এই কাগজ অনেক পুরোনো। আর কালিটা দেখ। বাবলার আঁঠা, হীরাকষ আর চিনি দিয়ে তৈরি কালি। ফলে চিরকুটটা যে বহুকাল আগে লেখা হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। "
" হীরাকষটা কি, - - হীরা গুঁড়ো টুঁড়ো ? "
" আরে না না। হীরাগুঁড়ো নয়। হীরাকষ হল গ্রীন ভিট্রিওল অর্থাৎ সাত অনু জল সহ আর্দ্র্য ফেরাস সালফেট। "
দেবলীনা বিক্রমের কাছ ঘেঁষে বসে। বিক্রম ভেবে পায় না এই নৈকট্য কিসের, - - ভয় নাকি প্রেম। সে যাইহোক বিক্রম দেবলীনার বিশ্বস্ত চুলগুলো মুখের উপর হতে সরিয়ে দেয়।
" এখনো দুজনের সাথে আমাদের পরিচয় হয় নি। রথিনবাবু আর মাসিমা । তিয়াশার সঙ্গে কথা বলে কেমন বুঝলে ?"
" খুব জটিল মহিলা। বাইরে হতে যতটা সহজ সরল দেখায় ততটা সহজ সরল নয়। আরেকটা কথা, ওর হ্যাণ্ড ব্যাগের শখ আছে। তোমাকে যেরকম ব্যাগে করে টাকা পাঠানো হয়েছিল সেরকম মডেলের গোটা দুই ব্যাগ ওর কালেকশনে আছে। "  দেবলীনাকে গম্ভীর দেখায়।
                      রাত দশটা। দেবলীনা আর বিক্রম খেতে বসে। হাবল বেশ যত্ন করে খাবার রেখে গিয়েছে। হটপটে ভরা নরম নরম রুটি, বাটিভর্তি খাঁসির মাংস, ঘন অড়হড়ের ডাল।এখানেই শেষ নয়, একগ্লাস দুধ, কিছু ফল ও মিষ্টিও আছে। দুজনের রাতের খাবারটা বেশ পরিপাটি করেই সমাধা হল।
  দেবলীনার দুধে প্রবল অনীহা। সে দুধ খেল না।
দেবলীনাকে খাট শুয়ে পড়তে দেখে বিক্রম বলল "এটা কি হল ! নিজের কক্ষে যাও বালিকা।"
" সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব আমার কুঞ্জে।" দেবলীনা পাশবালিশটাকে আঁকড়ে ধরে উত্তর দিল।
বিক্রম তখন বালিশটা কেড়ে নিতে নিতে বলল, " কবিগুরুর প্যারোডি, দেখাচ্ছি মজা। ভুতের ভয়ে একা থাকার মুরোদ নেই, তিনি আবার ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট। "
       ওদের খুনসুটি কতক্ষণ চলল জানি না। তবে দেবলীনা খাটের উপরে আর বিক্রম মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়ল। এই দীর্ঘ ব্যাচেলর জীবনে পাশে কেউ শুলে ঘুম হয় না বিক্রমের। একলা থাকার এই এক ডিসঅ্যাডভান্টেজ। রাতে এত ভালো ঘুম হল যে এক ঘুমেই সকাল। 

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ২ // সুব্রত মজুমদার

" ওটাই সেই কাজের মেয়েটা। চাওয়ালা বলছিল না ভূত দেখে পাগল হয়ে গিয়েছে। ডোন্ট অ্যাফ্রেইড ! "
         প্রবেশ করামাত্র একটা কালো বিড়াল রাস্তা কেটে অভ্যর্থনা জানাল। আর খিলানে বসে থাকা ডজনখানেক গোলাপায়রা 'বকবকম বকবকম বাকুরকুটুম বাকুরকুটুম' শব্দে ঝাপ্টাঝাপ্টি করতে লাগল।
-"কালো বিড়াল রাস্তা কেটেছে একটা অমঙ্গল না হয়ে আর যায় না দেখছি।"  দেবলীনাকে যথেষ্ট ভীত দেখায়।
-"হুমম্ ! এ পোড়া দেশের আর উন্নতি হল না। মানুষের ট্রাফিক সিগন্যালের চেয়েও কালো বিড়ালের উপর বিশ্বাস বেশি।
দেবলীনা কপট রাগের ভান করে। " ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। মা ঠাকুমারা যা বলেন আমি সেটাই বলেছি।"
বিক্রম আর দেবলীনা সদর দরজা পেরিয়ে উঠোনের মতো জায়গাগাটায় এসে পড়ে। জায়গাটা কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া। দক্ষিণ ঘেঁষে একটা তুলসীমঞ্চ। আর তুলসীমঞ্চের সামনেই দুর্গামণ্ডপ। দুর্গামণ্ডপের সঙ্গে ইংরেজি L অক্ষরের আকৃতি নিয়েছে মূল বসতবাড়িটি। দুর্গামণ্ডপে তখন ঠাকুরমশাই পুজো করছিলেন। মণ্ডপে ঠাকুরমশাইয়ের পিছনে লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে এক ষাটোর্ধ ভদ্রমহিলা।
         বিক্রমদের যাবারমাত্র পুজো শেষ হল। বড় থালায় করে প্রসাদ এনে ভদ্রমহিলা বিক্রম আর দেবলীনার সামনে দাঁড়াল। প্রসাদ দিতে দিতে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমাদের তো চিনলাম না বাবা !"
বিক্রম প্রসাদ হাতে নিয়ে দেবলীনার দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, "আসলে জ্যেঠিমা, মহেন্দ্র জ্যেঠু আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবার শরীর খুব খারাপ, - শ্বাসকষ্ট হয় অল্পেতেই। জ্যেঠুর মৃত্যুসংবাদে তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। তাই আমাকে পাঠালেন। আর এ আমার বান্ধবী দেবলীনা।"
"খুব ভালো করেছ বাবা। তোমরা ভেতরে এস। বৌমা.. ও বৌমা...। একবার শুনে যাও তো।" ভদ্রমহিলা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। সাথে সাথেই একটা অল্পবয়সী বৌ বেরিয়ে এল। গা-জোড়া অলঙ্কার দেখেই এদের সম্পদ বৈভবের কথা সহজেই অনুমান করা যায়।
" আপনারা ভেতরে আসুন। "
বৌটির সাথে সাথে বিক্রম ঘরের ভেতরে ঢুকল। পুরানো বাড়ি হলেও বেশ পরিপাটি করে সাজানো। আর ঘরের ছত্রে ছত্রে বৈভব আর রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। বৌটির সাথে দেবলীনার খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জানা গেল মহেন্দ্রবাবুর ছোট ছেলে রথিনের বৌ তিনি, - - নাম তিয়াশা।
     বিক্রম ঘরের আশপাশটা ঘুরে দেখতে থাকে। ঈশান কোণের দিকে একটা কুয়ো, তার পাশেই আলাদা করে একখানা পাম্প বসানো হয়েছে। বাড়ির স্নান শৌচ আর খাবার জলের চাহিদা এই পাম্পটিই মেটায়। আর অন্যান্য কাজ যেমন বাসনপত্র ধোয়ার কাজে কুয়োটি ব্যবহৃত হয়। বিক্রম দেখল একটা মাঝবয়সি লোক বাসনপত্র মাজছে আর অস্পষ্ট ভাষায় কি যেন বলছে। বিক্রমকে দেখে সে তার মনোভাব লুকোবার চেষ্টা করল।
" আজ্ঞে বাবু আপনি কি কত্তাবাবুর বন্ধুর ছেলে ?"
বিক্রম বুঝল যে তাদের ঠিকুজি কুষ্ঠী সব এতক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে। বাড়ির গৃহকর্ত্রীর পেটে কথা থাকে না। বিক্রম বলল " তুমিই বুঝি বাড়ির সব কাজ কর।"
চায়ের কাপগুলো ধুয়ে একটা ট্রেতে রাখতে রাখতে ফুঁসে উঠল লোকটি। " পেটের দায়ে পরের বাড়িতে কাজ করি বাবু, কিন্তু বাসনমাজা এঁটো মোছার কাজ হাবল পাল কোনোদিন করেনি। পেটে বিদ্যে আছে বাবু, - - ক্লাস থিরি অবদি পড়েছি। তারপর বাপ মারা গেল। "
" জানাগেল তৃতীয়শ্রেণী পাশ এই কাজের লোকটির পিতৃদত্ত নাম হাবল পাল। লোকটা কাজের। একে হাতে রাখতে হবে "   মনে মনে ভাবে বিক্রম।
হাবল আবার মুখর হয়ে ওঠে। " কি করব বাবু, কর্তাবাবু গত হওয়ার পর থেকে সংসারে অভিশাপ লেগেছে। কর্তাবাবুর ভূত সন্ধ্যা হলেই মোমবাতি হাতে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। সেটা দেখেই বিন্দির মাথা খারাপ হয়ে গেছে বাবু। কেউ এ বাড়িতে আসতে চায় না। কি করব বাবু তিনকুলে আমার নিজের বলতে কেউ নেই। আমি পড়ে আছি এখানে। যা আছে কপালে। "
  এবার বিক্রম একটা চাল চালে, সে মুখটা হালের অনেকটা কাছে এনে বলে," তোমার কোন ভয় নেই। আমি একজন তান্ত্রিক অনেক মন্ত্র তন্ত্র জানি। তোমাকে বাঁচিয়ে নেব। শুধু যা বলব তাই করবে। আর হ্যাঁ, এ কথা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ যেন ঘূণাক্ষরেও টের না পায়। "
হাবল মাথা নেড়ে সন্মতি জানায়। সে যেন মনে বল পেল এবার। " আমি জানতাম বাবু আমার মতো সৎ লোকের ভগবান কোনো অনিষ্ট হতে দেবেন না। আমি জানতাম। "
" এবার আমাকে সব খুলে বল। একদম গোঁড়া হতে। কিচ্ছু লুকোবে না"  বিক্রম কুয়োর উঁচু অংশটাতে বসে পড়ে।
" কি আর বলব বাবু"  হাবল শুরু করে " কর্তাবাবু এ এলাকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। সবাই মান্যিগন্যি করে এদের। তবে পুরোনো বড়লোক এরা। কর্তাবাবু মারা যাওয়ার সময় গিন্নীমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু বলতে পারলেন না। 'র..' বলেই তার ঘাড়টা নেতিয়ে পড়ল। তারপর থেকেই ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। আমার মনে হয় বাবু, শেষ কথাটা বলার জন্যেই তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাবু মন্তরটা বললেন না তো। "
-" বলব, তার আগে তুমি বল এ বাড়িতে কে কে থাকে। "
-" গিন্নীমা, রথিনবাবু, বৌদিমনি, বড়বাবু আর মাসীমণি।" হাবল আঙুল গুনে গুনে বলে।
-" বড়বাবু মানে মহেন্দ্রজ্যেঠুর বড়ছেলে ? কই তাকে তো দেখলাম না। "
-" আজ্ঞে হ্যাঁ, বড়বাবুর সাথে গিন্নীমায়ের ইদানিং তেমন বনিবনা হত না। তারউপর বড়বাবু একটা অনাথ মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। গিন্নীমা বলে দিয়েছেন ওই মেয়ে বাড়িতে ঢুকলে তিনি কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন। বড়বাবু বললেন যে গিন্নীমা যে কেমন মানুষ তা তিনি জানেন। সময় এলে হাটে হাঁড়ি ভাঙবেন। "   এতটা বলে হাবল একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল।
- " কান কাছে আন মন্ত্রটা তোমায় দিই"  হাবল কান কাছে আনলে বিক্রম বলল," রম্ভ করম্ভ উদুম্ব দুন্দুভি, - - এই মন্ত্রটা জপ করবে। বাকি কাজ আমার। "
মন্ত্র জপতে জপতে হাবল বিদায় নিল। বিক্রম এই সূযোগে একচোট হেঁসে নিল। হাবল পাল আর যাই হোক বুদ্ধিমান নয়।
       এদিকে দেবলীনার সাথে তিয়াশার বেশ ভাব জমে গেল। তিয়াশা দেবলীনাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তার শাড়ির সম্ভার দেখাল। শাড়ির সাথে সাথে বিভিন্ন রকমের লেডিস ব্যাগের কালেকশনও তার আছে। দেবলীনা ব্যাগগুলো দেখতে লাগলো।
-"আচ্ছা তিয়াশা, আসার সময় শুনলাম এ বাড়িতে ভূত আছে। তুমি কি তা মানো ?" দেবলীনা জিজ্ঞাসা করে।
তিয়াশার চোখমুখ পাল্টে যায়। " তুমি কি গোয়েন্দা ?" 

ঈশানপুরের অশরীরী - ভাগ ১ // সুব্রত মজুমদার

  সন্ধ্যা সাতটা। বিক্রম তার প্রিয় আরামকেদারায় বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছে। ইদানিং কাজ হাতে না থাকায় হাতখরচের বড্ড টান পড়েছে। বাড়ির কাজের লোক কাম কেয়ারটেকার মাধবদা সকাল বেলায় বিক্রমকে আশ্বাস দিয়েছে কিছু সাহায্য করার।
- "তা দাদাবাবু আমি শ'আষ্টেক দিতে পারি। না করবেন না।" একগাল কৃতজ্ঞতা ভরা হাঁসি হাঁসে মাধবদা।
টাকার অভাব বিক্রমের নেই। কিন্তু অনেক দোষের মধ্যে বিক্রমের ঐ এক দোষ - - বড্ড কৃপণ। আজ পর্যন্ত ক্রেডিট ভিন্ন ডেবিট হয়নি বিক্রমের অ্যাকাউন্ট হতে। হঠাৎ করে মোবাইলের আওয়াজে বিক্রমের চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়ল। মোবাইল তুলে নিল বিক্রম। ওপাশ হতে চাপা আর অস্পষ্ট একটা মেয়েলি স্বর ভেঁসে এল।
- আমি কি বিক্রমবাবুর সাথে কথা বলছি !
- হ্যাঁ, আপনি ?
- আমি কে তা না জানলেও চলবে। আমার কথাগুলো মনদিয়ে শুনুন। আপনার হাত খরচের টাকার টান পড়েছে তাই না !
- "হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো আপনার জানার কথা নয়। দুজন মাত্র একথা জানে, এক আমি আর অন্যজন মাধবদা। আমি নিশ্চিত মাধবদা ঘরের কোন কথা বাইরে বলবে না।" বিক্রম হতবাক হয়ে যায়।
- কিভাবে জানলাম সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি ! বরং শুনুন মনদিয়ে। আপনার বাগানের যে দেশী গোলাপের ঝোঁপটা আছে সেখানে যান। ওখানেই পাবেন একটা ব্যাগ। আর ঐ ব্যাগের ভেতর আপনার ফিজ-- পুরো বিশ হাজার টাকা। ঈশানপুর রায়ভিলা। মনে রাখবেন ঈশানপুর রায়ভিলা। কেসের ডিটেইল ওখানেই পাবেন।
ফোনটা ওপার হতে কেটে দেওয়া হল। বিক্রম দরজা খুলে বাগানে এলো। ছোট্ট বাগান। থরে থরে বেশ পরিপাটি করে লাগানো দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। রক্তগাঁদার সারির পাশেই ডালিয়ার মনোমুগ্ধকর সমাবেশ। এরপরে একটা পাতিলেবুর গাছ  ফলের ভারে নুইয়ে পড়েছে। পাতিলেবুর গাছের পাশেই দেশী গোলাপের ঝোঁপটা। লাল আর গোলাপী দুই ধরনের গোলাপের গাছকে একসাথে লাগানো হয়েছে। দুই হতে আড়াই ফুট উচ্চতার ঝোঁপে প্রায় শতাধিক গোলাপ ফুটে আছে। গোলাপের ঝোঁপের নীচেই একখানা ছেঁড়া লেডিস ব্যাগ। বিক্রম ব্যাগটাকে তুলে নিল। ব্যাগের চেনটা কাটা। আর ভিতর থেকে উঁকি মারছে গোলাপী রঙের নোটের গুচ্ছ। গুনে দেখল বিক্রম - - পুরো দশটা।
                                - -দুই - -
               পরদিন খুব ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ল বিক্রম। দেবলীনাকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। একদম ঈশানপুরেই দেখা হবে তাদের।
                               ঈশানপুর একটা মফস্বল শহর। রেল আর বাসের যোগাযোগের সুবিধার জন্যে রাইস মিল আর তেল মিলের মতো শিল্পের প্রাচুর্য্য এখানে দেখা যায়। ঈশানপুর রেলস্টেশনেই বিক্রম আর দেবলীনার দেখা হল।
-  চল, দেখি কি রহস্যের জালবুনে রেখেছেন শ্রীমতী অন্তরবাসিনী।
- " অন্তরবাসিনী ! বেশ বলেছ তো। অন্তরবাসিনী !!"  দেবলীনার হাঁসি আর থামতে চায় না।
বিক্রম আর দেবলীনা হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের বাইরে চায়ের দোকানে আসে।
-" দাদা, বেশ কড়া করে দুটো চা দেবেন তো। আর বিস্কুট ফিস্কুট কিছু থাকলে..."   বিক্রম দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ে। দেবলীনা দাঁড়িয়েই থাকে। ইতিমধ্যে চাওয়ালা কাগজের কাপে করে দুটো দুধ-চা আর একখানা করে দেশী বাদাম বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে যায়।
-" রায়ভিলাটা কোনদিকে বলতে পারবেন দাদা। "  চায়ে চুমুক দিতে দিতে বিক্রম চাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে।
- রায়ভিলা, সে তো এই পাকা রাস্তাটা দিয়ে সোজা গিয়ে গার্লস স্কুলের কাছে। বাবুরা কি উনাদের কুটুম ?
- না, ঠিক কুটুম নই। আসলে রায়বাড়ির দিদিমণি আছেন না, আমরা তারই পরিচিত। বন্ধুবান্ধবও বলতে পারেন।
- ছোট মুখে বড় কথা বাবু, ঐ বাড়িতে আপনাদের না যাওয়াই ভালো। বাড়িটা ভালো নয়। " চাওয়ালা বিক্রমের খুব কাছে এসে মৃদুস্বরে কথাগুলো বলে।
-" মানে ? ইঁদুর ছুঁচোর খুব উৎপাত নাকি ওখানে ! "  দেবলীনা চায়ের কাপটা ভাঙা প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে তৈরি বিন-এ ফেলাতে ফেলতে প্রশ্ন করে।
- কি যে বলেন মেমসাহেব, আপনারা বড় শহরের মানুষ ওসব বিশ্বাস করেন না। অপদেবতা মেমসাহেব, অপদেবতা। রায়বাবু মারা যাওয়ার পর ঐ বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ চলছে।
-" ঠিক কি হয় আপনি জানেন ?" বিক্রম চাওয়ালার দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।
- "রায়বাবুর ভূত। অনেকেই দেখেছে। সন্ধ্যার পর যারা ঐ বাড়ির আশেপাশে যায় তাদের উনি দেখা দেন। এই তো তিনদিন আগে রায়বাড়ির কাজের মেয়েটা চায়ের বাসন ধুতে কুয়োতলায় গিয়েছিল। তারপর হতে তার মাথা খারাপ। ঐ প্রেত যে দেখে তার মাথা খারাপ হয়ে যায় বাবু। আপনাদের না যাওয়াই ভালো। " চাওয়ালাকে ভীত সন্ত্রস্ত দেখায়।
-" আমরা ভূতের ডাক্তার। আমাদের কিছু করার সাধ্য তোমার ঐ প্রেতের নেই। " বিক্রম চায়ের দাম মেটাতে মেটাতে বলে। এরপর একটা টোটোয় চড়ে বসে দুজনে।
-" আমার সারা জীবনে এমন ভূতের কথা শুনিনি। হেভি মিস্ট্রিয়াস। " দেবলীনা  বলে ওঠে।
-" সেটা রায়ভিলাতে না গেলে বোঝা যাবে না। রায়বাবুর ভূত মানুষকে পাগল করে দেয়, আবার সেই ভূত ধরতে কোন আজ্ঞাতপরিচয় মহিলা গোয়েন্দা নিয়োগ করেন। মোটা অঙ্কের ফিজ তাও আবার অ্যাডভান্স। দেবলীনা, এবার আমার পাগল হওয়ার পালা। আচ্ছা রাঁচির পাগলাগারদটা কি এখনো গুড কণ্ডিশনে আছে....? "   বিক্রম হেঁসে ওঠে, দেবলীনাও বিক্রমের সাথে যোগ দেয়।
                              টোটোওয়ালা তার আরোহীদুজনকে রায়ভিলার অনেকটা আগেই ছেড়ে দেয়। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার তার, এই টোটো চালিয়েই সংসার চলে। বেমক্কা পাগল হওয়ার ইচ্ছা তার নেই। অগত্যা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করে বিক্রম ও দেবলীনা। কিছুটা হাঁটার পরই নজরে পড়ে ঈশাপুর মহেন্দ্র রায় বালিকা বিদ্যালয়। ঠিক তার পাশেই প্রাসাদোপম একটা বাড়ি। বাড়ির সিংহদরজাটায় ব্রিটিশ আমলের ছাপ স্পষ্ট। দুই দিকে দুটো সিংহ পরস্পরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত, আর মাঝখানে রোমান স্টাইলের রিবনের উপর লেখা - 'রায়ভিলা' ।
বাড়ির দরজার কাছাকাছি আসতেই একটা মেয়ে ওদেরকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। মেয়েটার পরনে আটপৌরে কাপড়, উস্কোখুস্কো চুল আর সিঁদুরের টিপটা থেবড়ে গিয়ে গোটা কপালময় হয়ে গেছে।
" মরবি মরবি ! কেউ বাঁচবি না। এ ঘরের ইঁটে ইঁটে পাপ। মরবি মরবি...."  মেয়েটা চিৎকার করতে করতে চলে গেল। দেবলীনা ভয়ে বিক্রমকে জড়িয়ে ধরল। বিক্রম এবার না হেঁসে পারল না। 

অজ উবাচ // সুব্রত মজুমদার

                                                 অজ উবাচ
                     নিন্দুকেরা আমাদের নামে যাই বলুক আমরা যা তা বলি এমন অপবাদ দেবার সাধ্য কারোর নেই। অবশ্য খাবার ব্যাপারে আমাদের অতটা রক্ষণশীলতা নেই। আর শীল রক্ষণের দায় দায়িত্বও আমাদের নেই। তবে বাছা নরপুঙ্গব আমাদের আচার ব্যবহার অনুকরণের অনুরোধ কে তোমাকে করেছে ? আমরা তোমাদের শুকোতে দেওয়া আচার মাঝেমধ্যে খাই বটে কিন্তু আমাদের আচার অতটা ভদ্রজনসুলভ নয়।
              পূর্বেই বলেছি আমরা কথা বলি কম। কেবলমাত্র ইংরেজীর পঞ্চমমাস আর হিন্দুস্থানির অহমবোধক শব্দই আমাদের ইষ্টমন্ত্র। তবে আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। আজ সকালে উঠেই পেটের ছুঁচোগুলো শরীরচর্চায় মনোনিবেশ করেছে। তাদের জন্য বাদাম পেস্তা পাই কোথা ?  যে খায় চিনি তাকে যোগান চিন্তামণি। দেখি চিন্তামণির চরণ চিন্তা করতে করতে সাধুবাবা আশ্রমের দিকে যাচ্ছেন। তারই সঙ্গ নিলাম। কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস। পৌঁছে গেলাম সাধুবাবার আশ্রমে। আহা ! আশ্রমের সামনেই কি সুন্দর নরম পেলব গাছ। খেলাম পেট ভরে। তখন কি জানতাম ঐ সব রম্যানি বৃক্ষানি আসলে গঞ্জীকা বৃক্ষ। ক্যানাবিস। কেনা বিষও বলতে পারেন, - যদিও কেনার সাধ্য বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার ছিল না। কেনা বিষের বিষক্রিয়া শুরু হতেই আমি উর্ধপদ হলাম। বাবাজী কোন ঈশ্বরীয় তত্ত্ব আমার মধ্যে পেলেন জানি না  আমার সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়লেন। তারপর আমার শৃঙ্গাঘাতে স্থানচ্যূত হতেই আমার উদ্দেশ্যে বাছা বাছা বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেন। পরে যষ্ঠি হাতে তাড়া করতেই পিতৃদত্ত প্রাণ রক্ষায় সচেষ্ট হলাম।
                                                        আপনারা যাই বলুন না কেন এ জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে দাদা। খুঁত থাকলে দেবতারা অপ্রসন্ন আবার খুঁত না থাকলে মানুষেরা অপ্রসন্ন। আমরা যাই কোথায় বলুন তো ? কারোর ছেলে পাড়াময় টো টো করে বেড়ালে তার দোষও পড়ে আমাদের উপরে। সবার মুখেই এক কথা, - দেখো অমুকের ছেলেটা 'ছাড়া পাঁঠা' র মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কেউ মূর্খামি করলে 'বোকা পাঁঠা' বলতে আপনারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। বিশ্বকবি একবার আমাদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। তিনি বিশুপাগলকে দিয়ে বলিয়েছিলেন যে আস্ত হয়ে থাকাটা আমাদের পাঁঠাদের জন্যেই আবশ্যক। যারা খায় তারা হাড় গোড় খুর লেজ বাদ দিয়েই খায়। কিন্তু আপনারা রবিবাবুরও মান রাখলেন না ! আজকাল হাড় গোড় তো কোন ছার নাড়ি ভুঁড়িরও  উপাদেয় পদ বানিয়ে দিচ্ছেন আপনারা !!
                                     অনেকেই ইঁচড়কে গাছ পাঁঠা বলে ডাকেন, এতে আমাদের কোন মান অভিমান নেই। কিন্তু আমাদের দাড়ি নিয়ে এত রসিকতা কেন ?  ছাগীদের যদি দাড়ি গজায়  তবে তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হল ? আপনাদের স্ত্রীজাতি যখন প্যান্ট কোট পড়েন তখন তো কই আমরা তা নিয়ে ছাগসমাজে রঙ্গরসিকতা করি না। তবে জামা প্যান্ট চিবোতে আমার ভালোই লাগে। একবার এক শহরের বাবু আমাদের গ্রামে এসেছিল। গ্রামের সবাই তাকে কত আদর যত্ন করলে। খাওয়া দাওয়ার পর সেই বাবু যখন মাদুরে শুয়ে নাক ডাকছিল তখন আমার খেয়াল হল বাবুকে একবার হাই হ্যালো বলে আসি। ধীর পায়ে গেলাম। শুঁকে শুঁকে দেখলাম। আহা, কি কলাপাতা কলাপাতা সুগন্ধ ! দিলাম বুক পকেটটা চিবিয়ে। লাল বেগুনি কাগজের সাথে একটা চারকোনা শক্ত কাগজও ছিল। খুবই সুস্বাদু।
                                ছাগল হলেও দাদা কৌতুহল তো আছে। গেলাম সুব্রত ভায়ার কাছে। বললাম - জামাকাপড় কি আজকাল কলার পাতা ছেঁচে তৈরি হচ্ছে, - নইলে জামাতে কলাপাতার গন্ধ কেন ? ব্যাটা বামুনের মুখ্যু কি বলল জানেন, বাবুটি নাকি কলাপাতা মোড়া মাছের পাতুরি খেয়েছেন। বোঝ কাণ্ড  !!! 

স্বপনচারিনী // সুব্রত মজুমদার

দেখেছি তোমাকে স্বপনচারিনী বিদ্যুন্মালা গলে
মদির নয়ন চপল চরণ কিঙ্কিণী রব তোলে।
সন্ধ্যা তারার মালিকা গলায়  চাঁদের মুকুট শিরে
পাকা কেঁদুরির মতন ওষ্ঠে জ্যোৎস্নার হাঁসি ঝরে।
সন্ধ্যার যত হংসবলাকা আপন কুলায় ফেরে
তাদের শুভ্র পালক তোমার সকল অঙ্গ ঘিরে।
বেলির গুচ্ছ নীবিবন্ধন রসনা কমলদল
কমলপত্রে শিশিরের মতো আঁখি করে টলমল।
স্বপনের ঘোরে দেখেছি তোমায় তমসা নদীর কূলে,
সবুজ পাড়ের আশমানী শাড়ি দখিনা হাওয়ায় দোলে।
লাল শালুকের মালা পরে গলে ঢেউ তুলে কালো জলে
হে মৃগনয়ণা ভাবো কার কথা এলাইয়ে এলোচুলে।
 ঝিঁঝিঁ ঝঙ্কারে শিঞ্জন তুলে বেলির সুবাস ছড়ায়ে
স্বর্ণলতার মতন প্রেয়সী অঙ্গে রহ গো জড়ায়ে।
তোমায় দেখেছি দ্বারকার কূলে দেখেছি গিরিকন্দরে
ইলোরার রুপে ধৌলির স্তুপে দেখেছি হৃদয় মন্তরে;
তোমারে হেরিয়া রচে কালিদাস মন্দাক্রান্তা ছন্দ,
ভিঞ্চির তুলি তোমার সুষমা আঁকে দিয়ে তার আনন্দ।
বৈজুর সুরে বীণাঝঙ্কারে বিরহীর অভিমানে
তুমি আছ প্রিয়া, আছ চিরকাল হৃদয়ের নিধুবনে। 

Saturday, May 4, 2019

উৎশৃঙ্খল // সুব্রত মজুমদার

উৎশৃঙ্খল
            সুব্রত মজুমদার
উৎশৃঙ্খল তুমি এসেছিলে নিয়ে ঝঞ্ঝা
লড়াই করতে দুনিয়ার সাথে পাঞ্জা।
তোমার থাবায় গোলাপ বাগান তছনছ,
একাকার হল সুখ-দুখ-রাগ-ঝুট-সচ্।
গরীবের কুঁড়ে রাজার মহল একাকার
তব রোষে হল মানুষের দ্বেষ চুরমার।
শতকের পর শতক আমরা গড়ে চলি
দিয়ে ইঁট কাঠ ধাতু পাথর আর ধুলোবালি;
আজ তুমি যাও তছনছ করে সবকিছুই
তবুও আমরা রইলাম হয়ে নাক উঁচুই ।
আজো বিভেদের জীর্ণ প্রাচীর গড়ে তুলি,
ভুলে যাই নিতে হোলির আবির রং তুলি।
বছরের পর বছর আমরা করি লড়াই
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনার করি বড়াই,
এসেছে সময় ভাঙো যত পুরাতনে
ভরাও বিশ্ব নব নবীনের গানে। 

অলীকপুরের লোককথা - শেষ ভাগ // সুব্রত মজুমদার

তিন দিক হতে তিনটে দল মার্চ করে এগিয়ে যেতে লাগলো। সবার মনেই চরম উত্তেজনা। ক্যানেল ব্রিজের কিছু পরে একটা নিম গাছের তলায় অলীকপুরের দল থামল। রজত রায় বসে পড়লেন গাছের তলায়। হরি ডাক্তার স্টেথস্কোপ লাগিয়ে রজত রায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিলেন।
হাতিডোবার দল নিমগাছ হতে অনেকটাই দূরে। দূর থেকে তারা আন্দাজ করতে পারলো যে গাছতলায় কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। মশালের আলো দেখে রসিকদাদু বললেন, " এ তো ছপ্পর সিংয়ের দলবল মনে হচ্ছে। কোথাও বোধহয় ডাকাতির পরিকল্পনা আছে। আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে। কি বল কর্ণেল ?"
কর্ণেল বললেন, "আমরা আলো নিভিয়ে ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াব। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এমনও তো হতে পারে ওরা আমাদের গ্রাম লুঠ করতেই জড়ো হয়েছে। "
কর্ণেলের কথায় সবাই সন্মতি জানাল। কেবল মহান্তজী নিমরাজি হলেন। তিনি বললেন," এ পথটা ভালো নয়। সাপখোপ থাকতে পারে। আমি অন্ধকারে একপাও যাবো না। "
সবাই বিপদে পড়লো মহান্তজীকে নিয়ে। শেষে রসিকদাদু রেগে গিয়ে বললেন," ওকে এইখানেই ছেড়ে দিয়ে চল। বাঘে শেয়ালে ছিঁড়ে খাক। এমন লোক মাইরি বাপের জন্মেও দেখিনি।"
দলের সবাই এগোতে শুরু করলে মহান্তজীও পেছন ধরলেন। সকলে ধীর পায়ে নিমগাছের পেছনের ঝোঁপের পেছনে হাজির হল। ইতিমধ্যেই হাতিডোবার মতো অলীকপুরের বাহিনীও আলো নিভিয়ে চলার নীতি নিয়েছে। কারন তারা কিছুক্ষণ আগেই একটা দলকে এগিয়ে আসতে দেখেছে। হঠাৎ করে কি করে দলটা অদৃশ্য হয়ে গেল তা হরি ডাক্তারের মাথায় ঢুকছে না।
   এমন সময় ছপ্পর সিংয়ের দল নিমতলার কিছুটা দূরে এসে হাজির হল।  বড় বাইরে পেতেই  ছপ্পর সিং পাশের ঝোপের দিকে দৌড় দিল। দলের এক নতুন ডাকাতের প্রশ্নের উত্তরে ছকুয়া বলল, " টাট্টি ফিরনে গেয়া। হর আধা ঘণ্টে মে সর্দারকো টাট্টি আতা হ্যা।"
 কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও হাতিডোবার দল নিমতলাতে সঠিক কি হচ্ছে তা বুঝতে পারল না। কর্ণেল সরকার বলল, "আমাদের আক্রমন করে দেওয়া উচিত। এরা যেই হোক ভালো লোক নয়।"
রসিকদাদু ডান হাত তুলে তর্জনি উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলেন," আক্রমণ !! "    সাথে সাথেই হাতিডোবার বাহিনী অলীকপুরের বাহিনীকে আক্রমণ করে দিল। আতর্কিত আক্রমণে অলীকপুরের  বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে গেল। অমাবস্যার অন্ধকারে কেউ কারোর মুখ  দেখতে পাচ্ছে না। রজত রায়ের হাত হতে কিরিচটা পড়ে গেল। রজত রায় অন্ধকারে হাঁতড়ে হাঁতড়ে কিরিচ খুঁজতে লাগলেন। এমন সময় হরি ডাক্তার এসে রজত রায়কে এক চড় মারল। ডাক্তার অন্ধকারে রজত রায়কে বিপক্ষ দলের ভেবে নিল। রজত রায় হরি ডাক্তারের ধুতি ধরে টান মারতেই ধুতি খুলে চলে এল। রসিকদাদু তার লাঠি তুলে চোখ বন্ধ করে হাওয়ায় বাড়ি মারতে লাগলেন । দু'তিনটে বাড়ি ব্যর্থ হওয়ার পর সামনের জমাট অন্ধকার হতে 'মা গো' বলে চিৎকার ভেঁসে এল। রসিকদাদু গলার স্বরটা চিনতে পারলেন। তিনি বললেন, " সুভাষ নাকি ? আমি অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না বাবা।"
সুভাষখুঁড়ো আর্তস্বরে বললেন, "তা বলে খুঁড়ো তুমি আমাকে মারবে !"
অন্ধকারে যে যাকে পারল  মারল।  কারোর পরনের ধুতিটা নেই তো কারোর বাঁধানো দাঁতের পাটি খুলে পড়ে গেছে। সবেমিলে জগাখিঁচুড়ি অবস্থা। নিমতলাকে মহাভারতের স্ত্রীপর্বে উল্লিখিত যুদ্ধক্ষেত্রের মর্মন্তুদ দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। পার্থক্য কেবল একটাই এখানে কেউই নিহত বা সিরিয়াস আহত নয়।
       ছপ্পর সিংয়ের দলবল নব্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ লক্ষ্য করছিল। অন্ধকারে রথিমহারথিদের কেবল চিনতে পারেনি। এবার তারা পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে নিমতলায় হাজির হল। পেট্রোম্যাক্সের আলোয় এখন নিমতলা আলোকিত হয়ে উঠেছে। সব রথিমহারথিরা একে অপরকে চিনতে পেরে ও নিজেদের মূর্খতায় লজ্জ্বিত হল। ছপ্পর সিং রাগ সম্বরণ করতে না পেরে ছুটে গিয়ে বটেশ্বরকে এক চড় মারে। আর তখনই সাপটি বটেশ্বরের আলখাল্লা হতে বের হয়ে ঝোঁপে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছপ্পর সিং বলল, " চলরে ছকুয়া, এরা আপসে লড়ে নিক। পরে আসবো।"
ছকুয়া বলল, " এ লোক কিউ আপসমে লড়তা.."
ছপ্পর সিং আর দলবল চলে গেল। যাবার আগে বটেশ্বরের জটা রামদা দিয়ে কেটে নিয়ে গেল।
       রজত রায় উঠে চিৎকার বললেন, "আপনারা শান্ত হন, আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলছি।" 
রজত রায় আদ্যোপ্রান্ত গুছিয়ে বললেন। সব শুনে রসিকদাদু বললেন, "আমরাও অমানুষ নই বাবা। তোমার ছেলেকে আমরা সঙ্গেই এনেছি। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েগেছে আর কি। তবে এখন থেকে আমরা দুটো গ্রাম একসাথে মিলেমিশে থাকব।"
হরি ডাক্তার বললেন," আমরাও তাই চাই। কি বলেন মহান্তজী ?"
মহান্তজী বললেন, "আমার একটা প্রস্তাব আছে।"
রজত রায় বললেন," কি প্রস্তাব ? "
মহান্তজী বললেন," সাহেব বাবা আর তিন্নি মায়ের চারহাত এক করে দিলে একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠবে দুই গ্রামের ভেতরে। "
সুভাষখুঁড়ো বললেন, "ছেলের মতটাও তো দরকার। কি বল সাহেব বাবা ? "
সাহেব লজ্জ্বায় মাথা নিচু করে রইল। রজত রায় বললেন, " ও রাজি হবে না ওর ঘাড় হবে। ওর আবার মত কি। আমি এই বিয়েতে মত দিচ্ছি। "
                           - - নটে গাছটি মুড়োলো--

এরপরে যা হল তা ভালোই হল। এক শুভক্ষণে সাহেব আর তিন্নির চারহাত এক হয়ে গেল। দুই গ্রাম পেটভরে ভোজ খেল। বিয়েতে ছপ্পর সিংও এসেছিল, তবে ডাকাতির জন্য নয় সে এসেছিল দলবল নিয়ে বিবাহ উৎসবে যোগ দিতে। ছপ্পর সিং সজল চোখে বলল, "আমার তো কোনো মেয়ে নেই, আমি তিন্নির কণ্যাদান করতে চাই।"
এ প্রস্তাবে কেউ গররাজি হল না। দুই গ্রাম বিভেদ ভুলে এক হয়ে গেল। ভোজ যা হল তা অনবদ্য। মেনু করেছেন স্বয়ং মহান্তজী। মেনুতে কি কি ছিল ?
রোষো বলছি....
            কল্যাণীয় সাহেব ও কল্যাণীয়া তিন্নির বিবাহ উৎসব
            বিবাহ বাসর :- হাতিডোবা
             রাত্রি আট ঘটিকায় বিবাহ অনুষ্ঠান ও প্রীতিভোজ
            অতিথি আপ্যায়নে ব্যাঞ্জনসমূহ :
        চাটনি সহযোগে মৎস্যের বড়া।
          মশলা ঘৃত ও বাদামাদি সংযোগে ভর্জিত অন্ন।
        গান্ধারদেশস্থ চানা সহযোগে পনিরের ব্যাঞ্জন।
          শুভ্র অন্ন।
       রোহিত মৎস্যের মস্তকচূর্ণ সহযোগে মুগসূপ।
       পঞ্চ সব্জি সহযোগে সুস্বাদু ব্যাঞ্জন।
        আলু সহযোগে অহিফেনবৃক্ষবীজ প্রস্তুত ব্যাঞ্জন।
        তরুণ অজ মাংস / রোহিত মৎস্য।
         পঞ্চফলাদি প্রস্তুত চাটনি।
       বারিপূর্ণ সন্দেশমিষ্টান্ন।
        রসগুলিকা।
        পরমান্ন।
        পাঁপড়াদি।
       গুবাকাদি সহযোগে মুখশুদ্ধি।
সকলে উপস্থিত থাকিয়া নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করিয়া বাধিত করিবেন।
                                       - শুভমস্তু-

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৯ // সুব্রত মজুমদার

ছপ্পর সিং তার ইয়াব্বড় গোঁফে তা দিতে দিতে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল, তারপর তড়াক করে উঠে পড়ল। এরপর ছপ্পর সিং বলল, " মহান্তজী একটা  আস্ত শয়তান। আমি নাকি ওর কাছে দীক্ষা নিয়েছি ! আমি নাকি বিবাগি হয়ে গিয়েছি ! অনেক বড় বড় কথা বলে বেড়ায় ব্যাটা, আজ আবার আমার ক্ষতি চেয়ে তন্ত্র মন্ত্র করছে ! ওর ব্যাবস্থা আমি করব। তুই বস আমি আসছি। "
ছপ্পর সিং যে কোথায় গেল তা খোচরটি জানে। তাই সে আর কথা বাড়াল না। মিনিট পাঁচেক পরেই পেট হাল্কা করে ছপ্পর সিং এল। খোচর বলল," বটেশ্বর ওঝাকে ডেকেছে ওরা। বটেশ্বর বলেছে, এই বিধি সম্পূর্ণ হলেই ডাকু ছপ্পর সিং ফিনিশ ।"
ছপ্পর সিং এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। সন্মন্ধে বটেশ্বর তার ভাইরাভাই। বটেশ্বর যতবারই ছপ্পর সিংয়ের বাড়িতে আসত ততবারই ছপ্পরের নামে শ্যালিকার কানে বিষ ঢালত। আর পরিণামে ছপ্পরের দাম্পত্য কলহ চরমে উঠত। ছপ্পর সিং তাই বটেশ্বরকে দু'চোখে দেখতে পারত না। আজ খোচরের মুখে বটেশ্বরের কীর্তিকলাপ শুনে ছপ্পর সিং হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, " বটেশ্বরের মুণ্ডু নেব আমি। আমার সঙ্গে শত্রুতা ! এর দাম দিতে হবে ওকে।"
ছপ্পর সিং দলবল নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করতে হবে। বটেশ্বর আর মহান্তজীকে ছাড়া যাবে না। রাঁধুনিরা রান্না বসিয়ে দিল। সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তৈরি থাকতে হবে। মোটা মোটা লাল চালের ভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধ আর ভাতের মাড়। ছপ্পর সিং বন্দুকের নল পরিস্কার করতে বসল। দলের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। ছকুয়া গান ধরল। সবাই সঙ্গত দিল তাতে।
                      বহুতদিন বাদ সাজন আইলবা রে
                    পেড় পর মিঠিয়া আমিয়া পক গেইলবা রে।
                     সাজনবা হামার পকাই রোটি গোল গোল
                     খনকি চুড়িয়া উনকি, পল্লু দে দোল দোল,
                      মাইকে সে আয়ি লেকে চুড়িয়া রে।।
ছপ্পর সিং আর থাকতে পারল না। সেও গান ধরল,
                     কুন পাড়ার ছুঁড়ি রে তুর খুঁপায় গুঁজা ফুল
                     বুকে আমার মেরে দিলি ভালবাসার শূল,
                      ঠুঁটে রে তুর ঠুঁটপালিশ গালে রে তুর লালি
                       তুকে দেখে মনে পড়ে আমার ছুটু শালী।
                      শালী আমার ভরযুবতী উকুন বাছে বসে,
                     বিহানবেলা কেটে গেল সেই শালীর আশে।
                    মুড়ির সাথে আলুভাজা আর পেঁয়াজ কাঁচা
                  মু'য়ের গন্ধে রয় না শালী, বেথাই আমার বাঁচা।
                   শালীর বাড়ি মল্লারপুর ট্রেনে বাসে ভিড়
                       হেঁটে হেঁটে চলে যাব আমি মারাং বীর হে আমি  মারাং বীর।।
                                                              - - ৬--
 অলীকপুরে টেনশনের শেষ নেই। রজত রায় পায়চারি করছেন ।চোখে মুখে তার টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করছেন, " ছেলেটাকে হাতিডোবায় কি কুক্ষণেই না পাঠালাম ! ওর মাকে এবার আমি কি জবাব দেব ! হে ভগবান, আমার মাথায় আর কিছু আসছে না।"
 হরি ডাক্তার এখন সুস্থ্য। তিনি বললেন, " তুমি চিন্তা কোরো না বাবা রজত, তোমার ছেলেকে ছাড়িয়ে আনবার দায়িত্ব গোটা অলীকপুরের। মাথা ঠান্ডা করো। কিছু একটা উপাই বেরোবই। "
-" না ডাক্তারবাবু, শান্ত হতে পারছি কই ! আপনার বৌমাকে আমি কি জবাব দেব বলুন তো। "
-" আমি সব বুঝতে পারছি। বৌমার সঙ্গে আমি কথা বলব।"
রজত রায়ের সঙ্গে যখন হরি ডাক্তারের কথোপকথন চলছে তখনই দৌড়তে দৌড়তে হাজির হল চাকলাদার। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বললেন," খবর আছে, একটা খারাপ খবর আছে। "
রজত রায় আর হরি ডাক্তার একসঙ্গে বলে উঠলেন," কি খবর... "
চাকলাদার বললেন," আমার কাজের মেয়েটার স্বামী ছপ্পর সিংয়ের ডাকাতদলে রান্না করে। কাজের মেয়েটাই আমার বৌকে বলেছে, ছপ্পর সিং হাতিডোবায় আক্রমণ করবে। পাক্কা খবর।"
হরি ডাক্তার একটু হতাশ হয়ে বললেন," এতে খারাপ কি ? হাতিডোবা আমাদের শত্রু। ওদেরকে শিক্ষা দেওয়া দরকার।"
চাকলাদার বলল," এতো সহজ নয় ডাক্তারবাবু, সাহেবকে ওরা তন্ত্রমতে বলি দেবে। "
রজত রায় শোনামাত্র অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হরি ডাক্তার বললেন," উকিলকে জাগাও। আজই আমরা হাতিডোবা আক্রমণ করব। আমি ষণ্ডাগুণ্ডা দেখে লোক বেছে রাখছি। এতবড় সাহস হাতিডোবার ! "
হরি ডাক্তার চলে যান। চাকলাদার রজত রায়ের চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। সারা গ্রাম সাহেবকে বাঁচানোর জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে।
এদিকে হাতিডোবায় সাহেবের দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছে তিন্নির উপর। তিন্নি একটু বেশিই যত্ন রাখছে। আজকের অলীকপুর অভিযানে সাহেবকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে মহান্তজী আর কর্ণেলের মধ্যে একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেছে। অবশেষে ঠিক হয়েছে সাহেবও সঙ্গে যাবে। হাতিডোবার দাবিদাওয়া মেনে নিলে সাহেবকে অলীকপুরের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল। অলীকপুরের বাহিনী রজত রায়, চাকলাদার আর হরি ডাক্তারের নেতৃত্বে রওনা দিল। হরি ডাক্তারের হাতে কিরিচ। কিরিচ হল একরকমের তরোয়াল যা ফাঁপা বাঁশের ভিতরে ঢোকানো থাকে। প্রয়োজনে লাঠি অংশটি একজন ও তরোয়ালটি আরেকজন ব্যবহার করতে পারে। হরি ডাক্তার নিয়েছেন ঘুমের ওষুধ ভর্তি ইঞ্জেকশন। আর অন্যান্যদের হাতে তেল মাখানো লাঠি।
হাতিডোবার লোকেরাও পিছিয়ে নেই। সাহেবকে পিছমোড়া করে বেঁধে আগে আগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার পেছনে কত্থক নৃত্যরত বটেশ্বর ওঝা। শেষের সারিতে কর্ণেল সরকার, মহান্তজী, রসিকদাদু, সুভাষখুঁড়ো ও অন্যান্যরা ।
কর্ণেল সরকারের পরনে মিলিটারি পোষাক, হাতে দোনলা বন্দুক । মহান্তজী কর্ণেল সরকারের পেছন পেছন আসছেন ইষ্টনাম জপ করতে করতে। তার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। তিনি এক একবার হুঙ্কার ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন, আবার কর্ণেল সরকারের পেছনে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। সুভাষখুঁড়ো একটা রামদা নিয়ে ঘোরাচ্ছেন আর 'লড়াই' 'লড়াই' বলে চিৎকার করছেন। রসিকদাদু সবার পেছনে চলেছেন তার প্রিয় রূপো বাঁধানো লাঠিটি নিয়ে। সবে মিলিয়ে লড়াইয়ের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে।
ডাকু ছপ্পর সিংও পিছিয়ে নেই। সে তার দলবল নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। যে কোনো সময় রওনা দেবে। টেনশনে ছপ্পর সিংয়ের বড় বাইরে যাওয়ার ডিউরেশন কমে গেছে। ছকুয়া বন্দুক হাতে এক একবার লাফিয়ে উঠছে। ছপ্পর সিং তার বিশাল পাগড়ি ঝাঁকিয়ে গর্জন করে উঠল, "কাউকে ছাড়বোনা। বটেশ্বর আমি আতা হুঁ। তোকে ছোড়তা নেহি।" 

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৮ // সুব্রত মজুমদার

দারোগা গিন্নী অকুস্থলে হাজির হয়ে দেখলেন তার কর্তা একটা পাতলা প্যাকপ্যাকে লোকের উপরে উপুর হয়ে পড়ে আছেন, আর তার উপরে রেলিং এর খুঁটির সাথে শোভা পাচ্ছে সাধের গোলাপের গামলাটা। তিনি তো সঙ্গে সঙ্গেই কান্না জুড়ে দিলেন, "ওগো তোমরা কে কোথায় আছো দেখে যাও গো.. ওও... ওওও.... আমার মাছ খাওয়া সারাজীবনের মতো ঘুচে গেল গো... ওওওওও.....।"
দারোগা গিন্নীর কান্নাকাটি শুনে পাড়া প্রতিবেশী সেপাই সবাই এসে হাজির হলো। তাদের দেখে দারোগার গিন্নীর কান্না আরো বেড়ে গেল। তিনি আবার শুরু করলেন," ওগো কোথায় গেলে গো ! যাবার সময় এটিএম-কার্ডের পিন নাম্বারটা বলে কেন গেলেনা গো ! গ্রামের বাড়ি বারো ভুতে দখল করছে গো ! তোমার মা আমাকে তার ভাগ দেবেনা গো !"
কান্নার সাথে সাথে দারোগাবাবুর পিঠে কিল মেরে চলেছেন অনবরত। দারোগাবাবু আর পারলেন না। তিনি ওই সুর নকল করে বললেন," এখনো মরিনি গো। তবে তোমার কিলে নিশ্চয়ই মরবো গো। দয়া করে আমাকে ওঠাও গো। তারপরে জমিসম্পত্তির ভাগ নিয়ো গো।"
উপস্থিত লোকেরা দারোগাবাবুকে উদ্ধার করলেন। এ যাত্রা দারোগাবাবু বেঁচে গেলেন। সামান্য চোট আঘাত ছাড়া আর কিছু হয়নি। আর উদ্ধার হলো প্যাঁকা চোর। প্যাঁকা চোরকে নিয়ে যাওয়া হলো হাজতে। চারদিন ধরে আচ্ছা রকমের ধোলাই খাওয়ার পর প্যাঁকাকে ছাড়া হলো। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণার থেকেও মনের যন্ত্রণায় বেশি কষ্ট পেয়েছিল প্যাঁকা। সে আর ঘরমুখো হয়নি। কোথায় যে গেল তা আর জানা গেল না।
প্যাঁকার  অন্তর্ধানে সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন জগদীশ দারোগা। তিনি সদর্পে বলে বেড়াতে লাগলেন, " আমাকে চ্যালেঞ্জ ! জগদীশ দারোগাকে চ্যালেঞ্জ ! দিয়েছি দেশান্তরি করে।"
আশেপাশের এলাকায় রটে গেল যে প্যাঁকা চোর জগদীশ দারোগার হেফাজতে দিনচারেক থেকেই শুধরে গেছে। সংসারে আর তার মায়ামোহ নেই। কোন এক মহান্তজীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সে এখন পুরোদস্তুর সাধুবাবা। আর হাতিডোবার মহান্তজী এই রটনাকে দস্তুরমতো কাজে লাগালেন। তিনি বললেন," সবই হরির লীলা, আমরা সবাই নিমিত্ত মাত্র। এসেছিল, প্যাঁকা এসেছিল। রাতের অন্ধকারে এসে লুটিয়ে পড়ল আমার শ্রীচরণে। আমি বললাম, বল বৎস কি দরকারে আগমন। প্যাঁকা কেঁদে বলল, সংসারে আর রুচি নেই প্রলয়ের প্রভূ, আমাকে উদ্ধার করুন। আমি মস্তক মুণ্ডণ করিয়ে কাষায় বস্ত্র পরিয়ে দীক্ষা দিলাম। সে চলে গেল হিমালয়ের পথে, তপস্যায়। "
রঘু গোয়ালা দুধ দিতে এসেছিল। সে সবকিছু শুনে বলল," বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না বাবু, আমি কাকভোরে দুধের ড্রাম নিয়ে আসছিলাম  দেখলাম সামনে এক  নাগাবাবা। পাতলা চেহারা, সারা শরীরে ছাইমাখা। আমাকে একগ্লাস দুধ চাইলেন । আমি বললাম, একগ্লাস কেন যত ইচ্ছা দুধ খাও বাবা। বাবাজী দুধ খেয়ে বললেন, তোর দুধ যা মিষ্টি আর টাটকা  খেয়ে শরীর চাঙ্গা হয়ে গেল। তারপর আমাকে আশীর্বাদ দিয়ে বললেন , আমার এই ড্রামের দুধ যে  খাবে তার শরীরে কোন রোগ এসে বাঁসা বাঁধবে না। "                              বলা বাহুল্য সেদিন থেকে রঘু গোয়ালার দুধের বিক্রি বেড়ে গেল। যাদের অম্বলের ধাত পেটে একফোঁটাও দুধ সহ্য হয় না তারাও লিটার লিটার দুধ কিনে খেতে লাগল। এভাবে প্যাঁকার অন্তর্ধান অনেকেরই ব্যবসার বিজ্ঞাপনে পরিণত হল। গল্পও রটল অনেক। সবেমিলে পরিস্থিতি সরগরম হয়ে উঠল।
  জগদীশ দারোগার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্যাঁকার আর বাঁচতে ইচ্ছা করল না। সে মরতে গেল, কিন্তু মরা হল না। চোরসম্রাট চৌর্য্যকুমার প্যাঁকাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল নিজের ডেরায়। চৌর্য্যকুমারের উপদেশে প্যাঁকার মনোবল ফিরে এল। প্যাঁকা শপথ নিল জগদীশ দারোগাকে যেকোনো উপায়ে জব্দ করার।
  অলীকপুর আর হাতিডোবার পাশে যে জঙ্গল আছে সেখানে ডেরাবাঁধল প্যাঁকা। গব্বর সিং এর সাথে মিলিয়ে নিজের নাম রাখল ছপ্পর সিং। ছপ্পর সিংয়ের অনেক সহযোগী জুটে গেল। দলবেঁধে ডাকাতি করতে শুরু করে প্যাঁকা ওরফে ছপ্পর সিং। কিন্তু কপাল তার বিরূপ। সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয় না। সব পরিকল্পনা তখন ঘেঁটে-ঘ হয়ে যায়।
এই তো সেদিন ছপ্পর সিং গিয়েছিল হরি ডাক্তারের বাড়িতে ডাকাতি করতে। গোটা ডাকাত দল দরজা ভেঙ্গে ঢুকছে ডাক্তারের ঘরের ভেতর। হরি ডাক্তারের কোষ্ঠকাঠিণ্যের ধাত ।তিনি প্রতিদিন দুধের সাথে সামান্য জোলাপ মিশিয়ে খেয়ে শুতে যান, এতে সকালবেলায় খুব সহজেই পেট সাফ হয়ে যায়। ছপ্পর সিংয়ের খোচর হরি ডাক্তারের বাড়ি রেকি করতে এসে সেটা দেখে। তার ধারনা হয় বৃদ্ধ বয়সেও শরীর স্বাস্থ্য যৌবন অটুট রাখতে হরি ডাক্তার এই ওষুধ খান বোধহয়। তাই ঘরে ঢুকেই হরি ডাক্তারের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ছপ্পর সিং বলল, "বল, শরীরে তাগদ হবার ওষুধ কোথায় রেখেছিস বল।"
হরি ডাক্তার ঢোঁক গিলে বলল, "ওরকম কোন ওষুধ নেই বাবা প্যাঁকা।"
ছপ্পর সিং রেগে বলল, "কে প্যাঁকা ! আমি ছপ্পর সিং, ডাকু ছপ্পর সিং। আর মিথ্যে কথা বললে বুড়ো সবকটা পেতল তোর মগজে ভরে দেব।"
হরি ডাক্তার দেখলেন যে এরা সত্যিকথা বিশ্বাস করবে না, অতএব মিথ্যা বলে জীবন বাঁচানোয় শ্রেয়। তিনি ওষুধের আলমারির কোনার দিকে রাখা জোলাপের বোতলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন," ওই বোতলটা। "
 বোতলটা বগলদাবা করে ছপ্পর সিং অ্যান্ড কোম্পানি ডেরায় ফিরে গেল। হরি ডাক্তার এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ডাকাতেরা জোলাপের বোতলটা পেয়ে এতটাই আনন্দ পেয়েছিল যে তারা আর কোনো জিনিসে হাত দেয়নি।
                    ডেরায় গিয়ে এক ড্রাম দুধে গোটা বোতলটাই খালি করে দেয়। শুরু হয় আনন্দোৎসব। ছপ্পর সিং আলাদা পাত্রে বেশি পরিমাণে জোলাপ গুলে নিয়েছে। সর্দার হিসাবে বেশি ক্ষমতা তারই হওয়া উচিত। দেখতে দেখতে ড্রাম খালি হয়ে গেল।
      জোলাপের অ্যাকশন শুরু হতেই সবার পেট মোচড় দিয়ে উঠল। ছপ্পর সিং বলল, " শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে অ্যাকশন। এবার দেহে হবে হাতির মতো বল। তারপর জগদীশ দারোগা তোমার খেল খতম।"
        ছপ্পর সিংয়ের দলের এক হিন্দুস্থানি ডাকু তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, " তাগদ নেহি, টাট্টি আ রাহা হ্যা।"   এই বলেই সে মারল এক দৌড়। তারপরেই ছপ্পর সিং পেট হাতে করে ধরে বলল," ঠিক বা। "  গভীর নিম্নচাপে বাংলা আর ভোজপুরি গুলিয়ে গেল ছপ্পর সিংয়ের। ছপ্পর সিং কিন্তু আর দৌড়াতে পারল না, সে দু'পা গিয়েই বসে পড়ল। দলের অন্যান্যদের অবস্থাও সঙ্গীন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলাকাটা বিশ্রী দুর্গন্ধে ভরে উঠল। ভোর হতে হতেই সবার চোখের কোণে কালি পড়ে গেল। আধমরা হয়ে পড়ে রইল সবাই। কার মুখে কে জল দেয়।
                সময়ের সাথে সাথে সবাই সুস্থ্য হলেও ছপ্পর সিংয়ের পেট বিগড়ে গেল। এখন প্রতি আধঘন্টা অন্তর বড় বাইরে যেতে হয়।
এক খোচর এসে ছপ্পর সিংকে খবর দিল যে হাতিডোবায় কিছু একটা ঘটেছে। ছপ্পর সিং বলল, " যা বলবি স্পষ্ট করে বল। তোর আধখাওয়া খবর শুনে আজ আমার এই হাল।"
খোচর বলল, "হাতিডোবার লোকেরা অলীকপুরের উকিলবাবুর ছেলেকে আটকে রেখেছে। বলি দেবে। মহান্তজী ইয়াব্বড় খাঁড়া নিয়ে শান দিচ্ছে। আজ অমাবস্যা। আজকে নরবলি দিয়ে মায়ের কাছে আপনার ধ্বংস চাইবে।"
প্রসঙ্গত বলে রাখি এই খোচরটির তিলকে তাল করার অভ্যাস আছে। এইরকম লোক সর্বত্রই দেখা যায় এবং এরা এদের এই বদভ্যাসের জন্য এমন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা কল্পনা করতেও ভীতির উদ্রেক হয়।

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৭ // সুব্রত মজুমদার

কর্ণেল আর রসিকদাদু গেলেন আশ্রমে। সাহেব আর তিন্নির অপলক দৃষ্টিবিনিময় তখনও চলছে। রসিকদাদু একটা মগে করে জল নিয়ে দুজনের মুখে ছুড়ে মারলেন। তিন্নি সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল," এ মা, কত বেলা হয়ে গেল ! যাই আবার বাবার শরীরটা খারাপ, পথ্যি দিইগে।"
  তিন্নি চলে গেলে সাহেবের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রসিকদাদু বললেন, "কিছু খেয়েছ ?"
সাহেব মাথা নেড়ে সন্মতি জানাল। তার মুখে কাপড় বাঁধা। ব্যাপারটা বুঝে কর্ণেল সরকার সাহেবের মুখ হতে বাঁধনটা খুলে দিলেন। এরপর কর্ণেল জিজ্ঞেস করলেন," কি অভিপ্রায়ে আসা হয়েছে ? হাতিডোবায় যা ঘটেছে তা সন্মন্ধে কি জান ? আমি রিটায়ার্ড কর্ণেল, আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না।"
সাহেব বলল, "আমি কিছুই জানিনা। বাবা ডাক্তারবাবুকে ডাকতে বললেন তাই এসেছি। আমাকে ছেড়ে দেন, আমার সামনে পরীক্ষা। আমি আর কোনোদিন এ গাঁয়ে আসব না। "
রসিকদাদু বললেন," ঘুঘু দেখেছ বাছাধন !.... ঘুঘুর ফাঁদ কেমন হয় এবার দেখতে পাবে। শুধু তুমি নয়, তোমার মেন্টররাও বুঝতে পারবে এই হাতিডোবা কি বিষম ঠাঁই। "
সাহেব দু'চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। সামনে কোনো আশার আলোই দেখা যাচ্ছে না। কি কুক্ষণেই সে অলীকপুর হতে বেরিয়েছিল !
                                             --৫--
                     হাতিডোবা আর অলীকপুরের মাঝখানে ক্যানেল, আর ক্যানেলের পাশেই ঘন বন। এই বনের একচ্ছত্র সম্রাট হল ডাকু ছপ্পর সিং। ছপ্পর সিংয়ের আসল নাম প্যাঁকা। অলীকপুর আর হাতিডোবায় প্যাঁকা চোরের জ্বালাতনে ঘটিবাটি রাখাই দায় হয়েছিল। সরু লিকলিকে চেহারার প্যাঁকা চোর সিঁদ কেটে অনায়াসে লোকের বাড়িতে ঢুকে পড়ত। তারপর শুরু হত আসল খেলা।
প্যাঁকার সাথে থাকত দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরী ক্লোরোফর্ম। সিঁদ কেটে প্রথমে সেই গর্তে একটা চোখ-মুখ আঁকা মাটির হাঁড়ি লাঠির সাহায্যে ভরে দিত। বাড়ির কেউ জেগে থাকলে মানুষের মাথা ভেবে প্রথম আক্রমণ হবে ওই হাঁড়ির উপর। আর সতর্ক হয়ে যাবে চোরবাবাজীবন, - এবং থলি ঝুলি নিয়ে ভাগলবা।
আর মাটির হাঁড়ি বহাল তবিয়তে থাকলে পরের পর্যায় শুরু। প্যাঁকা তার একটা পা ধীরে ধীরে গর্তের মধ্যে ঢোকায়, তারপর পর্যায়ক্রমে হাত মাথা ও সারা শরীর ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। তারপর গৃহস্থকে অজ্ঞান করে জিনিসপত্র গয়নাগাঠি নিয়ে প্যাঁকা হাওয়া।
এইভাবেই বেশ চলছিল। দারোগাবাবুরা প্যাঁকার জ্বলনে অস্থির। কোনোমতেই তাকে ধরা যায় না। অবশেষে থানায় এলেন নতুন দারোগ, - - জগদীশ জোয়ারদার। অফিসার হিসেবে তিনি খুব কড়া। এসেই ঘোষণা করলেন যে প্যাঁকা চোরকে তার চাই। থানায় হইচই পড়ে গেল। হাবিলদার, সিপাই, আমজনতা সবাই শশব্যস্ত হয়ে উঠল। চারিদিকে একই কথা, "আর প্যাঁকার রেহাই নেই।"
এইভাবে সবাই প্যাঁকার পেছনে পড়ে গেলে প্যাঁকারও জেদ চেপে গেল। সে চিঠি লিখল জগদীশ দারোগাকে। অবশ্যই  চিঠি প্যাঁকা নিজে লেখেনি। এই চিঠি লেখার জন্যে সে গিয়েছিল তার মেজোমেসো অতুল বাগ্দীর কাছে। অতুল ক্লাস থ্রি পাশ। বেরাদরিতে অতুলই একমাত্র শিক্ষিত এবং সর্ববিষয়ে পারঙ্গদ। তাই অতুলের কাছে প্যাঁকা গিয়েছিল পরামর্শের জন্য।
অতুল বলল, "আমি বলি কি বাপ, একখান হুমকি দিয়ে চিঠি দে। দারোগাবাবু ভয় পেয়ে তোর পেছন ছেড়ে দেবে।"
প্যাঁকা বলল, " তুমি যা বলবে তাই হবে মেসো। কিন্তু চিঠি লিখতে তো আমি জানি না। ক অক্ষর গোমাংস আমার কাছে। যা লিখতে হয় তুমিই লেখ।"
অতুল লেখতে বসল। খাগের কলম আলতায় ডুবিয়ে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা হল চিঠিখানা। কাটাকুটি আর ভুলভ্রান্তি বাদ দিলে চিঠিটা মোটামুটি এই রকম :
             পরম পূজনীয় দারোগাবাবু,
                                           আপনি কাজটা ঠিক করলেন না। আপনার কাজের পিতিশোধ আমি
                        নিয়েই ছাড়ব মশাই। আসছে ভাদর মাসের দোসরা আপনার বাড়িতে চুরি করবার
                        ইচ্ছা হইছে। পারলে আমাকে ধরে আপনার  দেখান। 
                                                                                                      ইতি
                                                                                          আপনার স্নেহের প্যাঁকা
   চিঠি পড়া ইস্তক জগদীশ দারোগার মনে একটুও শান্তি নেই। তিনি পায়চারি করছেন আর কাপের পর কাপ চা খাচ্ছেন। আর জোরে জোরে হুঙ্কার ছেড়ে বলছেন, " স্নেহের প্যাঁকা ! স্নেহ বের করছি তোর। আমাকে হুমকি চিঠি ! জগদীশ দারোগাকে হুমকি চিঠি ! হাবিলদার, গাড়ি বের করো;.... রেডে বরুবো।"
এরপর  হ্যাট্রিক করে ফেলল প্যাঁকা। কোনোবারই তাকে ধরা যায় না। সবাই এই অপেক্ষায় আছে যে জগদীশ দারোগার ঘরে কবে চুরি হয়। প্যাঁকা চোর হতে পারে তবে তার কথার নড়চড় হয় না। সে যখন বলেছে দারোগার বাড়িতে চুরি করবে তখন করবেই।
  কৃষ্ণাতিথির রাত, মরা চাঁদের আলোয় সবকিছু অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। একদল কুকুর রাস্তার মাঝখানে কুণ্ডলিপাকিয়ে শুয়ে আছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মরা চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট গাছের ছায়াকে নড়তে দেখে মুখ তুলে চিৎকার করছে, পরক্ষণেই আবার মুখ নামিয়ে নিদ্রার উদ্যোগ করছে। কুকুরগুলোর আওয়াজ রাত্রির নিস্তবদ্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে। এমত সময় কয়েকটা মাংসের টুকরো আর রুটি কুকুরগুলোর মুখের সামনে এসে পড়ল। আকস্মিক খাবার পাবার আনন্দে কুকুরগুলো চিৎকার ভুলে খাবারে মনোনিবেশ করল। আর সেই সুযোগে একটা অস্পষ্ট কালো ছায়া রাস্তা পার হয়ে পাশের বাড়ির পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ল।
আজ রাত্রে আলুর পরটার সাথে খাঁসির কষা কষা মাংস হয়েছিল।  ডিউটি হতে ফেরার পথে জগদীশ দারোগা 'স্নেহলতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' হতে কালাকাঁদ আর গোলাপজাম এনেছিলেন, আলুপরটার সঙ্গে বেশ জমে গেল ! কিন্তু হতচ্ছাড়া পেটটা 'রণং দেহি' বলে উঠল ।  প্রথমে ভারি ভারি ভাব ও কুনকুনে ব্যাথা, পরে সেটা ভয়াবহ হয়ে উঠল। গিন্নীর পরামর্শে জোয়ান খেলেন। এবার শুরু হল অন্যরকম উপসর্গ, - জাপানের বোমারু বিমান হতে বোমা বর্ষণের মতো ঘন ঘন সশব্দে অধোবায়ু নির্গত হতে থাকল।
  এমতো অবস্থায় দারোগাবাবুকে আর বেডরুমে থাকতে দেওয়া যায় না। তাই গিন্নী প্রথমে অনুরোধ ও পরে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বেডরুম হতে বের করে দিলেন। দারোগাবাবু মনের দুঃখ আর পেটের অস্বস্তিত নিয়েই ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। মৃদুমন্দ হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছিল। ঠিক তখনই ঘটল বিপত্তি। ঝুলবারান্দার রেলিং ভেঙ্গে সোজা নিচে পড়লেন দারোগাবাবু। আর পড়বি পড় সেই ছায়ামূর্তির উপর গিয়ে পড়লেন। ছায়ামূর্তি আর জগদীশ দারোগার যুগপৎ চিৎকারে সবাই জেগে উঠল। 

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৬ // সুব্রত মজুমদার

বটেশ্বর বলল, " যা বলেন কত্তা, আমিও ছাড়বো না বলে রাখলাম কিন্তু।"   বটেশ্বরের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল মনে হয় যেন গড়িয়ে পড়ল। অনেকেই লক্ষ্য করল, আবার অনেকেই অবিশ্বাস করে বলল, " বটেশ্বরের মতো ঘুঘু লোক বিনা স্বার্থে কাঁদবে ! যে ভুতের শরীর হতেও তেল নিংড়ে নেয় তার চোখের জলে বিশ্বাস হয় না। "
  করালির মা সত্তর-আশি বছরের বৃদ্ধা, সে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে খুনখুনে গলায় বলল, " রসিকঠাকুরপো বরাবরই ধাতপাতলা, তুলারাশি তো...। তা ও বাবা বটা, রসিকঠাকুরপো বাঁচবে তো রে ? "
বটেশ্বর তার মাথার ঝাঁকড়া চুল নাড়িয়ে বলল," অলীকপুরের সবকিছুর কাটান আমার কাছে আছে কাকি। তুমি দেখতেই থাকো না কি করি আমি।"
জ্ঞান হবারমাত্র রসিকদাদুর দৃষ্টি গেল  বটেশ্বরের মুড়ো ঝাঁটার দিকে, রসিকদাদু আবার চোখ বুজলেন। এইভাবে যতবার রসিকদাদু চোখমেলেন ততবারই আবার চোখ বুঝতে হয়। এইভাবে বটেশ্বর বিরক্ত হয়ে উঠল। সে আর রসিকদাদুর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করল না। মন্ত্র বলতে বলতে ঝাঁটা চালাতে লাগল।
             অলীকপুরের শালিখ জোড়া ঘুরে বেড়ায় সারা পাড়া,
              মাছি মশা পচা ব্যাঙ রসিকদাদুর বেতো ঠ্যাং
      সেই ঠ্যাঙে বসল মশা, মশার এবার শেষের দশা।
        বটেশ্বরের খিলের ঝাঁটা দে দমাদম এক্কাশিটা,
        তাতেও যদি না দেয় রা শুকনা মরিচ লে আ।
মন্ত্রযুক্ত ঝাঁটার প্রভাবে রসিকদাদু উঠে দাঁড়ালেন। পিঠে বুকে সর্বাঙ্গে তার ঝাঁটার কাঠি ফুটে চিনচিনে জ্বালা। রসিকদাদু বিচক্ষণ মানুষ, তিনি জানেন এসময় বটেশ্বরের বিরোধিতা করলে বটেশ্বর স্বমহিমা বজায় রাখতে আবার আসুরিক চিকিৎসা শুরু করবে, তাই তিনি এমন ভাব করলেন যেন এইমাত্র একডজন প্রেতাত্মা তার শরীর থেকে বেরিয়ে গেল।
রসিকদাদু  বললেন, "আমি কোথায় ?"
বটেশ্বর ধুনুচিতে শুকনো লঙ্কা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু রসিকদাদুর আচমকা সুস্থ্য হয়ে যাওয়াতে সে লঙ্কাগুলো নামিয়ে রাখল। তারপর একগাল হেঁসে সবার উদ্দেশ্যে বলল, " দেখলেন তো সবাই, এই বটেশ্বর ওঝাকে ভয় পায় না এমন ভুত ভূভারতে নেই। চলুন এবার ডাক্তারের চিকিৎসা করি। "
সবাই চলল উৎসাহী হয়ে। আশ্রমের একটা ঘরে একপাশে হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে চেয়ারম্যান হয়ে বসে আছে রজত উকিলের একমাত্র বংশপ্রদীপ শ্রীমান সাহেব। আর সাহেবের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পঞ্চানন ডাক্তারের মেয়ে তিন্নি। সাহেবের দৃষ্টিও অপলক।
   ঘরের আরেকদিকে স্টেথস্কোপ গলায় প্লাস্টার-অফ-প্যারিসের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পঞ্চানন ডাক্তার। বটেশ্বর প্রথমে তিন্নি আর সাহেবের কাছে এসে একবার সাহেবের দিকে তো একবার তিন্নির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তারপর চোখ কচলে মেঝেতে বসে পড়ল। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, " উচাটন। এর কাটানও আমার কাছে আছে, তবে পরে। আগে ডাক্তারবাবুকে চেকআপ করি।"
বটেশ্বর এতদিনে কোন ডাক্তার পেশেণ্ট পেয়েছে, তাই সে ডাক্তারি কায়দায় চেকআপের জন্যে পঞ্চানন ডাক্তারের স্টেথস্কোপটি গলা থেকে খুলতে গেল। আর তাতেই ঘটল বিপত্তি। সাপবাবাজী পঞ্চানন ডাক্তারের আশ্রয় ত্যাগ করে বটেশ্বরের আলখাল্লার ভেতরে ঢুকে গেল। একটানা দাঁড়িয়ে থাকা, আতঙ্ক আর অনিদ্রায় পঞ্চানন ডাক্তার মাটিতে পড়েই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সবাই তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল শুশ্রূষার জন্যে।
       বটেশ্বর হাতের ভঙ্গি করে করে নানান নৃত্যের নমুনা দেখাতে লাগলো। উপস্থিত দর্শকদের হাততালিও পড়ল। বটেশ্বরের নৃত্যপটুতা আমজনতার ভালো লাগলেও হাতিডোবা গ্রামের মাতব্বরদের ভালো লাগলো না। তারা এসবকিছুতেই অলীকপুরের অসাধু পরিকল্পনার ইঙ্গিত পেলেন।
সুভাষখুঁড়ো বললেন, "আর নয়, জল নাকের উপরে চলে গেছে। এবার কিছু একটা করতে হবে।"
রসিকদাদু একটু সুস্থ্য হয়েছেন। তিনি এখনও সাপের ব্যাপারটা মামুলি বলে মেনে নিতে পারছেন না। তার দৃঢ় বিশ্বাস অলীকপুরের কুচুটেগুলো তার বুড়ো হাড়ে সর্পবাণ মেরেছে। নেহাত দুধ-ঘি খাওয়া ব্যায়ামলব্ধ শরীর তাই কাবু করে উঠতে পারেনি। একজন কমবয়সি ছোকরা শুধু বলেছিল, "দাদু, তোমার বাড়িতে দুধ-ঘি কবে হতে হয় ? ঠাকমা তো তোমার জন্য দুবেলা গাঁদাল পাতার ঝোল রাঁধে।"
রসিকদাদু লাফিয়ে উঠে গালাগালি দিয়ে দিয়ে বললেন, "তোর এত পাকামো কেন রে ! আমি কি খাই কি না খাই তার হিসেব তোকে দেব। পাজী গর্দভ....."
সুভাষখুঁড়ো বললেন, "রসিকখুঁড়ো, আমাদের উচিত হবে অলীকপুর আক্রমণ করা। "
সুভাষখুঁড়োর কথায় কর্ণেল সরকার সন্মতি প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, "আক্রমণ হবে গেরিলা কায়দায়। আমি সামনে থাকব। ভারত-চিন যুদ্ধে যেমনভাবে লড়াই করেছিলাম তেমনি লড়ব। জীবন যায় যাক, সন্মান ...কভি নেহি।"
কর্ণেল সরকারের রণং দেহি মনোভাবে হাতিডোবার সকলে অনেকটাই অক্সিজেন পেল। তারা মহাভারতীয় কায়দায় কর্ণেল সরকারকে সেনাপতি হিসেবে মনোনীত করলেন। মহান্তজী হলেন উপসেনাধ্যক্ষ -- অবশ্যই পদাধিকার বলে। হাতিডোবা গ্রামে মহান্তজীর একগুঁয়েমি সর্বজনবিদীত। ইতিহাসেও তার মতো চরিত্র আছে, যাদের জেদের কাছে অনেক সম্ভাবনা ও প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেছে। যাইহোক এটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
    মহান্তজী উপসেনাধ্যক্ষ হয়েই কর্ণেল সরকারের ডানা ছাঁটলেন। বললেন, "কর্ণেল বাবা খুব গরম মাথার লোক, ওর সব কথা তোমরা ধরো না বাবারা। আমি বলছিলাম কি..."
মহান্তজীর কথা শেষ হবার আগেই সভাস্থ একজন লাফিয়ে উঠে বলল, " ওসব প্রেম বিলিয়ে হবে না প্রভূ, প্রেম বিলোতে হলে অলীকপুরে মায়া ঠাকুমার কাছে প্রেম বিলোন। আমরা পরমাণু হামলা চাই।"
মহান্তজী রাগে গজগজ করতে লাগলেন। রসিকদাদু বললেন," পরমাণু মানে অ্যাটম বোম ! তা তোমরা পারো বাবা। ইস্কুলের গণ্ডিটা না পেরোনোর এই এক ঝামেলা।"
কর্ণেল সরকার বললেন," ওসব ছাড়ুন তো ! এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমরা আজ রাত্রে অলীকপুরে হানা দেব গেরিলা কায়দায়। রজত রায়, অবিনাশ ঘোষ সহ দু'চারজন অলীকপুরের মাতব্বরকে বেঁধে আনলেই কাজ। এবার আমরা শর্ত দেব আত্মসমর্পণ করতে। তাছাড়া যা দাবিদাওয়া সবকিছু আদায় করে নেব।"
মহান্তজী বললেন," যা ভালো বোঝো করো, কিছু হলে আমাকে বলো না। "
রসিকদাদু বললেন," আপনি ভজন সাধন করুন মহারাজজী। সঠিক সময় হলে আপনার ভবনে রথ পৌঁছে যাবে। আপনাকে ছাড়া অভিযান অসম্পূর্ণ। "
রসিকদাদুর কথায় মহান্তজী রাগে গজগজ করতে করতে সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এই ঘটনায় কারোর কোনো আফসোস হল বলে মনে হল না। সবাই পরবর্তী আলোচনায় মনোনিবেশ করল।
কর্ণেল সরকার বললেন," সাহেবকে চাপ দিয়ে পজিশনগুলো জেনে নিতে হবে। অনেক তথ্য চাই। বাকি তথ্য সরবরাহ করবে শ্রীকান্ত দাস। ও আজবপুরের লোক, আর ভিক্ষা করতে যায় অলীকপুরে।"     সভা তখনকার মতো শেষ হলো। 

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৫ // সুব্রত মজুমদার

ক্যানেলের ব্রিজের কিছুটা আগে রসিকদাদু কিসে যেন একটা হোঁচট খেলেন।   " ওরে মা গো ! বাবা গো ! আমি একেবারে খুন হয়ে গেলাম রে ! " এই বলে রসিকদাদু মাটিতে পড়ে গেলেন।
পঞ্চানন ডাক্তার টর্চের আলো ফেলে দেখলেন রসিকদাদু একটা মাঝারি মাপের ইঁটের টুকরোতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন। তিনি রসিকদাদুর হাত ধরে টেনে তুললেন।  রসিকদাদু উঠেই আবার গুঁড়ি হয়ে পাটকেলটা তুলে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিলেন। বললেন," কি, ঠিক করলাম কিনা বলুন ! কে কখন রাস্তা পার হতে গিয়ে হোঁচট খায়, তাই ফেলে দিলাম।"
পঞ্চানন ডাক্তার মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন। কিন্তু সবার ধাতে সৎকর্ম সয় না। রসিকদাদুরও কপালে পরোপকার সইল না। ঝোপে প্রাতকৃত্য সেরে জগদীশ দারোগা পুকুরে শৌচে গিয়েছিলেন। শৌচ সেরে যেই উঠতে যাবেন অমনি কোথা হতে একটা পাটকেল এসে লাগল কপালে। জগদীশ দারোগা ঝপ করে জলে পড়ে গেলেন। কোনোক্রমে উঠেই যেদিক হতে পাটকেলটা এসেছে সেদিকে দৌড় লাগালেন।
রাস্তার উপরে উঠে জগদীশ দারোগা দেখলেন দু'জন লোক খোশগল্প করতে করতে যাচ্ছে। জগদীশ দারোগা বুঝে গেলেন যে এরাই সেই আততায়ী । রিভলভারটা উঁচিয়ে ধরে দুজনের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
" হ্যাণ্ডস্ আপ ! নড়েছ কি মরেছ। ধাঁই ধাঁই করে গুলি চলবে। বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবারে ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ।"
রাস্তার মাঝখানে পঞ্চানন ডাক্তার আর রসিকদাদু দুই হাত তুলে গৌর নিতাই হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। রসিকদাদুর হাত হতে লাঠি খসে পড়ে রাস্তায়। রসিকদাদু কাতর কণ্ঠে বললেন," হেই ডাকাত বাবা, আমরা ঘুঘু নই। আমাদের মেরো না। "
জগদীশ দারোগা রিভলভার নাচাতে নাচাতে বললেন," কি.. কি বললি ব্যাটা আমি ডাকাত। চল একবার থানায় তোকে বোঝাবো ডাকাত কাকে বলে।"
পঞ্চানন ডাক্তার রসিকদাদুর গা-ঘেঁষে দাঁড়ান। তিনি ভয়ে ভয়ে মিনমিন করে বলেন, " অন্ধকারে কিচ্ছু ঠাওর হচ্ছে না বাবা। আমরা দুজনেই সিনিয়ার সিটিজেন, আমাদের মেরো না।"
জগদীশ দারোগা এবার আরো রেগে গেলেন। তিনি বললেন," সিনিয়ার সিটিজেন হও আর জুনিয়ার সিটিজেন হও কাউকে ছাড়ব না। দু-দুবার আমার মাথায় ঢিল মারা হয়েছে, আমি শোধ তুলবই।"
রসিকদাদু সাহসে ভর করে বললেন," দুবার নয়, একবার আমি ঢিল ছুঁড়েছি।.. তাও ভুল করে। মাফ করে দাও বাবা।"
      দু'পক্ষের বাগবিতন্ডা যখন চলছে তখনই একটা তীব্র আলো এসে জগদীশ দারোগার মুখের উপর এসে পড়ল। তীব্র আলোতে রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তার দেখলেন সামনেই দাঁড়িয়ে রিভলভার হাতে জগদীশ দারোগা। তীব্র আলোর ঝলসানি কাটিয়ে উঠতেই জগদীশ দারোগা দেখলেন তার রথ সামনে দাঁড়িয়ে। জিপ হতে ড্রাইভার নেমে এসে বলল, "গাড়িটা হঠাৎ করে স্টার্ট হয়ে গেল দারোগাবাবু।"
জগদীশ দারোগার রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তারকে জোর করে জিপে তুলে নিলেন। জিপে বসেই তারা দারোগাবাবুকে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বললেন। দারোগাবাবু সমস্ত কথাশুনে একটু নরম হলেন। তিনি বললেন, " তাহলে প্রথম ঢিলটা ওই ছোঁড়াটাই মেরেছে। ওকে আমার কাছে হ্যাণ্ডওভার করবেন। আর আপনাদেরকে অলীকপুরে নামিয়ে দিচ্ছি চলুন।"
               জগদীশ দারোগা রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তারকে অলীকপুরের চণ্ডীমণ্ডপে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় সাহেবের সব বৃত্তান্ত রজত রায়কে জানিয়ে দিয়ে গেলেন। এবং বলে গেলেন," আচ্ছা ছেলে তৈরি করেছেন মশাই। আর একটু হলে আমার ছবিতে মালা ঝুলে যেত। "
রজত রায় কাঁচুমাচু হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু জগদীশ দারোগা তাতে কর্ণপাত না করে গাড়ি স্টার্ট করে দিলেন। রসিকদাদুও তাদের শর্তের কথা জানালেন । এতে রজত রায় কোন মন্তব্য করলেন না। তিনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
     ওদিকে হাতিডোবার লোকেরা অলীকপুরের লোকেদের উপর বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। তারা রসিকদাদুদের বেরোনোর আধঘণ্টা পরেই বাছা বাছা ষণ্ডামার্কা লোক পাঠিয়েছে অলীকপুরে। কোনোরকম বেগতিক দেখলেই রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তারকে ঘাড়ে করে নিয়ে আসবে হাতিডোবায়।
                             পঞ্চানন ডাক্তার স্টেথস্কোপ বাগিয়ে হরি ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গেলেন। হরি ডাক্তারের বুকে স্টেথস্কোপ বসানো মাত্র সাপ বাবাজী পুরাতন আশ্রয় ত্যাগ করে পঞ্চানন ডাক্তারের জামার নিচে আশ্রয় নিল। হরি ডাক্তার কাটা গাছের মতো পড়ে গেলেন ও সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা। আর পঞ্চানন ডাক্তার দুই বাহু তুলে নিতাইগৌর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ সবকিছুর উপরে লক্ষ্য রাখছিল হাতিডোবার কম্যাণ্ডোবাহিনী । তারা পঞ্চানন রসিকদাদু আর ডাক্তারকে তুলে নিয়ে দে ছুট।
                                                - - ৪--
                        সকাল হতেই মহান্তজীর আশ্রমে প্রায় মেলা বসে গেছে। গ্রামের ছেলে বুড়ো বৌ-ঝিরা এসে ভিড় জমিয়েছে আশ্রমের প্রাঙ্গণে। তিন্নির আজ কাজের শেষ নেই, - আগত লোকজনের ভিড় সামাল দেওয়া, বাপের স্ট্যাচুতে ঝাড়পোঁছ করা, অলীকপুরের ছেলেটাকে দেখাশোনা করা, আরো কত কি। আজ তার বসার সময় নেই।
                 অন্যদিন মহান্তজীর আশ্রমে লোক আসে নামগান করতে, আর আজ সবাই এসেছে পঞ্চানন ডাক্তারের স্ট্যাচু দেখতে। গোটা গ্রামে রটে গেছে যে অলীকপুরের লোকেরা ম্যাজিক করে পঞ্চানন ডাক্তারকে স্ট্যাচু করে দিয়েছে। গ্রামের লোকেরা সাহেবের উপর খুব রেগে আছে, একবার সুযোগ পেলেই ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে একদম। আর তার সাথে যোগ দিয়েছেন মহান্তজী। মহান্তজী মাঝে মাঝেই সাহেবের কাছে আসছেন আর মধুর স্বরে জিজ্ঞেস করছেন, " গোবিন্দের কৃপায় সব ঠিকঠাক আছে তো বাবা ? তোমার পিসি যদি আমাকে একটু বুঝত.... গোবিন্দ !.. গোবিন্দ !!..."
               
            রসিকদাদু ব্যাপার-স্যাপার দেখে রাত্রেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সকাল থেকেই রসিকদাদুর মাঝে মাঝে জ্ঞান আসছে, আবার তিনি "ঊরিব্বাস !!! " বলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। তার শিয়রের পাশেই বটেশ্বর ওঝা বসে আছেন ঝাঁটা আর শুকনোলঙ্কা নিয়ে। জ্ঞান হলেই ভুত ঝাড়বেন রসিকদাদুর।

        সুভাষখুঁড়ো রসিকদাদুর কপালে হাত রেখে বিজ্ঞের মতো কিছু পরীক্ষা করলেন। তারপর উদাস গলায় বললেন, "একেবারে মেরে রেখেদিয়েছে গো অলীকপুরের শয়তানগুলো !" 

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৪ // সুব্রত মজুমদার

সুভাষখুঁড়ো সাহেবের দিকে লন্ঠন উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কে হে ছোকরা ! এদিকে কোন মতলবে ?"
সাহেবের মুখ দিয়ে ভয়ে আওয়াজ বেরোল না। সে জানে হাতিডোবার লোকেরা অলীকপুরের চরম শত্রু। এত রাতে অলীকপুরের কোন ছেলেকে আয়ত্তে পেয়ে ছেড়ে দেবে না। আজ সবাই মিলে মনের সুখে তার পিঠে হাতসাফ করবে। ভাবতেই ভয়ে কেঁপে ওঠে সাহেব।
রসিকদাদু বার দুয়েক কেশে নিয়ে বললেন, " এ নিঘ্ঘাত চোর। ও সুভাষ, তুমি বরং জগদীশ দারোগাকে খবর দাও। আর ততক্ষণ এই ব্যাটা চোরকে বেঁধে রাখা হোক চণ্ডিমণ্ডপে।"
সবাই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো। রাজি হলেন না কেবল মহান্তজী। তিনি বললেন, " পেটের দায় বড় দায় বাবা। ওকে পুলিশে দিয়ো না। হরির সংসারে কেউ না খেয়ে থাকবে আর কেউ খেতে পারছে না বলে অপচয় করবে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না বাবা। তুমি ভয় পেয়ে না চোর বাবা, আমি আছি। আমি থাকতে কেউ তোমার উপর অন্যায় করতে পারবে না।"
সাহেব দেখলো যদি পুলিশে দেয় তবে জগদীশ দারোগা ঠিক পেট হতে কথা বের করে ফেলবে। তখন ঢিল মারার জন্য উল্টো করে টাঙ্গিয়ে মারবে। তাই সত্যি সত্যি বলে দেওয়াটাই মঙ্গল। কথায় আছে না, - 'সচ্ বোলনে সে রাহত হ্যায়' ।
সাহেব বলল," আমি সাহেব, অলীকপুরের উকিল রজত রায়ের ছেলে।আমি চোর টোর নি।"
সুভাষখুঁড়ো বললেন, "তাহলে এত রাতে এখানে কি করছ বাছাধন ? হাতিডোবার কি সর্বনাশ করতে এসেছ ?"
মহান্তজী বললেন, "আহাহা ! ছেলেটাকে ধমকাও কেন ! ওকে থামের সাথে বেঁধে রাখো। আমি সর্বজীবে প্রেম বিলাই, কেবল অলীকপুর বাদে। ওই অলীকপুরে বিয়ে করেই আমার কাল হল। "
রসিকদাদু মহান্তজীর দিক তাকিয়ে বললেন," তখন শুনেছিলে আমার কথা ? বার বার বলেছিলাম মেয়ে না জুটলে বিলেত হতে মেম এনে দেব তবুও অলীকপুরের মেয়ে বিয়ে করো না। এখন আর আফসোস করে কি হবে ? "
সুভাষখুঁড়ো এবার বিরক্ত হয়ে বললেন," যা করবার সেটা ঠিক করো। অনেকদিন পর অলীকপুরের কাউকে বাগে পেয়েছি, ছাড়া চলবে না। হাতের সুখ করে নেবো। "
বিপদ বুঝে কাঁদো কাঁদো হয়ে সাহেব বলল," আমি আসতে চাইনি। বাবা জোর করে পাঠিয়েছে। "
রসিকদাদু বললেন," তা তো পাঠাবেই ! না পাঠালে কি হয় ! তোমার বাবার উকিলি বুদ্ধি, কাকে কি করে বাঁশ দিতে হয় তা তোমার বাবা ছাড়া ভালো কে জানেন বলো ! "
সুভাষখুঁড়ো একগাছা দড়ি এনে সাহেবকে চণ্ডিমণ্ডপের থামের সাথে বেঁধে ফেললেন। সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখে শোনা চাকলাদার আর হরি ডাক্তারের সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। সবকিছু শুনে রসিকদাদু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন," কেস তো সিরিয়াস ! কিন্তু পঞ্চানন ডাক্তার তো যাবে না।সেবার পদা নাপিতের উরুস্তম্ভ হল, হরি ডাক্তারকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম, অলীকপুরের লোক আসতে দেয়নি।"
মহান্তজী বললেন, " নৈব নৈব চ। অলীকপুরের কাউকে সাহায্য করা যাবে না। আর তোমরা সে চেষ্টা করলে আমি অনশনে বসব।"
মহান্তজীর দিকে  সকলে সভয়ে তাকাল। কারণ এর আগেও অনেক আলতু ফালতু কারনে মহান্তজী অনশনে বসেছেন, আর প্রতিবারই কোনো না কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। এই তো আগের বছর রাসপূর্ণিমার সময় মহাপ্রসাদে লুচি না ভাত কি হবে তা নিয়ে বিবাদ বাধল। মহান্তজী ভাতের পক্ষে আর রসিকদাদু লুচির পক্ষে। শেষে জনসমর্থন না পেয়ে মহান্তজী অনশনে বসলেন। অবশেষে গ্রামের সবাই মহান্তজীর কথা মেনে নিতে বাধ্য হল। রান্নার ঠাকুর ইতিমধ্যেই ময়দা মেখে ফেলেছে। ফলে কেজি চল্লিশেক ময়দার লেই গরু-ছাগলের পেটে গেল।
রসিকদাদু বললেন, " তোমরা শান্ত হও। মাথা খারাপ করো না। শত্রুতা দু'গাঁয়ের মধ্যে, কিন্তু তাবলে বিবেক মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়। অলীকপুরের লোককে আমরা দেখিয়ে দেবো যে মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে আমরা ওদের থেকে অনেক উঁচুতে।"
আজ আর মহান্তজীর অনশনের ধমকি কোনো কাজে দিল না। উপস্থিত সবাই রসিকদাদুর কথা মেনে নিলো। একজন গেল পঞ্চানন ডাক্তারকে ডাকতে।
সুভাষখুঁড়ো বললেন," আমার একটা প্রস্তাব আছে। "
সবাই সমস্বরে বলল," বলুন.. "
সুভাষখুঁড়ো বললেন," দেখো, বিপদের দিনে আমরা পাশে দাঁড়াবো ঠিক আছে কিন্তু শত্রুকে বিশ্বাস নয়। ছেলেটাকে আমাদের হেফাজতে রাখা হোক। ডাক্তারবাবু যাবেন অলীকপুর আর তার জমানত থাকবে ছেলেটা। এবার বলো তোমরা রাজি কি না। "
 সকলে জানাল তারা রাজি। বিশেষত হরিদাস মহান্ত খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন," আমার আশ্রমেই থাক ছেলেটা। আমি কথা দিচ্ছি কোনো অযত্ন হবে না। "
মহান্তজীর এই প্রস্তাবের পিছনে একটা গূঢ় কারণ ছিল। অনেকদিন হয়ে গেল মহান্তজীর পূর্বাশ্রমের পত্নী মায়ার কোনো খবর তিনি পান নি। হাজার বৈরাগ্য হোক পুরানো প্রেমের আগুন ( দাম্পত্যে কি প্রেম কি অপ্রেম বলা শক্ত ) এখনো নিভে যায় নি। সাহেবকে আশ্রমে রেখে মায়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নেবেন।
এসব কথাবার্তা যখন চলছে ঠিক সেসময় পঞ্চানন ডাক্তার এসে হাজির। তাকে সমস্ত বৃত্তান্ত বলা হলে তিনি বললেন, " ডাক্তারি যখন জানি তখন যাওয়াটা কর্তব্য। তাছাড়া অলীকপুরের লোকদেরও জানানো উচিত যে হাতিডোবাকে ছাড়া অলীকপুর অচল।"
পঞ্চানন ডাক্তাররের কথায় সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। পঞ্চানন ডাক্তারর ব্যাগপত্র নিয়ে অলীকপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সাথে গেলেন রসিকদাদু।
রাস্তায় যেতে যেতে দুজনে অলীকপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা বিষয়ে অনেক আলোচনা হল। দুজনে ধীর পায়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা জগদীশ দারোগার জিপ দেখতে পেলেন। রসিকদাদু ঘুমন্ত ড্রাইভারকে লাঠি দিয়ে এক খোঁচা মেরে বললেন, "ডিউটিতে মে ফাঁকি দেতা হে !"
ড্রাইভার খোঁচা খেয়ে মিটমিট করে তাকিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তার আবার হাঁটতে লাগলেন। রাতের পথ, আর দুজনেই বয়স্ক তাই একটু ধীরে পথ চলছেন দুজনে। একটা কালপেঁচা কর্কশকণ্ঠে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে গেল। রাস্তার দু'পাশ থেকে অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেঁসে আসছে। কতগুলো মেঠো ইঁদুর চিঁচিঁ শব্দ করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  প্রচণ্ড হাওয়ায় বগা শিরশির করছে। রসিকদাদু চাদরটা গায়ে ভালোকরে জড়িয়ে নিলেন। পঞ্চানন ডাক্তার বললেন, " বুঝলেন রসিকবাবু, ডাক্তারি করা যার তার কর্ম নয়, রীতিমতো এলেম লাগে। ওই হরি ডাক্তার আমার নামে আকথা কুকথা বলে বেড়ায়, আর কপাল দেখুন আজ সেই হরে গাঁটকাটাই আমার খপ্পরে !" এই বলে পঞ্চানন ডাক্তার একচোট হেঁসে নিলেন ।

অলীকপুরের লোককথা - ভাগ ৩ // সুব্রত মজুমদার

এবার মুখ খুললেন অবিনাশ ঘোষ , " আলঝাইমার হয়েছে মশাই, এ রোগ আমার মাসতুতো দাদার শালার... "
রজত রায় মাঝ পথে বাধ দিয়ে বললেন ," ছাড়ুন আপনার মাসতুতো দাদার শালা, ডাক্তার কি মুখ দেখতে এনেছি ! ডাক্তারবাবু, দেখুন একটু ভালোকরে  ব্যাটা হনুমান গেল কি রইল। "
   হরি ডাক্তার রোগীর কাছে গিয়ে ভালোকরে পর্যবেক্ষণ করলেন। রোগী প্রথমে নার্ভস দেখাতে চাইল না, কিন্তু হরি ডাক্তার জেদী মানুষ তিনি জোর করে চাকলাদারের কব্জিটা টেনে নিয়ে নার্ভস পরীক্ষা করলেন।
এরপর হরি ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন," না, নার্ভস খুব চঞ্চল। বড় কোন রোগ না হয়ে যায় না।"
অবিনাশ ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন , "ডাক্তারবাবু, কি রোগ কিছু বুঝতে পারলেন  !"
হরি ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন, "সে জেনে তুমি কি করবে বাপু।"
নাছোরবান্দা অবিনাশ ঘোষ বললেন , "তাও বলুন শুনি।"
হরি ডাক্তার স্টেথস্কোপটি কান থেকে নামিয়ে বললেন," সিটিস্কপ। "
রজত রায় বললেন ," আরেকবার ভালোকরে দেখুন ডাক্তারবাবু। "
হরি ডাক্তার স্টেথস্কোপটি আবার কানে পরে নিয়ে চাকলাদারের কাছে গেলেন। ভালোকরে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন চাকলাদারকে। চোখের পাতা আঙুল দিয়ে প্রসারিত করে পরীক্ষা করলেন। রোগীকে জিভ দেখাতে বললেও রোগী তা শুনল না।
     হরি ডাক্তার যেই না স্টেথস্কোপটি চাকলাদারের বুকের উপর রেখেছেন অমনি একটা হাতখানেক লম্বা সাপ চাকলাদারের জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে ভায়া স্টেথস্কোপ হরি ডাক্তারের পাঞ্জাবির ভেতরে ঢুকে গেল। চাকলাদার এক ছুটে আটচালা থেকে নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর হরি ডাক্তার চাকলাদারের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শি শি করতে লাগলেন।
      উপস্থিত সবাই দেখেশুনে হকচকিয়ে গেল। হরি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ ঘোষ বললেন , " ডাক্তারবাবু ! বলি ও ডাক্তারবাবু ! আছেন না টেঁশে গেলেন ?"
হরি ডাক্তার চিঁ চিঁ করে কি বললেন বোঝা গেল না। অবিনাশ ঘোষ হরি ডাক্তারের কাছে গেলেও খুব কাছে গেল না। তার ভয় হল যে চাকলাদারের থেকে হরি ডাক্তারের রোগসংক্রমণ হয়েছে, যদি তারও কিছু হয়ে যায় !
রজত রায় বললেন ," একবার হাতিডোবার পঞ্চানন বটব্যালকে ডাকলে হয়। শুনেছি সে একদম ধন্বন্তরি।"
অবিনাশ ঘোষ বললেন , "কিন্তু উকিলবাবু, পঞ্চানন ডাক্তার কি আসবে ? আপনি তো জানেনই হাতিডোবার লোকেরা আমাদের অলীকপুরের লোকেদের খুব একটা সহ্য করতে পারে না। তারপরেও আপনি আশা রাখেন ?"
       রজত রায় বললেন ," তোমরা ডাক্তারবাবুর দিকে নজর রাখ, আমি আসছি। "   এই বলে কালবিলম্ব না করে রজত রায় বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
                                   - - ৩--
                                 উকিল রজত রায়ের বাড়ি।   রজত রায়ের ছেলে সাহেব, সামনেই কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা তার। বই নিয়ে বসে আছে, কিন্তু পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র মন নেই। সামনেই অলীকপুরের যাত্রানুষ্ঠান। বাপের কাছে আবদার করেছিল একটা পার্টের। টাকা নয়, পয়সা নয়, সামান্য একটা পার্ট - - তাও দিল না। মুখ ব্যাজার করে পড়তে লাগল বাংলা সাহিত্যে লোকশিল্পের অবদান ।
                 ঠিক এসময় হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকলেন উকিলবাবু।  বাড়িতে ঢুকেই হাঁক পড়লেন, " সাহেব ..সাহেব ! , কই রে.. গেলি কোথায় ?
ঘরের ভেতর থেকে সাহেবের উত্তর এল," পড়ছি। কেন কি হল ? ভটচাজ্ কাকাকে ডাকতে যেতে হবে তো !... ও আমি পারব না। "
রজত রায় ঘরের ভেতরে ঢুকেই ছেলের কানে একটা রামমোচড় দিয়ে বললেন," লেখা পড়া শিখিয়ে তোমাকে এই মানুষ করছি ! বাপের মুখের উপর না বলা !"    এরপর কানটা ছেড়ে দিয়ে গলা একটু নরম করে বললেন, " একটু হাতিডোবায় যেতে হবে, পঞ্চানন ডাক্তারের কাছে। টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ো।"
      অন্যদিন হলে সাহেব বাবার মুখের উপর না বলে দিত, কিন্তু আজ সে নাসূচক কোনো কথাই মুখে আনল না। কারনটা হল তিন্নি। পঞ্চানন ডাক্তাররের মেয়ে তিন্নি। সাহেবের ভারি পছন্দ তিন্নিকে। তিন্নি অবশ্য এখনো হ্যাঁ বলেনি তবুও সাহেবের মনে আশা আছে যে তিন্নি একদিন ওকে হ্যাঁ বলবেই ।
      পিতার আদেশ শিরোধার্য করে উকিল বাপের শ্রবণকুমার সন্তান বেরিয়ে পড়লেন হাতিডোবার উদ্দেশ্যে । হাতিডোবা হতে অলীকপুর বেশিদূর নয়। খুব বেশি হলে আড়াই কিলোমিটার। তবুও এই অল্প রাস্তাটুকুও সাহেবের কাছে অনন্ত পথ বলে বোধ হল। তার মনে শুধু একটাই বাসনা, একটাই কামনা - - তিন্নিকে একঝলক দেখতে পাওয়া। হাতিডোবা আর অলীকপুরের মধ্যে যা শত্রুতা তাতে তাদের ভালবাসাকে ভালচোখে দেখবে এমন মানুষ দুই গ্রামে নেই।
              সাহেব ছুটে চলেছে, - হাতে তার তিন সেলের টর্চ। কিছুদূর যাবার পর ব্রিজের কাছে সাহেব থেমে গেল। ব্রিজটি একটা ক্যানেলের উপরে নির্মিত হয়েছে। ব্রিজ পেরিয়েই সাহেবের মনে হল  কেউ যেন পাশের ঝোপ হতে তাকে লক্ষ্য করছে। সাহেব  রাস্তা হতে একটা আধলা ইঁট তুলে নিয়ে ঝোপের দিকে ছুড়ে মারল। সহসা একটা আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভরে উঠল । পাশের গাছটিতে  ঘুমন্ত বকগুলো জেগে উঠে কলরব জুড়ে দিল। কেউ কেউ তো আবার বাঁসা ছেড়ে বেরিয়ে এসে কি ঘটল তার পরীক্ষায় মনোনিবেশ করল।
                     ঝোপ হতে বেরিয়ে এলেন জগদীশ দারোগা। দারোগাবাবু একটা চোরের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। পথিমধ্যে গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে তিনি হেঁটেই অলীকপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। ব্রিজের কাছে আসতেই পেটটা গুড়গুড় করে ওঠে। তাই রাস্তার পাশের ঝোপেই বসে যান। পেট সাফ হবার আগেই সাহেব দারোগাবাবুর উপর হাত সাফ করে বসে।
দারোগাবাবু  শরীরের অর্ধেকটা ঝোপের ভেতর রেখেই উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠেন, " কে রে ! মাই কা লাল হলে এগিয়ে আয়। জগদীশ দারোগার সঙ্গে পাঙ্গা ভারি পড়বে রে হারামি !"  আরো যা যা বলল তা শোনার মতো নয়। বিপদ বুঝে সাহেব টর্চ নিভিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। পেছনে তখনও জগদীশ দারোগার চিল চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
কিছুটা এগিয়ে যেতেই দারোগাবাবুর গাড়িটা নজরে পড়ল সাহেবের। সাহেব দেখল ড্রাইভার সিটে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। ড্রাইভারকে এড়িয়ে যাবার জন্য সাহেব মাঠে নেমে গেল। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার রাস্তায় উঠে এল সাহেব। হাতিডোবা গ্রামের শুরুতেই চণ্ডীমণ্ডপ। সাহেব চণ্ডীমণ্ডপের কাছাকাছি যেতেই একটা কাশির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াল। চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসে থাকা কুকুরগুলোও একসাথে চেঁচাতে লাগল। সাহেব ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে হুশহাশ শব্দ করে কুকুরগুলোকে  তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল ।
" কে যায় ? দেখতো সুভাষ, চোর ছ্যাঁচড় কিনা।"   রসিকদাদু কাশতে কাশতে উঠে বসেন।
সুভাষখুঁড়ো অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসেন। তারপর মাথার কাছে থাকা তেলচকচকে লাঠিটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। রসিকদাদুও সুভাষখুঁড়োর সঙ্গ নিলেন। এরই মধ্যে অন্যরাও জেগে উঠেছে। সবাইকে একসাথে আসতে দেখে সাহেবের আত্মারাম খাঁচাছাড়া।

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...