Thursday, April 25, 2019

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - শেষ ভাগ // সুব্রত মজুমদার

                       ৭
                                      আজকে কেলোর মাকে দেখে ঘুঘু ঘাবড়ে যায়। সেদিন বিশুকাকার ভূত তাড়াতে এসে যে নাকানি চোবানি খেয়েছে তারপর আর গ্রামের কোনো ব্যাপারে ঘুঘু থাকে না।
-"আপনারা কি মনে করে ? আমি সেইদিন হতে আপনাদের কোনো ব্যাপারে থাকি না। আপনারা আসুন।" ঘুঘু পত্রপাঠ বিদায় করে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু নিস্তারিণীর কান্না আর কেলোর মায়ের অনুনয় বিনয়ে ঘুঘু রাজি হয়।
ঘুঘু খড়ি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটে। তারপর মন্ত্র পড়তে শুরু করে।
               চ্যাং চ্যাচাং চিকা চাঁই                  জলের পোকার খবর নাই
              জলের পোকা জলকে যা             আমার শেলেট শুকিয়ে যা।
             শেলেটে পড়ল ঢিল                         ভূতে মারল কিল;
            ভূতের বাবার ছেঁড়া জামা                  সেলাই করে মিলন মামা।
           মিলন মামার টিনের চাল                  তাতে বসে কাকের পাল।
           একটা কাকের দুটো ঠ্যাং                  দুপুরে খায় মরা ব্যাঙ
           মরা ব্যাঙে মারল লাথি                     হারিয়ে গেল লেড়কা কোথি ?
          ঘন বনে ভূতের বাস                           পড়ে আছে বাঘের লাশ।
         জটাধারী যমের নাম                         পুরবে সেথায় মনষ্কাম। "
ঘন বনের মাঝে মিলবে। জটাধারী কোনো লোকের সাথে আছে। তার নাম যমের নামে। আর এর বেশি কিছু বলতে পারব না। তাড়াতাড়ি যাও তবেই ছেলেকে পাবে। একান্ন টাকা। সিধে আর কাপড়ও লাগবে।
                        ঘুঘুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেলোর মা আর নিস্তারিণী বাড়ি ফিরে এলেন। সব কথা শুনে নিখিল মাষ্টার মাথা চুলকোতে চুলকোতে কিছুক্ষন ভাবল তারপর বলল, "নেহাত মিথ্যা নয় ! যমের নাম কৃতান্ত ।আর আমাদের সদানন্দই তো কৃতান্ত নাম নিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছে। না একবার চেষ্টাটা করা যাক।"
-"হ্যাঁ মাষ্টার আমারও তাই মনে হচ্ছে। তুমি আর দেরি কোরো না। আমিও তোমার সঙ্গে যাব। পাড়ার আপদে বিপদে দাঁড়াব না তো আর মানুষ হয়ে জন্ম হল কেন ! "
সবাই মিলে কৃতান্তের ডেরার উদ্দেশ্যে রওনা হল। রাস্তায় শান্তিময়ীও সঙ্গ নিল। নদী পার হয়ে সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করলে শান্তিময়ী মুখ খুলল।
-আপনারা আমার পেছনে আসুন। ঐ খালভরার কাছে এর আগেও আমি গিয়েছি। রাস্তা আমি চিনি।"
জঙ্গলে প্রবেশ করে সোজা উত্তরদিকে কিছুটা হাঁটার পর কৃতান্তের কুটির দেখা গেল। সবাই মিলে একসাথে ডেরায় ঢুকতেই কৃতান্ত পালাবার উদ্যোগ করল।
-" খালভরা ! ড্যাকরা ! সাধুগিরি হচ্ছে ।চল ঘরে চল। "  শান্তিময়ী কৃতান্তের চুলের মুঠিতে ধরল।
এদিকে শ্যামলকে পেয়ে মা-বাবার আনন্দের শেষ নেই। "চল বাবা ঘরে চল। এবার তোকে কেউ কিছু বলুক, তার ঠ্যাং আমি ভেঙে দেব।"
শান্তিময়ীকে দর্শনমাত্র বাঘবাবাজী ভয়ে লাগায় দৌড়। ঝোঁপের ভেতরে বসে লিলু আর মিলু নতুন পঁয়তারা কষছিল। হঠাৎ কিছু একটা দৌড়ে আসতে দেখে দুজনেই লাগায় দৌড়। তারপর বাঘ সহ লিলু মিলু গিয়ে পড়ে সেই কাদার পুকুরে, যেখানে ডুবে তারা মরেছিল। কাদার ভেতরে আটকে থাকা নিজ নিজ শরীরে ঢুকে পড়ে তারা। তারপর অনেক কষ্টে কাদা হতে বেরিয়ে আসে।
             বাড়ি ফেরার পথে কেলোর মা চিৎকার করে ওঠ, "ও মাষ্টার, দ্যাখো দ্যাখো অনামুখোদের কাণ্ড দ্যাখো।"  নিখিল মাষ্টার দেখে কিছু দূরে নদীর বালিতে একটা পুলিশ জিপের সামনেটা ঢুকে আছে আর বাকি অংশ আকাশের পানে উঠে আছে। মনে হচ্ছে যেন জিপটা শীর্ষাসন করছে। পাশেই একটা মানুষ দিয়ে গড়া স্তুপ, - তার নিচে ভজা গজা আর মধ্যস্থলে বিশুকাকা স্বয়ং। একদম উপরে বড়বাবু পড়ে পড়ে গোঙাচ্ছেন ।

       পরিশিষ্ট
আজবপুরে এখনো অনেক কিছুই আজব ঘটে। কিন্তু শ্যামল আর পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় না। সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। গ্রামের মানুষের সেবা করতে হবে যে।
বিশুকাকা এখনো তার স্বভাব ছাড়তে পারেনি। সে কৃতান্তের ঘরে আজ উঁকি মারছিল। দেখে কৃতান্ত লাল কাপড় পরে জটাজুট এলিয়ে বৌয়ের কাপড় কাচছে । মুখে একরাশ বিরক্তি। এমনসময় শান্তিময়ী এসে আরো একগাদা কাপড় নামিয়ে দিয়ে গেল। কৃতান্ত "হে ভগবান !!" বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার কাপড় কাচায় মন দিল।
ইদানিং গ্রামে দুটো চোরের উৎপাত হয়েছে। একবার ধরাও পড়েছিল, কিন্তু সবাইকে চকমা দিয়ে পালায়। বড়বাবু রক্ষাকর পুরকায়স্থও এই গ্রামে ডিউটি বাড়িয়ে দিয়েছেন। চোর তিনি ধরবেনই।
কৃতান্তের পরিত্যক্ত ডেরাতে বাস করতে গিয়েছিল ঘুঘু গুনীন। কিন্তু পারেনি। একটা কেঁদো বাঘের উপদ্রব ঘটেছে আজকাল।
আজই নিখিল মাষ্টারের চিঠি পেলাম। আজবপুরে যেতে লিখেছেন। আমি ভাবছি আগামী কালই রওনা দেব। আপনারা কেউ যাবেন কি ? 

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৮ // সুব্রত মজুমদার

আগেরবার যখন পচা লোহারের বৌকে ভূতে পেয়েছিল তখন ডাক পড়েছিল ঘুঘু গুনীনের। ঘুঘু যেই না থলের ভেতর থেকে জিনিসপত্র বের করেছে অমনি কোথা হতে হাজির হল বিশুকাকা।
-"রোগীকে মেরে ফেলার আগে একবারও ভাববে না ঘুঘু।" বিশুকাকা গম্ভীরমুখে বলেন।
- কি যে বল দাদা, মরা বাঁচা সবই উপরওয়ালার হাতে। আমি দাদা নিমিত্ত মাত্র।
- কিন্তু পচার বৌয়ের কি হয়েছে তুমি জান ?
- হেঁ .. হেঁ.. হেঁ... তা আমি জানব না। পচার বৌকে ভূতে পেয়েছে। ঐ যে কাঁদরের ধারে হিজল গাছ সেই গাছেই ছিল ব্যাটা। তা তুই সন্ধ্যাবেলা খোলাচুলে ওদিকে গেলি কেন ?
- আমড়ার আঁটি জান তুমি। হিস্টিরিয়া বোঝ ! হিস্টিরিয়া হয়েছে ওর।
উপস্থিত জনতা আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না। তারা হৈ চৈ করে নরক গুলজার করে তুলেছে।
-"কৈ গো গুনীন এবার তোমার কেরামতি দেখাও। না পারবে তো বলো পাশের গাঁয়ের ভল্টু মাহাতকে ডেকে আনি।" একজন পাব্লিক ফুট কাটে। পাশ হতে আরেকজন বলে ওঠে, "ওসব বাওয়ালি চলবে না। এখন হিং চিং বিং কিছু ঝাড়তো।
- " আরে বাপু, আমি তো রেডি হয়েই আছি। কিন্তু বিশুদাদা যে সব কথাবার্তা বলছে..." ঘুঘু তার কথার জাল পাতে।
-"না না, বিশু চক্কত্তি মহা ঘোড়েল মালিক। ওকে পাত্তা দিয়ো নাতো। " জনতা বিক্ষুব্ধ হয়। জনতার দাবিকে নস্যাৎ করার মতো যুক্তি বিশুকাকার কাছে ছিল। কিন্তু সেসব যুক্তি এখানে বেকার। সমাজ যেখানে কুসংস্কারের বেড়াজালে আচ্ছন্ন সেখানে একা কুম্ভ হয়ে কি আর করবেন বিশুকাকা।
সেদিন বিশুকাকা ফিরে গিয়েছিলেন বটে কিন্তু ঘুঘুকে দুচক্ষে দেখতে পারতেন না। পাড়ায় বদনাম থাকলেও যেকোন কাজে বিশুকাকাকেই প্রয়োজন পড়ত। আর ঠিক এই কারণেই গ্রামের মধ্যে বিশুকাকার একটা প্রভাব ছিল। তাই ঘুঘু বিশুকাকার সাথে বিশেষ পেরে উঠত না।
আজ হঠাৎ সেই বিশুকাকা অসুস্থ্য। তাও আবার ডাক পড়েছে ঘুঘু গুনীনের। ঘুঘু খুশি হয়েও হতে পারে না। বিশু চক্কত্তিকে বিশ্বাস নেই, - জলে আগুন লাগাতে পারে ঐ বামুনের পো। কিন্তু কি আর করা যাবে ডেকেছে যখন তখন তো যেতেই হবে। ঘুঘু ধীর পায়ে বাড়ি থেকে বের হল।
                      ৭
                     বিশুকাকা অকৃতদার মানুষ। বাড়ির উঠোনে একটা বাবুই দড়ির খাটে শুয়ে আছেন তিনি, - চোখ বোজা। মুখে দিন সাতেকের বাসি দাড়ি। উঠোনে পাড়ার লোকজনের ভিড়। ঘুঘু সবকিছু দেখে শুনে মনে মনে হাঁসে, "সেই তো এলে বাছাধন আমার কব্জায়। এবার দেখো এই ঘুঘু তোমাকে কি ফাঁদ দেখায় !!!"
-"দেখো সবাই, বিশুদাদা কিন্তু আমাকে তেমন পছন্দ করে না। মন্ত্র তন্ত্র ঝেড়ে আমি সুস্থ্য করে দেব ঠিকই কিন্তু সুস্থ্য হয়ে আমাকেই দাঁত দেখাবে।" ঘুঘু তার কথার জাল ছড়ায়।
-"না বাবা, তুই তোর কাজ কর। অনামুখোটা সুস্থ্য হয়ে দাঁত দেখালে ওর দাঁত আমি নোড়া দিয়ে ভেঙে দেব না ! " কেলোর মা ঘুঘুকে আশ্বস্ত করে।
-" তাহলে শুরু করি। এই ভটা ঠাকুরকে খাট হতে নিচে নামা। " ঘুঘু থলে থেকে একটা মাথার খুলি, একটা ময়ূরের পাখার ঝাঁটা ও আরো কিছু সামগ্রী বের করে। এদিকে ভটা ও কেলোর বাবা মিলে বিশুকাকাকে খাট হতে নামিয়ে মাটির ওপরে শুইয়ে দেয়।
-" একটা পুরানো খিলের ঝাঁটা আর কিছু শুকনো লঙ্কা লাগবে। " ঘুঘু ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
-" হ্যাঁ বাবা, আমি আনছি। তুই ভালো করে মন্ত্র পড় । বিশুর তিনকুলে কেউ নেই। ও বদমাইশ হতে পারে, দু'লাগানে হতে পারে, হাড়হাভাতে হতে পারে তবুও তো পাড়ার ছেলে।" কেলোর মায়ের চোখে জল চলে আসে।
-" কেউ কাপড়ে গিঁট দেবেন না। চুল খোলা থাকলে বেঁধে নিন।" ঘুঘু তার বাঁধা গতে ভাষন ঝাড়তে থাকে।
-" এই নে বাবা তোর ঝাঁটা আর লঙ্কা। " কেলোর মা এসে পড়ে।
-" হিং সিং গাধার শিং
কালো ঘোড়ার হলুদ ডিম
ঘটির ভেতর টিকটিকি
আমার মন্ত্রে নেই ফাঁকি।
কার দোহাই কাণাবাঘের লেজের দোহাই।
কার দোহাই বাবা ফক্করেশ্বর মহারাজের দোহাই।"
মন্ত্রের প্রভাবেও বিশুকাকার কোনো বিকার দেখা গেল না। তখন সমবেত সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। ঘুঘু প্রমাদ গুনল। সে তখন সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, "এ তো ভালো মনে হচ্ছে না। খুব জটিল ব্যাপার। বিশুদাদাকে যে ধরেছে সে কোন সাধারণ প্রেত নয়। এবার রামবাণ দিতে হবে।" এই বলে ঘুঘু জ্বলন্ত ধূপসীতে শুকনো লঙ্কা দিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করল। ধোঁয়ায় অনেকেই কাশতে শুরু করলেও লোভ বড় বিচিত্র জিনিস। তাই একটু দূরে সরে গিয়ে কষ্ট উপেক্ষা করেও ঘুঘুর কেরামতি দেখতে লাগল।
                          এতক্ষণ বিশুকাকা মটকা মেরে শুয়ে ছিল। যেই না ঘুঘু ঝাঁটা তুলেছে অমনি সটান উঠে পড়ল বিশুকাকা। তারপর ঝাঁটাটা কেড়ে নিয়ে দমদম লাগাতে লাগল বাড়ি। ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে ঘুঘুর অবস্থা কাহিল। সে হাত জোড় করে মাফ চাইতে থাকে।
- তুমি যেই হও বাবা বা মা আমাকে মাফ করে দাও। বড় অপরাধ হয়ে গেছে। আর মেরো না গো......
- আর ভাঁওতাবাজী করবি.... বল ?
- না কত্তা। আর এ তল্লাটেই আসব না
এবার বিশুকাকা ঝাঁটা ফেলে হো হো করে হাঁসতে লাগলেন। সবাই এতক্ষণে বুঝতে পারল ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছিল। কিন্তু সব গল্পেরই একটা টুইস্ট থাকে। এখানেও আছে।
                           লিলু আর মিলুর প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠেছে ( যদিও প্রাণ বস্তুটি হারিয়েই আজ তাদের এই রূপ )। লিলু বলল, "চল ভাই একবার গ্রাম হতে ঘুরে আসি। এখানে আর ভালো লাগছে না। সবকিছু যেন পানসে পানসে লাগছে।"
-"ঠিক কথাই বলেছিস লিলু। আমিও সেই কথাটাই ভাবছিলাম। চল..." দুজনে উড়তে উড়তে আজবপুরের দিকে রওনা দিল।
আজবপুরে পৌঁছেই দেখে বিশুকাকার ঘরে জটলা। "না এই বিশুটা আর শোধরালো না। চল একটু মজা করে আসি। " লিলুর ঠোঁটের কোণে হাঁসির রেখা দেখা যায়। এরপর তারা দুজনে নিঃশব্দে নামে। লিলু  বিশুকাকার শরীরে প্রবেশ করে। বিশুকাকা নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছিল। হঠাৎ  ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো বিশুকাকার শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। বিশুকাকা তখন একটা অট্টহাস্য হেঁসে এগিয়ে যায় ঘুঘুর দিকে। তারপর ঘুঘুর হাত থেকে ঝাঁটাটা কেড়ে নিয়ে লাগাতার বাড়ি দিতে থাকে।
-" বিশুদাদা গো ছেড়ে দাও মাইরি। আর তোমার কোনো ব্যাপারে থাকব না। মা গো... বাবা গো... ও রি. রি.. ই... ঈ....." ঘুঘু তার ঝোলা-ঝম্পা না নিয়েই সবেগে মারে দৌড়।
এদিকে মিলু কেলোর মায়ের শরীরে ঢুকেই তাণ্ডব শুরু করে দেয়। যাকে সামনে পায় তাকেই মারতে শুরু করে। উপস্থিত জনতা যে যেদিকে পারে দৌড় লাগায়। মূহুর্ত মধ্যে উঠোন ফাঁকা হয়ে যায়। 

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৭ // সুব্রত মজুমদার

হঠাৎ করে পাশে বসে থাকা ভজা গজার চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। এবার তারা চেঁচাতে লাগে," গাড়ি থামান স্যার ! গাড়ি থামান ! "
-" তোদের আবার কি হল ?একে বিশুতে রক্ষা নেই... " বড়বাবু আরো স্পিড বাড়ান।
- এই বুড়ো ভামটা কাপড়ে... খেঁ.. খেঁ... খেঁ...
- "হাঁসি নয়.. হাঁসি নয়, যা বলবি স্পষ্ট করে বলা।
এবার বিশুকাকাই বোমা ফাটায়," ওরা বলবে কি আমি বলছি। আপনার এই ঝড়ের বেগে গাড়ি চলছে, আমার ব্লাডার কি মশাই একইরকম থাকবে ? বার্স্ট হয়নি এই অনেক। "
বড়বাবু হা হা করে হেঁসে ওঠেন। আর তক্ষনি ঘটল কাণ্ড। জিপটা অন্যমনস্কতার কারনে বেরাস্তা হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষন আগেই। এবার গাড়ি গিয়ে পড়ল মাঠের মাঝখানে। মাঠের একপ্রান্তে ছিল আগলদারদের কুড়ে। গাড়ি সোজা কুঁড়েঘরে ঢুকে কুঁড়েঘর শুদ্ধ চলতে শুরু করল।
সামান্য একটু ফোঁকর দিয়ে রাস্তা চিনে বড়বাবু যখন অকুস্থলে পৌঁছলেন তখন সেখানে ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে। অগত্যাই গুলি চালাতে হলো। গুলির শব্দে যেমন খুশি তেমন মারো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা তখনকার মতো খেলায় ইতি টানল।
                         বড়বাবুকে গুলি ছুড়তে দেখে সবাই ভয় পেলেও ভয় পায় নি কেবল একজন। সে আর কেউ নয় স্বয়ং শ্রীমান বীরবাহাদুর। সে বড়বাবুকে দেখেই এগিয়ে এসে পায়ের ধুলো নিল। আর বড়বাবুও বীরবাহাদুরকে চিনতে পারলেন। এই প্রথম বানর খোঁজার জন্যে অনুশোচনার পরিবর্তে আনন্দ হল। বীরবাহাদুরকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। বীরবাহাদুরও বড়বাবুর মাথা হতে পটাপট দুটো উকুন বের করে মুখে পুরে দিল।
-"ছাড়বেন না হতচ্ছাড়াকে, জেলে পুরে দিন।" কেলোর মা চেঁচিয়ে ওঠে। তার দাবিতে সন্মতি দেয় উপস্থিত প্রায় সকলেই। একমাত্র নিখিল মাষ্টার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
-"এ সম্ভব নয়। চড় মারুক চাপাটি মারুক... যাই করুক না কেন ও তো আর মানুষ নয়। বানরের কোন শাস্তি হয় না। " বড়বাবু দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেন। আসলে এখন বীরবাহাদুরকে তার বেশ মনে ধরে গেছে। আহা ! বনের পশু, তার এমন সহবত ! ভাবা যায় !
বড়বাবুর কথায় উত্তেজিত জনতা তেড়ে আসে বীরবাহাদুরকে। বীরবাহাদুর বড়বাবুর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। তখন বড়বাবু আবার বন্দুক বার করেন। জনতা তখনকার মতো 'মিশন বীরবাহাদুর' স্থগিত রাখে।
-"বিশুবাবু কই ! কোথায় তিনি ? খুব যে বলছিলেন ছেলে হারিয়েছে,... সিরিয়াস ব্যাপার..." বড়বাবুর ডাকে বিশুকাকা এগিয়ে আসেন।
- এই যে স্যার, আমি এখানে।
-বেশিক্ষণ থাকবেন না। হাজতে পুরবো আপনাকে। বাচ্চাছেলে মিসিং বলে ডেকে এনে হনুমান ধরার কাজে লাগানো !...... আমাকে দেখে কি রিংমাষ্টার বলে মনে হয় ?
তখন এগিয়ে আসেন নিখিল মাষ্টার। শ্যামলের পালিয়ে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা তিনি বড়বাবুকে বুঝিয়ে বলেন।
-"ও এই ব্যাপার ; তা আগে বলবেন তো। মাষ্টারমশাই, আপনাকে কথা দিচ্ছি যে করেই হোক আর যেভাবেই হোক আপনার ছেলেকে আপনার হাতে তুলে দেব তবেই আমার শান্তি।" বড়বাবু নিখিল মাষ্টারের কাঁধে হাত রেখে বলেন।
-"সে সব তো হবেই, তবে তার আগে এই দত্তরপো টাকে অ্যারেস্ট করুন। মেয়েছেলের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ে স্যার। " কেলোর মা আর্জি জানায়।
সঙ্গে সঙ্গে বিনয় দত্তও প্রতিবাদ করেন," মোটেই না ;নিখিল মাষ্টারের বৌ আমাকে ঝাঁটার বাড়ি মারতে যায় নিজেকে বাঁচাতে আমি কেলোর মায়ের গায়ে পড়ে গিয়েছি। এটা দূর্ঘটনা। অ্যারেস্ট করতে হলে নিখিল মাষ্টারের বৌকে অ্যারেস্ট করুন। "
-" ষড়যন্ত্র করে আমার সংসার ভাঙবে আর আমি ছেড়ে দেব।" নিস্তারিণী আবার লেকচার শুরু করেন।
বড়বাবু বেগতিক দেখে বিশুকাকাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে ভজা ও গজা গাড়ির উপর হতে কুঁড়েঘরটিকে সরিয়ে গাড়িটা সাফসুতরো করে তুলেছে।
-আমি না ফেরা পর্যন্ত কোন অশান্তি যেন না হয়। এসে যদি শুনি কেউ বেগড়বাই করেছে.......... ডাইরেক্ট একাউন্টার। " বড়বাবু বন্দুক বেরকরে হাবুল বোসের কপালের কাছে ধরেন। হাবুল বোস হাতদুটো উপরে উঠিয়ে গৌরনিতাই হয়ে দাঁড়ায়।
গাড়ি ছেড়ে দেয়। বড়বাবুর উপর ভরসা না করে নিস্তারিণী কেলোর মায়ের স্মরণাপন্ন হন।
-" দিদি, একবার ঘুঘু গুনীনের কাছে গেলে হয় না ? " নিস্তারিণী বিগলিত স্বরে প্রশ্ন করে।
-"হয় মানে, আমার মনের কথাটাই বললে বৌ।
-" তাহলে বেলাবেলি চল দিদি। " কেলোর মা কে সঙ্গে নিয়ে নিস্তারিণী ঘুঘু গুনীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
                                     গ্রামের একপ্রান্তে ঘুঘু গুনীনের ঘর। সে নামেও ঘুঘু কাজেও ঘুঘু। জলপড়া তেলপড়া চালপড়া সব পড়াতেই ডিস্টিংশন সহ ফার্স্টক্লাস অর্জন করেছে ঘুঘু গুনীন । সে একমাত্র বিশুকাকার সঙ্গে পেরে ওঠে না। বিশুকাকা সর্বসমক্ষেই বলেন, " ঘুঘুর ফাঁদে পড়ার চেয়ে গলায় কলসি বেঁধে জলে ঝাঁপ দেওয়া ভাল।"
একবার হল কি ঘুঘু তার গোবর নিকানো উঠানে  পৌষের মিঠে রোদের দিকে পিঠ করে বসে আছে। পরনে লাল কাপড়। চোখদুটো নেশায় কড়মচা ফলের মতো লাল হয়ে আছে। নেশাটা বেশ জমলেও হুঁশ কিন্তু দিব্যি আছে। এই নেশার ঝোঁকেও কথাবার্তা একটুকুও টাল খায় না।
-" কাকা ঘরে আছো ! " একটা বাচ্চা মতো ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
- কে....? ও ঘন্টা। বল কি বলবি।
- কাকা তোমাকে একবার যেতে হবে ; বিশুদাদুর শরীর খারাপ।
ঘুঘু মনে মনে হাঁসল । গত দু'তিন দিন হতে কোনো রোজগারপাতি নেই, এ দাঁওটা ছাড়লে চলবে না। সে তার জিনিসপত্র সব একটা লালশালুর ঝোলাতে ভরে ঘন্টার সঙ্গে রওনা হল। আজ মনে তার খুব আনন্দ। বিশু চক্রবর্তীকে একহাত না নেওয়া পর্যন্ত মনের শান্তি হচ্ছে না।

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৬ // সুব্রত মজুমদার

এমন সময় গুড়ুম্ গুড়ুম্ শব্দে নর ও বানর সকলেই ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সকলে রণে ভঙ্গ দেয়। সম্ভাব্য বিপদের আঁচ পেয়ে হনুমানটি পগার পার।
- "হ্যান্ডস্ আপ... আই সে হ্যান্ডস্ আপ !" খাঁকি পোষাক পরা নধর ভুঁড়িওয়ালা এক পুলিশ অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ইনি হলেন রক্ষাকর পুরকায়স্থ । দেশ দশের রক্ষার চেয়ে নিজের বসামাংস সম্বলিত উদরের রক্ষাতেই ইনি সময় ব্যয় করেন বেশি। গোলগাল মুখ, নাকের নিচে হিটলার মার্কা মাছি গোঁফ আর অতিরিক্ত তেলে ভেজানো চুল বেশ পরিপাটি করে সিঁথি করা। সারাক্ষণ পানের কষে মুখ লাল হয়ে থাকে। পানের লাল কষ দুই কষা বেয়ে মাঝে মধ্যেই উঁকি মারে।
দীর্ঘ বারো বছর ধরে একই পদে আটকে থাকায় মন মেজাজ আজকাল আর ভালো থাকে না তার। ভজা ও গজা তার সর্বসময়ের সঙ্গি। দুজনেই কনস্টেবল। রক্ষাকরের মতো ভজা গজারও কোনো উন্নতি বা অবনতি নেই। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোটাকয়েক গ্রাম নিয়ে প্রাণবল্লভপুর থানা। মাঝে মধ্যে দু'একটা ছিঁচকে চুরির কেস এলেও গড়পড়তা প্রায় দিনই ঘুমিয়েই কাটাতে হয়।
রক্ষাকরবাবু থুরি বড়বাবু অনেক খুঁজে পেতে দেখেছেন কিন্তু এ তল্লাটে গত পঞ্চাশ বছরে কোন বড়সড় চুরি ডাকাতি বা ছিনতাই গোছের কিছু ঘটেনি। তবে বহু পূর্বের একটা ছেঁড়া মলিন জাবদা খাতার শেষদিকে দুজন ছিঁচকে চোরের নাম পাওয়া যায়। যদিও তারা অভাবে না পড়লে চুরি করত না বলে উল্লেখ আছে। যতই হোক চোর তো ছিল।
- কি যেন নাম - -লিলু - মিলু। বাহ্ ! খাসা নাম তো। এই ভজা গজা শোন শোন, এ তল্লাটেও চোর ছিল তাহলে।
আনন্দের আতিশয্যে বড়বাবু নাচতে শুরু করে দিলেন। সাথে যোগ দিল ভজা আর গজা। সেদিনই সদর হতে লিলু-মিলুর ছবি বাঁধিয়ে এনে বড়বাবু যেখানে বসেন ঠিক তার পেছনের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হল। প্রতিদিন চলল ধূপধূনো সহযোগে আরতী। কিন্তু এতেও ভবি ভূলল কই ? একটাও কেস এলো না। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ডায়েরি খাতা সম্পূর্ণ আনকোরা হয়ে আছে। উঁহুহু ... ভূল বললাম। বড়বাবু প্রতিদিন সকালে উঠে খাতাটায় ধূপজল দিয়ে মা চৌরেশ্বরীর নাম লেখেন একশ'আট বার।
কেস যে একেবারেই আসেনি সেটা বললে মিথ্যা বলা হবে। ঐ যে গতবার শিবরাত্রির আগের দিন বড়বাবু চেয়ারে বসে বসে সুখনিদ্রা দিচ্ছেন। নাক ডাকার তালে তালে ভুঁড়িটাও দুলে দুলে উঠছে। ঘুমের সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে পৌঁছে গেলেন এক অচেনা দ্বীপে। দ্বীপে নামার সাথে সাথেই মিলিটারি পোষাক পরা লোকজন সাঁজোয়া গাড়িতে করে বিউগল বাজাতে বাজাতে তার সামনে হাজির হল। তাদেরই এক দলনেতা গোছের লোক বড়বাবুর গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, "স্যার ! আজ হতে এই চোরাইপুরের সব দায়িত্ব আপনার।"
সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের উল্লাস আর নাচনকোদন শুরু হল। বড়বাবু ধীর পায়ে এলেন শহরের ভেতরে। কত রকমের চোর। বড় চোর, ছোট চোর, মেজ চোর, সেজ চোর--কতরকমের যে চোর তা না দেখলে বোঝা যাবে না। নিমেষের মধ্যে বেল্টটা হাওয়া হয়ে গেল। তারপর গেল পকেট হতে মানি ব্যাগ। অস্তে আস্তে জামাকাপড় সবই গেল চোরের কব্জায়। শিবরাত্রির সলতের মতো একমাত্র সম্বল আণ্ডারপ্যান্টখানা। একি রে ! কোথা হতে লিকলিকে চেহারার একটা চোর এসে আণ্ডারপ্যান্টের দড়ি ধরে টানাটানি করতে লাগল। টানাটানির চোটে ঘুমটা গেল ভেঙে। চেয়ে দেখলেন একটা নধর সাইজের ছাগল জামার নিচের দিকটা আরাম করে চিবোচ্ছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়সি লোক।
- "খুব ভালো ছাগল ! আপনার বুঝি স্যার !" লোকটা দাঁত বার করে জিগ্গেস করে।
-"হ্যাঁ, আমার ! আমি মরলে এই ছাগলের মাংস দিয়ে ভোজ করব। কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে যাবে !!" বড়বাবু হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন।
-"আপনার নিমন্ত্রণ বলে কথা স্যার, আমি কি আমার ঘাড় আসবে।" লোকটা বড়বাবুর নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত হয়।
-" তবে আর কি, এবার মানে মানে গাত্রোত্থান কর। না কি ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে ! এই ভজা ! এই গজা ! " বড়বাবু ডাকছাড়েন ।
- আজ্ঞে বেরিয়ে এক্ষুনি যেতে পারি স্যার কিন্তু.....
- কি কিন্তু ?
-" আমার বীরবাহাদুরকে খুঁজে দেন স্যার !" লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
-"ভজহরি, হামারা গাড়ি লে আও। " বড়বাবু   তর্জন গর্জন করতে করতে বের হলেন। সাথে ভজা গজা আর সেই বীরবাহাদুরের খোঁজে আসা লোকটি।
এপথ সেপথ ঘুরে নানান ফন্দিফিকির করার পর বীরবাহাদুরের খোঁজ মিলল। অনেক খোঁজ খবরের পর ঠিক সন্ধ্যার মুখে হঠাৎ লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, "রোখকে জরা রোখকে ! "
-" ফাজলামি হচ্ছে। আমার সঙ্গে হিন্দি নিয়ে মসকরা !" বড়বাবু গাড়ি থামিয়েই ধমক দিলেন।
- না স্যার, মসকরা নয়। আমার বীরবাহাদুর.... ঐ.. ঐ যে...
-কোথায় তোমার বীরবাহাদুর ? আমার নজরে তো পড়ছে না।
এমনসময় একটা গোব্দা হনুমান ঝাঁপিয়ে পড়ল জিপের উপর। তারপর লোকটি হনুমানটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল," এই আমার সবেধন নীলমণি একমাত্র আদরের বীরবাহাদুর।"
এরপরে বড়বাবুর মুখের অবস্থা কি হবে সেটা সহজেই অনুমেয় । সেদিন হতে নিখোঁজ সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে তিনি থাকেন না।
                         ৬
                             আজ সকাল বেলাতেই বিশুকাকা থানায় এসে হাজির। এসেই বদমাইসি সুলভ হাঁসি হেঁসে বড়বাবুকে নমস্কার করল বিশুকাকা।
-  একটা জরুরী কেস আছে স্যার। এক্ষুনি বেরোতে হবে।
- "কি কেস ?" চোখ বন্ধ করে গাড়ির চাবি দিয়ে কান পরিস্কার করতে করতে বড়বাবু জিজ্ঞাসা করেন।
- মিসিং কেস স্যার।
- "মিসিং কেস আমি নিইনা। গেট আউট।" বড়বাবুর নির্বিকার উত্তর।
অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বড়বাবুকে রাজি করালেন বিশুকাকা। বড়বাবুও বার বার করে জেনে নিলেন যে নিখিল মাষ্টার আর তার ছেলে শ্যামল আদতেই মানুষ কি না।  ঐসব হনুমান জাম্বুবানের মধ্যে তিনি নেই। ওদের জন্যে চিড়িয়াখানা আছে। বিশুকাকা বড়বাবুর সাথে জিপে চড়ে বসলেন। ব্রিটিশ আমলের পুরানো জিপ ছুটল ঝড়ের বেগে। জিপ যত ছোটে বিশুকাকার পিলে ততই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
- "ও স্যার, একটু আস্তে চালান। বামুনের ছেলে, ব্রহ্মহত্যা হয়ে যাবে একেবারে।" বিশুকাকা চিলচিৎকার জোড়েন।
- "কভি নেহি। আপনাকে আমি চিনি মশাই। এত তাড়াতাড়ি টেঁশে যাবার লোক আপনি নন। একহাজার শেয়াল আই মিন ক্লেভার ফক্স মরে আপনি জন্মেছন।" বড়বাবু উদাত্ত স্বরে জবাব দেন।
-" ব্রহ্মহত্যা হয়ে যাবে স্যার ! " বিশুকাকা প্রায় কেঁদে ওঠেন। 

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৫ // সুব্রত মজুমদার

                              ৫
            সকাল হতেই আজবপুরে হইচই বেঁধে গেল। নিখিল মাষ্টার মাথায় হাত দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে বসে পড়লেন। বিনয় দত্ত, বিশুকাকা, কেলোর মা, পাঁচু সবাই একে একে হাজির হতে লাগল। সর্বপ্রথম নিস্তবদ্ধতা ভাঙল কেলোর মা।
- বলি হ্যা গো মাষ্টার, তা সক্কাল সক্কাল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছো কেন ? মাথার ব্যামো হয়েছে ?
নিখিল মাষ্টার মাথা নেড়ে না বলে। তখনই পাঁচু বলে ওঠে, "দান্ত বেথা হয় !" 
- "ওরে বাবা আমার কিছু ব্যাথা করে না।" নিখিল মাষ্টার কঁকিয়ে ওঠেন।
-"ব্যাটা আধা মাওড়া আধা বাঙাল, ভাষা ঠিক কর আগে। বলে কিনা দান্তে বিথা। হারামজাদা তাতে তোর কি রে !"  কেলোর মা চিৎকারে পাড়া মাথায় করে তোলেন। তারপর গলার স্বরকে আবার কোমল করে জিজ্ঞাসা করেন, "বল না মাষ্টার, কি হয়েছে ? "
- হবে আর কি !  আমার ছেলে - - শ্যামলকে খুঁজে পাচ্ছি না। সেই কাল সন্ধ্যা হতে নিখোঁজ, কত জায়গা খুঁজলাম কোত্থাও নেই।
-" কেন হয়েছিলটা কি ? রাতবিরেতে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেই বা কোথা ?" বিনয় দত্ত জানতে চায়।
- "কি আর হবে, অতবড় ছেলেটাকে চোরের মার মারলে গো ! আমার শ্যামলা যদি না ফেরে তবে তোমারও এ ঘরে অন্নজল উঠল বলে দিলাম।" শ্যামলের মা কাঁদতে কাঁদতে এসে দাঁড়ায়।
-"মেরেছি কি আর সাধে, বাবুর ডানা গজিয়েছে। ঐটুকু ছেলে বলে কিনা বিয়ে করব। আপনারাই বলুন ঐ ছেলেকে মারব না তো পুজো করব। " নিখিল মাষ্টার সাফাই দেয়।
-" তাবলে অতবড় ছেলেকে মারবে। বিয়ে করব বললেই তো আর হয়ে যাচ্ছে না। বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল ।" বিনয় দত্ত তার ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করে।
- না দাদা, শুধু বিয়ে নয় কণেও ঠিক হয়ে আছে।
-" বল কি হে, তা বৌমার নামটা কি ? " বিনয় দত্ত বিষয়টার রসগ্রহণের চেষ্টা করে।
-"আপনার মেয়ে পুঁটি !!! " নিখিল মাষ্টার সক্রোধে বলে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে সকালের শান্ত পরিবেশ আরো শান্ত হয়ে ওঠে। বিশুকাকা এতক্ষণ নানান ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলেন। এবার তিনি আস্তে আস্তে কেটে পড়লেন। সারা ফ্যাসাদের জড় যে তিনি তা প্রকাশ পেলে আজবপুরের ভাত চিরকালের মতো উঠে যাবে তার।
এতক্ষণে বিনয় দত্তের ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি এবার বুদ্ধ অবতার ত্যাগ করে সাক্ষাৎ কল্কি অবতার গ্রহন করেছেন।
- কি বললে মাষ্টার, - - - পুঁটি ?... আমার মেয়ে পুঁটি ? আগুন জ্বলবে... গোটা গ্রামে আগুন জ্বলবে। আমি শেষবারের মতো বলছি মাষ্টার ঐ ছেলে যদি গ্রামে ঢোকে তবে গোটা গ্রামে আগুন জ্বলবে।
- "   ল্যাজে জড়ানোর ন্যাকড়া লাগলে বলবেন কাকা, ঐ মিনসের অনেককটা জামা পড়ে আছে।" শান্তিময়ী ফোড়ন কাটে। সদানন্দের উপর জমে থাকা রাগের বহিঃপ্রকাশ করল শান্তিময়ী। বিনয় দত্ত কটমট করে তাকালেন শান্তিময়ীর দিকে। আগেকার দিন হলে শান্তিময়ী ভস্ম হয়ে যেত।
- "নিজেদের সমস্যা এখানে আন কেন বৌমা ? দেখছ পুঁটিকে নিয়ে শ্যামলা পালিয়েছে। " কেলোর মা অযাচিত উপদেশ প্রদান করে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিনয় দত্ত চিৎকার করে ওঠেন, "চোপ ! একদম চোপ ! কে বলল পুঁটি পালিয়েছে ! পালিয়েছে তো ঐ নিখলে মাষ্টারের সুপুত্তুর। আমার পরিবারের উপরে পড়ে আছে ঐ মাষ্টার আর ওর ব্যাটা। "
- মানে... কি বলতে চান আপনি ?
- ঐ যে নিকুচি ! কার নাম...
- কার নাম......
- "তোমার ! নি তে নিখিল আর কু তে কুমার।" বিনয় দত্ত বিশ্বজয়ী কাষ্ঠহাঁসি হাঁসেন।
-" আর চি টা কি বলুন ? " নিখিল মাষ্টার বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আজ সন্মানের প্রশ্ন।
-" চি নিয়ে আর কি হবে ? যা চিনিয়ে দিয়েছ মাষ্টার।" বিনয় দত্ত একটু দমে যায়। সে গোঁজামিল দেবার চেষ্টা করে।
পাশেই ছিলেন নিস্তারিণী, তিনি এবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। হাতের ঝাঁটাটা দমদম পড়ে নিখিল মাষ্টারের পিঠে।
- তলে তলে এই ! ছেলেটাকে তাড়িয়ে রাজত্ব করবে ! ও মেয়ে এ বাড়িতে ঢুকলে আমিই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধবব।
নিখিল মাষ্টার বিনাদোষে মারধর খেয়ে হতাশ হয়ে বসে পড়ে। বিনয় দত্ত কিছু বলতেই যাচ্ছিল এমনসময় আচমকা ঝাঁটার বাড়ি পড়তে থাকে তার পিঠে।
- বেণের পো, তুই ভেবেছিস কি মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে আমার সংসার ভাঙবি !
ঝাঁটার বাড়ি আটকাতে গিয়ে বিনয় দত্ত হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কেলোর মায়ের উপর। কেলোর মা বিশাল শরীর নিয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল। তারপর কোনোক্রমে উঠে বিনয় দত্তকে মারতে গেলেন চড়, কিন্তু দৈবযোগে সেই চড় গিয়ে পড়ল শান্তিময়ীর গালে। শান্তিময়ী রাগে গরগর করতে লাগল। সে নিস্তারিণীর হাত থেকে ঝাঁটা কেড়ে নিয়ে কেলোর মা কে উদ্দেশ্য করে মারল সজোরে বাড়ি। কিন্তু কেলোর মা হঠাৎ সরে যাওয়ায় ঝাঁটাটা হাবুল বোসের টাঁকে আঘাত করেই ছিটকে পড়ে। সেই ঝাঁটা গিয়ে লাগে পাশেই বসে থাকা একটা হনুমানের গায়ে। হনুমান বাবাজী একপাশে বসে বসে মানুষদের বাঁদরামো পর্যবেক্ষণ করছিল। হঠাৎ করে গায়ের উপর ঝাঁটাটা এসে পড়ায় মাথা গরম হয়ে যায় হনুমানের। সে তখন ভিড়ের মধ্যে ঢুকে তাণ্ডব চালাতে থাকে। যাকে সামনে পায় লাগায় চড়। সবেমিলে অবস্থা যথেষ্ট ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৪ // সুব্রত মজুমদার

কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয় আরকি, - - নদী পেরোবার আগেই মুরগি যায় উড়ে। সেই মুরগি ধরতে বাঘবাবাজী সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তার দৌড়ঝাঁপ আর গরজানিতে মাঠের আগলদারদের নজরে পড়েযান বাবাজীবন। আর আগলদারদের তাড়া খেয়ে বাঘবাবাজী মারেন টেনে দৌড়। তারপর সোজা এই ঝোঁপে । ঘাবড়ে ছিল বলে বাঘ লিলু-মিলুকে  দেখতে পায়নি। চোখবুজে নিজের গাল চাটতে গিয়ে যখন নরম কিছুতে জিভটা ঠেকল তখন আরো নার্ভাস হয়ে গেল বাঘ বাবাজীবন। আর এরপরেই তিনজনের ম্যারাথন রেস। জঙ্গলে গাছের ডালে অনেকগুলো বানর বসেছিলো তারা জাজ হবার চেষ্টা করলেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারলো না। কিন্তু হুপ হাপ শব্দ করে উৎসাহ জোগানোর কোনো ত্রুটি রাখল না।
লিলু, মিলু আর বাঘ তিনজনেই গিয়ে পড়ল কাদাভর্তি ডোবার ভিতরে। আর কাদায় ডুবে তিনজনেরই পরলোকপ্রাপ্তি ঘটে। লিলু আর মিলুর জুটি মৃত্যুর পরেও অক্ষুন্য থাকলেও বাঘবাবাজী কিন্তু এদের সামনাসামনি হয় না।
আর এই লিলু-মিলুর যত রাগ কৃতান্তের উপর। জঙ্গলে আসার সময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের গলার চাঁদি বাঁধানো রুদ্রাক্ষের হার আর ফিতেওয়ালাবেলকাঠের সুদৃশ্য খড়ম চুরি করে এনেছিল। এখন দৈবযোগে সেগুলো সব কৃতান্তের সম্পত্তি।
- "ভাই, এই কৃতান্তের বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না। আমাদের সর্বস্ব নিলি নিলি আবার অপমানও করলি। ব্যাটা ভণ্ড তান্ত্রিক তোর আন্ত্রিক না ধরলে আমার নাম লিলু নয়।
-" আমার নামও মিলু নয়। " দুজনে একচোট হেঁসে নেয়। প্রেত হবার পর এই হয়েছে রোগ। কথায় কথায় হাঁসি পায়, সে সুখই হোক আর দুঃখই হোক।
আর বাঘ, সেও মরার পর বেশ ফুরফুরে জীবন কাটাচ্ছে। এখন সে কৃতান্তের সবসময়ের সঙ্গি। কৃতান্তের স্থির ধারনা যে মন্ত্রের বলে বনের বাঘকে বশ করতে পেরেছে। আর এই ভেলকিতেই আজবপুর সমেত আশেপাশের সমস্ত এলাকার লোকজনের মনে ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছে। সবাই বলে, "জীবনে তান্ত্রিক সাধক তো অনেক দেখলাম কিন্তু কৃতান্ত তান্ত্রিকের মত তান্ত্রিক দুনিয়া ঢুঁড়লে পাওয়া যাবে না। বাঘের পিঠে চেপে চলাফেরা করে ! কজন পারে বলতো এমন কাজ  !!!!!" কৃতান্তের নামে আরো অনেক গুজব প্রচলিত আছে। কেউ বলে কৃতান্তকে সে আকাশে উড়তে দেখেছে, কেউ বা বারো শত ভূতের সাথে কৃতান্ত তান্ত্রিককে ফিস্ট করতে দেখেছে।
এহেন কৃতান্তের কাছে এসে শ্যামল যে নিরাপদ বোধ করেনি সেটাই স্বাভাবিক। এর চেয়ে বাপের পাচনপেটা হওয়াই ভালো ছিল। শ্যামল একরকম নিশ্চিত যে বিয়ে তার আর হবে না।
 "আচ্ছা কৃতান্ত তান্ত্রিককে দিয়ে আরেক গালে চড় মারিয়ে নিলে কেমন হয় ?" মনে মনে ভাবে শ্যামল। "যা আছে কপালে একবার চেষ্টা করে দেখতেই হবে।"
কৃতান্তের ঘরে চাল ডালের অভাব নেই। একবার লোকালয়ে গিয়ে দাঁড়ালেই কাজ। ভক্তিতে গদগদ হয়ে লোকজন চাল ডাল আনাজ রাশিকৃত করে দেবে কৃতান্তের পায়ের কাছে। তবে শর্ত একটাই কৃতান্ত যাবে না আজবপুরে আর লোকজনও যাবে না কৃতান্তের ডেরায়। কৃতান্ত ভয় করে শান্তিময়ীকে তাই আজবপুরের মাটিতে সে পারতপক্ষে পা রাখে না। আর লোকজনও কৃতান্তকে ভয় পায়। তাই জঙ্গলে ঢুকতে সাহস করে না। ব্যতিক্রম কেবল শান্তিময়ী। সে না ভয় করে কৃতান্তকে আর না বিশ্বাস করে কৃতান্তের তন্ত্রবিদ্যাকে।
- অলপ্পেয়ে মিনসে ! তান্ত্রিক হয়েছেন। তুই তান্ত্রিক নয় রে হাভাতে তুই আন্ত্রিক। আয় একবার ঘরে, তোর মুখে নুড়ো না জ্বালি তো আমার নাম শান্তিময়ী নয়।
কৃতান্ত প্রথম প্রথম গালাগালি সহ্য করতে পারত না। সেও পাল্টা গালাগালি করত। কিন্তু সেবার এই পাল্টা গালাগালিতে শান্তিময়ী গেল ভড়কে। সোজা ঝাঁটা নিয়ে কৃতান্তের ডেরায় হাজির। গালাগালির সাথে সাথে সমান তালে চলতে থাকে ঝাঁটার বাড়ি। মিশন শেষ করে শান্তিময়ী বাড়ি ফিরে গেল। আর কৃতান্ত ও কৃতান্তের পোষ্য বাঘ রইল মেঝেতে পড়ে। দুজনেরই সারা শরীরে ঝাঁটার বাড়ির দাগ আর সর্বাঙ্গে ব্যাথা। বাঘবাবাজী মরার আগে কাঁটার খোঁচা, শিকারীর তীর, আগলদারদের ধোলাই এইরকম অনেককিছুই খেয়েছে কিন্তু মরার পর যে এমন মর্মান্তিক পেটানি খেতে হবে তা জানা ছিল না।
টানা সাতদিন পড়ে থাকার পর ক্রমশ শরীরে বল ফিরে আসে। আর সেদিন থেকেই কৃতান্ত শান্তিময়ীর কোনো ব্যাপারেই থাকে না। কথায় বলে না '...... স্হানত্যাগেন দুর্জনঃ' ।
                        ৫
- "মন্ত্রবলে চোখের নিমেষে রান্না করে দিতে পারি কিন্তু তুই তো আর তান্ত্রিক নোস,.. তোর সে খাবার খাওয়া ঠিক হবে না রে ।" কৃতান্ত উনুনে জ্বাল দিতে দিতে মন্তব্য করে। এ কথায় শ্যামল মাথা নেড়ে সায় দেয়।
রান্না শেষ হলে দুজনে খেতে বসে। অ্যালুমিনিয়ামের থালাতে লাল লাল মোটা মোটা ভাত সাথে আলু-বেগুনের তরকারি আর অড়হড়ের ডাল। কৃতান্তের হাতের রান্না খুব একটা খারাপ নয়। শ্যামল বেশ তৃপ্তি করেই ভাতগুলো খেল। কুঁড়েঘরটির দরজার সামনে বাঘটি বসেছিল। প্রেতযোনি পাবার পর বাঘের আর খিদে পায় না। তাই কৃতান্তের বাঘটিকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
খাওয়া দাওয়া শেষে পাশাপাশি দুটি মাদুর পাতা হল। একটাতে কৃতান্ত ও অপরটিতে শ্যামল শুয়ে পড়ল। কাঁথা বালিশের কোনো বন্দোবস্ত নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে কৃতান্ত নাক ডাকতে শুরু করল। শ্যামলের কিন্তু ঘুম এল না। এর কারণ অবশ্য অনেক। প্রথমত আজ যা কিছু হল তাতে কিভাবে বাড়ি ফিরবে সেটা যথেষ্টই চিন্তার বিষয়। দ্বিতীয়ত বালিশ ছাড়া ঘুম আসে না শ্যামলের। আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল কৃতান্তের নাসিকাগর্জন। মুহুর্মুহু নাক ডাকার আওয়াজে শ্যামলের ঘুমের দফা রফা হয়ে গেল।
এমনসময় শ্যামলের কানে এল একটি খরখর আওয়াজ। মনে হল কোনো জন্তু যেন প্রাণপণে ছুট দিল।
-"বাঘ-ভালুক নয়তো !" শ্যামল আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। "হে ভগবান, শেষে বাঘ ভালুকের পেটে যেতে হবে !! এখনো তো আমার বিয়েও হয়নি।"
এদিকে আওয়াজটা আর নেই। শ্যামল আবার ঘুমোবার চেষ্টা করে। যেই চোখটা একটু ভারী হয়ে এসেছে অমনি আবার একটা ফিসফিস আওয়াজ হল। না আজ আর শ্যামলের কপালে ঘুম নেই। এদিকে আওয়াজটা অনেক স্পষ্ট হয়েছে।
-এ আবার কে রে মিলু ?
-" নতুন মাল বলে মনে হচ্ছে ভাই। " দ্বিতীয় কণ্ঠটি ফিসফিসিয়ে বলে। শ্যামল বুঝতে পারে এরা মানুষ। আর তাদের মধ্যে একজনের নাম মিলু। তাহলে কি চোর পড়েছে ?
- "হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। তবে জানিস ভাই এই কৃতান্তকে বিশ্বাস নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কৃতান্ত একে ঘর পাহারার জন্য এনেছে। " দ্বিতীয়কণ্ঠ বলে ওঠে।
-না ভাই লিলু, ব্যাপারটা আমার সুবিধার লাগছে না। তবে যাই হোক আমাদের জিনিস আমরা উদ্ধার করবই।
 ও তাহলে দ্বিতীয়জন লিলু। আর এই লিলু মিলুর জুটি কোন জিনিস চুরি করতে এসেছে। কিন্তু কি এমন জিনিস যেটা এই দুজনে যে কোন মূল্যে চায়। আর কি বলে শুনতে হবে। বিপদ বুঝলে সাধুবাবাকে জাগাতে হবে। এইরকম যখন পরিস্থিতি তখন কৃতান্ত তান্ত্রিক নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
- "কি করবি রে ভেতরে যাবি ?" মিলু লিলুর মুখের দিকে তাকায়।
দুজনে সাহস জুটিয়ে কৃতান্তের ঘরে ঢুকে পড়ে। কৃতান্ত কাত হয়ে শুয়ে থাকায় রুদ্রাক্ষের মালাটির কিছুটা অংশ হাতের তলায় চাপা পড়ে ছিল। কৃতান্তকে পাশফেরাতে লিলু কৃতান্তের নাকে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে। কৃতান্ত "খড়ড়.. খসস্.. হ্যা..." করে থেমে যায়। হাঁচি আর হয় না। এবার মিলু পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে। কৃতান্ত এবার পাশ ফিরে শোয়। আবার তার রুদ্রাক্ষের মালাটি অন্য হাতের তলায় চাপা পড়ে যায়। এবার লিলু মিলু দুজনে মিলে কৃতান্তকে চ্যাংদোলা করে তুলে ধরে।
-" হ্যাইয়া মারো হেঁইয়ো.. মারো জওয়ান হেঁইয়ো....." লিলু মিলুর ঐক্যতাণে শ্যামলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। লিলু মিলুর কথাবার্তা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ খুলেই যা দেখল তাতে করে শ্যামলের চোখ আবার বন্ধ হয়ে গেল । এটুকু সময়ের মধ্যেই সে দেখতে পেল দুটো কঙ্কাল কৃতান্ত তান্ত্রিককে চ্যাংদোলা দোলাচ্ছে ।

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ৩ // সুব্রত মজুমদার

- না আর এই মেয়েছেলের সাথে ঘর করতে পারবো না। চললাম আমি যেদিকে দু'চোখ যায়।
- যা না যে দিকে যাবি যা। হে মা কালী মুখপোড়াকে এবার নাও মা।
বাস, আর দাঁড়াল না সদানন্দ, হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর হতে। খিদের জ্বালা উঠলে শান্তিময়ীকে মনে পড়েনি তা নয় কিন্তু পুরুষাকার বলে কথা। শান্তিময়ী কিন্তু আর সদানন্দকে তেল মারেনি। এদিকে সদানন্দ শ্মশানে তন্ত্র সাধনায় মন দিল। জটাজুট ধারন করে লাল কাপড় আর কপালে লাল টকটকে সিঁদুরের ফোঁটা নিয়ে সদানন্দ হল শ্রী শ্রী ১০৮ স্বামী কৃতান্ত কান্ত অবধূত ওরফে কৃতান্ত তান্ত্রিক।
কৃতান্ত তান্ত্রিকের সব জুটলেও গলাটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। সাধু মানুষ, তাতে আবার অতবড় তান্ত্রিক তার গলায় মালা নেই ! এ হতেই পারে না। অবশ্য কথাটা তাকে বলেছিল বিশুকাকা। সেবার হরনাথ ঘোষালের বাড়িতে নোংরাভর্তি কলসি ভেঙে পালিয়ে আসার পথে তাড়া খায় বিশুকাকা অ্যান্ড কোম্পানি। পরিমরি করে দৌড়াতে থাকে তারা। বর্ষা ছাড়া নদীতে প্রায় সারাবছরই জল কম থাকে। ফলে নদী পার হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে খুব বেগ পেতে হল না।
সেবার টানা সাতদিন কৃতান্তের অতিথি হয়ে ছিলেন বিশুকাকা। কৃতান্ত কিন্তু খুব অতিথিবৎসলতা দেখায়নি। সে বলেছিল, "কাকা, তুমিও মরবে আর আমাকেও মারবে। আর লুকোনোর জায়গা পেলে না ?"
- দেখ সদা, বেশি ফ্যাচ ফ্যাচ করবি না। যাব তোর বৌয়ের কাছে ? কৃতান্তগিরি ঘুচে যাবে।
- "দোহাই কাকা যতদিন খুশি তুমি থাক। আর আমাকে বিপদে ফেলো না।"  কাতর আবেদন জানায় কৃতান্ত।
যাবার সময় অযাচিত ভাবে বিশুকাকার উপদেশামৃত বর্ষিত হয়," শোন সদা, তান্ত্রিক হয়েছিস ভালো কিন্তু সবসময় জাকজমকে থাকবি। গলায় গোটা তিনেক রুদ্রাক্ষের মালা নে। হাড়ের মালা হলেও ভালো হয়। আর খড়ম পরতে শুরু কর। দেখবি খদ্দের লাইন লাগিয়ে দেবে।"
                                ৪
                                                           জঙ্গলে কৃতান্ত ছাড়াও থাকে দুই প্রেত। বহুযুগ আগে এরাও ছিল আজবপুরের বাসিন্দা। দুজনে থাকত গ্রামের দুই প্রান্তে। দুজনের মধ্যে ছিল খুব ভাব। একজন কিছু খাবার পেলে অন্যজনকে না দিয়ে খেত না। সারাদিন দুজনে জোট বেঁধে কারোর নর্দমা পরিস্কার তো কারোর বাগানের আগাছা পরিস্কার করে দুপাঁচ টাকা আয় ইনকাম করত। আর সময় পেলে মানুষের পেছনে লেগে জীবন তীতিবিরক্ত করে তুলত ।
একবার বাঁকুড়া হতে রামায়ণ পাঠ করতে এসেছেন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। সাদা দাড়ি, পরনে সাদা ধুতি ও ফতুয়া। ফতুয়ার নিচ হতে সাদা উপবীত দেখা যাচ্ছে। বহু পথশ্রমে ক্লান্ত ব্রাহ্মণ আজবপুরে এসে পৌঁছলেন তখন সূর্য মধ্যগগণে। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের আটচালাতে স্হান পেলেন তিনি। রান্নার সব সরঞ্জাম এসে পৌঁছল। আর সঙ্গে এলেন দুই মূর্তিমান।
খোশগল্প করতে করতে দুজনে পটিয়ে ফেললেন বৃদ্ধকে। রাতে রামায়ণ পাঠ হবার পর খাওয়া দাওয়া করে তিনি যেই ঘুমোতে যাবেন অমনি দুইজনে হাজির।
- ঘুমিয়ে পড়লেন ঠাকুর ?
- কে বাবা ? ও তোমরা। কিছু বলবে বাপ ?
- "হেঁ হেঁ হেঁ......" দুজনে তাদের পেটেন্ট করা হাঁসির প্রদর্শন করে। "বলছিলাম কি ঠাকুর আনেক ধকল গেছে তো, তা আমরা দুজনে পদসেবা যদি করে দি..... ব্রাহ্মণ সেবার পূণ্য হতে বঞ্চিত করবেন না ঠাকুর।"
- তোরা খুব ভালো ছেলে। এ যুগে তোদের মতো ছেলে পাওয়া ভার বাবা। বড় হও, অনেক উন্নতি কর।
- "আসার পথে বৌ বললে, যাচ্ছ যখন তখন এই অয়ুর্বেদিক তেলটাও নিয়ে যাও। খুব ভাল তেল ঠাকুর। এমন মালিশ করে দেবো না.... খুব আরাম পাবেন। কি বলিস মিলু। " লিলুর কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয় মিলু।
তারপর দুজনে বৃদ্ধের দুটো পা নিয়ে মালিশ শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধ  ঘুমিয়ে পড়েন। তার নাকের ডাক ঝিল্লির আওয়াজের সাথে পাল্লা দিতে থাকে।
সকালে উঠেই বৃদ্ধ হাত মুখ ধোবার জন্য যেই পুকুরের জলে নেমেছেন অমনি নজর গেল পায়ের উপর। একি ! একিকরে হল ! আর ধৈর্য্য রইলো না। তিনি গাল পাড়তে লাগলেন।
- মরবি, কেউ বাঁচবি না। ব্রাহ্মণের সাথে তামাশা !! ওরে পাজী গর্ভশ্রাব অনামুখো মরবি !
বৃদ্ধের গালাগালি শুনে গ্রামের সবাই হাজির। "কি হল ঠাকুর, গালি দিচ্ছ কেন ?" গ্রামের মোড়ল এসে দাঁড়ালেন।
- দেখ বাবা দেখ, কি করেছে দেখ। এরপর বল গাল দেব না আরতী করব।
মোড়ল যা দেখলেন তাতে তার চক্ষুস্থির। বৃদ্ধের দুটি পায়ে তেলকালি আর মোবিলের মিশ্রন বেশ পরিপাটি করে লাগানো হয়েছে। ধুতিটাও বাদ যায়নি।
বৃদ্ধের কথা শুনে যা বোঝা গেল তাতে আর গ্রামবাসীদের কোনো সংশয়ই থাকল না, - নিঃসন্দেহে একাজ লিলু-মিলুর। সঙ্গে সঙ্গে লোক ছুটলো গ্রামের বিভিন্নদিকে। কিন্তু লিলু-মিলু কই ? লিলু-মিলু তখন আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলের গভীরে।
- মিলুরে, আর ঘরে ফিরতে পারবো না ভাই !
- সত্যি বলেছিস লিলু। এই জঙ্গলে বাঘের অভাবও নেই।
- হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. হ্যাঁচচৌ....
- "কি হল রে মিলু ?" লিলু জিজ্ঞেস করে। তার নাকে একটা বদখত গন্ধ আসে।
- কি যেন একটা নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে !
- সাপ নয়তো। এ জঙ্গলে সাপের কমতি নেই। আ.. আ.. আমার গালেও কি যেন ঠান্ডা ঠান্ডা....
"বা.... আ.. আ....." বলে চিৎকার করতে করতে দুজনেই মারে ছুট। বন জঙ্গল পেরিয়ে খানা ডোবা ডিঙিয়ে ছুটতে থাকে তারা। সঙ্গে থাকা জন্তুটিও ছুটতে থাকে প্রাণের ভয়ে।
আসলে হয়েছিল কি একটা বাঘ নদী পার হয়ে ঢুকেছিল আজবপুরে। হারু দাসের গোয়ালে ঢুকে সে বুঝতে পারে যে গরু নেহাৎ নিরীহ প্রাণী হলেও সহজবধ্য নয়। দু'চার গুঁতো খেয়ে শার্দুলবাবাজী সটান গোয়ালের বাইরে। এরপর ছাগলের গোয়ালেও বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে একটা মুরগি মুখে করে দে দৌড়। 

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ২ // সুব্রত মজুমদার

ক্ষয়ক্ষতি যা হবার হল। বিনয় দত্তের ধুতি গেল খুলে। রাগে গরজাতে লাগলেন তিনি। ইতিমধ্যে পাঁচু এসে হাজির। নিখিল মাষ্টারের সাইকেলের পিছনে ছুটতে ছুটতে কুকুরের মতো জিভ বেরিয়ে গেছে। সে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
- হে ভগমান ! এসকিডেন হইগিলো রে।
-"দূর হতভাগা ! এসকিডেন নয় অ্যাকসিডেন্ট ।" নিখিল মাষ্টার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে প্রতিক্রিয়া দেয়। তার আয়রন করা প্যান্টের একদিকটা ছিঁড়ে ঝুলতে থাকে। আর সেই অংশের ফাঁক দিয়ে লাল সবুজের স্ট্রাইপ দেওয়া আন্ডারপ্যান্ট উঁকি মারতে থাকে। সম্বিত ফিরে পেতেই ঐ অংশটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরেন। আর বিনয় দত্তও এতক্ষণে সাইকেলের বাহুপাশ ছাড়িয়ে উঠে পড়েছেন। সদ্য খুলে যাওয়া ধুতির দুই তৃতীয়াংশ গলায় জড়িয়ে নিয়ে কাগজটা মাষ্টারের হাতে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়েন, "বিষ নেই তার কুলোপানা চক্কর ! ভাগলপুর হতে পাশ দেওয়া মাষ্টার এসেছেন কেতা করে সাইকেল চালাতে।"
নিখিল মাষ্টার কাগজটা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এমন হাতের লেখা একটা অক্ষরও পড়া যায় না। অনেক কষ্টে লিপির পাঠোদ্ধার হল।
  আমার ভালবাসার শকু,
                                     পত্রের প্রথমে তোমাকে আমার ভালোবাসা জানাই। তোমার বাপকেও প্রণাম দিতে পারতাম, কিন্তু দেবো না। শালা আটকুড়ো তেঁতুল গাছে ঝুলে মরুক। তুমি জানো না একদিন আমি তোমাকে দেখতে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোমার বাপের ভয়ে লুকিয়ে পড়ি ছোট পাঁচিলটার পাশের ঝোঁপে । আর ঐ সাতখচ্চর বিনয় দত্ত করল কি... না বলা যাবে না। সেদিন মিত্তিরপুকুরে ডুবে ঘরে ফিরেছি। আমিও সুযোগ পাই, ওর মাথায় পেচ্ছাপ করবো বলে দিচ্ছি।
আর কি বলবো। আমার আদর নিয়ো।
                                                       ইতি
                                                   তোমার আদরের
                                                     নি. কু. চি.
চিঠি যত এগোতে থাকে বিনয় দত্তের প্রেসারও তত চড়তে থাকে। চিঠি শেষ হতেই তিনি লাফ দিয়ে ওঠেন।
- নিকুচি ! নিকুচি এবার আমি করবো। অ্যাই পেঁচো....
পাঁচু কাছেই ছিল। সে আদেশ পাওয়া মাত্র নিকুচির খোঁজ শুরু করে দিল। নিকুচিকে না পাওয়া গেলেও তার খোঁজ এখনো চলছে। কোনো পাঠক বা পাঠিকা যদি নিকুচির খবর পান তাহলে অবশ্যই জানাবেন।
এহেন নিখিল মাষ্টারের সুবোধ বালক শ্যামল। পড়াশোনায় তেমন ভালো না হওয়ায় বাপের সুনজরে থাকে না। জামাকাপড় ছেড়ে হাত পা ধুয়ে মাদুর বিছিয়ে বসেছেন নিখিল মাষ্টার। নিস্তারিণী গাইয়ের দুধের ফেনাওঠা চা আর চানাচুর - নারকেল মাখানো মুড়ি নিয়ে হাজির। বাপের পাশে বসে বসে চা- মুড়ি খাচ্ছিল শ্যামল ।হঠাৎ বাপকে শুধায়, "বাবা তোমাকে একটা কথা বলব রাগবে নাতো ?"
- "রাগবো কেন রে, বল কি বলবি।" নিখিল মাষ্টার স্নেহভরে ছেলের দিকে তাকায়।
- সবারই তো বিয়ে হচ্ছে, আমার বিয়ে দেবে না ?
- "কি বললি তুই, আবার বল।" মাষ্টারের চোখ মুখের ভাব পাল্টাতে থাকে।
-বাবা পুঁটি ......
কথা শেষ হবার আগেই নেমে এল বিরাশি শিক্কার চড়। একগালে চড় মারতে নেই। তাহলে নাকি বিয়ে হয় না। তাই শ্যামল আরেকটা চড়ের অপেক্ষা করতে লাগল। হাজার হোক সারা জীবনের ব্যাপার। আরেকটা চড় সে হজম করে নিতে পারে কিন্তু বিয়ে না হওয়া - - কভি নেহি । কিন্তু ভুল ভাঙল তখন যখন দেখল বাপের হাতে উঠে এসেছে গরু ডাকানো পাচন। শ্যামল আর দেরি করে না, এক ছুটে বাড়ির বাইরে। ঘরে তখনো বাবা চিৎকার করতে থাকে।
                                   ৩
                       এমন অগ্নিগর্ভ পরিবেশে বাড়ি ফেরা যে খুবই রিক্সের হয়ে যাবে তা শ্যামল জানত। তাই সে সোজা হাঁটা দিল মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রামটা পেরোলেই নদী আর নদী পেরোলেই ঘন বন। এই বন পেরিয়ে আরো কয়েক মাইল যাবার পর আসবে প্রাণবল্লভপুর। সেইখানেই তার মামার বাড়ি। ওখানে তার মামা সুধন্য চট্টরাজকে এক ডাকেই সবাই চেনে। একবার সুধন্য মামাকে এক পেল্লাই বাঘে ধরেছিল। সারারাত বাঘে মানুষে লড়াই। ভোরের দিকে যখন মামার জিত প্রায় সুনিশ্চিত ঠিক তখনই বড় বাইরে পেয়ে যায় মামার। মামা এক ছুটে নদীর ধারে। সকালে বাড়ি ফিরলে বৃত্তান্ত শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। অবনী ঘোষ তো পরদিনই নিজের কাঁধে চাপিয়ে সুধন্যমামাকে গোটা গ্রাম ঘোরালেন। সঙ্গে ঢাক ঢোল কাঁসি আরো কত কি।
পরদিন এলেন নিখিল মাষ্টার। শ্যালকের পিঠের আঁচরের দাগ দেখে একচোট খুব হাসলেন। শেষে বললেন, "বুঝলে সুধন্য, চিন্তার কোনো কারণ নেই। জংলি কুলের কাঁটাতে আঁচর লেগেছে সেরে যাবে।"
সুধন্য অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। ব্যাপারটা বেশি ঘাটানো ঠিক নয়, - বাঘের নখের আঁচর বলে কেউ মানতে চাইলে মানুক নয় তো বাকিটা তার ব্যাপার।
নদী পার হয়ে শ্যামল যখন জঙ্গলে ঢুকল তখন সূর্য্য পাটে যাচ্ছে। গা-টা ছমছম করতে লাগল শ্যামলের। বাঘ ভাল্লুক তো আছেই আবার রাত হলে তেনারা নামেন। ঐ যে রাতে যাদের নাম করতে নেই। রাম নাম জপ করতে করতে শ্যামল এগোতে থাকে। জঙ্গলের ভেতর কিছুটা এগোবার পরেই একটা টিমটিমে আলো চোখে এসে পড়ল। এ কোথায় এল শ্যামল ?
-"কে রে ? যে বটিস বাপু ঐখানই দাঁড়া, নইলে এমন বাণ মাব........" একটা গর্জন ভেঁসে আসে। এমন গম্ভীর গলা শ্যামল বাপের জন্মেও শোনেনি।
- আমি শ্যামল আজবপুরের নিখিল সান্যালের ছেলে।
- ও... তাই বল। আমি কৃতান্ত তান্ত্রিক। আজবপুরের সবাই আমাকে চেনে।
কৃতান্ত তান্ত্রিকের আসল বাড়ি আজবপুরেই। গৃহস্থাশ্রমে নাম ছিল সদানন্দ । সদানন্দের বৌ শান্তিময়ী। শান্তির তো বালাই নেই ছিন্নমস্তার মতো কারোর না পেলে নিজের রক্তই পান করার ক্ষমতা রাখে। এহেন শান্তির আলয়ে সদানন্দের আনন্দ বলে কিছু রইল না। সারাবেলা হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুপুরে বাড়িতে এসে সবেমাত্র খেতে বসেছেন, দেখলেন গলা গলা ভাতের সাথে একটুকরো আলুসেদ্ধ।
- "শান্তি ! শান্তি ! এই হারামজাদী !" সদানন্দ হাঁক পাড়ে। ঠিক সেই সময় গোয়ালঘর হতে মুড়ো ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে আসে শান্তিময়ী।
- কি হল রে অলপ্পেয়ে হাড়হাভাতে মিনসে ? এই ঝাঁটা দেখেছিস, - দেবো মুখের ভেতরে ভরে। খাবি খা, নাহয় ওঠ । "
শান্তিময়ীর শান্তিবারি বর্ষণে সদানন্দের মনপ্রাণ শীতল হয়ে যায়। সে তখন মিহি গলাতে ডাকে," শান্তি, আমার সুনুমুনু শান্তি !..... "
-" তোর সুনুমুনুর কাঁথায় আগুন খালভরা। খেয়েদেয়ে শিগ্গির ওঠ। " শান্তিময়ীর অগ্নিবর্ষনে সদানন্দ আর টিকতে পারলো না । খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো । 

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত - ভাগ ১ // সুব্রত মজুমদার

আজবপুরের আজববৃত্তান্ত
                                                  ১
        মাঘ মাস শেষ হব হব করছে। আমের গাছগুলোতে মুকুল এসেছে। দক্ষিণে বাতাস এখনো বইতে না লাগলেও মনে লাড্ডু ফুটতে শুরু করেছে শ্যামলের। আর দোষটাই বা কি ! তেরো হতে সবে চৌদ্দ বছরে পড়েছেন মূর্তিমান। পাতলা প্যাটপ্যাটে চেহারা, পরনে হাঁটুর কিঞ্চিৎ উপর পর্যন্ত হাফপ্যান্ট আর একটা বুশশার্ট।  সেদিন স্নান করতে পুকুরে যাচ্ছিল শ্যামল। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে এখন এই ভরদুপুরে কোনো বৌ-ঝিরা স্নান করতে আসে না। তাদের সময় সকাল দশটা হতে বারোটা পর্যন্ত। স্বভাবতই এখন পুকুরের ঘাটজুড়ে চ্যাংড়া ছেলেদের ভিড়।
-"কে রে শ্যামলা নাকি ? চান করবি ?" বিশুকাকা দাঁত বের করে হেঁসে ওঠেন। গোটা গ্রামে বিশুকাকা অর্থাৎ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী আঁতেল বুদ্ধির জন্য বিখ্যাত। কার পুকুরে বোয়াল মাছ ছাড়তে হবে, কার মাচা হতে লাউ কেটে আনতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি বদবুদ্ধিতে খ্যাত আমাদের বিশুকাকা। এহেন বিশুকাকাকে সমীহ করে চলে না এমন লোক গ্রামে কমই আছে।
যাইহোক বিশুকাকার কথায় শ্যামল মাথা নড়ে। এতে বোঝা মুশকিল যে শ্যামলের প্রতিক্রিয়াটি কি। বিশুকাকা পায়ের গোঁড়ালিটা ঝামাপাথর দিয়ে ঘষতে ঘষতে শ্যামলের দিকে তাকায়।
- তা বেশ ডাগরটি হলি । বাপকে এবার মেয়ে দেখতে বল। ঐযে বিনয় দত্তর মেয়ে পুঁটি। খুব মানবে কিন্তু তোর সঙ্গে।
বিনয় দত্ত গ্রামের বিত্তশালী মানুষ। জনশ্রুতি আছে বিনয় দত্ত নাকি তার তিনতলার ছাদে টাকার বস্তা খুলে সারা ছাদময় টাকা মেলে দেন। আর সারাদিন এপিঠ ওপিঠ করে শুকিয়ে আবার বস্তায় ভরে সিন্দুকে চালান করে দেন। মুস্কিল হয় জোরে হাওয়া বাতাস দিলে। তখন টাকা উড়েগিয়ে নিচে পড়তে পারে। অনেক সময় উড়ে যায়ও। এই তো সেদিন মাল পাড়ার পদা যাচ্ছিল বিনয় দত্তের বাড়ির পাশদিয়ে। এমনসময় উঠল বাতাস। কয়েক গোছা নোট উড়ে এসে ঘুরপাক খেতে লাগল পদার নাকের সামনে। পদা যেই ধরতে গেল অমনি টাকা ভ্যানিশ ।
-"বড় তামুক একটু কম খা। গাঁজার ধোঁয়ায় একবার আমিও জলহস্তি দেখেছিলাম আমাদের বাড়ির সামনের ডোবাতে। শালা আমাকে দেখেই ভেংচি কেটে জলে ভূশ করে ডুবে গেল।" বিশুকাকা খিঁক খিঁক করে হেঁসে উঠল। পদা কিন্তু অতসহজে দমবার পাত্র নয়। সে নিরীহ নিরীহ মুখ করে বিশুকাকার দিকে তাকিয়ে বলল, " যাই বলনা কেন ঠাকুর ভূল আমি দেখি নাই। "
এই বিনয় দত্তের মেয়ে পুঁটি। হয়তো ভালো নাম তার একটা কিছু আছে, কিন্তু গ্রামের কারোরই  সেটা কৌতুহলের বিষয় নয়। পুঁটি বাবার ভক্ত। বিনয় দত্তের নামে কেউ কিছু বললে পুঁটি তার চোখ গেলে নিতে পারে। পুঁটিকে শ্যামলের খুব পছন্দ। আর সে বিষয়টা বিশুকাকা ভালোকরেই জানে। তাই এই নিরীহ অথচ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকনাকে শ্যামলের মনরুপী খড়ের গাদায় ঢুকিয়ে দিলেন। এখন অগ্নিকাণ্ডের অপেক্ষা।
শ্যামল আর কোনো কথা বলে না। অন্যদিন সাঁতার কেটে পুকুরের এপার ওপার ঘুরে বেড়ায় শ্যামল। সময়জ্ঞান তার থাকে না। ছেলের দেরি দেখে মা নিস্তারিণী দেবী খুন্তি হাতে পুকুর পাড়ে হাজির হন।
- এই অলপ্পেয়ে ! ওঠ, ওঠ বলছি ! বামুনের ছেলে পড়াশোনায় তো অষ্টরম্ভা, বাবু আমায় উদ্ধার কচ্ছেন। আসুক তোর বাপ। বলব, - তোমার ছেলে তুমি দেখ বাপু আমি যে দিকে দু'চোখ যায় চলে যাব।
চিৎকার শুনে বিশুকাকা আসেন ঘোলাজলে মাছ ধরতে।
-অনেকদিন বলেছি বৌদি তোমার ছেলে আমাদের কথা শুনলে তো। মানুষ হলো না, মাষ্টারমশায়ের ছেলেটা মানুষ হল না।
এতক্ষণে নিস্তারিণী খড়্গধারিনী হয়ে ওঠেন। যত রাগ গিয়ে পড়ে বিশুকাকার উপর। খুন্তিটা হাওয়ায় নাড়িয়ে চিৎকার করেন, "তুমি ধোওয়া তুলসী পাতা ! গোটা গাঁয়ের ছেলেপুলেকে নষ্ট করছো তুমি।"
 গতিক খারাপ বুঝে বিশুকাকা কেটে পড়েন। শ্যামল এই ফাঁকে পুকুর হতে উঠে ঘরের দিকে দে ছুট। নিস্তারিণী তখন ছেলের পিছন পিছন  খুন্তিহাতে রওনা দেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আজ আর মনটা চাইল না।শ্যামল গা-মুছে গামছাটা পরে নিল। তারপর রওনা দিল বাড়ির দিকে। বিশুকাকা মনে মনে হাঁসলেন, - ওষুধ ধরেছে বাপধন !
                                  ২
                            সারাদিন ছাত্রঠেঙিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন নিখিল মাষ্টার। নিখিল সান্যাল মানুষ হিসেবে বড় ভাল। গ্রামের সবাই আপদে বিপদে তার কাছ হতে পরামর্শ নিতে আসে। পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। এই তো আগের বছর বিনয় দত্তের বড় মেয়ে শকুন্তলাকে চিঠি লিখে বসল কোন এক পাজী ছোকরা। শকুন্তলা চিঠিটা পেয়ে উল্টে পাল্টে বাঁয়ে ডানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবরকম করে দেখল। কিন্তু বিধি বাম। শকুন্তলার ক অক্ষর গোমাংস। তাই দরকারী কাগজ ভেবে নিয়ে গেল বাপের কাছে।
- "দরকারী কাগজ বলেই তো মনে হচ্ছে। সিল সই অবশ্য নেই। তুই যা মা ভেতরে যা। আমি নিখিল মাষ্টারকে ডেকে পাঠাই। পাঁচু.. ও পাঁচু. ..."  বিনয় দত্ত জলদগম্ভীর গলায় হাঁক পাড়লেন।  শকুন্তলা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। কিন্তু পাঁচুর কোনো খবর নেই। বিনয় দত্ত রেগে গিয়ে আবার জোরে হাঁকদিলেন," এই হতভাগা পাঁচু, কানের মাথা খেয়ে বসে আছিস ? তোর পিঠের চামড়া যদি গুটিয়ে না নিই তবে আমার নাম বিনয় দত্ত নয়। "
- "এজ্ঞে হুজুর কিছু বুলছিলেন ?" পাঁচু লাঠিয়ালের আবির্ভাব ঘটে। রোগা মার্কা চেহারা, মাথায় লাল কাপড়ের ডাকাতমার্কা পাগড়ি আর কপালে সিঁদুরের বিরাট তিলক। বিনয় দত্তের বাড়িতে ভালোমন্দ খেয়ে খেয়ে দুই ঠোঁটের শালকেতে ঘা। তবে দাপট বেজায়।
- না হরিনাম জপছিলাম। ভালোমন্দ খাচ্ছ আর সদর দরজায় বসে ঝিমোচ্ছ।
- তা আপনার দয়া এজ্ঞে। বুলেন বুলেন, মা জননীকে মাছ কেটে দিতে হবে। আমার টেইম নাই, বুলেন !
- যা, নিখিল মাষ্টারকে ধরে আন কাজ আছে।
"যে আজ্ঞে !" বলে পাঁচু ছুটল নিখিল মাষ্টারের বাড়ি। মাষ্টার তখন খেয়ে দেয়ে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বের হচ্ছেন।
- এজ্ঞে মাষ্টারবাবু, কত্তা আপনেরে ডাকছেন। খুব ইমারসেন্ট্রি দরকার।
- ইমারসেন্ট্রি নয় রে এমারজেন্সি।
- উসব পরে হবে। আপনি চলেন।
নিখিল মাষ্টার সাইকেলে চেপে রওনা দিল। বিনয় দত্তের বাড়ির সামনে এসে ব্রেক কষলেন সজোরে। কিন্তু কোথায় ব্রেক ! সাইকেল গিয়ে পড়ল দরজার সামনে অপেক্ষমান বিনয় দত্তের উপরে। ধাক্কায় বিনয় দত্ত পড়লেন হুমড়ি খেয়ে। তার উপর পড়ল সাইকেল আর সবার উপরে নিখিল মাষ্টার। 

হোটেলে হাহাকার - শেষ ভাগ // সুব্রত মজুমদার

  কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পৌঁছাল। পুলিশের গাড়ি বিক্রম আর অঘোরবাবুকে নিয়ে চলল স্বর্গদ্বারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিপদ পিছু ছাড়ে না। হোটেলে পৌঁছেই দেখা গেল  বিক্রমদের জিনিসপত্র রুম হতে বেরকরে রিসেপসনে রাখা হয়েছে। বিজনবাবু এগিয়ে এলেন বিক্রমের কাছে। তিনি বললেন, " আমার বলতে খুবই খারাপ লাগছে বিক্রমবাবু, আপনাদের আর এই হোটেলে রাখতে পারব না।"
বিক্রম বলল, "এ কি রকম কথা বিজনবাবু ! আমরা এখন কোথায় যাব ? আর আপনি যদি মনে করে থাকেন যে হোটেল হতে বের করে দিলেই তদন্ত থেমে যাবে তবে আপনি ভুল করছেন। এই তো বড়বাবুও এসেছেন।
বড়বাবু এইমাত্র হোটেলে ঢুকলেন। মুখের মধ্যে একটা পান পুরে দিয়ে বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বললেন," এই যে বিক্রমবাবু, শুনলাম কোনার্ক হতে আসার পথে আপনাকে কেউ কিডন্যাপ করেছিল। আপনি সোজা এসপি সাহেবকে ফোন না করে আমাকে ফোন করতে পারতেন।"
বিক্রম বলল, "বিড়ালকে মাছ বাছতে দেওয়াটা বোকামি হয়ে যেত না মিঃ মহাপাত্র !"
বড়বাবু সবিস্ময়ে তাকালেন বিক্রমের দিকে ।  "আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না বিক্রমবাবু। "
বিক্রম বলল," বুঝিয়ে বলছি। আমি যখন এই প্রথমদিন এই হোটেলে আসি বিজনবাবু আমাকে দেখে ঘাবড়ে যান। তিনি ভেবেছিলেন যে আমাকে কেউ এই ভুতুড়ে আওয়াজের ও সহদেব সামন্তের সপরিবারে আত্মহত্যার রহস্যভেদের জন্য নিয়োগ করেছে। তাই তিনি একটা চাল চাললেন। আমাকে তার ফ্রি-ফান্ডের গেষ্ট করে নিলেন। কিন্তু নিয়তি সর্বত্র বলবান, আমাদের জন্য রুম নির্দিষ্ট হল ৩০৮ অর্থাৎ ভুতুড়ে রুমের পাশেই।
এইবার শুরু হল আসল খেলা। আমাদের ভয় দেখানোর জন্য সাউন্ড এফেক্টের কারসাজি শুরু হল। আমি ওই ঘরের কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। ছবিটা কিসের জানেন ? "
অঘোরবাবু বললেন," হ্যাঁ বিক্রমবাবু, আমার মনে পড়েছে। কিন্তু তারপর তো ছবিগুলোর কথা বেমালুম চেপে গেলেন মশাই । "
বিক্রম হেঁসে বলল," সবকিছুর সময় থাকে অঘোরবাবু। ছবিগুলো আমি ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম। যে ওই ঘরে ঢুকে ভৌতিক আওয়াজের ব্যবস্থা করত সে খুবই চালাক, পায়ের ছাপ ঢাকতে একধরনের মিহি ধূলো ব্যবহার করত। আর এজন্যই ঘরের মধ্যে পায়ের ছাপ দেখা যেত না। ছবিগুলো সেইসব অস্পষ্ট পদচিহ্নের।
  এরপরই  রঘুকে লাগান হয় আমাদের গতিবিধি জানবার জন্য। রঘু আমাদের পিছন নেয়। আমি যে রঘুকে লক্ষ্য করেছি এটা বুঝে যান বিজনবাবু, তাই তিনি চাইলেন এক ঢিলে দুই পাখি মারতে। রঘুকে  আমাদের রুমে ডেকে হত্যা করেন। "
সহসা বিজনবাবু চিৎকার করে উঠলেন," প্রমাণ আছে আপনার কাছে ? যে কাউকেই অপরাধী সাব্যস্ত করে ফেললেই হল না প্রমাণ দিতে হবে। "
বিক্রম বলল," কুল ডাউন বিজনবাবু, কুল ডাউন ! সব প্রমাণ আমি দেব। হ্যাঁ, প্রসঙ্গে আসি। বিজনবাবু চেয়েছিলেন মার্ডার কেসে আমাকে জড়িয়ে দিতে, কিন্তু তাতে বাধ সাজেন বড়বাবু। আমি রেহাই পেয়ে যাই।
আমার সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে আরেকজনের উপর। তাই আমি তাকে এড়িয়ে নিজস্ব সোর্সকে কাজে লাগাই। বৃদ্ধের বেশে উদয়গিরি যাই। কিন্তু বিজনবাবুর কাছে আমাকে হার মানতে হয়। যে ছেলেটি আমাকে মারতে গিয়েছিল সে আমাকে তাদের ঠ্যাং সন্মন্ধে অনেক তথ্য দেয়। এসব খবরও বিজনবাবু অ্যান্ড কোম্পানির কাছে যাচ্ছিল। তাই আমাকে রুখতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। কিডন্যাপ করা হয় আমাদের।
কিন্তু মিঃ মহাপাত্র আপনার শেষরক্ষা হল না। "
বড়বাবু ফুঁসে উঠলেন," কি বলতে চান কি আপনি ? শখের গোয়েন্দা হয়েছেন বলে যা নয় তাই বলবেন ! আপনি আমাকে এখনো চেনেনি। আমি কি করতে পারি তা জানলে এখানে মরতে আসতেন না। "
বিক্রম বলল," প্রমাণ ছাড়া কোনো কাজ আমি করি না বড়বাবু। আমাদের যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছিল সেখানে আপনার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তাছাড়া আপনার পোষা গুণ্ডাদুটোর মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাছাড়া ওই ফোনের কললিস্ট এনালিসিস করে দেখা হয়েছে। ওই দুজনকে আপনি এই দু'দিনে অজস্রবার কল করেছেন। "
বড়বাবু পালাবার উদ্যোগ করতেই  দেখলেন সামনে ফোর্স নিয়ে এসপি সাহেব দাঁড়িয়ে। একজন এএসআই এসে বড়বাবুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। বিজনবাবুকেও গ্রেফতার করা হল।
বিক্রম বলল," সময়মতো এসেপড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ এসপি সাহেব। একটু দেরি হয়ে গেলে পাখি উড়ে যেত। "
এসপি সাহেব বললেন, "আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে এতবড় রহস্য সমাধান হত না। আমি অনেকক্ষন আগেই এসেছি। আপনার সব কথাই আড়াল হতে শুনেছি। কিন্তু গুপ্তধন নিয়ে তো কিছু বললেন না। "
বিক্রম হেঁসে বলল," গল্পটা আপনাকে আগেই বলেছি। এখন যেটা বলিনি সেটা হল বড়বাবুর সাথে এই গুপ্তধনের সম্পর্ক কি। বড়বাবুর সাথে কলকাতায় আলাপ হয় মৃন্ময় সরখেলের। ভদ্রলোক পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তার কাছ হতেই বড়বাবু জানতে পারেন রাজা অনন্ত পদ্মণাভনের গুপ্তধনের কথা। মৃন্ময়বাবু ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গিয়েছিলেন। তাই সপরিবারে মৃন্ময়বাবু যখন বেড়াতে আসেন তখন তাদের ড্রাগ প্রয়োগে অজ্ঞান করা হয়। এরপর মৃত বলে ঘোষণা করে মিথ্যে ফরেন্সিক রিপোর্ট কোর্টে পেশ করা হয়। যেখানে মৃতদেহই নেই সেখানে ফরেন্সিক টেস্ট হয় কিভাবে !
সপরিবারে মৃন্ময়বাবুকে আটকে রাখা হয়। পুলিশ বোধ হয় এতক্ষণে তাকে উদ্ধার করেছে। আর মৃন্ময়বাবুর কাছ  হতে তথ্য নিয়েই চলতে থাকে গুপ্তধন আবিস্কারের প্রচেষ্টা। "
বিক্রমের কথা শেষ হতে না হতেই এসপি সাহেবের ফোন আসে। কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে এসপি সাহেব বললেন," মৃন্ময়বাবুকে সপরিবারে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের ভূবনেশ্বর মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতদিন আটক ছিলেন তো, মেডিক্যাল চেকআপ প্রয়োজন। "
                                                --উপসংহার --
  বড়বাবু আর বিজনবাবুর উপর খুন, অপহরণ, ষড়যন্ত্র সহ একাধিক ধারায় মামলা করা হয়েছে। ইদানিং তারা জেলের হাওয়া খাচ্ছেন। বিক্রম আর অঘোরবাবু পুরিতে আরো দিন তিনেক ছিলেন। সমুদ্রস্নান করে আর মাছভাজা খেয়ে অঘোরবাবুর মন খুব চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ফিরবার সময় ট্রেনে বসে তিনি বিক্রমকে বললেন, " যা হবে হোক মশাই একবার ফুগু মাছ খেয়েই দেখব।"  এই প্রথম অঘোরবাবু সঠিক ভাবে ফুগু বললেন। ট্রেন অন্ধকারে কু-উ-উ-ঝিক্-ঝিক্ করতে করতে ছুটে চলল হাওড়ার দিকে।
                                        সমাপ্ত

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ৭ // সুব্রত মজুমদার

বিক্রম উত্তর দিল, "হ্যাঁ অঘোরবাবু, সেই কালাপাহাড়। পুরাণে কোনার্ক সন্মন্ধে একটা গল্প আছে। একবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার রানীদের নিয়ে জলক্রীড়া করেছিলেন। সে সময় আড়াল হতে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্ব তা দর্শন করে। এ কথা জানতে পেরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার পুত্র শাম্বকে কুষ্ঠরোগগ্রস্থ হবার শাপ দেন। শাম্ব অনুনয়বিনয় করলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে দ্বাদশ মাস দ্বাদশ নদীতে ভগবান সূর্যের তপস্যা করতে বলেন। শাম্ব সেইমতো ভগবান সূর্য্যের তপস্যা করেন এবং সূর্য্যের বরে কুষ্ঠরোগমুক্ত হন । এই দ্বাদশ নদীর মধ্যে অন্যতম হল কোনার্কের পাশে বয়ে যাওয়া চন্দ্রভাগা নদী। আর কোনার্ক মন্দিরের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা অবশ্যই শাম্ব। প্রথম নরসিংহদেব সম্ভবত জীর্ণোদ্ধার করেন। "
অঘোরবাবু মন দিয়ে শুনছিলেন কাহিনী। তিনি বললেন," আচ্ছা মশাই, এটা যখন মন্দির তখন মূর্তিও নিশ্চয়ই থাকবে। "
" হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। এই মন্দিরে আগে ভগবান সূর্য্যের একটা মূর্তি ছিল, যেটা পরবর্তীকালে পুরির রাজারা নবগ্রহ মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। "
অপরাহ্নের আলোয় কোনার্ক যারা দেখেননি তারা বুঝবেন না সে দৃশ্য কত  সুন্দর কত মনোহর। আস্তে আস্তে রাত্রি নেমে আসছে। বিক্রম অঘোরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। কিছুটা যাওয়ার পর ড্রাইভার বলল," স্যার, এখানে একটা ভালো দোকান আছে, চাইলে টিফিন করে নিতে পারেন। "
বিক্রম কিছু বলার আগেই অঘোরবাবু পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠলেন, "সেই কোন দুপুরে খেয়েছি মশাই, পেটে আমার বিশটা ছুঁচোয় ছু-কিতকিত খেলছে।"
অগত্যা গাড়ি দাঁড় করাতে হলো। দোকানটা ছোট কিন্তু খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দোকানদার জানাল যে বললেই খুব নরম নরম আর গরম গরম ডালপুরি ভেজে দিতে পারে। অর্ডার হল। গরম ডালপুরির সাথে ঝাল ঝাল আলুর দম বেশ ভালোই জমল।
খাওয়া দাওয়া সেরে গাড়িতে উঠে বসল বিক্রম। অঘোরবাবু বললেন, "বেশ জম্পেশ করে খেলাম বলুন। কি বলব মশাই এমন নরম পুরি আর সুস্বাদু আলুর দম অনেকদিন পরে খেলাম।"
এরপর গাড়ি চলতে শুরু করলো। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুম পাচ্ছিল দুজনেরই । চোখ জড়িয়ে আসছে বিক্রমের , মনে হচ্ছে যেন কালো একটা ব্ল্যাকহোলে ডুবে যাচ্ছে।
                             - - পাঁচ--
   বিক্রম যখন চোখ মেলল তখন অনুভব করল যে মাথাটা ভারি হয়ে আছে। হাত পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। একি ! সচকিতে সে নিজের হাতের দিকে লক্ষ্য করল, হাত পা বাঁধা। পাশেই অঘোরবাবু একইভাবে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছেন। জায়গাটা একটা মাটির ঘর বলেই মনে হচ্ছে। মেঝেতে একটা জলের কুঁজো আর তার উপর একটা স্টেনলেস স্টাইলের গ্লাস। ঘরে আর কোনো আসবাবপত্র নেই।
বিক্রম ভাবছিল যে তারা এখান থেকে কি করে বেরোবে, ঠিক এমনসময় দুজন লোক ঘরে ঢুকল। একজন মোটাসোটা আর অন্যজন রোগা গড়নের। দুজনের হাতেই পিস্তল । বিক্রম বলল, " এই যে ভাই, একটু বাথরুমে যাব, হাতের দড়িটা খুলে দেবে !"
মোটাটা একজন বলল, " না, তুমি খুব চালাক। যেকোনো সময় পালিয়ে যেতে পারো।"
বিক্রম বলল, " তুমি ভুল ভাবছ, পালাবার মতো শক্তি আমার শরীরে নেই। তাছাড়া আমার সঙ্গি ভদ্রলোককে ছেড়ে কোথায় যাব !
দুজনে খানিকটা আলোচনা করে নিল, তারপর রোগা লোকটা বলল, "ঠিক আছে, তবে বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবে না। চালাকি করলে এই যন্তরটা দেখছ তো, এর ছ'ছটা দানাই ভেজাতে গুঁজে দেব।"
বিক্রম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, "যা বলবে তাই করব, শুধু একটু...." বিক্রম কড়ি আঙুল দেখাল। এরপর রোগা লোকটা এসে বিক্রমের হাতের দড়ি খুলে দিল। এরপর বিক্রমের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে চলল।
ঘরটা একটা জঙ্গলের মাঝখানে। আশেপাশে ঘরবাড়ি তো দুরস্ত জনমানবের চিহ্নও নেই। মাটি পাথুরে, মনে হচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে কোন টিলার উপরে বাড়িটা বানানো হয়েছে। চারিদিকে অজস্র গাছের সমাবেশ। গাছগুলোর তলায় ঝোঁপঝাড় আর সেই ঝোঁপঝাড় হতে কঠবেড়ালী আর খরগোশের মতো জীবেরা বের হয়ে আবার অন্য কোন ঝোঁপে মিলিয়ে যাচ্ছে। বিক্রম একটা ঝোঁপের সামনে প্রস্রাব করতে লাগল।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও বিক্রমের হচ্ছে না দেখে লোকদুটো বিক্রমের কাছে এল। মোটা লোকটা মেজাজ চড়িয়ে বলল, "এই শালা, কতক্ষণ লাগে তোর। জলদি কর।"
কথা শেষ হবার মাত্রই বিক্রম পিছন ফিরে দুজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজনেই  একে অপরের কাছাকাছি ছিল।  বিক্রমের ধাক্কায় দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল। ওদের হাত হতে পিস্তলদুটো ছিটকে পড়ল মাটিতে। বিক্রম এক ঝটকায় উঠে পিস্তলদুটো কুড়িয়ে নিল। এবার দু'হাতে দুটো পিস্তলকে লোকদুটোর দিকে তাক করে ধরে বলল,"কোনো চালাকি করবি না। চুপচাপ ঘরের ভিতরে চল।"
লোকদুটো ঘরের ভেতরে যেতেই দড়ি দিয়ে ওদের হাত পা বাঁধল। তারপর বলল, "এবার বলতো বাছাধন কে তোমাদের বাপ ! সেই লোকটার নাম বল যে তোদের পাঠিয়েছে।"
লোকদুটো বিক্রমকে সব কথা খুলে বলল। বিক্রম লোকদুটোর ঘাড়ে রদ্দা মেরে অজ্ঞান করে দিল। এবার অঘোরবাবুকে জাগাতে হবে। কুঁজো হতে জল নিয়ে অঘোরবাবুর মুখে ছিটা মারতেই তিনি চোখ খুললেন। চোখ খুলেই বলে উঠলেন," এই দেখেছেন, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মশাই.... তা হোটেলে পৌঁছতে আর কতক্ষণ ?"
বিক্রম বলল, " আপনার কি মনে হয় যে আপনি গাড়িতে আছেন ?"
- গাড়িতে নেই  !!
- না। আপনি গাড়িত নেই।
- "তবে.."  অঘোরবাবুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
বিক্রম বলল, "আপনি গাড়িতে ঘুমিয়েছিলেন গতকাল রাতে, আর এখন সকাল আটটার মতো। আমরা আছি জঙ্গলের ভেতরে শত্রুদের আড্ডায়।"   এরপর বিক্রম অঘোরবাবুকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে অঘোরবাবু বললেন, "তাহলে উপাই !"
বিক্রম আশ্বাস দিয়ে বলল, "ভয় নেই। মোবাইলের জিপিএস অন করে দিয়েছি। আর আপনাকে জাগানোর কিছু আগে পুলিশে ফোন করেছিলাম। ওরা এলো বলে।  "
অঘোরবাবু মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বললেন, "আমার মাথায় মশাই একটা কথা ঢুকছে না যে ওরা আমাদের এখানে আনল কিভাবে !"
বিক্রম হাঁসল । " কোনার্ক হতে বেরোবার সময় একটা দোকানে পুরি আর আলুর দম খেয়েছিলাম মনে আছে ? ওই পুরি-আলুরদমেই ছিল ঘুমের ওষুধ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ড্রাইভার ছেলেটাও এই কাজে জড়িত। "

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ৬ // সুব্রত মজুমদার

আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। বিক্রম বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। অঘোরবাবু গাড়িতে বসেই প্রশ্ন করলেন," আচ্ছা মশাই, আপনি কি করে জানলেন যে এ সবকিছুই গুপ্তধনের জন্যে হচ্ছে ? "
বিক্রম শান্ত গলায় জবাব দিল," সবই বলব অঘোরবাবু, শুধু সঠিক সময়টা হতে দিন। আমার মনে হয় দলের পাণ্ডাকে আমি পেয়ে গেছি।"  অঘোরবাবু আর কিছু বললেন না। বিক্রম গাড়ি থেকে নেমে সোজা ডাইনিং হলে চলে গেল। অনেক রাত হয়েছে। অঘোরবাবু আসার পথে একটা হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরেছেন। আজ খেতে খেতে বিক্রমেরও একটা আনসিকিওর আনসিকিওর ফিলিং হচ্ছিল। না অঘোরবাবুর সঙ্গদোষে নয়, বরং ঘটনা যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে অঘোরবাবুর নয় প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে বিক্রমেরই।
খাওয়া দাওয়া সেরে বিক্রম রুমে ফিরে দেখল অঘোরবাবু মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। জলের জাগ হতে জল নিয়ে চোখে মুখে ছিটাতেই অঘোরবাবুর জ্ঞান ফিরে এল। তিনি কিছুক্ষণ গোল গোল চোখ করে বিক্রমের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, "চোর... চোর.."
বিক্রম বলল, "কোথায় চোর ?"
অঘোরবাবু বললেন, "আপনি ডাইনিং হলে ঢুকে গেলেন, আমি চলে এলাম রুমে। এসে দেখি রুমের দরজা খোলা। কি বলব মশাই একটা চিমড়ে মতো লোক আমাদের জিনিসপত্র হাঁতড়ে দেখছিল। আমি চোর বলে চিৎকার করতেই নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ এল, তারপর আর জানি না। "
বিক্রম অঘোরবাবুকে  ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। অঘোরবাবু একটু জল চাইলেন। বিক্রম জলের জাগ হতে গ্লাসে করে জল এনে অঘোরবাবুকে দিয়ে বললেন," চিন্তা করবেন না অঘোরবাবু, জাল আমি গুটিয়ে এনেছি, দুদিনের মধ্যেই সব রহস্যের সমাধান করব। "   অঘোরবাবু জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন। বিক্রমের ঘুম এলো না। সে টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালেই বিক্রম আর অঘোরবাবু বেরিয়ে পড়লেন। তাদের গন্তব্য নন্দনকানন। গাড়িতে চেপেই অঘোরবাবু বললেন," ভগবানকে ডাকুন বিক্রমবাবু যেন আজ আর কোনো ঝামেলা না হয়। আচ্ছা বিক্রমবাবু, নন্দনকাননে বাঘ আছে ?"
বিক্রম বলল, "বাঘ আছে, হাতি আছে, আরো অনেক পশুপাখি আছে। এই অভয়ারণ্যটা হল ছন্দক অরণ্যের একটা অংশ। ১৯৬০ সালে এই অভয়ারণ্য তথা চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠা হয় ।"
নন্দনকাননে ঢুকবার মুখেই টিকিটঘর ।বিক্রম লাইনে দাঁড়াল টিকিট কাটার জন্যে। অঘোরবাবু হঠাৎ এসে বললেন," সব চোর মশাই, এ তো দিনে ডাকাতি।
-কেন কি হল ?
- ওই যে ওই ওজন মেশিনগুলো রয়েছে না মশাই, তা ভাবলাম ওজনটা একটু মেপে নিই। বারো কেজি বেশি। পুরি আসার আগেই কৈলাশের দোকানের কম্পিউটার কাঁটায় ওজন করিয়েছি মশাই । ভাবুন কি কাণ্ড !
বিক্রম বলল," কৈলাশের দোকানে ওজন করানোর সময় নিশ্চয়ই আপনার কাঁধের ভারি ব্যাগটা ছিল না।"
অঘোরবাবু জিভ কেটে বললেন, "কি বিপদ বলুন তো মশাই, এ হে হে হে..."
অঘোরবাবুর কথা শেষ করতে না দিয়ে বিক্রম বলল, "কিসব এনেছেন ! ওগুলো নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারবেন তো !
                            বিক্রমের কথা ভুল প্রমাণ করে অঘোরবাবু ওই ব্যাগ নিয়েই গোটা নন্দনকানন ঘুরলেন। কুমিরের এনক্লোজারের সামনে এসে একটু বিমর্ষ দেখাল তাকে। " ঈসস্ ! কয়েকটা পাউরুটি নিয়ে এলে ভালো হতো বিক্রমবাবু। আহারে ! বেচারা কুমিরগুলো কেমন মরার মতো পড়ে আছে। নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে।"
বিক্রম বলল, "ক্ষিধে পেয়েছে কিনা জানি না, তবে কুমির আপনার পাউরুটি খায় না।"
-  তবে কি খায় মশাই ?
- এই ধরুন আপনার মতো সাহিত্যিক পেলে একটু চেখে দেখত আরকি ! ওদের আবার লবণ লঙ্কাও লাগে না।
বিক্রমের এহেন জবাবে অঘোরবাবু যে আরো মুষড়ে গেলেন তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। শুধু তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন," এ ধরনের জীবজন্তু হতে দূরে থাকাটাই শ্রেয়স্কর।
ফোয়ারার জলে স্নান করার ইচ্ছা জেগেছিল অঘোরবাবুর, বিক্রমের হস্তক্ষেপে এ যাত্রা সে ইচ্ছা অবদমিত রইল। তবে গোটা চিড়িয়াখানাতে এতগুলো বানর থাকলেও পূর্বের অভিজ্ঞতার বলে অঘোরবাবু বানরদের ধারে কাছেও যাননি। অবশ্য দু'একটা বানর অঘোরবাবুর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু অঘোরবাবু আর ওপথে যাননি।
নন্দনকানন থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে ঢুকল বিক্রম। অঘোরবাবুর পছন্দ কাঁকড়া কারি, কারনটা অবশ্যই ফুগু। বিক্রমও কাঁকড়াই খেল। এক প্লেটে বড় বড় দুটো করে কাঁকড়া। বেশ জম্পেশ ভোজন হল। এবার গন্তব্য কোনার্ক।
কোনার্কে এসে হতে অঘোরবাবুর মনটা উড়ু উড়ু করছে। তিনি সিঁড়ির উপর ধপ করে বসে পড়লেন। তারপর বিক্রমকে ডেকে বললেন, "একটা ফাইন করে ছবি তুলুন তো মশাই। বয়স হয়েছে বলেকি শখ সাধ সব জলাঞ্জলি দিয়েছি নাকি। আর হ্যাঁ, বাড়ি ফিরেই একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেবেন তো। বুঝলেন মশাই, সারাজীবন আইবুড়োই থেকে গেলাম। মিথ্যা বলব না প্রেম এসেছিল জীবনে। কিন্তু টিকল না !"  দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অঘোরবাবু।
বিক্রম বুড়োর মনের কষ্টটা বুঝতে পারল কি না জানি না সে বলল," আপনি অঘোর অর্থৎ সব অসুন্দরকে পরাজিত করেছেন। জানেন তো শিবের এক নাম অঘোর। আর এই অঘোর হতেই অঘোরী। "
অঘোরবাবু বললেন," অতশত বুঝি না। তবে এটুকু বলতে পারি যে জীবনের অনেককিছুই আমি হারিয়েছি। মশাই, এখনো সময় আছে, ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে সংসারী হন। পাশেই থাকি বৌমার হাতের রান্না কপালে জুটবে। আপনারা ছাড়া আমার আর কে আছে বলুন ! "
বিক্রমের মুখে কথা যোগালো না, কারন অঘোরবাবুর কথার সাথে তার মনের ইচ্ছাটা মিলে যায় যে। দেবলীনাও তাই চায়। কিন্তু দেবলীনার মা বাবা কি মেনে নেবে বিক্রমকে ? ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর আইএএস হয়েছিল বিক্রম। কিন্তু সরকারি চাকরি সে বেশিদিন করতে পারেনি। দুর্নীতির সাথে লড়াই করতে গিয়ে চাকরি হতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড হয় বিক্রম। কোর্টে আবেদন করেছিল, এখনো চলছে সেই মামলা। এমন চাকরি হারানো হাড়-হাভাতে ছেলের হাতে কেই বা তার মেয়েকে তুলে দিতে চায় !
বিক্রম বলল, " কোনার্ক   একটা সূর্যমন্দির। এই সূর্যমন্দিরটি তৈরি করেন গঙ্গ রাজবংশের শাসক প্রথম নরসিংহদেব। আর ধ্বংস করেন সেই কুখ্যাত কালাপাহাড়।"
অঘোরবাবু বললেন, "সেই কালাপাহাড়, যে অনেক মন্দির ধ্বংস করেছিল !"

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ৫ // সুব্রত মজুমদার

খণ্ডগিরি দেখার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি পথ দিয়ে গাড়ি চলতে লাগল। বিক্রম ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল," ধৌলি পৌঁছতে কত সময় লাগবে ?" 
ড্রাইভার সামনের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, "চল্লিশ মিনিট মতো। ওখান থেকে কোনার্ক হয়ে স্বর্গদ্বার। হোটেলে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। কোনার্ক যাবার পথেই লাঞ্চ করে নেবেন।"
গাড়ি চলতে লাগল পাহাড়ি পথে। অঘোরবাবু তার ব্যাগ হতে দুটো লস্যির প্যাকেট বের করলেন। " উদয়গিরিতে কিনেছি। খেয়ে দেখুন মশাই। এতদিন তো অন্যকে ঘোল খাওয়ালেন এবার নিজে খেয়ে দেখুন। আমার মনে হয় না ওরা আমাদের এত সহজে ছেড়ে দেবে। "
বিক্রম গম্ভীর হয়ে গেল। কিছু একটা ভাবনা বিক্রমকে ক্ষণিকের মধ্যে অবসন্ন করে তুলেছে। সে গাড়ির সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলল, "যবে থেকে জন্মেছি  শুধু ঘোলই খেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু অঘোরবাবু ঘোল কি শুধুমাত্র খাওয়াই যায় ? - আমাদের মাথায় কেউ ঘোল ঢালছে না তো ? "
অঘোরবাবু ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বিক্রমের দিকে, তারপর বললেন, "ঠিক বুঝলাম না বিক্রমবাবু।"
বিক্রম বলল, " কয়েকটা প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছে, উত্তর পাইনি। যেমন ধরুন, মল্লদেবনের লুকিয়ে রাখা সম্পদের খোঁজ করছে কারা ? স্বর্গদ্বারের একটা অখ্যাত হোটেলের সঙ্গে কি সম্পর্ক এই গুপ্তধনের ? আর আমরা যে ছদ্মবেশে উদয়গিরি যাচ্ছি সেটা আততায়িরা জানল কিভাবে ? "
অঘোরবাবু বললেন," ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কিন্তু আপনি ওই গুহাতে এত তন্ময় হয়ে কি দেখেছিলেন মশাই ? ওইসব হিজিবিজি লেখাগুলো কি এমন ইম্পরট্যান্ট মশাই ? "
বিক্রম হেঁসে বলল," কুছ নেহি পুরা ডাল কালা হ্যায়। আর ওই লেখাগুলো কি জানেন, - গুপ্তধনের চাবি। এই শিলালিপি অনুসারে কোন এক ব্যক্তি বলছে যে
মহারাজধীরাজ চক্রবর্তীসম্রাট অনন্ত পদ্মণাভনের বিশ্বস্ত সেবক শ্রীমান মল্লদেবন দেববর্মন
 রাজার নির্দেশে এক গোযানপূর্ণ ধনরাশি শত্রুহস্তহতে দূরে নিরাপদে রাখার বন্দোবস্ত করেছেন।
বরুণদেবের উপস্থিততিতে নিলাচল.......
তার পরের অংশ আর নেই। কালের হস্তক্ষেপে মুছে গেছে বহুবছর আগেই। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এতসব কাণ্ডের মূলে কি। তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তরই পাওয়া যায় নি। অঘোরবাবু, আমাদের কাজ হবে হোটেলের ভৌতিক ব্যাপার আর এই মল্লদেবনের গুপ্তধনের সম্পর্ক বের করা। "
অঘোরবাবু গালে হাত দিয়ে বিক্রমের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার মুখে কোন কথা সরলো না। আর তখনই বিক্রমের মোবাইলটা বেজে উঠল।
" হ্যালো, কে বলছেন ? "
.............
" হ্যাঁ , বলুন.. "
.............
বিক্রম ফোনটা কেটে দিয়ে বলল," লোকটার জ্ঞান ফিরেছে। পুলিশ জানতে পেরেছে ওর নাম পরমেশ ভোই , ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিতে জড়িয়ে পড়েছে বহুদিন। দু'দুবার জেলও খেটেছে পরমেশ । ধৌলি থেকে ফিরে একবার লোকটাকে দেখে আসতে হবে। ওই হতে পারে আমাদের  সবচেয়ে বড় অস্ত্র।"
                                - - -চার - - - -
        ধৌলি দেখে ফেরার পথে বিক্রম হসপিটালে নামল। পরমেশ ভোই যে রুমে ভর্তি আছে সেই রুমের সামনে একজন উর্দিপরা পুলিশ পাহারায় রয়েছে । বিক্রমকে দেখে সে সেলুট করে বলল," বড়বাবু আপনার কথা বলে গিয়েছেন। ভেতরে যান, কোন সমস্যা হলে ডাকবেন।"
রুমে ঢুকে বিক্রম দেখল পরমেশ বিছানায় শুয়ে আছে, মাথায় তার বিশাল ব্যান্ডেজ বাঁধা। তার খাটের পাশে চেয়ারে বসে একজন খাঁকি পোষাকের পুলিশ। বিক্রম ইশারা করতেই পুলিশটি বাইরে চলে গেল। অঘোরবাবু বললেন," এটা ঠিক করলেন না মশাই। পুলিশ থাকলে এই মর্কটটা একটু চাপে থাকত।" 
বিক্রম অঘোরবাবুর কথায় একটু হাঁসল। এরপর চেয়ারটা টেনে নিয়ে পরমেশের কাছে বসল। বিক্রম জিজ্ঞাসা করল, " এখন কেমন বোধ করছ ?"
- ভালো।
- আমাকে মারতে গিয়েছিলে কেন ?
- আমি জানি না।
- বললে তোমারই মঙ্গল। এ কেসে জামিন পাবার আশা কম। আমাকে মারার চেষ্টা, হোটেলের খুন এই সব অপরাধের চার্জ তোমার উপরই বর্তাবে। সামান্য ক'টা টাকার জন্য কেন জেলে পচে মরবে ? রাজসাক্ষী হয়ে যাও তোমার যাতে কিছু না হয় সে দায়িত্ব আমার।
-আমাকে ওরা মেরে ফেলবে স্যার !
- তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের, তুমি নির্দিধায় সবকিছু খুলে বল।
- আমাদের যিনি বস আমি তার মুখ দেখিনি কোনোদিন, সবাই তাকে গুরু বলে  । উনার মুখ সবসময় ঢাকা থাকে। উনার কথার অবাধ্য হলে মৃত্যু অনিবার্য। আমাদের দলে কাজ করত একজন কলকাতার লোক, লোকটা ওখানকারই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক ছিল। গুরু আমাকে ডেকে বললেন যে লোকটা নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ওকে মেরে ফেলতে হবে।
-  তারপর.... মেরে ফেললে ?
- আমি নয়, রঘু। রঘু ওদের খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।
- বিষ মানে মাছের বিষ ?
- "হ্যাঁ । গুরু এনে দিয়েছিল মাছটা। বিদেশী মাছ। রঘু কেবল ঐ মাছটার কারি বানিয়েছিল। রঘুও চেয়েছিল আপনাকে সবকিছু জানাতে। বস ওকে গুলি করে মেরেছে। আমার কি হবে স্যার ! " পরমেশ ডুকরে কেঁদে ওঠে।

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ৪ // সুব্রত মজুমদার

এবার বিক্রমের আবাক হওয়ার পালা। অঘোরবাবু একটা পলিব্যাগের ভেতর হতে কয়েকটা রুটি আর তড়কার পার্শেল বের করলেন।   " আমি আমার খাবার কিনে এনেছি। ফ্রির খাবারে আমি আর নেই মশাই। "
বিক্রম আর কথা বাড়াল না। সে ডাইনিং হলের দিকে রওনা হল। রাতের রান্নাটাও দারুণ হয়েছে। পটলের রসা, ডিমের ডালনা, আলুপোস্ত, মুগের ডাল আর চাটনি। আলুপোস্তটা সম্ভবত দিনের। বিক্রম খেয়েদেয়ে যখন রুমে এল তখন অঘোরবাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাক ডাকার আওয়াজে সিলিং ফ্যানের আওয়াজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বিক্রম শুয়ে পড়ল।
                         পরদিন ভোরবেলায় স্বর্গদ্বারের রাস্তায় দেখা গেল দুজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক লাঠি হাতে গল্প করতে করতে বায়ুসেবন করছেন। একজনের মাথায় বিশাল টাঁক আর উপরের ঠোঁটটি ঢাকা দেওয়া পুরুষ্টু গোঁফ। আর অন্য বৃদ্ধের একমাথা সাদা চুল ব্যাকব্রাশ করা। দুজনের পরনেই সাদা ধুতি পাঞ্জাবী। টাঁকমাথা বৃদ্ধ অন্য বৃদ্ধকে বললেন, " এই যে ঘোষালবাবু, অত ধীরে ধীরে হাঁটলে হবে ! চলুন একটা গাড়ি দেখি। সকাল সকাল না বেরোলে উদয়গিরি খণ্ডগিরি দেখতে বেলা হয়ে যাবে যে।"
ঘোষালবাবু একটা পান মুখে চালান করে দিয়ে বললেন, ' আর মশাই, আপনার আর কি যা কেলো হচ্ছে তো আমার। পঁয়ষট্টি বছর বয়স হল মশাই বহুরুপী সাজতে হয়নি কোনোদিন।"
টাঁকমাথা বলল, " কি হচ্ছে কি ! এখন আমি জটাধর সাহা আর আপনি ত্রিশূল ঘোষাল। ক্যারেক্টার থেকে বেরোবেন না। গাড়ি বলা আছে, এক্ষুনি চলে আসবে। "
      গাড়ি এল। এসি কার। দুইবৃদ্ধ গাড়িতে চড়ে বসলেন। গাড়িটা রওনা হতেই আরেকটা গাড়ি পিছন পিছন ফলো করতে করতে চলল। ব্যাপারটা নজরে পড়তেই ঘোষালবুড়ো  চাপা গলায় বলে উঠলেন," আপনার ছদ্মবেশে কোন লাভ হল না মশাই। পেছনে দেখুন, একটা গাড়ি সেই শুরু থেকে আমাদের ফলো করছে। কি যে হচ্ছে মশাই আমার মাথায় তো কিস্যু ঢুকছে না।"
  সাহাবুড়ো বলল, " মাথা কোনোদিন খাটিয়েছেন যে মাথায় ঢুকবে। ওসব অগ্রাহ্য করুন। প্রায় ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা মাঝে কোথাও নেমে একটু চা খেয়ে নেব। "
     মঙ্গলপুরে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামল। দুই বুড়ো বেরিয়ে এসে চায়ের অর্ডার করল। এই দোকানটাতে ভালো ব্রেড টোস্ট বানাচ্ছে। সাহাবুড়ো দুটো এগ-ব্রেড টোস্ট আর আরেক কাপ করে চায়ের অর্ডার করা হল। পিছনের গাড়িটা একটু এগিয়ে একটা দোকানে দাঁড়িয়েছে। ঘোষালবুড়োর নজর ওই গাড়িটার দিকে। হঠাৎ কি যেন একটা দেখে ঘোষালবুড়ো সাহাবুড়োর কানে কানে চাপা গলায় বলল, " খুব ডেঞ্জারাস মশাই। আমি ওদের একজনের কাছে বন্দুক দেখেছি। আমার অবজার্ভেশন ভুল হতে পারে না।"
সাহাবুড়োর কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। ইতিমধ্যে টোস্ট এসে গিয়েছে, সাহাবুড়ো টোস্টে মনোনিবেশ করল।
            গাড়ি যখন উদয়গিরি পৌঁছাল তখন সকাল আটটা। পর্যটকদের ভিড়ে পাহাড়ের তলদেশটা থিকথিক করছে। একপাশে খণ্ডগিরি জৈন মন্দির আর অন্যদিকে উদয়গিরির মনোমুগ্ধকর সব গুহা। উদয়গিরি এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে। টিকিট কাউন্টারে টিকিট কেটে দুই বুড়ো উদয়গিরিতে ঢুকল। উদয়গিরির গুহাগুলো বেশ উঁচু উঁচু। সাহাবুড়ো অবলীলায় উঠে গেলেও ঘোষালবুড়োর চড়াই উঠতে বেশ কষ্টই হচ্ছে।
"এ পাহাড় চড়া আমার পক্ষে অসম্ভব মশাই। আপনি চলুন আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি।"  ঘোষালবুড়ো বসে বসে হাঁপাতে লাগলেন। আর ওদিকে একটা বড় গুহায় ঢুকে সাহাবুড়ো কিছু খুঁজতে লাগল। মাথার উপরের একটা শিলালিপিতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সাহাবুড়ো।
           এই লিপি রাজা খারবেলার লিপি থেকে আলাদা। দুটোই ব্রাহ্মী লিপি হলেও অনেক পার্থক্য আছে। এই লিপি অনেকটাই পাঠযোগ্য, সংস্কৃতের টান আছে।  সাহাবুড়ো মোবাইলে ছবি তুলে নিল। এমনসময় সাহাবুড়ো দেখল গুহামুখে  বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছেন ঘোষালবুড়ো। পাশে একটা লোক পড়ে আছে, লোকটার মাথা হতে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। ঘোষালবুড়োর হাতের লাঠিটা রক্তে ভিজে গেছে।
সাহাবুড়ো বলল, " কিকরে হল এসব ! অঘোরবাবু..."
ঘোষালবুড়ো একটা দম নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর বললেন , " আর একটু হলেই আপনি ফিনিশ মশাই। আমি অনেক কষ্টে উপরে উঠে আপনাকে খুঁজে বের করলাম। দেখি কি এই হতভাগা একটা পাথর তুলে আপনাকে মারতে যাচ্ছে। আমিও দিলাম এই লাঠির গায়ে অজ্ঞান করে।"
বিক্রম এবার পরচুলা খুলে ব্যাগে ভরে নিল। "আর ছদ্মবেশের দরকার নেই অঘোরবাবু, শত্রুরা আমাদের চিনে ফেলেছে। এই ইনস্ক্রিপশন দেখছেন তো, এটা রাজা অনন্ত পদ্মণাভনের  বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর লিপি। সম্ভবত এই শিলালিপি এখানে ছিল না। অন্যকোথাও থেকে এনে খুব নিপুণ হাতে এই গুহার দেওয়ালে  বসানো হয়েছে।"
অঘোরবাবু বললেন," আমি আগেই বলেছিলাম আমদের একটা গাড়ি ফলো করছে, আপনি মশাই আমার কথা কানেই নিলেন না। "
বিক্রম ফোন করছিল, ফোন শেষ করে অঘোরবাবুকে বলল," ভুল। আপনি যে গাড়িটা দেখেছেন সেটা পুলিশের গাড়ি। আমাদের গাড়িকে প্রোটেকশন দিচ্ছিল। এখানেও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন আছে। আমি খবর দিয়েছি এখনি পুলিশ এলো বলে। "
অঘোরবাবু এবার লোকটার বুকের উপর লাঠিটা ঠেকিয়ে বললেন, "তবে যাই বলেন বিক্রমবাবু, আমি না এলে এই মর্কটটা আপনার দফা রফা করে দিত।"
বিক্রম কিছু বলার আগেই সাদা পোশাকের দুজন পুলিশ গুহায় প্রবেশ করল। তাদের মধ্যে একজন সম্ভবত এএসআই  থাকের অফিসার বললেন," ইউ ক্যান গো নাও স্যার। আপলোগ ঘুমিয়ে ফিরিয়ে, ইহা কি সিচুয়েশন হামলোগ সাম্ভাল লেঙ্গে । " উড়িষ্যার অনেক শিক্ষিত লোকই বাংলা জানে কিন্তু হিন্দিটাই কম্যুনিকেশনের কাজে বেশি ব্যবহার করে।
উদয়গিরি ভ্রমন শেষ করে অঘোরবাবু আর বিক্রম তাদের সাজপোষাক পাল্টে নিল। এতে গাড়ির ড্রাইভার খুব অবাক হলেও কিছু মন্তব্য করল না। ছেলেটা খুবই বুদ্ধিমান। গাড়িতে পরচুলা লাঠি ইত্যাদি রেখে অঘোরবাবু আর বিক্রম চলল খণ্ডগিরি দর্শনে। অঘোরবাবু অনেক কষ্টে সিঁড়ি চড়ে উপরে উঠলেন। মাঝপথে বাধল বিপত্তি। একটা ছোকরা মতো বাঁদর অঘোরবাবুর কাঁধে চড়ে বসল। কোনোমতেই সে নামতে চায় না।
অঘোরবাবু প্রথমে ভয় দেখালেন তারপর কলার লোভ দেখালেন, এবং শেষে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। ব্যাপার দেখে অনেক লোক জমে গেল। সবাই নিজেরমতো করে বাঁদর তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কেউই সবল হল না বানরবাবাজী কাঁধে চড়ে অঘোরবাবুর সযত্নে ব্যাকব্রাশ করা চুলের দফা রফা করে ছাড়ল।
অঘোরবাবু কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, "এই শেষ, আর এই বাঁদরামর জায়গায় আসব না।"  অঘোরবাবুর কথায় ব্যথিত হয়ে কিনা জানি না বানরবাবাজী অঘোরবাবুর ঘাড় হতে লাফিয়ে নেমে গেলেন। অঘোরবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। 

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ৩ // সুব্রত মজুমদার

- - তিন - -
নিচের তলায় একটা রুম খালি হয়ে যাওয়ায় বিক্রমদের সেই রুমে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রুমটা মোটেরউপর ভালো হলেও সমুদ্রের হাওয়ায় আয়েশে ঘুমানোর সুযোগ নেই।
 দুপুরের খাবার খেতে দেরি হয়ে গিয়েছে। অঘোরবাবু বারবার ঘড়ি দেখছেন আর পায়চারি করছেন। " আচ্ছা বিক্রমবাবু, এটা কেমন হল বলুন তো। নির্ঘাত অশ্লেষা বা মঘাতে বেরিয়েছি। এখন জেলে না গেলেই হল। আর যদি জেলে নাও যাই ওই বগু খেয়েই দুজনের ভবলীলা সাঙ্গ হবে মশাই।"
"ওটা বগু নয় ফুগু।" বিক্রমের নির্বিকার উত্তর।
এমন সময় বিজন বাবু রুমে এলেন। তিনি শান্ত গলায় বললেন," আপনাদের কাছে আমি অপরাধী। আপনারা এসেছেন পুরি বেড়াতে এনজয় করতে আর আমার হোটেলে এসে আপনারা কি সব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন....। "
অঘোরবাবু বিক্রমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আক্রমণাত্মক মেজাজে বললেন, " ফ্রি অনেক খেয়েছি মশাই ! এবার তো দেখছি ফ্রির ঠেলায় আমরাই না ফ্রি হয়ে যাই মশাই। আপনার হোটেলে ভুত, মার্ডার, ডুগু কি নেই বলুন তো। "
বিক্রম অঘোরবাবুকে বাধা দিয়ে বললেন," ওটা ডুগু নয় ফুগু হবে। আর বিজনবাবু আপনি অঘোরবাবুর কথায় কিছু মনে করবেন না।"
বিজনবাবু বললেন," না না তা কেন। আসলে যে কথাটা আমি বলতে এসেছিলাম.... অনেক বেলা হয়ে গেল খাওয়া দাওয়াটা যদি করে নেন.... ! সব রেডি। "
বিক্রম ও অঘোরবাবু বিজনবাবুর সাথে ডাইনিং হলে গেলেন। সব বোর্ডারদের খাওয়াই প্রায় শেষ। কেবল সামনের একটা টেবিলে দুজন ও মাঝের দিকে একটা টেবিলে চারজন রয়েছেন। তাদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। বিক্রম সামনের একটা টেবিলে বসে পড়ল। ভাত, শাক, আলুপোস্ত,এঁচড়ের তরকারি ও মাছের ঝোল এল । অঘোরবাবু খেতে খেতে মাছের প্লেটের দিকে হাত বাড়ালেন। প্লেট হতে মাছের মুড়োটা তুলে নিয়ে বসালেন এক কামড় । তারপর চিবোতে চিবোতে বিক্রমের দিকে তাকিয়েই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ছুটলেন সোজা সিঙ্কের দিকে। বিক্রম সেই দিক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর আবার খাবারে মনোনিবেশ করল।
"স্যার কিছু লাগবে ?" পরিবেশনের ছেলেটা টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। বিক্রম তার দিকে চেয়ে বলল, " মেকাপের কিট।"   ছেলেটা কোন উত্তর না দিয়ে বিক্রমের পাতে কিছুটা আলুপোস্ত দিয়ে চলে গেল।
একটু পরেই ফিরে এলেন অঘোরবাবু। এই মিনিট কয়েকের ভিতরেই তার চোখমুখ যেন বসে গিয়েছে। গলার আওয়াজ ক্ষীণ। অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, " ফুগু ! আই অ্যাম ডাইং মশাই ! গুড বাই। "  বলেই অঘোরবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
পরিবেশনের লোকজন এসে অঘোরবাবুকে পাঁজাকোলা করে তুলে রুমে নিয়ে গেল। বিক্রমের কিন্তু কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ভাত শেষ করে চাটনির জন্য হাঁক দিল। আঙুল চাটতে চাটতে অপেক্ষা করতে থাকল চাটনির।
দীর্ঘ দুই ঘন্টা ঘুমানোর পর অঘোরবাবু মৃত্যুমুখ হতে ঘুরে এলেন। উঠেই দেখলেন বিক্রম রেডি হয়ে বসে আছে। একগাল হেঁসে বিক্রম বলল, " অঘোরবাবু, কুইক ! ধ্বজাবাঁধা দেখতে যাবো।"
অঘোরবাবু তড়িঘড়ি উঠে রেডি হয়ে নিলেন। একটু দেরি হয়ে গেল বটে কিন্তু ধ্বজাবাঁধা দেখতে পাওয়া গেল। একটা বাচ্চা ছেলে কি সুন্দর ধীরে ধীরে মন্দিরের গা-বেয়ে উঠে গেলে নতুন পতাকা হাতে নিয়ে। পুরানো পতাকার পরিবর্তন করে নতুন পতাকা লাগানো হল। তারপর আবার মন্দিরের খাঁজ ধরে ধরে নেমে এল ছেলেটি। উপস্থিত জনতা 'জয় জগন্নাথ' ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলল।
অঘোরবাবু এতক্ষণে ঘোর কাটিয়ে দু'হাত তুলে বলে উঠলেন, "জয় বাবা জগন্নাথঅ ! ধাঁই কিড়িকিড়ি ।"  তারপর বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বললেন, " আপনি বিশ্বাস করবেন না মশাই সেই রঘু মাছ খেয়ে যখন মরতে বসেছিলাম তখন ভেবেছিলাম এই শেষ, আর কোনার্ক দেখা আমার হলো না।"
বিক্রম বলল, " অঘোরবাবু, ওটা রঘু নয় ফুগু। আর আপনি শুধু কোনার্ক কেন নন্দনকানন, ধবলগিরি, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি সবই দেখবেন।"
মন্দির থেকে বেরোতেই বিক্রমের পাশে একটা অটো থামল। বিক্রম আর অঘোরবাবু তাতে চড়ে বসলেন। অটোর সিটের উপরে একটা পেটমোটা ব্যাগ পড়েছিল। বিক্রম পকেট হতে বড় সাইজের একটা জামাকাপড়ের পলিব্যাগ বের করে ব্যাগটা  তাতে ভরে নিল। অঘোরবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন। " আরে কি করছেন মশাই, যদি ওতে বোম থাকে তাহলে ! না না বিক্রমবাবু, ওটা ফেলিয়ে দিন।"
বিক্রম অঘোরবাবুকে কোনোক্রমে থামালেন ।সারাটা রাস্তা অঘোরবাবু জড়সড় হয়ে থাকলেন। হোটেলে এসে বিক্রম ব্যাগটা খুলল। ব্যাগের ভেতরটা পোষাক পরচুলা ইত্যাদিতে ঠাঁসা। অঘোরবাবু বিস্ময়ে চোখদুটো গোল গোল করে বিক্রমের দিকে তাকালেন। বিক্রম বলল," এসব বড়বাবু শ্রীযুক্ত কমলদল মহাপাত্রের উপহার।"
অঘোরবাবু বললেন, " আর উপহার দেবার জিনিস পেলেন না বড়বাবু, শেষে বহুরুপীর পোষাক।"
"ইয়েস মাই লর্ড ! বহুরুপীর পোষাক। আর এগুলো পরেই আমরা যাবো উদয়গিরি খণ্ডগিরি। জানেন তো ধবলগিরি তৈরি হয়েছে ভগবান বুদ্ধের বিশ্বশান্তির বাণীকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তাই ধবলগিরি একটি শান্তিসৌধ।
২৬৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন মহারাজ প্রীয়দর্শী অশোক। সিংহাসনে বসার জন্যে তিনি তার ভাইদের নির্মমভাবে হত্যা করেন। তার নির্মমতার জন্য তাকে বলা হত 'চণ্ডাশোক'। ভারতের বহুরাজ্য তার পদানত হলেও হার মানেনি কলিঙ্গ। আর কলিঙ্গ জয় করতে না পারলে সম্রাট অশোকের দাক্ষিনাত্য জয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে, তাই তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। কলিঙ্গরাজ অনন্ত পদ্মণাভনের সঙ্গে যুদ্ধে দুই পক্ষের বিশাল সংখ্যক সেনা নিহত ও আহত হন। রাজা অশোক যুদ্ধে জয়ী হলেও এই যুদ্ধের ভয়াবহতায় তিনি ব্যথিত হন। এরপর উপগুপ্তের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন ও শান্তির বাণী প্রচারে মন দেন। "
অঘোরবাবু বিক্রমের কাহিনী শুনে চোখ বড় বড় করে বলে ওঠেন," ওয়াণ্ডারফুল ! কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে পরচুলার কি সম্পর্ক মশাই ? "
বিক্রম হাঁসে । " আছে অঘোরবাবু আছে। সম্পর্ক তো আছেই। কাল আমরা যাব ধবলগিরি। আর সেই ধবলগিরির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দয়া নদী। এই দয়া নদীর তীরেই হয়েছিল সেই রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধ। সৈন্যদের রক্তে দয়া নদীর জল হয়ে উঠেছিল লাল। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর রাজা অনন্ত পদ্মণাভনের সোনা-রূপো হীরে জহরতের একটা অংশ নিয়ে তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী মল্লদেবন নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এখানেই সাসপেন্স মাই ওল্ড ফেলো। "
অঘোরবাবু বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়লেন। তারপর বললেন, " আপনার সঙ্গে এসে অব্দি সাসপেন্স তো কম দেখলাম না মশাই, আমার থ্রিলার উপন্যাসেও এত সাসপেন্স থাকে না। তবে মশাই, ফিরে গিয়েই লিখতে বসব। গুছিয়ে নিয়েছি মনে মনে, বেস্ট সেলার নভেল। "
বিক্রম বলল," সে নাহয় হবে, কিন্তু এখন তো দক্ষিণ হস্তের কাজটা সমাধা করতে হয়। ওবেলা বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। চলুন। "

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ২ // সুব্রত মজুমদার

বিজনবাবু আবার বলতে শুরু করলেন।  " ঘটনার পর যতজনকে ওই রুম ভাড়া দিয়েছি কেউই একরাত্রির বেশি ওই রুমে থাকতে পারেনি। বাচ্চা ছেলেমেয়ের আওয়াজ  শুনতে পাওয়া যায় । হোটেলের উপার্জনে আমার সংসার চলে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে আমার কাছে এটা কতবড় একটা সমস্যা।"
 বিক্রম বিজনবাবুর দিক তাকিয়ে বলল, "  আমি  রুমটা একবার সরেজমিনে দেখতে চাই, আপনার কোন আপত্তি নেই তো ! "
বিজনবাবু মাথা নেড়ে বললেন," না না, আপত্তি করব কেন, আপনি যে ব্যাপারটাটে উৎসাহ দেখাচ্ছেন সেটাই আমার বড় পাওনা। "  এরপর উঠে গিয়ে ৩০৮ এর চাবি আনলেন। " চলুন বিক্রমবাবু।"
বিক্রম  বিজনবাবুর সঙ্গে দ্রুতপায়ে উঠে এল তিনতলায়। অঘোরবাবু পেছন পেছন এলেন বটে কিন্তু তাকে বেশ নার্ভাস নার্ভাস মনে হচ্ছে। তিনি বারবার চোখবুজে বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। মনে হচ্ছে যেন পরীক্ষার আগে কোন অমনোযোগী ছাত্র শেষের পাঠটা ঝালিয়ে নিচ্ছে। বিজনবাবু তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢোকার আগেই ঘরের মেঝেটায় চোখ বুলিয়ে নিল বিক্রম। না পায়ের ছাপ নেই কোথাও। ঘরটির চারিদিকে অব্যবহারের ছাপ স্পষ্ট। খাটের উপর, মেঝেতে, পর্দায়, - - সর্বত্র পুরু ধুলোর আস্তরন। ঘরের কোথাও পুরানো রক্তের দাগ নেই। বিক্রম ফ্যানের দিকে তাকাল। না, ফ্যান অবিকৃত আছে।
" পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কি বলেছে বলতে পারবেন।" বিক্রম খাটের উপর হতে গদিটা সরাতে সরাতে প্রশ্ন করে।
বিজনবাবু বললেন, " হ্যাঁ, সবার পেটেই বিষ পাওয়া গেছে। কি যেন একটা মাছের বিষ...... হ্যাঁ মনে পড়েছে, - ফুগু।"
বিক্রম সবিস্ময়ে ঘুরে তাকাল, " ফুগু ! পুরি বা তার আশেপাশের বাজারে এই মাছ পাওয়া যায় ? "
বিজনবাবু বললেন, " আমি যতদূর জানি এই মাছ এখানে পাওয়া যায় না। এমনকি বিক্রমবাবু আমি এই মাছের নামটাও এই প্রথমবার শুনলাম। "
অঘোরবাবু আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি খিঁক খিঁক করে হেঁসে উঠলেন। তারপর বললেন," মশাই মাছের কাঁটা গলায় আটকে লোক মরে শুনেছি তাবলে মাছের বিষ ! কি নাম যেন বললেন জুগু না সাগু, এরকম মাছের নাম মশাই আমি বাপের জন্মে শুনিনি। "
বিক্রম বলল," জুগুও নয় সাগুও নয়। ফুগু, - একটা জাপানী মাছ। এর পিত্তথলিতে বিষ থাকে। অন্যান্য মাছের পিত্ত গলে গেলে আমরা তেঁতোয় থুথু করি, আর ফুগু মাছের পিত্ত গলে গেলে জাপানীরা কফিন কিনতে যায় । "
বিজনবাবু বিস্ময়ে বিক্রমের দিকে তাকালেন। অঘোরবাবু লাফিয়ে উঠলেন। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটভাবে বেরোল," উরিব্বাস. !!! "
বিক্রম অঘোরবাবুকে বলল," অঘোরবাবু, এখন থেকে মাছটাছ সাবধানে খাবেন। বলা যায় না আপনি  কাতলা মাছের পেটি ভেবে যেটাতে কামড় বসিয়েছেন সেটা আসলে....."
" ফুগু.." অঘোরবাবু বিক্রমের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলেন। বিজনবাবু মুখ নামিয়ে হাঁসতে লাগলেন।
বিক্রম এবার মোবাইল বের করে দ্রুত কিছু ছবি তুলে নিল তারপর বলল," চলুন বিজনবাবু, আমার কাজ এখনকার মতো শেষ। চলুন অঘোরবাবু স্নান সেরে নিই চটপট, মন্দিরে যাবো। "
      স্নান করে বিক্রমেরা গেল জগন্নাথ দর্শনে। বিজনবাবু আগে থেকেই পাণ্ডা ঠিক করে রেখেছিলেন। অঘোরবাবু তো মন্দির দেখে অবাক। তিনি তার নিজ স্টাইলে মন্দির পরিদর্শন করে বেড়াতে লাগলেন। এবার তার প্রশ্নবাণের মুখে পড়লেন পাণ্ডাপ্রবর।
" আচ্ছা ঠাকুরমশাই, এই মন্দির কে করুচি ?"
আমাদের পাণ্ডা ভালোমতো বাংলা জানেন। তিনি অঘোরবাবুর 'করুচি' শুনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেন বোধহয়, কারন অঘোরবাবুর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। মন্দিরে পুজো দিয়ে বিক্রমরা ফিরে আসছে এমন সময় বিক্রমের নজর গেল পেছনের অটোটার দিকে। ওই অটোর আরোহী নিল রঙের গেঞ্জি পরা একটা লোক। লোকটাকে বিক্রম বহুবার দেখেছে। আজ সকাল হতেই এই লোকটা বিক্রমদের সর্বত্র ফলো করে বেড়াচ্ছে। কি অভিপ্রায় এর ?
ব্যাপারটা অঘোরবাবুও লক্ষ্য করেছেন। তিনি বললেন, " কিডনাপের মতলব মশাই ! চোর খুনে ধরে ধরে আপনি যে টাকার পাহাড় জমিয়েছেন সেটাতে এবার নজর পড়েছে। যা কৃপণ আপনি, আপনার পাল্লায় পড়ে আমার জীবনটাও না যায় !"
অঘোরবাবু আর বিক্রম যখন হোটেলে ঢুকল তখন বেলা একটা। রুমের তালা খুলে চমকে উঠল বিক্রম। অঘোরবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, " মার্ডার ! খুন হয়েছে খুন !"
অঘোরবাবুর চিৎকারে আশেপাশের রুম থেকে দু'চারজন এসে জড়ো হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিসেপশন হতে বিজনবাবুও উঠে এলেন। বিক্রমের বিছানার উপরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে সেই নিল গেঞ্জির লোকটা। লোকটার কপালে একটা গোল ক্ষতচিহ্ন, সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা।
বিক্রম সাবধানে দেহ পরীক্ষা করে বলল, " মারা গেছে। বিজনবাবু, পুলিশে খবর দিন। আর ডেডবডিতে কেউ হাত দেবেন না। "
পুলিশে খবর দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের গাড়ি এল। ডিউটি অফিসার বেশ খোলামেলা লোক। বড় বড় গোঁফ আর পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। কপালে চন্দনের তিলকটা বেশ বড়সড়, বোঝাই যায় অফিসার একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। পান চিবোতে চিবোতে বিক্রমের দিকে এগিয়ে এসে ডানহাত বাড়িয়ে দিলেন, " হ্যালো মিস্টার গোয়েন্দা ! আমি কমলদল মহাপাত্র। এখানকার অফিসার-ইন-চার্জ।"
বিক্রমও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। বোঝা গেল এই মহাপাত্র বিক্রমকে চেনেন। বিক্রম অফিসারকে বলল, " দেখুন অফিসার, রুমটা যেহেতু আমার আর তা বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল তাই আমিও একজন সাসপেক্ট। ইউ ক্যান ডু অ্যানিথিং। "
অফিসার আঙুল দিয়ে দাঁত থেকে পানের টুকরো বের করতে করতে বললেন, " কি যে বলেন বিক্রমবাবু, আপনাকে সন্দেহ করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। আজ বিশ বছর এই প্রফেশনে আছি, আমার চোখই ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি। আমার ইচ্ছা আপনি এই কেসে পুলিশকে সাহায্য করুন। "
বিজনবাবু কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। দেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হল। বিক্রম গ্লাভস পরে রুমটি পর্যবেক্ষণ শুরু করল। বেডের কাছাকাছিই বুলেটের খোলটা পাওয়া গেল। মার্ডার ওয়েপন কোথাও পাওয়া গেল না। বিক্রম অফিসারকে বলল," অনেক কাছ হতে গুলি করা হয়েছে। তারমানে আততায়ী নিহতের পরিচিত।"
" বিক্রমবাবু, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন কি ? পাশের ফাঁকা রুম থাকতেও মার্ডার হল আপনার রুমে। এর মানেটা কি !" অফিসার বিক্রমের দিকে তাকাল।
বিক্রম এবার হাঁসল। " অফিসার, খুনি আমাকে ফাঁসাতে চায়। হয়তো আমার কারনে তার কোন ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। আর নিহত লোকটা আজ সকাল থেকেই আমার পিছু নিয়েছিল। স্বর্গদ্বারে অটো থেকে নেমে আমি আর অঘোরবাবু মিষ্টির দোকানে গিয়েছিলাম। সেই সময়টাই কাজে লাগিয়েছে খুনি।"
অফিসার আর বিক্রম রুম থেকে বেরিয়ে এল। আসার সময় অফিসারকে বিক্রম আর অঘোরবাবুর ব্যাগপত্র বের করে দিয়ে রুমটা সিল করে দিলেন।

হোটেলে হাহাকার - ভাগ ১ // সুব্রত মজুমদার

অনেকদিন পর বিক্রমের বেড়াবার অবকাশ হয়েছে। রায়ভিলার ভুতের রহস্য সমাধান করার পর থেকেই বিক্রমের হাতে কোন কাজ নেই। দেবলীনাও এখন পাটায়া ট্যুরে। এই মধুমাসে অলসের মত বসে থাকাটা বিক্রমের পক্ষে খুবই অসহনীয়। ভরসা শিবরাম। হ্যাঁ, মুক্তারাম স্ট্রিটের সেই আদি অকৃত্রিম শিবরাম চক্রবর্তী। বিক্রম আরামকেদারায় বসে বাগিয়ে ধরে শিবরাম রচনা সমগ্র। এবার একটু চা চাই। তাই সজোরে হাঁক দিল বিক্রম, " মাধবদা, চা দিয়ে যাও।"
এরপর সদর দরজার দিকে নজর যেতেই দেখলেন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছেন এক ব্যক্তি। লোকটির মাথায় ব্যাকব্রাশ করা একরাশ কালো চুল, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা আর হাতে একটা ছোটমতো নোটবুক। আরে ইনি তো পাশের বাড়ির অঘোরবাবু !
        অঘোরবাবু রিটায়ার্ড মানুষ। ইরিগেশন না কি একটা দফতরে চাকরি করতেন। এখন রিটায়ারের পর সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হয়েছেন। ইনি এলেই বিক্রমের দফারফা করে ছাড়েন। এটা কি করে হল, ওটার মানে কি, - - এজাতীয় প্রশ্নের বিরাম নেই। এহেন অঘোরবাবুকে আসতে দেখে বিক্রম মনে মনে প্রমাদ গুনলেন।
" এই যে বিক্রমবাবু, আছেন কেমন ? আপনার ঐ মেয়েছেলে বন্ধুটিকে তো আর আসতে দেখি না !" একটা আঁতেল হাঁসি হাঁসলেন অঘোরবাবু।
বিক্রম জবাব দিল, " ওটা বান্ধবী হবে। আর সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, আপনার মতো পরছিদ্রান্বেষণের সময় কারোর নেই।"
" আরে মশাই, এত রেগে যাচ্ছেন কেন ? আজ আপনাকে এমন খবর দেব মশাই আনন্দে দু'হাত তুলে নাচবেন। " অঘোরবাবু বিক্রমের পাশের চেয়ারে বসলেন। মাধবদা চা নিয়ে এল। সে অঘোরবাবুকে আগেই দেখেছে, ফলে দুজনের জন্যেই চা এনেছে।
" সুসংবাদটা কি ? আমি রাজা হচ্ছি ? নাকি আমার লটারি লাগল ? " বিক্রম চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে।
অঘোরবাবু চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বিক্রমের দিকে তাকিয়ে খিঁক খিঁক করে হেঁসে ওঠেন।  "আরে না না মশাই, লটারি তো লেগেছে আমার। সেই যে সেদিন এসেছিলাম আপনার কাছে, জানতে পরপর চারটে সংখ্যা বলতে বললাম, মনে আছে তো ! সেই নাম্বারের লটারি টিকিট কিনেছিলাম। দেড় লাখ টাকা মশাই ! "
"তাতে আমার আনন্দের কি হল ? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হল আপনার।" বিক্রম বিরক্ত হল।
এবার অঘোরবাবু আসল কথা পাড়লেন। " ব্যাপার হল কি দুটো আপডাউন টিকিট কিনেছি, - টু পুরি। পুরো খরচা আমার। আপনি আমার কাছে খুব লাকি আরকি। তাছাড়া আপনার মতো লোক সাথে থাকলে ভরসা পাই মশাই। "
অন্যদিন হলে বিক্রম অঘোরবাবুকে পত্রপাঠ বিদায় দিতেন কিন্তু আজ আর না বললেন না।
                                                        - - দুই - -
                     হাওড়া-পুরি এক্সপ্রেসে চেপে রওনা দিলো বিক্রম। গোটা রাস্তা অঘোরবাবু বকবক করেছেন। বিভিন্ন স্টেশনের নাম কিভাবে হল, রেলের খাবার তৈরিতে কতগুলো ঘুঁটে গুল লাগে, উড়িয়ারা কি সত্যিই উড়তে পারে ইত্যাদি নানান প্রশ্নে বিক্রমকে জেরবার করে তুললেন অঘোরবাবু।
 পুরিতে নেমে স্বর্গদ্বারের কাছে হোটেল ভাড়া করা হল। হোটেল সুপ্রভাত। বাঙালি মালিক, কলকাতার লোক। বিক্রমকে তিনি টিভিতে দেখেছেন। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন বিক্রমকে।. " কি সৌভাগ্য আমার, বিক্রমবাবু অমি যে আপনার কতবড় ফ্যান তা বলে বোঝাতে পারব না। আপনার সব কীর্তিকাহিনী আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।"
অঘোরবাবুও হোটেল মালিককে জড়িয়ে ধরতে গেলেন, কিন্তু পাত্তা পেলেন না। খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্রমের কানে কানে বললেন, " দেখছেন তো মশাই, আমার মতো উদিয়মান সাহিত্যিককে পাত্তা দিল না। ঘোর কলিকাল। ". বিক্রম মুচকি হাঁসল।
হোটেলমালিক বিজনবাবু জানালেন যে সব রুম বুকড। তিনতলার ৩০৭ আর ৩০৮ ফাঁকা আছে। তবে ৩০৮ রুমটি দেওয়া যাবে না। কারনটা ব্যক্তিগত। অগত্যা ৩০৭ এই দুজনের থাকার ব্যবস্থা হল। বিজনবাবু বিক্রমের কাছে ভাড়া নিলেন না, এমনকি খাবার চিন্তা করতেও মানা করলেন।
সারাদিন সমুদ্রে স্নান করে আর সন্ধ্যাবেলায় অটোতে করে পুরি শহর দেখে বেড়ালো বিক্রম আর অঘোরবাবু। রাতের মেনু ছিল গরম গরম খাঁসির মাংস আর রুটি। দিন ও রাতের খাবারের দায়িত্ব নিয়েছেন বিজনবাবু। সিসাইড জানালা থাকায় সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল বিক্রম।
মাঝরাতে অঘোরবাবুর ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল বিক্রমের। বিক্রম বিরক্ত হয়ে বলল, " কোন চাক্কির আটা খান মশাই, রাতেও ঘুম নেই ! রাতের আঁধারে কোন গল্পের প্লট মাথায় এল নাকি ? আমার মাথা না খেয়ে লিখে ফেলুন।"
অঘোরবাবুর মুখে তার পেটেন্ট হাঁসিটি নেই, তিনি শশঙ্কিত হয়ে বললেন, " আরে মশাই কথাটা তো শুনুন। পাশের ঘরটা ভালো নয় বিক্রমবাবু। ভালোকরে শুনুন.... "
বিক্রম দেওয়ালে কান পাতল। অঘোরবাবু চাপা স্বরে বললেন," কি কিছু শুনতে পাচ্ছেন ? " বিক্রম মাথা নেড়ে সন্মতি জানাল। তারপর অঘোরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, " অনেকগুলো ছেলেমেয়ের গলা। চাপা গলায় যেন কি আলোচনা করছে। "
" কিন্তু ঘরটা তো বন্ধ মশাই, ছেলেপিলে আসবে কোথা থেকে ? ভুত প্রেত নয়তো !! রাম রাম রাম.... !!!". অঘোরবাবু ভয়ে রামনাম জপতে লাগলেন।
বিক্রম দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে ৩০৮ এর দরজায় কান পাতল। হ্যাঁ, আওয়াজ স্পষ্ট। কিন্তু বাইরে থেকে তো তালা বন্ধ। বিক্রম নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ল। অঘোরবাবু ততক্ষণে মাথা হতে পা অব্দি চাদর ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
চাদরের ভিতর হতে আওয়াজ এল, "কিছু বুঝলেন..?"    বিক্রম জবাব দিল, " ভুত।"  এরপর অঘোরবাবুর আর আওয়াজ পাওয়া গেল না।
      সকালবেলা চা খেতে খেতে বিক্রম কালকের রাতের অভিজ্ঞতার কথা বিজনবাবুকে বললেন। বিজনবাবু প্রথমে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে তারপর বললেন, " রুমটা আজ তিন বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে। আজ থেকে তিন বছর আগে ওই ঘরে এসে উঠেছিলেন এক দম্পতি, তাদের দুই ছেলে আর এক মেয়ে সহ। হঠাৎ কি হল জানিনা এক রাতে সবাই মিলে সুইসাইড করে। সকালবেলায় আমাদের হোটেলের সার্ভিসবয় গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করেও উত্তর না পেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমি পুলিশে খবর দিই। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে দেহগুলো উদ্ধার করে। "
অঘোরবাবু এতক্ষণ চুপ ছিলেন, তিনি এবার কৌতুহল প্রকাশ করেন। " বলেন কি মশাই, এ তো একদম নির্ভেজাল ঘোষ্ট ষ্টোরি। আমার পরের গল্পের বেশ ভালো প্লট হবে। 'হোটেলে হাহাকার'।

ভ্যালেন্টাইন // সুব্রত মজুমদার

এই মেয়ে তুই আমার হবি ? মিষ্টি চুমু দেব গালে,
এই যে মেয়ে ! আমার হলে রাখবো তোকে রাজমহলে।
মিথ্যে ভাবিস, রাজার মহল মর্মর আর ইট পাথরের;
আমার হৃদয় সিংহাসনে তুই যে রাণী সত্যিকারের।
ফাগুন আসে বসন্তবায় সঙ্গে নিয়ে ভ্যালেন্টাইন
পোড়া এ মন তাই মানে না সমাজ ধর্ম নিয়ম আইন।
প্রেমের পদ্যে তোকেই দেখি প্রেমের স্বপ্নে তোরই মুখ
মুখ লুকালে বুকের মাঝে উদ্ধত হয় আমার বুক।
তুই যে আমার বুকের মাঝে ঝড় তুলে যাস নিত্যদিন
তুই তো আমার স্বপন প্রিয়া তুই তো আমার ভ্যালেন্টাইন।
লাল গোলাপের পাঁপড়িগুলো আমার হৃদয় কপাটিকা
তোর হাতে আজ ধরিয়ে দিলাম, - ভালোবাসার দিব্যি আঁকা।

গোলাপ বাগে তন্দ্রা জাগে // সুব্রত মজুমদার

গোলাপ বাগে তন্দ্রা জাগে ঘুমিয়ে আছে ফুলগুলি
আসবে কি মোর নিঠুর প্রিয়া দখিন হাওয়ায় চুলখুলি ?
লাল অধরের মিষ্টি চুমু আর কি পাব ও সাকি ?
তোমার বুকে লুটাতে চাই আর যে ক'টা দিন বাকি।
তোমার নূপুর যখন বাজে আমার হৃদয় গলির পথে
ভালোবাসার লাল গুলাবের লালি মেশে খুনের সাথে।
লাইলা-সিরিন-রাইকিশোরী সব ছাড়িয়ে তোমার প্রেম,
নিকষ কালো কষ্টিযাচা আগুন শুদ্ধ নিখাদ হেম।
তোমার জন্যে আসবো আমি নতুন রুপে বারম্বার ;
অমর মহাকাব্য হয়ে রইবে লেখা মোদের প্যার । 

এক যে ছিল প্যাঁচা // সুব্রত মজুমদার

এক যে ছিল প্যাঁচা
খেতো সন্দেশ-মেচা,
তার যে ছিল প্যাঁচানি
বাজখাই তার চ্যাঁচানি।
প্যাঁচার ছেলে ভূতো
আনল কিনে জুতো।
ভূতো গেল পাঠশালে
পাকুড় গাছের মগডালে।
চাঁদনি রাতের জ্যোৎস্নাতে
গ্রাম ছাড়িয়ে দূরপথে
চললো বাড়ি ভবেশ রায়;
এমন সময় নিত্যি যায়।
পাকুড় গাছের ঠিক কাছে
গাছের ডালে কে নাচে ?
আঁতকে উঠে বললো রায়
-"কে পাকুড় ডালে পা নাচায় ?"
এই না বলে ভির্মি খায়
ডাকাবুকো ভবেশ রায়।
ভাবছে ভূতো - কি মুস্কিল !
দিইনি তো চড় কিম্বা কিল;
তবুও ভূঁইয়ে পড়ল ক্যান ?
জবাবটা কেউ যদি দেন..... 

আর পারি না // সুব্রত মজুমদার

দেখছ দাদা, দেখছ দাদা, বিটকেলেটার কাজ, -
আদেশ পেলে এক থাপরে বুঝিয়ে দিতাম আজ।
চরণ ধরে গুরুজনের  অনুনয়ে হাত,
ভালোবাসায় বক্ষে ধরে, - কে দেয় লেজে হাত ?
চড়িয়েছিলাম রামচড়ান সিংহীবাড়ির কাছে-
সেটার খবর ভালোমতো ভূলোর জানা আছে।
বসেছিলাম দেওয়ালপরে ভুঁড়িভোজের শেষে
চোখের পরে তন্দ্রা নামে, - চোখ জড়িয়ে আসে।
কোথায় ছিল বেয়াক্কেলে হাড়জ্বালানি ভূলো
চিৎকারে তার ঘুমের আমার দফারফাই হলো।
মিনিট পাঁচেক খুব চেঁচাল, - কর্ণ ঝালাপালা,
সূযোগ বুঝে কান ধরে তার দিয়েছি রামটালা।
থাপর খেয়ে সেই যে গেল আসে না আর কাছে ;
আর এ ব্যাটা লেজটা ধরে ধেই ধেই ধেই নাচে ! 

কি তাজ্জব // সুব্রত মজুমদার

কি তাজ্জব্
রাতের পরে দিন আসে
দিনের পরে রাত,
দূরের মাঠে আড্ডামারে চৌধুরীদের ছাত।
আমার কলম আজ গিয়েছে
ঘোষপুকুরের ধারে
আনবে ধরে রুই কাতলা মৃগেল বস্তা ভরে।
স্কুলের থেকে আসার পথে
চমকে দেখি চেয়ে
ওদিক হতে জেব্রাক্রসিং আসছে যেন ধেয়ে।
জলের কলে বালতি চলে
হোথায় মিটিং আজ,
সঙ্গে হবে ফ্যাশান প্যারেড আমি তো তার জাজ।
চায়ের দোকান জীবন দাদা
গোমড়া কেন মুখ ?
-"কেটলি গেছে নেমন্তন্য, ফেরেনি উজবুক।"
এসব দেখে ভির্মি খেয়ে
যেই পড়েছি ভুঁইয়ে
আমনি দেখি সকাল হলো জল বসেছে চায়ে'। 

সন্মান // সুব্রত মজুমদার

অনেক বছর আগে শাল-মহুলের বনের ছায়ায় খেলত যখন বাঘে
ভেলাগাছের কচি পাতা রাঙত রৌদ্ররাগে।
সে অনেক বছর আগে।।
ছিল সে এক রাজা, দ্বারকানদীর স্বচ্ছ জলে স্নান করে তার মজা।
ছিল সে এক রাজা।।
আসল পাঠান ধেয়ে, মাল রাজা তো ছুটল তার বর্শা ধনুক নিয়ে।
আসল পাঠান ধেয়ে।।
লড়াই হল শুরু , ধনুক হাতে আদিবাসী স্মরল 'মারাংবুরু' ।
লড়াই হল শুরু।।
রক্তে বইল বান, শতেক আদিবাসীর খুনে পাঠান করল স্নান।
রক্তে বইল বান।।
'বাঁচাব সন্মান' , বলল রাজা - 'প্রাণের চেয়ে বড় মানের দাম।'
বাঁচাব সন্মান।।
দিল কুয়ায় ঝাঁপ, সঙ্গে রাণী রাজার কুমার বৃদ্ধ সে মা-বাপ।
দিল কুয়ায় ঝাঁপ।।
আজও দ্বারকা তীরে, মজা কুয়ায় শুনবে যেন কান্না ঘুরে মরে।
আজও দ্বারকা তীরে।।
আজও সবই আছে, রাজার বেড়া রাজার কুয়ো, - চিহ্ন অনেক গেছে।
আজও সবই আছে।।
কান্না শোনা যায়, কান পাতলে আজও তাদের কান্না শোনা যায়।
ব্যাকুল বাতাসে রোদন তাদের ফিরে ফিরে আসে যায়। 

ভালোবেসে সই // সুব্রত মজুমদার

ভালোবেসে সই মরেছি অনেক আগে,
আবার মরার সাধ যে হৃদয়ে জাগে।
আলোছায়া ঘেরা বনপথে যেতে যেতে
হাত রেখেছিনু তোমার ও দুটি হাতে, -
মুখ ঢেকেছিল রক্তরবির রাগে।
চোখে চোখ রেখে অনেক হল যে কথা
পায়ে পায়ে হল অনেক পথ তো হাঁটা ;
বিবাগী পরাণে প্রেমের মুকুল জাগে।
আরো পথ আরো কত পথ পার হয়ে
ভেঁসে যাবো মোরা প্রেমের সরণি বেয়ে,
দুই চোখে তাই প্রেমের আবেশ জাগে।
তোমার ঠোঁটের ভীরু কাঁপুনিতে ওগো
পড়েছি যে লিপি সেই স্বরলিপি কিগো -
আজ দুজনার মনগুঞ্জনে জাগে ?
ভালোবেসে সই মরেছি অনেক আগে। 

কেউ পড়ে নাকো কবিতা আমার // সুব্রত মজুমদার

কেউ পড়ে নাকো কবিতা
কেউ পড়ে নাকো কবিতা আমার
লিখে চলি আপন খেয়ালে;
হাতে বানানো ধূপকাঠির মতো পড়ে থাকে এককোণে,
মোটরগাড়ি - সাদাহাতি আর নীলপরী ছাপগুলো
বিক্রি হয় সোনার সিক্কায়।
আফগানে এক রাজা ছিলেন - 'বাচ্চা-ই-সিক্কা' , -
পয়সার বেটা বলে কথা !
তার মতো হলে লিখতে হবে না,
এমনিই পড়বে সবাই।
তাই তো লিখিনা ফুলেদের গান
তাই তো জাগে না পাতার উপর শিশিরের গান।
যৌনতা হতে ধর্ম সবকিছুই আজ যান্ত্রিক,
ইলুমিনাতি আর বামাচারের জগমচ্ছবে
আমরা আজ ভগবানের দর্শন পাই।
আর কিছু শতক পরে হয়তো থাকবে না কোন কবি,
কবিতা হবে মিউজিয়ামের শোকেসে বন্ধ,
সেদিন যদি আবার কোন জন্ম হয়, - আবার আসি ফিরে
সেদিন গাইবো গান।
সুর তুলেছি হৃদয় বীণায় আয় রে চলে।
- জগৎ ঘেরা স্থবিরতায় ভাঙব বলে।। 

অধর তোমার // সুব্রত মজুমদার

অধর তোমার কোন লালিমায় লাল হল ?
প্রথম চুমু দেওয়াই কি মোর কাল হল !
জানলে আগে লাজের ঘটা
কইত কে আর প্রেমের কথা ;
তোমার লাজের লালিমাতে অস্তরবি লাল হল।
খোঁপার ঘ্রাণে মিথ্যে আমায় বশ করো,
মন ভূলাতে মিথ্যে আমার যশকরো,
কাজল কালো চোখের তারা
করলো আমায় তন্দ্রাহারা ;
রাত্রি জেগে তাকিয়ে রই, - তাও মেটে কি আশ কারো ?
যাচ্ছ তুমি আলতা পায়ের ছাপ ফেলে
পায়ের নূপুর বাজছে মধুর সুর তুলে।
দূর্বাঘাসে জলের  কণা
যাচ্ছে নাকো মাণিক গণা
হেমন্ত আজ এল যেন পথ ভূলে।
নীলাম্বরীর নীল মিশেছে রক্তরবির লাল ঠোঁটে
বক্ষবাঁধন ভেদ করে তাই অচল নগের বাঁধ টুটে।
পদ্মিনী লো তোর 'বাসে
মন মধুকর ওই আসে,
গুঞ্জনে তার বিভোর হয়ে কমলিনীর ঘুমছুটে। 

দলছুট // সুব্রত মজুমদার

তাণকা ( জাপানী সনেট )
          (১)
            প্রীয় মোর
আজ ঘুমায়ো না,
বাহু ডোর
না খুলো না
থাকো কাছে।
      (২)
ফুলডোর
ছিঁড়েছে,
বাস তোর
উড়েছে
এই সাঁঝে ।
  বয়াৎ (পার্সী )
       (১)
যা কিছু সব তোমায় দিলাম ও মোর সাকী,
আমার জন্য রইলো শুধু দুঃখ বাকি।
যেমন ফেলে স্বর্গ-সুধা পাগলা ভোলা
সার করেছেন শ্মশানচিতা হাড়ের মালা, -
তেমনি তোমার বিরহ আজ বক্ষে লয়ে
কাটিয়ে দেব দিন যা আছে এখন বাকি।। 

শাল পাতাদের গান // সুব্রত মজুমদার

শালের বনে পাখির গানে
              মত্ত মাতাল বাতাস হানে
                              বর্শা ভীষণ হায় !
জীর্ণ পাতা দুলিয়ে মাথা
              মর্মরিয়ে জানায় ব্যাথা,
                         আজ সে ছুটি চায়।
গাছের কোলে কলরোলে
                বুনো-টিয়া শাখায় দোলে
                              তর্ক জমায় ভারি ।
শালের তলে রাখাল ছেলে
               ঝিমোয় বসে ছাগল ফেলে,
                           - খেয়ে তালের তাড়ি ।
জংলি মাছি যাচ্ছে নাচি
               সুগন্ধে তার নাইকো রুচি
                           হোথায় পড়ে মরা বিড়ালছানা।
বনবিড়ালে ঐ আড়ালে
                ঘুরছে পাখি ধরার তালে,
                               সঙ্গে দুটি ছানা।
এডাল হতে সেডাল হতে
              ঝাঁপ দিচ্ছে  কাঁড়সাপেতে 
                               ধরতে টিয়ার ঝাঁক।
তন্দ্রা আসে নেশার বশে
                রাখাল শুয়ে খুব আয়েশে
                              ডাকায় জোরে নাক।
ছাগলগুলি আওয়াজ তুলি
                দূরের দিকে যাচ্ছে চলি
                             ধরে বনের পথ।
সূয্যি মামা সোনার জামা
                চড়িয়ে গায়ে দিচ্ছে হামা,
                                  ঐ যে স্বর্ণরথ।
 বালিহাঁসে দূর আকাশে
                  কলকলিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে
                             ছুটছে দলে দলে।
কঠবেড়ালী পুচ্ছতুলি
                   পাত-বাদামে পড়ছে ঢলি
                          কেবল  খেলার ছলে।
বন-শুয়োরে আসছে তেড়ে
                 উর্ধ্বশ্বাসে রাখাল দৌড়ে
                             টুটল নেশার ঝোঁক;
মচমচিয়ে মর্মরিয়ে
                  শালের পাতা দেয় মাড়িয়ে
                                 এমন কঠিন রোখ, - -
মর্মধ্বনি ঐ তো শুনি
                     শালের পাতার মচমচানি
                                   যেন করুন গীত।
মাঘের শীতে আচম্বিতে
                   এ যেন রে ধানভানিতে
                                 গাওয়া শিবের গীত।
নড়ছে পাতা পড়ছে পাতা
                     বায়ুর ভারে ঝড়ছে পাতা,
                                     মর্মব্যাথা শুনি।
শালের পাতার করুন ব্যাথার
                 উৎস ফুঁড়ে কথকতার
                                           উঠছে করুণ ধ্বনি।। 

জলতরঙ্গ

#জলতরঙ্গ (পর্ব ১) #সুব্রত_মজুমদার                                                             এক                             আশ্বিনের এখনও শ...